ইতিহাস

হোলি আর্টিজেন: রক্তাক্ত সেই রাতের নয় বছর

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৫৮

২০১৬ সালের ১ জুলাই। ঢাকার গুলশানের শান্ত ও অভিজাত একাংশে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় ক্যাফে, হোলি আর্টিজেন বেকারি, ছিল সেই রাতে অন্যান্য অনেক দিনের মতোই প্রাণবন্ত। দেশি-বিদেশি অতিথিরা খাচ্ছিলেন, গল্প করছিলেন। কেউ কেউ হয়তো পরদিনের ছুটির পরিকল্পনায় ব্যস্ত। কিন্তু রাত ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে সবকিছু বদলে যায়। সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয় এক নির্মম, অবিশ্বাস্য ও বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার অধ্যায়।

সেদিন কী ঘটেছিল সেই রাতে?

রাত প্রায় ৯টার দিকে পাঁচজন সশস্ত্র তরুণ হঠাৎ হোলি আর্টিজেনে ঢুকে পড়ে। তারা গুলি ছুঁড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় এবং দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় পুরো রেস্তোরাঁ। সেখানকার দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে রাখা হয়। সন্ত্রাসীরা শুধু আধুনিক অস্ত্রেই সজ্জিত ছিল না, তারা ছিল অত্যন্ত সংগঠিত, প্রশিক্ষিত এবং একটি বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত — তারা ভাবত, এই কাজই তাদের “ধর্মীয় দায়িত্ব”।

প্রথমেই তারা গুলিতে হত্যা করে দু’জন পুলিশ সদস্যকে, যারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ এক বন্দিদশা, যেখানে ১৭ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জিম্মি করে রাখা হয় রেস্তোরাঁর অতিথি ও কর্মচারীদের। পুরো রাতজুড়ে চলতে থাকে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও হতাশার প্রহর।

সকালে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘থান্ডারবোল্ট’ নামে একটি কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে পাঁচ সন্ত্রাসী নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন জিম্মিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে তার আগেই, জঙ্গিরা হত্যা করে মোট ২০ জন জিম্মিকে — যাদের মধ্যে ছিল ইতালি, জাপান, ভারত এবং বাংলাদেশি নাগরিক।

কেন এই হামলা?

এই হামলার দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। যদিও বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলে এসেছে, এটি দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) পুনর্গঠিত একটি অংশের কাজ। আইএস-এর সংযুক্তির বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ না পেলেও, হামলার পেছনের ভাবাদর্শ যে আন্তর্জাতিক জিহাদি নেটওয়ার্ক দ্বারা অনুপ্রাণিত, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

এই হামলা ছিল অনেক দিক থেকে অনন্য। এর আগে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা মানেই ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ব্লগার, বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে বিচ্ছিন্ন আক্রমণ। হোলি আর্টিজেন ছিল প্রথম “ব্যাপক আন্তর্জাতিক” হামলা — যেখানে বিদেশি নাগরিকদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়, তাদের ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে।

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে

সন্ত্রাসবাদ ও দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ও জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিন ফেয়ার, এই হামলা সম্পর্কে বলেন: “এটি ছিল বাংলাদেশের ৯/১১ মুহূর্ত। এই হামলার পরিকল্পনা, লক্ষ্য নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ — সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদবিরোধী ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তন ছিল।”
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনায় বাংলাদেশের “উদারপন্থী” ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় একটি ধাক্কা খায়।

অন্যদিকে, ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থা MI6-এর সাবেক সদস্য এবং জাতিসংঘের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ব্যারেট মন্তব্য করেন: “হামলাকারীরা ছিল তরুণ, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। এটি আমাদের প্রচলিত সন্ত্রাসবাদী পরিচয়ের ধারণাকে পাল্টে দেয়।”
তার মতে, এই হামলা প্রমাণ করে যে শুধুমাত্র দরিদ্র, ধর্মান্ধ পরিবেশ থেকে আসা তরুণ নয় — শহুরে, আধুনিক, উচ্চশিক্ষিত তরুণও উগ্রবাদে আকৃষ্ট হতে পারে।

বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া

হামলার পর বাংলাদেশ সরকার দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশে জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। বহু সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়, এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। “নিও-জেএমবি” নামে পরিচিত এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতাদের একে একে নির্মূল করা হয়।

২০১৯ সালে, আটজন আসামির মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই মামলার রায়ে বিচার বিভাগীয় শক্তি প্রদর্শিত হলেও, মানবাধিকার সংস্থাগুলো কিছু প্রশ্ন তোলে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবানবন্দি আদায়ের পদ্ধতি নিয়ে।

সমাজ ও তরুণদের মনোজগতে প্রভাব

এই হামলার পর এক প্রশ্ন জোরালোভাবে উঠে আসে — কেন একদল তরুণ, যারা ভালো পরিবার থেকে এসেছে, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে, তারা এমন চরম পথ বেছে নেয়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদ বলেন: “সন্ত্রাসবাদ এখন আর কেবল অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফল নয়। এটি একটি বর্ণনার যুদ্ধ — তরুণরা যেসব গল্পে, চিন্তায়, দর্শনে বিশ্বাস করে, তার ওপর নির্ভর করছে তারা কোন পথে যাবে।”
এই বাস্তবতা সরকার, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে — তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, পরিচয়ের সংকট, ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও মূল্যবোধের বিকাশে কী ভূমিকা রাখা হচ্ছে তা নিয়ে।

নয় বছর পরে: কোথায় আমরা ?

নয় বছর পার হয়ে গেছে। হোলি আর্টিজেন এখন পুনরায় চালু হয়নি, তবে ঘটনাস্থলটি স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে আছে। প্রতিবছর ১ জুলাই নিহতদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

বাংলাদেশে বড় ধরনের আর কোনো আন্তর্জাতিক মাত্রার হামলা হয়নি এরপর। এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্য হলেও, বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই শান্তি যেন আত্মতুষ্টি না ডেকে আনে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের গবেষক ড. রুমি আহমেদবলেন: “উগ্রবাদ এক ধরনের ভাইরাসের মতো। এটি কখনো ঘুমিয়ে থাকে, আবার উপযুক্ত পরিবেশ পেলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।”
তার মতে, শুধু পুলিশি দমন নয়, একটি সমাজের মূল্যবোধ, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সচেতনতা ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিই পারে দীর্ঘমেয়াদে এই ভাইরাস ঠেকাতে।

হোলি আর্টিজেন হামলা ছিল শুধুমাত্র একটি ট্র্যাজেডি নয়; এটি ছিল একটি “জাগরণের ডাক” — রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি সবার জন্য। সেদিন যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তারা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, শান্তির জন্য কতটা সতর্ক থাকতে হয়। তরুণদের হাতে বই, কলম, কল্পনা ও মানবতা তুলে দিতে না পারলে, হাতে উঠতে পারে অস্ত্র — ইতিহাস সেটিই দেখিয়েছে।

নয় বছর পরেও প্রশ্ন রয়ে যায়: আমরা কি সত্যিই সেই পাঠ গ্রহণ করেছি?

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিডিটি কমাবেন কী করে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে জানতে হবে, অ্যাসিডিটি কেন হয়। আমাদের পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা খাবার হজমে সহায়তা করে।

২১ ঘণ্টা আগে

সংখ্যানুপাতিক বা পিআর নির্বাচন ব্যবস্থা আসলে কেমন

এই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো—এতে অনেক সময় জোট সরকার গঠনে দীর্ঘ সময় লাগে।

১ দিন আগে

নিষেধাজ্ঞার পাহাড় মাথায় নিয়েও ইরানের অর্থনীতি কীভাবে টিকে আছে

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের ওপর আরোপিত হয় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।

২ দিন আগে

হৃদরোগের লক্ষণগুলো কীভাবে বুঝবেন

হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ করেই হয় বলে অনেকে মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে অনেক সময় আগেভাগে কিছু সংকেত দেয় শরীর, যা যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে অনেক বড় বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব।

২ দিন আগে