top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

বিজ্ঞান

গাছের ঘুম : কী বলছে বিজ্ঞান

গাছের ঘুম : কী বলছে বিজ্ঞান
মরুগোলাপ খ্যাত অ্যাডেনিয়াম

ঘুম বলতে আমরা সাধারণত চোখ বন্ধ করে গভীর বিশ্রামে থাকার বিষয়টা বুঝি। এটা মানুষের প্রতিদিনের জীবনচক্রের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন—গাছেরাও কি ঘুমায়? গাছ তো কথা বলে না, চোখ-মুখও নেই। তাহলে তাদের ঘুম বোঝা যাবে কীভাবে?

আসলে, ঘুম শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকার নাম নয়। জীবের শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে ঘুম। এই ঘুমের ধারা গাছের মধ্যেও দেখা যায়, তবে সেটা একেবারে অন্যভাবে।

মানুষের শরীরে যেমন একটা বায়োলজিক্যাল রিদম আছে—যেটাকে আমরা দেহঘড়ি বা ‘সার্কাডিয়ান রিদম’ বলি—গাছের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটাই ঘটে। এই দেহঘড়ি সূর্যের আলো ও রাতের অন্ধকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীরের ভেতরের নানা কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।

গাছেরা দিনের আলোতে সক্রিয় থাকে, তখন তারা সালোকসংশ্লেষণ করে খাবার তৈরি করে। আর রাতে, যখন সূর্যের আলো থাকে না, তখন গাছ বিশ্রামে চলে যায়। এই সময় গাছের পাতাগুলো একটু ঝুলে পড়ে, পানির প্রবাহ কমে যায়, আর গ্যাস আদান-প্রদান ধীর হয়ে আসে। এটাই গাছের ঘুমের মতো একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

বিজ্ঞান কী বলছে?

এই বিষয়ে গবেষণা হয়েছে অনেক। বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রমাণ পেয়েছেন যে গাছের আচরণে ঘুমের মতো ধারা রয়েছে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড. লুসি কোল বলেন, “গাছের সার্কাডিয়ান রিদম শুধু বিশ্রাম নয়, বরং গাছের কোষ মেরামত ও বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দিনে তারা খাবার তৈরি করে, আর রাতে সেই খাবার ব্যবহার করে শক্তি বণ্টন করে।”

২০১৬ সালে ফিনল্যান্ডের ফিনিশ জিওস্পেশাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি যৌথভাবে এক গবেষণা চালায়। তারা লেজার স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাতের বেলা গাছের শাখা ও পাতার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, রাতের বেলা গাছের পাতা ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে, ঝুলে পড়ে। সকালে আবার তারা সোজা হয়ে যায়। এটা দেখে বিজ্ঞানীরা বলছেন, গাছ আসলে রাতের বেলা বিশ্রামে যায়।

কেন এই ‘ঘুম’ দরকার?

দিনের বেলা গাছ সূর্যের আলো দিয়ে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রচুর শক্তি তৈরি করে। কিন্তু সেই শক্তি সরাসরি ব্যবহার হয় না। গাছ রাতে সেই শক্তি দিয়ে কোষগুলোকে মেরামত করে, কিছু অংশ শক্তি হিসেবে জমিয়ে রাখে।

ভিয়েনা ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. এনরি জিনো বলেন,

“রাতের এই বিশ্রাম গাছের পানি সংরক্ষণ এবং কোষের কার্যক্রম ধীর করে আনে। এটা গাছের সার্বিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত দরকারি।”

রাতের বেলা গাছের স্টোমাটা নামক ক্ষুদ্র রন্ধ্র আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলে গ্যাস গ্রহণ-বর্জনের হার কমে যায়। পানির প্রবাহও ধীরগতিতে চলে, যেটা গাছের জন্য এক ধরনের বিশ্রাম।

বিশ্রাম না নিলে কী হয়?

যেমন মানুষ দিনে কাজ করে আর রাতে ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেয়, তেমনি গাছেরও একটা নির্দিষ্ট সময় আছে বিশ্রামের। এই ঘুম বা বিশ্রাম না হলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। কোষগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।

ড. আন্দ্রেস রুথ বলছেন, “রাতের বেলা গাছের ভেতরে পানি চলাচলের হার কমে, শাখা-প্রশাখা ধীরে নড়ে। এটা গাছের কোষের ওপর চাপ কমায় এবং পরের দিনের জন্য প্রস্তুত করে।”

তাহলে গাছ ঘুমায়?

যদিও গাছ মানুষের মতো বিছানায় গিয়ে ঘুমায় না, চোখ বন্ধ করে নিদ্রায় যায় না, কিন্তু বিজ্ঞান বলছে—গাছেরও নিজস্ব ঘুম বা বিশ্রাম ব্যবস্থা আছে। তারা রাতের বেলা কাজ ধীরে করে, কিছু কোষ মেরামত করে, পানি সংরক্ষণ করে, এবং পরের দিনের আলো পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

এটা এক ধরনের নীরব বিশ্রাম। শব্দ নেই, শব্দহীন শান্তির ঘুম।

গাছের ঘুম আমাদের ঘুমের মতো নয়, কিন্তু তা বিজ্ঞানসম্মত, প্রাকৃতিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশ্রাম না হলে গাছের স্বাভাবিক জীবনচক্র ব্যাহত হয়। একসময় ভাবা হতো গাছ নিঃপ্রাণ, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে—গাছও জীবন্ত, সচেতন এবং ছন্দময়। তারা জানে কখন কাজ করতে হয়, কখন বিশ্রাম নিতে হয়। তারা আমাদের নিঃশব্দে শেখায়, প্রকৃতি কতটা নিয়ম মেনে চলে।

তাই যখন রাত নামে, আর গাছের পাতা ধীরে ঝুঁকে পড়ে, তখন বুঝে নিতে পারেন—গাছও একটু আরাম নিচ্ছে। ঠিক যেমন আমরা ঘুমিয়ে যাই দিনের শেষে।

সূত্র:ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

r1 ad
top ad image