top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

নববর্ষে পান্তা-ইলিশ যেভাবে এলো

নববর্ষে পান্তা-ইলিশ যেভাবে এলো

নববর্ষে পান্তা-ইলিশ যেভাবে এলো
পান্তা-ইলিশ এখন বাংলা নবর্ষের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

নববর্ষ এলেই এখন শহর থেকে গ্রাম, প্রান্তিক থেকে অভিজাত—সব জায়গায় একটা বিশেষ খাবারের কথা ঘুরেফিরে আসে, আর সেটা হলো ‘পান্তা ইলিশ’। পান্তা ভাতের সঙ্গে এক টুকরো ইলিশ, একটু নুন, কাঁচা লঙ্কা আর লাউভর্তা বা বেগুন পোড়া—এই সরল খাবার আজ হয়ে উঠেছে এক বিশাল উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে কবে থেকে এই খাবার নববর্ষের সঙ্গে এমন নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে গেল? কেবল পান্তা নয়, ইলিশই বা কবে থেকে তার সঙ্গী হলো? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হয় গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য আর ইতিহাসে।

পান্তা ভাত ঠিক কত বছর আগে থেকে বাঙালির খাদ্য তালিকায় আছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও ধারণা করা হয় এর প্রচলন কয়েক শতাব্দী পুরোনো। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত মঙ্গলকাব্যে, এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ষোড়শ শতাব্দীর কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে আছে—

‘মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে
এক শ্বাসে সাত হাড়ি আমানি উজাড়ে
চারি হাড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ
ছয় হান্ডি মুসুরি সুপ মিশ্যা তথি লাউ।’

এখানে 'আমানি' বলতে বোঝানো হয়েছে ভাত ভিজিয়ে রাখার পানি, অর্থাৎ পান্তা। ঐ সময়ে 'আমানি' ছিল চৈত্র সংক্রান্তি ও নববর্ষের সময়কার একটি বিশেষ রীতি। চৈত্র মাসের শেষ দিনে কৃষাণীরা অপরিপক্ব চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখতেন, আর নববর্ষের সকালে সূর্যোদয়ের আগে সেই ভাত খাওয়া হতো প্রতীক হিসেবে—পুরনো বছরের কষ্ট ধুয়ে ফেলে নতুন বছরে সতেজভাবে যাত্রা শুরু করার।

বাঙালি চিরকালই কৃষিভিত্তিক জাতি। ফলে গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে পান্তা ভাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই খুব ঘনিষ্ঠ। মাঠে কাজ করার আগে কৃষকেরা খেতেন পান্তা—কারণ এটি হজমে সহজ, সস্তা এবং শরীরের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এর সঙ্গে থাকত নুন, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ বা কাঁচা লঙ্কা, কখনো বা পোড়া বেগুন, সরষে তেলে মাখানো আলু ভর্তা।

বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বডি বিল্ডার মনোহর আইচ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, `পান্তাভাতের জল—তিন জোয়ানের বল।’ তিনি স্বীকার করেছিলেন, দিনে চারবার পান্তা ভাত খেয়ে তিনি শক্তি অর্জন করতেন।

গ্রামীণ দরিদ্র কৃষকরা কখনোই মূল্যবান পাত্রে পান্তা পরিবেশন করতেন না। মাটির পাত্র, কচুপাতা বা কলাপাতাই ছিল পান্তা পরিবেশনের মাধ্যম। এ বিষয়টিও বাংলা সাহিত্যে উঠে এসেছে। মনসামঙ্গল কাব্যের কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন:

‘আনিয়া মানের পাত বাড়ি দিল পান্তাভাত’

এখানে ‘মান’ বলতে মানকচুর পাতা বোঝানো হয়েছে।

সময়ের সাথে সাথে পান্তা ভাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা উপকরণ—বেগুন, আলু, সরষে পাতা, ডাল, ছোট মাছ ইত্যাদি। তবে এসবই ছিল সহজলভ্য ও স্থানীয় উপাদান।

মাছে-ভাতে বাঙালি হলেও পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছের সংযোগ পুরোনো নয়। ইলিশ ছিল চিরকালই খানিকটা দামি আর অভিজাত মাছ। গ্রামীণ অঞ্চলে গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ ছিল জনপ্রিয়, কিন্তু পান্তা ছিল গরীবের খাবার, তাই ইলিশের সংযোগ সেখানে সাধারণ ছিল না।

শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির কাছে পান্তা ছিল অনেকটা অবহেলিত খাবার। ফলে নববর্ষে কিংবা উৎসবে ইলিশ থাকলেও পান্তা ছিল অনুপস্থিত।

আশির দশকের শুরুর দিকে ঢাকায় নববর্ষ উদযাপনের ধরনে নতুন এক ধারা যোগ হয়—পান্তা-ইলিশ আয়োজন। যদিও ছায়ানট ১৯৬৭ সাল থেকেই রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপন করে আসছিল, সেখানে পান্তা ইলিশের আনুষ্ঠানিক কোনো স্থান ছিল না।

১৯৮০/৮১ সালের দিকে সাংবাদিক বোরহানউদ্দিন আহমেদের উদ্যোগে নববর্ষ উপলক্ষে প্রথম পান্তা ইলিশের আয়োজন করা হয়। পরে শহিদুল হক খান তা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন পোস্টার ও আয়োজনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কিছু উদ্যোগে রমনায় পান্তা ইলিশ বিক্রি শুরু হয়।

আন্দোলনমুখর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী সাংস্কৃতিক জাগরণের অংশ হিসেবে পান্তা ইলিশ হয়ে ওঠে এক ধরনের প্রতীক। বাঙালিয়ানার পরিচায়ক হিসেবে এটি গ্রহণ করে নেয় সাধারণ মানুষ।

নব্বইয়ের দশক পেরোতেই পান্তা ইলিশ সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দোকান, হোটেল, ক্যাটারিং, পারিবারিক আয়োজন—সবখানে পান্তা ইলিশ।

তবে এর জনপ্রিয়তা যেমন বেড়েছে, তেমনি ইলিশের চাহিদাও হু হু করে বাড়তে থাকে। ফলে দেখা দেয় জাটকা নিধনের মতো পরিবেশগত সংকট। সরকারকে বাধ্য হয়ে নিতে হয় পদক্ষেপ—১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পদ্মা, মেঘনা, তেঁতুলিয়াসহ পাঁচটি নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

তবুও বাজারের চাহিদা মেটাতে ব্যবসায়ীরা আগেভাগেই হিমঘরে ইলিশ মজুত করতে থাকেন। অনেক সময় পঁচা বা বাসি ইলিশও ‘ফ্রেশ’ বলে বিক্রি করা হয়। এতে পান্তা-ইলিশ সংস্কৃতি যেমন বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় হয়, তেমনি তা প্রশ্নবিদ্ধও হয়।

যদিও পান্তা ইলিশ নববর্ষের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তবে এটি আদিতে ছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাবার। নববর্ষের প্রাক্কালে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তিতে বাঙালির ছিল শাক-ভাত খাওয়ার রেওয়াজ। বাড়ির বউ-ঝিরা সকাল বেলা ঝোপ-জঙ্গল থেকে তুলে আনতেন বিভিন্ন অনাবাদি শাক। চৌদ্দ প্রকার শাক দিয়ে তৈরি হতো ‘শাকান্ন’। বিশ্বাস ছিল, এসব শাক খেলে শরীর বিশুদ্ধ হয়, রোগ দূরে থাকে।

পান্তা ইলিশের ইতিহাস মূলত শ্রেণি, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের ইতিহাস। এটি যেমন গ্রামীণ বাঙালির দৈনন্দিন শ্রমজীবনের স্মারক, তেমনি শহুরে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক। আজ পান্তা ইলিশ নববর্ষের দিনে এক জাতীয় ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ালেও, তার পেছনে আছে বহুদিনের ইতিহাস, কৃষিভিত্তিক জীবনধারা, এবং একটি জাতির আত্মপরিচয়ের খোঁজ।

অতএব, পান্তা ইলিশ শুধু একটি খাবার নয়—এটি বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতির আয়না, যেখানে যুগ যুগ ধরে উঠে এসেছে অভাব, আবেগ, উৎসব ও ঐতিহ্য।

r1 ad
top ad image