স্বাস্থ্য

চিয়া সিড কেন খাবেন, এর উপকারিতা-অপকারিতা কী

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম, উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে আজকাল অনেকের আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা এই ছোট বীজের বড় গুণের কথা শুনে রীতিমতো অভিভূত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই বীজ আসলে কী? কীভাবে খেতে হয়? আর এতে কী এমন উপকার আছে, যার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমরা এবার তুলে ধরব চিয়া সিড নিয়ে একটি সহজবোধ্য ও তথ্যভিত্তিক ফিচার।

চিয়া সিড মূলত স্যালভিয়া হিশপানিকা (Salvia hispanica) নামে এক ধরণের মরু গাছের বীজ, যার জন্মস্থল মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা। অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতার মানুষেরা এটি তাদের খাদ্যতালিকায় নিয়মিত রাখতেন। “চিয়া” শব্দের অর্থই হচ্ছে ‘শক্তি’, আর এই শক্তির ধারণা থেকেই বোধহয় একে সুপারফুড বলা হয়।

এই বীজের বিশেষত্ব হলো, এটি শরীরকে শক্তি দেওয়ার পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণ, হজমশক্তি বাড়ানো, হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখা এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, চিয়া সিডে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস।

কিন্তু চিয়া সিড কীভাবে খেতে হয়? সাধারণত এটি পানিতে ভিজিয়ে খাওয়াই সবচেয়ে ভালো। এক গ্লাস পানিতে ১ থেকে ২ চা চামচ চিয়া সিড মিশিয়ে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখা উচিত। এতে বীজগুলো ফুলে ওঠে এবং এক ধরনের জেলি তৈরি হয়। এই মিশ্রণটি সরাসরি খাওয়া যায় বা জুস, দই, ওটস, স্মুদি বা লেবু পানির সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া যায়। তবে চিয়া সিড শুকনো অবস্থায় বেশি খাওয়া উচিত নয়, কারণ এটি শরীরের মধ্যে পানি শোষণ করে এবং গলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আমেরিকান নিউট্রিশনিস্ট এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক ডঃ ফ্রাঙ্ক হু বলেন—“চিয়া সিড এক অসাধারণ উৎস ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের, যা আমাদের হৃদপিণ্ডের জন্য খুবই উপকারী।” বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—“চিয়া সিড ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের এক দারুণ উৎস, যা আমাদের হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।”

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডেলেইডের গবেষক ডঃ ক্যাথরিন অ্যন্ডারসন বলেন—“চিয়া সিড শরীরে দীর্ঘস্থায়ী শক্তি সরবরাহ করে এবং এটি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সহায়তা করে।” এর বাংলা অনুবাদ—“চিয়া সিড শরীরে শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং হজমশক্তি উন্নত করতে পারে।”

এছাড়া চিয়া সিড ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও সহায়ক হতে পারে। কারণ এতে থাকা ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। কানাডার গ্লিনোর ইউনিভার্সিটির খাদ্যবিজ্ঞানী ডঃ রিকার্ডো অ্যাভিলা বলেন—“চিয়া সিড রক্তে চিনির শোষণ ধীর করে, ফলে এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে।” বাংলায় বলা যায়—“চিয়া সিড শরীরে চিনি শোষণের গতি কমিয়ে দেয়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো।”

তবে সবকিছুরই যেমন উপকার থাকে, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত বা ভুলভাবে খেলে চিয়া সিড থেকেও কিছু ক্ষতি হতে পারে। প্রথমত, চিয়া সিডে প্রচুর ফাইবার থাকায় বেশি খেলে পেট ফেঁপে যাওয়া, গ্যাস, বমি বমি ভাব বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যাঁরা আগে থেকে হজমজনিত সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের সাবধানে খাওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত, যাঁদের অ্যালার্জির প্রবণতা আছে, তাঁদের শরীরে চিয়া সিড এলার্জি তৈরি করতে পারে। যেমন চুলকানি, র‍্যাশ, শ্বাসকষ্ট বা ঠান্ডা লাগার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তৃতীয়ত, ওষুধ গ্রহণকারী ব্যক্তিদের জন্য চিয়া সিড কখনো কখনো সমস্যা তৈরি করতে পারে, বিশেষত যাঁরা রক্ত তরল করার ওষুধ খান বা যাঁদের রক্তচাপের সমস্যা আছে।

এই বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ডেভিস-এর পুষ্টিবিজ্ঞানী ডঃ এলেনা বার্নস বলেন—“যাঁরা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান বা অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট ব্যবহার করেন, তাঁদের চিয়া সিড খাওয়ার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ নেওয়া উচিত।” বাংলায় তার বক্তব্য—“চিয়া সিড রক্তচাপ ও রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে, তাই এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।”

চিয়া সিডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর পরিমাণ। সাধারণত প্রতিদিন ২০ গ্রাম বা প্রায় ১.৫ চা চামচ চিয়া সিড খাওয়াই নিরাপদ ও উপকারী বলে মনে করা হয়। তবে শুরুতে অল্প করে খাওয়া ভালো, যেন শরীর সহজে মানিয়ে নিতে পারে। শিশু, গর্ভবতী নারী এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

চিয়া সিড নিয়মিত খেলে ওজন কমানো, ত্বক ভালো রাখা, হাড় মজবুত করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি দূর করতেও সাহায্য করে বলে নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। এটি একদিকে যেমন একটি প্রাকৃতিক শক্তির উৎস, অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতার জন্যও এক শক্তিশালী সহায়ক হতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, চিয়া সিড অবশ্যই একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর খাদ্য উপাদান, তবে সেটি কোন পরিমাণে এবং কীভাবে খাওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে সচেতনভাবে, তবে অতিরিক্ত প্রত্যাশা বা ভুল ধারণা নিয়ে নয়। যেমনটা নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডঃ লিসা ম্যাথিউজ বলেন—“চিয়া সিড কোনো জাদু নয়, এটি কেবল একটি ভালো অভ্যাসের অংশ হতে পারে।” অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—“চিয়া সিড কোনো ম্যাজিকের মতো নয়, তবে এটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের এক সুন্দর উপাদান হতে পারে।”

সুতরাং চিয়া সিড খাওয়ার ক্ষেত্রে গাইডলাইন একটাই—জেনে বুঝে, নিয়ম মেনে এবং নিজের শরীরকে বুঝে খাওয়া। তাহলেই এই ছোট বীজ হতে পারে সুস্থ জীবনের বড় সহায়।

সূত্র: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

নিম্নচাপ কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় নিম্নচাপ হলো একটি এমন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি যেখানে বাতাসের চাপ চারপাশের তুলনায় কম হয়ে যায়। সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাতাস সবসময় উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।

১৪ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১ দিন আগে

খালি পেটে লেবু খাওয়া ক্ষতিকর!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই অভ্যাস বশে এক গ্লাস লেবু পানি খান। বিজ্ঞাপন আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে এমন ধারণা ছড়িয়ে গেছে যে খালি পেটে লেবু খেলে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যায়, ওজন কমে, আবার হজমশক্তিও নাকি বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি খালি পেটে লেবু খাওয়া এতটা উপকারী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেবুর কিছু ভালো দিক

১ দিন আগে

কেন ভাদ্র মাসে তাল পাকে?

১ দিন আগে