প্রকৃতি

বর্ষা আসছে...‘গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে’

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ২২: ৪৪

প্রেম, বিষণ্ণতা আর রুপসি বাংলার প্রেমমুগ্ধ কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর রুপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে’মধুর বৃষ্টি ঝরে ঘাসে যে বৃষ্টি ঝরে ! এভাবেই কবিতায় তিনি রুপসী বাংলার বর্ষার এক অনন্য রুপ একেঁছেন। মার্চ-এপ্রিলের তীব্র তাপ প্রবাহে, সোনালী রৌদে তপ্ত এই পৃথিবীর গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। তখন বৃষ্টির জন্যই কবির এমন আকুলতা। তবে ওই আকুলতা কিন্তু গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্তের সকল জনমানুষেরও। কারণ বাংলা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের আম-কাঁঠাল পাকার সাথে গরমও পাল্লা দিয়ে তেঁতিয়ে উঠে। আর মধুমাস জ্যৈষ্ঠর সকল ফল-ফলাদি পাকা নিয়ে সুকুমার রায় সেই ‘পাকাপাকি’ কবিতায় ‘আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে রোদে জলে টিকে রং পাকা কই তাহারে !’ গরমের আঁচ পাওয়া যায়। রুপসী বাংলার কবি প্রখর রৌদ্য-তাপদাহে খানিক শীতল ঠাণ্ডায় প্রাণ জুড়াতে চেয়েছেন। তাই কবি বর্ষার জলতরঙ্গ বৃষ্টির জন্য প্রবল আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। বৃষ্টির পূর্বাভাস মেঘের জন্য উন্মুখ কবি ‘কেমন বৃষ্টি ঝরে’ কবিতায় আরো লেখেন, ‘আকাশে এমন ছেঁড়া ময়লা মেঘের রাশ পড়েছে/তাদের ছায়া নীলের ঘোলা জলে নিঝুম পিরামিডে।/সেও মেঘের মত চোখ / আকাশে সোনালী চিল পাখনা ছড়ায়ে কাঁদে।’

ওদিকে প্রেমিক ও একসাথে বিপ্লবী-বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বর্ষার বন্দনায় গেয়েছেন, ‘অথৈ জলে মাঠঘাট থৈ থৈ, আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই?’ আরো গেয়েছেন, ‘এসো হে সজল শ্যাম ঘন দেয়া, ফুটাইয়া যূথী-কুন্দ-নীপ-কেয়া, বারিধারে এসো চারিধার ভাসায়ে, বিরহী মনে জ্বালায়ে আশার আলেয়া।’ এভাবেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্টিতে গভীর ব্যঞ্জনা তৈরি করেন বর্ষা ও বৃষ্টির প্রত্যাশায় প্রেম ও বেদনার বিরহে। তিনি লেখেন ‘ঝুরিবে পূবালী বায় গহন দূর বনে, রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে/ বিরহী কুহু কেকা গাহিবে নীপ শাখে/যমুনা নদী পাড়ে শুনিবে কে যেন ডাকে।’

বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এদেশে গ্রীস্মকাল চৈত্র, বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাস। ইংরেজীর মার্চ-এপ্রিল ও মে’ মাস। এই মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় তীব্র তাপদাহ। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। বইতে থাকে ‘লু হাওয়া’। গরম বাতাসের সাথে পথের ধুলায় ধূসর-উষ্ণতায় মানুষের তখন চরম নাভিশ্বাস অবস্থা। পথের বিস্তীর্ণ দিগন্তরেখায় মরীচিকার মিছে মতিভ্রমে পড়ে জনমানস। আসলে গরমে শরীরে-মনে আনচান করে যাতনা। গ্রীস্মের খরোতাপে তৃর্ষান্ত হদয় আর পিপাসা নিবারণে ছটফট করেন পথিক। শরীর মনের ক্লান্তি ছাপিয়ে ভাবতে থাকেন পথের নাগাল আর কতদূর? গন্তব্যে পৌঁছানোর তীব্র আকাঙ্খায় হিসেবের দোলাচালে চোখে তাঁর নানান ‘বিভ্রম’‘ইলুয়েশন’কিংবা ‘হ্যালোসলেশন’। এই বুঝি দেখা যায় প্রিয় ঘরদোর একান্ত আপন ঠিকানা। কখনো অলস কোন পথিক ইতিউতি চান একটু ছাঁয়ায় আশ্রয়ের আশায়। পথের শেষ দিগন্ত রেখায় তখনো চলে পথিককে বিভ্রান্ত করার সেই মিছে মরীচিকা। তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকার তাঁর ‘মরীচিকা’ কবিতায় উল্লেখ করেছেন

‘ঘরছাড়া সব ভাবনা যত, অলস দিনে কোথা ওদের গতি।

দখিন হাওয়ার সাড়া পেয়ে / চঞ্চলতার পতঙ্গদল ভিতর থেকে বাইরে আসে ধেয়ে।

চেলাঞ্চলে উতল হল তারা /চক্ষে মেলে চপল পাখা আকাশে পথহারা।’

গ্রীস্মের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস ‘এপ্রিল’। এসময় প্রকৃতির বুকে লাল কৃষ্ণচূড়া আর হলুদ সোনালুর নান্দনিক দোল খাওয়া। শহর কিংবা গ্রামের প্রত্যন্তে তখন আরেক আগুনলাগা রূপ। এসব দেখে কবিগুরু লেখেন ‘গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী/কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।’ প্রেম, বিরহ আর বিপ্লব-বিদ্রোহ ও ভালোবাসার কবি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন নজরুল সঙ্গীত ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জরি-কর্ণে। আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে। মোরে চেন কি?’

কালের পরিক্রমায় সময়ের সাথে বদলে গেছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাবে গত কয়েক বছরে এদেশে উষ্ণতম মাস এপ্রিল সরে গিয়ে নতুন মাস জুনের নাম যুক্ত হয়েছে গ্রীস্মের চিরায়ত ক্যালেন্ডারে। বিশ্বজুড়ে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ২০২৪-এর জুন মাসকে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে চিহ্নিত করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ পরিসেবা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রা, তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের ভোগান্তি চরমে। সেবার ওই অঞ্চলের দেশে-দেশে হিটস্ট্রোকে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। বৈশ্বিক ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল মানে শিল্প পূর্ব যুগের তুলনায় ২০২৪ সালে গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। জাতি সংঘের মহাসচিব আন্থোনিয় গুতেরেস তাই বলেছেন, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা উষ্ণায়নের যুগ চলে গেছে, বিশ্ব এখন গ্লোবাল বয়েলিংয়ের যুগে প্রবেশ করেছে।’

বাংলা বর্ষ পুঞ্জিতে গ্রীস্মের পর আসে বর্ষা। এদেশের ক্যালেন্ডারে জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টম্বর বর্ষাকাল। গ্রীস্মের তাপদাহে বিপন্ন জনপদে বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের জন্য মার্চ থেকে মে মাস বাংলায় চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ এই সময়ে কঠোর ও কঠিন এক সময়। দিন আনতে পান্তা ফুরানো শ্রমজীবীদের পেটের তাগিদেই পথে নামতে হয়। ঘানি টানা জীবনে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরাশ্রমিক-মজুর, ঠেলা, রিক্সা, ভ্যান চালক আর পথে, বাজারে-প্রত্যন্তের নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ হয়ে উঠে অবর্ণনীয়। ওইসব মানুষের উদ্দেশ্যেই বুঝি কবি গুরুর লেখনিতে উঠে আসে ‘সমাজ সংসার মিছে সব/মিছে এ জীবনের কলরব’। আরেক দল নান্দনিক নাগরিক সুবিধা আর সুখ সজ্জায় হাপিত্যেস করেন, কবে শীতল হবে কবে দেখা পাবো প্রবল বারিঝরার।

তাই তো সেই উনিশ শ ত্রিশের দশকের প্রায় সকল প্রধান কবিকেই দেখা গেছে বর্ষা কিংবা বৃষ্টির বন্দনায়। বৃষ্টি ও বর্ষার তাত্ত্বিক ও লৌকিক রূপ নিয়ে পঙক্তি রচনা করেছেন তাঁরা। তাদের লেখনিতে পৌঁছে গেছেন, মুগ্ধতার মৌন চৈতন্যের খেয়ালে। একইভাবে তাঁদের জড়বাদিতায় উঠে আসে বাস্তবতা। কবির অন্তর অঝর ধারা বৃষ্টিতে প্লাবিত আবেগে ছন্দে বর্ণে বোহেমিয়ান জীবনের বাঁকে বারুবাদের সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দেয়। সেই ত্রিশের দশকে আধুনিকতায় অধিকমাত্রায় বিপ্লবী ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন আষাঢ়-শ্রাবণের গাঁথা। বিপ্লবের কবির সেই লেখনিতে কী যে রোমান্টিক তাঁর ছন্দ ভাবলে মন বুঁদ হয়ে যায় প্রবল রোমান্টিকতায়। বর্ষার বন্দনায় লেখেন, ‘আকাশে আষাঢ় এলো, বাংলাদেশ বিহ্বল...বৃষ্টিতে ধুমল...মেঘবর্ণ, মেঘনার তীরে তীরে নারকেল সারি’। একইভাবে তিনি বৃষ্টির বন্দনায় লেখেন, ‘এসো বৃষ্টি, এসো তুমি অতল ভূতলে রুদ্ধ স্তম্ভিত পাষাণে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তো খরোতপ্ত, পোড়া, তৃষ্ণার্ত মাটিতে বৃষ্টিভেজা সোঁদাগন্ধ বৃষ্টিস্নাত ফুলের সুবাস সমানভাবেই মুগ্ধ করেছে। তাই তাঁর বৃষ্টি ধোওয়া আকাশ ও প্রকৃতির প্রাণময় রূপ অসম্ভব রকম কল্পনার রংয়ে আপ্লুত করে। তৎকালীণ বাংলা অঞ্চল শিলাইদহ-পতিসরে রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর সুবাদে নদীকেন্দ্রীক এই বাংলার জল-বৃষ্টির অনিন্দ্য নান্দনিকতা কবিগুরুকে তাঁর কবিতায়-গানের সুরধ্বনীতে অনুরণীত করে। কী নিবিড় মমতাএর সবই তিনি তুলে এনেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে। বৃষ্টিঝরা সকাল-সন্ধা কিংবা রাতের নেশাধরানো মায়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে রবীন্দ্রণাতের গানে-কবিতায়, ছোটগল্পে। তিনি লেখেন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।/এমন দিনে মন খোলা যায়এমন মেঘস্বরে বাদল--ঝরোঝরে/ তপনহীন ঘন তমসায়।’

অথবা‘এখন বাদল-সাঁঝের অন্ধকারে আপনি কাঁদাই আপনারে।’ আরো বলেছেন, ‘বাদল দিনে প্রথম কদম ফুল’। উপহারের অনন্য এক উপমা।

বাংলা জৈষ্ঠের মধুমাস ফলের বাহারি সাজে বাঙালির রসনায় পাতে পরে ফলাহার আর ফল ফলাদির বিচিত্র বিবিধ উপকরণ। হঠৎ বর্জ্যবৃষ্টির সাথে কালবৈশাখের তান্ডবলীলায় উচ্ছনে যায় কত আয়োজন। তবুও ঠাঠা বজ্ররে সাথে খানিক শিলাবৃষ্টির দেখে আপ্লত হয় মানব ও প্রকৃতি।

কিন্তু হঠাৎ এসেই কেন যায় এধারার বৃষ্টির খানিক ছিটেফোঁটায়? তাতে যে, মানুষের তৃষ্ণার্ত ছাতি আর খরোতপ্ত মাটি ফেটে চৌচির প্রকৃতির তৃপ্তি পুরোপুরি মেটে না! তখন তো অধীর অপেক্ষা জৈষ্ঠের খরোতাপ শেষে ‘আষাঢের বর্ষার’ আকুলতা। প্রকৃতি-মানব আর পাখিকূলের তৃষ্ণা যে তখন চরমে। অনাবৃষ্টিতে নদী খাল বিল শুকিয়ে। তীব্র তাপদাহে শুকিয়ে ফসল নষ্টের উপক্রম। অভাব দেখা দেয় সুপেয় খাবার পানির।

বাধ্য হয়ে বৃষ্টির বন্দনায় নানান লোকাচারে মাতে গ্রাম বাংলার মানুষ। ‘ব্যাঙের বিয়ে’বাচ্চাদের সাথে বড়রাও সামিল হয় বৃষ্টি চেয়ে ব্যাঙের বিয়ের প্রতীকি আয়োজনে। কোথাও কোথাও ‘তালতলার সিন্নির’ জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ চাল আর গুড় সংগ্রহ করে রান্না হয় গ্রামের একটি গাছের ছায়ায়। গ্রামের লোকেরা সকলে জড়ো হয়ে সেই সিন্নি খেতে। তারপর সবাই মিলে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেন। এছাড়াও লোকসঙ্গীতের গুরু শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কন্ঠে বহুল প্রসিদ্ধ সেই গান তো সর্বজনীন! ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে/ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে/আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা/মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তোর কেডা...!’ বৃষ্টি চেয়ে গ্রাম বাংলায় যুগ যুগ ধরে মানুষেরা এই গান গেয়েছেন। হালের পাড়ায় মহল্লায় মজসিদে-মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা।

ক্রমেই বর্ষার জন্য বহুল কাঙ্খিত মৌসুমী বায়ু প্রবাহ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর কারণে শুরু হয় বৃষ্টির ধারা। বাংলা বর্ষপুঞ্জিকা অনুযায়ী আষাঢের প্রথম প্রহরে বৃষ্টির জন্য মুখিয়ে থাকে বাঙালি। এর আগে অবশ্য বর্ষার আগমণী নিয়ে সরব হয় প্রকৃতি। গাছে গাছে দেখা মেলে বহুল প্রত্যাশার আষাঢে স্মারক সেই কদম ফুলের। এছাড়াও বেলি, কেয়া, কামিনী, চামেলি-বকুলের সুবাসে বাংলার দ্বিতীয় ঋতু ‘বর্ষার’আগমন ঘটে আষাঢ় মাসের স্মারক হয়ে সবার আগে প্রকৃতিতে।

কবি মানষে বর্ষাকাল যেন সাহিত্যের উর্বর এক উপলক্ষ্য। সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় বর্ষা বন্দনা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আষাঢ় কবিতায় লিখেছেন ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে/ ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।’ আবার ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো’ কবিতায় কবি বলছেন, আষাঢ় সন্ধা ঘনিয়ে এল/একলা বসে ঘরের কোণে/কী ভাবি যে আপন-মনে/সজল হাওয়া যুথীর বনে/কী কথা যায় কয়ে/বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা/ঝরছে রয়ে রয়ে।’

৮০-৯০ দশকের শৈশবে আষাঢ়ের ঘরবন্দী দিনগুলোতে অধিকাংশের সময় কেটেছে জানালার পাশে বসে। মায়ের অগোচরে খাতার পাতা ছিড়ে কাগজের নৌকা বানিয়ে সেই নৌকা ঘরদোরের চৌকাঠ পেরানো পানিতে ভেসেছে। ভাই বোনদের কার নৌকা কতক্ষণ টিকেছে বৃষ্টিরচ্ছ্বটায় সেই প্রতিযোগিতায় মানেনি এমনটা ঘটেনি। এভাবে প্রতিযোগিতা করে নৌকা বানাতে গিয়ে কে-কার পরের দিনের স্কুলের হোমওয়ার্ক লেখা পাতাটার গতি করেছে নৌকায়? সেটা টের পেয়ে ভাইবোনদের কিঞ্চিত মান-অভিমান থেকে খানিক হাত টুকাটুকিতে ঠেকেছে বটে। কান্নাকাটি ঠেকাতে গিয়ে বাড়ির মায়েরা হয়ত কখনো কখনো হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। নয়ত হাতের লেখা সুন্দর করার পাঠে রুল টানা খাতায় বার বার একই অক্ষরের ওপর হাত ঘুরানোর মত হোমওয়ার্ক। তখন যে পাঠ্যবইয়ে পড়া সেই কবিতা “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি/’ এই কবিতাখানি চিৎকার করে বলার ইচ্ছা হলেও সাহসে কুলাইনি বটে।

এভাবে বর্ষার আগমনে ছোট্ট শিশুমনের অতৃপ্তি থেকে বড়রাও হয়ত ভুগেছেন বিষন্ন বিরহে। তাদের মনেও হয়ত বাঁজে সেই সব সুর‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে/এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/নতুন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে/আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ চেয়ে।’

অথবা, ‘আজি বরিষন মুখরিত শ্রাবণ রাতি/স্মৃতি বেদনার মালা একেলা গাঁথি/ আজি কোন ভুলে ভুলি আধাঁর ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি/মনে হয় বুঝি আসিছে সে মোর দুখরজনীর সাথী।’

আবার কারো কারো মনে হতেই পারে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে।’তখন প্রিয়জনের উপস্থিতির জন্য উন্মুখ গেয়ে উঠে নিরবে নিরালায়, ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে এসো কর স্নান নবধারাজলে।’ কবিগুরু তার এই গানের মাধ্যমে যেন বর্ষার বন্দনাই করেছেন। তপ্ত খরোতাপে জৌলুস হারানো প্রকৃতিকে যেন আহ্বান করেছেন, বর্ষার নবীণ জলে ধুয়ে মুছে প্রকৃতির যত ধুলো-বালি-জরা-উত্তাপ ধুয়ে মুছে নতুন ও সজীব হয়ে নতুনের আহ্বানে।

এভাবে বর্ষার আগমন, বৃষ্টির প্রবল ধারায় সিক্ত হয়ে উঠে প্রকৃতি। চৌচির জমিন পূর্ণ তৃষ্ণা মিটিয়ে হয়ে উঠে উসর-সজীব। গাছে-গাছে পাতারা সবুজ সাহসী-সুন্দরী-পল্লরী হয়ে মুগ্ধতা ছড়ায় নয়া যৌবনের। কৃষকের মুখে ফোটে হাসি। এবার তবে ফল-ফসলের বীজতলা আর মাঠের সোনালী দানা মারা যাবে না। কৃষক ক্রমেই ভবিষ্যতের নয়া স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠে। এবার তবে সময় মত ধান মাড়িয়ে নয়া দামানের জন্য উৎসব হবে। অথবা নতুন ভিটের নিচু জলাটা ভরাট করবেন। কিংবা ঘরের গিন্নিকে গড়িয়ে দেবেন নয়া অলঙ্কার এসব স্বপ্ন।

তবে আশঙ্কাও কম থাকে না। ভরা গাঙ্গের থৈ থৈ পানিয়ে বুঝি তলিয়ে যায় দুই কানি নিচু জমিনে করা সুগন্ধি চালে চাষ। বড় সাধ করে বুনেছিলেন, নয়া দামান আর মেয়ের জন্য। শ্বশুর কূলের স্বজনদের জিয়াফত দেবেন। সত্যি ফলন হবে তো ঠিকঠাক? এমন স্বপ্ন ও শঙ্কায় বাংলার কৃষকের আজন্মের প্রকৃতির প্রতি আস্থা কিংবা অনাস্থার যুদ্ধ। এমন আশা ও আশঙ্কার কথা কবিরাও তাদের ছন্দে বেঁধেছেন। কবি গুরু তাঁর ‘সোনার তরী’ কবিতায় আপামর কৃষকের কথাই যেন বলেছেন সংগোপনে‘গগনে গরজে মেঘ,ঘর বরষা/কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা/রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা/ভরা নদী ক্ষুরধারা খর-পরশা/কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।’

আবার বিষন্নতায় প্রকাশে মেঘজমা বা বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকা আকাশে দিকে তাকালে মনে আসে কবির আরেক সৃষ্টি-‘দিঘির কালো জলে মেঘের ছায়া’ নতুন মাত্রা যোগ করে। এভাবে বর্ষা ও বৃষ্টির ঋতু একই সাথে নাগরিক জীবনে প্রবল প্রত্যাশা সিক্ত হওয়া আকাঙ্খা এবং ফুল ফসলের অনিবার্য হয়ে এক অনুসঙ্গ।

নগর জীবন ছাড়িয়ে নাগরিক কবি, লেখক ও সৃজনশীল সকল সত্ত্বাকে বর্ষণ-বৃষ্টির ঋতু নানান আবেগের ধরণে তাড়িত করে। গ্রীস্মের প্রখোর তাপদাতে তৃষার্ন্ত হৃদয়ে বিষাদ বিষন্নতা, বিচ্ছেদ, বিরহ-বেদনার নানান ভাববাদিতায় আচ্ছন্ন করে। বাংলা পুঞ্জিকার দ্বিতীয় ঋতু ‘বর্ষা’ মানে ভাববাদী, বিষন্ন-উদাসীনতা ও আধ্যাত্মবাদী এই তিনের মিশ্রন। ভাববাদিতা ও ব্যক্তিক বিরহের দারুণ এক উপলক্ষ্য বর্ষা কিংবা বৃষ্টির আগমন।

নগর ও নাগরিক জীবনে বর্ষা ও বৃষ্টির এত মোহচ্ছন্নতা আছে যে, তা বর্ষাকে জীবনের পার্টে আলাদা করেই স্থান দিতেই হয়। এক বৃষ্টি মুখর দিনে কিভাবে যেন আত্মা ও মননের এক যৌগিক সংযোগ স্থাপিত হয়। নাগরিক ব্যস্ততার মধ্যেও বুঝি বা নিজের সাথে সেই নিরবতা বা একান্ত আত্মীক সর্মাপনের জন্যই সুযোগ করে দেয়। খানিক নিরালায় একাকিত্বের যাতনায় নিজেকে পুড়িয়ে শুদ্ধতার জন্যও মুখিয়ে থাকেন কেউ কেউ। তখন নগরের নিয়ন বাতি কিংবা ঝলমলে বিত্তের বেসাতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয় চাওয়া ও পাওয়ার মাঝের দোলাচাল। তাতে সঙ্গী হয় গুণীজন মান্না দে, ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে/জানি নে জানি নে/কিছুতেই কেন যেন মন লাগে না।’

আধুনিক বাংলা গানেও বর্ষার মোহমুগ্ধতার জয়জয়কার অবস্থা। জয় সরকারের সুরে শ্রীকান্ত আচার্য’র সেই মনমুগ্ধ গান ‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম/শুধু শ্রাবণ সন্ধাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম।’ সত্যি অনবদ্য। একপেয়ালা চায়ের সাথে সন্ধায় বৃষ্টি দেখার দারুণ উপলক্ষ্য কজন উপেক্ষা করতে পারে? বরং এমন বিরল বিষন্ন কিংবা বিরহের বেলা কারো কারো অজান্তেই নিয়ে যায় অনাগত ভবিষ্যতে।

কখনো কখনো হারিয়ে যাওয়া তারুণ্য ফিরে আসে। এমনকি শৈশবের কুমারের ঢেলায় গড়া কাঁচা নবীণ দিনগুলোও ধরা দেয়। এভাবে আমাদের নাগরিক জীবনের গ্রীস্মের তাপদাহ থেকে বর্ষার জললৌহরীর পালে বর্ষার আনাগোনা। আমাদের নতুন পথের দিশায় আহ্বানে নতুন করে উজ্জীবীত করে বৃষ্টির ঝর্ণাধারা। তাই রবী ঠাকুরের নেই গানের সাথে মন মিলিয়ে বলি, ‘হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে/ সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে।/অধর করুণা-মাখা, মিনতি বেদনা-আঁকা/ নীরবে চাহিয়া থাকা বিদায়খনে।/ঝরঝর ঝরে জল, বিজুলি হানে,/পবন মাতিছে বনে পাগল গানে।/ আমার পরানপুটে কোনখানে ব্যথা ফুটে/ কার কথা জেগে উঠে হৃদয়কোণে।”

আসছে বর্ষার আগমন সময়। আগাম সম্ভাষণে বলতে মন চাই ‘প্রিয় প্রেম ভালোবাসার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়---‘বরষা ঐ এলো বরষা/আলোর ধারায় জল ঝরঝরি অবিরল/ধূসর নীরস ধরা হলো সরসা।’

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ও লেখক-গবেষক-কবি

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

অ্যাপোস্টিল সার্ভিস: সহজ হয়েছে প্রামাণিকরণ

সানজানা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখাতে দেখাতে বলল, ‘অ্যাপোস্টিল হলো এমন একটা সার্টিফিকেট, যেটা দিয়ে আমার দলিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে। কোনো দূতাবাসে দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।

১ দিন আগে

বিদায় মদিনা, বিদায়

সবুজ গম্বুজ তলে সবুজ ঝালরে গোলকের মায়াবী নিশানা ঢেউ তোলে বারবার মনের গহীনে

১ দিন আগে

দুপুরের মধ্যে ৭ অঞ্চলে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

দেশের ৭ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৬০ কিমি বেগে ঝড় হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শুক্রবার (২৩ মে) ভোরে নদীবন্দরের জন্য দেওয়া সতর্কবার্তায় এ কথা জানানো হয়।

২ দিন আগে

শিক্ষাজীবন: বাবা-ছেলের দুই সময়ের গল্প

খরচ হতো অনেক। ঢাকায় আসাযাওয়া ও থাকার খরচ জোগাড় করে যাত্রা শুরু করতে হতো। রিয়াদ বললো, “আমরা তো এখন অনলাইনে ফরম পূরণ করি। মোবাইল দিয়েই জমা দিয়ে দিই।

২ দিন আগে