ব্যক্তিত্ব

ডেভিড অ্যাটেনবোরো: নট আউট নাইন্টি নাইন

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ২৩: ১৬
চ্যাটজিপিটির চোখে ডেভিড অ্যাটেনবরো

জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও যদি কেউ পৃথিবীর সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য নিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারেন, তবে নিঃসন্দেহে তিনি ডেভিড অ্যাটেনবোরো। ৯৯ বছর বয়সেও যিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে, প্রাকৃতিক জগতের গল্প শোনান কণ্ঠে অদ্ভুত স্নিগ্ধতা নিয়ে। তাঁর এই কর্মক্ষমতা ও জীবনযাপন কোটি মানুষের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস।

ডেভিড ফ্রেডেরিক অ্যাটেনবোরো জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ৮ই মে, ইংল্যান্ডের লন্ডনের নিকটবর্তী অ্যাইলস্টোনে। তাঁর বাবা ছিলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ, লেস্টারের অধ্যক্ষ। ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল অগাধ আগ্রহ। পাথর, শুকনো পোকামাকড়, গাছের পাতা — সবই ছিল তাঁর সংগ্রহে। তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন, “আমি কখনও খেলাধুলার ছেলে ছিলাম না। বরং আমি জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পোকা খুঁজে বেড়াতাম।”

তাঁর দুই ভাইয়ের একজন ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক রিচার্ড অ্যাটেনবোরো, যিনি “গাঁধী” চলচ্চিত্রের জন্য অস্কার পেয়েছিলেন। অপর ভাই ছিলেন একজন মোটামুটি সাধারণ নাগরিক, কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের জীবনেই ছিল বিশেষত্ব।

ডেভিড পড়াশোনা করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, ন্যাচারাল সায়েন্সে। এরপর ব্রিটিশ নেভিতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি যোগ দেন বিখ্যাত বিবিসি-তে, যা পরবর্তীতে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

১৯৫৫ সালে তিনি বিবিসির "জু কোয়েস্ট" নামের একটি প্রাকৃতিক ডকুমেন্টারির উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এই অনুষ্ঠান তাঁকে পরিচিত করে তোলে ব্রিটেনের ঘরে ঘরে। তবে ডেভিড কেবল একজন উপস্থাপকই ছিলেন না — তিনি ছিলেন নির্মাতা, পরিকল্পক ও গবেষকও।

১৯৭৯ সালে ‘লাইফ অন আর্থ’ডকুমেন্টারিটি প্রকাশের পর সারা পৃথিবীতে তিনি পরিচিত হন প্রকৃতির গল্পকার হিসেবে। এরপর একে একে “দ্য লিভিং প্ল্যানেট”, “দ্য ব্লু প্ল্যানেটt”, “প্ল্যানেট আর্থ”, “ফ্রোজেন প্ল্যানেট”, “লাইফ”, “আওয়ার প্ল্যানেট” ও সাম্প্রতিক “আ লাইফ অব আওয়ার প্ল্যানেট” — সবগুলো সিরিজই ছিল যুগান্তকারী।

এক জীবন, এক লক্ষ্য: পৃথিবীকে রক্ষা করা

ডেভিড অ্যাটেনবোরো কেবল একটি গাছ, পাখি বা মাছের নাম বলেন না। তিনি প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে একধরনের হৃদ্যতা তৈরি করে বলেন, “এই প্রাণীটি যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, আমরা হারাবো পৃথিবীর একটি অংশ।”

৯০ বছর পার হওয়ার পর যখন অনেকেই অবসর নিয়ে নেন, তখন ডেভিড অ্যাটেনবোরো ঘুরে বেড়ান অ্যান্টার্কটিকা, গভীর সাগর আর সাহারা মরুভূমিতে। তিনি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম মুখপাত্র। ২০২০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর “A Life on Our Planet” ডকুমেন্টারিতে তিনি বলেন, “আমি এই গ্রহের জীবন্ত সাক্ষী। আমি দেখেছি কীভাবে আমরা ধ্বংস করছি আমাদেরই একমাত্র বাসস্থানকে।”

আমেরিকার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির গবেষক ডঃ মার্গারেট হিল বলেন, “ডেভিড অ্যাটেনবোরোর কণ্ঠ ও উপস্থাপন ভঙ্গি মানুষকে পরিবেশের প্রতি যে ভালোবাসা শেখায়, তা কোনো রাজনৈতিক ভাষণ বা বিজ্ঞাপন পারে না।”

৯৯ বছর বয়সেও কর্মক্ষম

৯৯ বছর বয়সেও তিনি শুধু ঘরে বসে স্মৃতি চারণ করেন না। তিনি নিয়মিত ভ্রমণে যান, স্ক্রিপ্ট লেখেন, ভয়েস রেকর্ড করেন, গবেষণা পড়েন, নতুন প্রকল্প পরিকল্পনা করেন। তাঁর ডকুমেন্টারির সেরা গুণ হলো — প্রতিটিই বর্তমানের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সমৃদ্ধ।

তিনি বলেন, “ব্যস্ত থাকাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি এখনো শিখি, জানি এবং বলি।”

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. এলেনা ব্রুক বলেন, “ডেভিড অ্যাটেনবোরোর মতো মানুষেরা প্রমাণ করে দেন যে মস্তিষ্ক ও মন যদি সচল থাকে, তবে বয়স শুধুই একটি সংখ্যা।”

তাঁর খাদ্যাভ্যাসও সহজ — বেশি চর্বি বা প্রক্রিয়াজাত খাবার তিনি খান না। নিয়মিত হাঁটেন, বই পড়েন, লেখালেখি করেন।

অর্জন

ডেভিড অ্যাটেনবোরোর ঝুলিতে রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি। ৩২টি সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে “Sir” খেতাব পেয়েছেন, পেয়েছেন এমি, বাফটা, গোল্ডেন পাম, র‍য়াল সোসাইটি মেডেলসহ অজস্র পুরস্কার।

তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি সাদা-কালো টেলিভিশন, রঙিন টেলিভিশন, এইচডি এব ফোরকে — চার প্রজন্মের প্রযুক্তিতেই প্রাকৃতিক ডকুমেন্টারি উপস্থাপন করেছেন।

২০১৬ সালে “প্ল্যানেট আর্থ ২” সিরিজটি যখন মুক্তি পায়, তখন তার ভিউয়ার সংখ্যা ছিল ১.২ বিলিয়ন — পৃথিবীর ষষ্ঠাংশ মানুষ সেই সিরিজটি দেখেছে। এমন ঘটনা টেলিভিশন ইতিহাসে বিরল।

তাঁর কাজের প্রভাব

ডেভিড অ্যাটেনবোরোর ডকুমেন্টারিগুলো শুধু বিনোদন নয়, এগুলো শিক্ষা, বিজ্ঞান ও মানবতার জন্য এক মহামূল্যবান সম্পদ। তাঁর দেখানো আফ্রিকার গহীন জঙ্গল, গভীর সমুদ্রের জীবজগৎ, বা মেরুপ্রদেশের বরফাবৃত ধ্বংসপ্রায় প্রজাতিগুলো নতুন প্রজন্মকে শিখিয়েছে কেমন করে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়।

তিনি প্রায়ই বলেন, “প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ হারালে, আমরা ধ্বংসের দিকেই এগোবো।”

তাঁর কারণে বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী আন্দোলন জোরদার হয়েছে। ব্রিটেনে “প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ আইন”, “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন”, “কার্বন নিঃসরণ হ্রাস প্রকল্প” — এসব উদ্যোগেও তাঁর অবদান ছিল পরোক্ষভাবে।

ভবিষ্যতের জন্য বার্তা

একশ বছর বয়স ছুঁই ছুঁই করেও তিনি নতুন প্রজেক্টে কাজ করছেন। ২০২4 সালে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, “আমি যতদিন কথা বলতে পারি, ততদিন পৃথিবীর কথা বলব।”

ডেভিড অ্যাটেনবোরোর জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা — বয়স কোনো বাধা নয়, যদি মন থাকে তরুণ, চোখ থাকে কৌতূহলী, আর হৃদয় থাকে প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ।

একবিংশ শতাব্দীর এক ব্যতিক্রমী চরিত্র ডেভিড অ্যাটেনবোরো। তাঁর জীবন, কাজ ও চিন্তা আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে একজন মানুষ প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের হয়ে কথা বলতে পারেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও দার্শনিক হয়ে। তিনি কেবল একজন ডকুমেন্টারি নির্মাতা নন, তিনি এক আদর্শ — যিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন, পৃথিবী শুধু বসবাসের জায়গা নয়, এটি ভালোবাসার জায়গা।

আপনি যদি জীবনে কখনো হতাশ বা ক্লান্ত বোধ করেন, একবার ডেভিড অ্যাটেনবোরোর কণ্ঠে “প্ল্যানেট আর্থ” শুনে দেখুন। আপনি নতুনভাবে পৃথিবীকে দেখতে শিখবেন।

সূত্র: বিবিসি

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

ওটস কেন খাবেন?

সকালের নাশতায় অনেকেই এখন ‘ওটস’ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলছেন। কেউ কেউ আবার এটাকে “বিদেশি খাবার” বলে এড়িয়ে চলেন। কেউ বলেন, এতে ঠিকভাবে পেট ভরে না। আবার কেউ বলেন, ওটস খাওয়া মানে একঘেয়ে একটা জিনিস মুখে দেওয়া। কিন্তু আসলেই কি ওটস খাওয়া কেবল ট্রেন্ড না পেট ও স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিছু? আমরা যদি একবার এই খাবার

৪ দিন আগে

দেশজুড়ে বজ্রবৃষ্টির আভাস

আজ সারা দেশে বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই সঙ্গে কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টিও হতে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

৫ দিন আগে

তাপপ্রবাহ কমে বাড়তে পারে বৃষ্টি

দেশের চার বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপপ্রবাহ আজ বুধবার কমতে পারে। একই সঙ্গে আগামী কয়েক দিনে দেশের অধিকাংশ স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়তে পারে। কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণের সম্ভাবনাও রয়েছে। তাই তাপমাত্রা কমে যেতে পারে।

৫ দিন আগে

মারা গেছেন চিত্রনায়িকা তানিন সুবহা

সোমবার (২ জুন) হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এই অভিনেত্রীকে ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তবে এই কয় দিনে তাঁর শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।

৮ দিন আগে