তেল নিয়ে ট্রাম্পের দাবি, ভারতের অস্বীকার, কোন পথে কূটনীতি?

ডয়েচে ভেলে

রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে বিতর্ক কূটনীতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে পররাষ্ট্র নীতিতে, রাজনীতিতে?

প্রথমে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত বন্ধের কৃতিত্ব নেওয়া, তারপর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে দাবি করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। দুইটি ক্ষেত্রেই ভারত ট্রাম্পের দাবি অস্বীকার করেছে। প্রথম ক্ষেত্রে সংসদের ভিতরে ও বাইরে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক আলেোচনার ভিত্তিতেই সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছে এবং পাকিস্তান প্রথমে সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব দেয়।

রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখনো পর্যন্ত একটা কথাও বলেননি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে ফোনে কোনো কথা হয়নি।

এরপর এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প জানিয়েছেন, ''আমি জানি না। ওরা যদি এরকম কথা বলে, তাহলে বিপুল পরিমাণ পণ্য মাসুল দিতে হবে।''

নতুন ধরনের কূটনীতি?

সাধারণত কূটনৈতিক ঘোষণা এরকম একতরফা ও প্রকাশ্যে হয় না। কিন্তু এখন হচ্ছে। সাধারণত অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে একটা দাবি করছেন, তারপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি তা খারিজ করে দিচ্ছে, এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না, এখন ঘটছে।

ওপি জিন্দল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এর ফলে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে একটা প্রশ্ন ওঠে। যখন প্রকাশ্যে এই ধরনের বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয়, তখন সেই প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। সমাজমাধ্যমের কল্যাণে দুইটি বিবৃতিই সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বে চলে গেছে।''

সাবেক কূটনীতিক কে সি সিং ইন্ডিয়া টুডে-কে বলেছেন, ''ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দুইভাবে কূটনীতি হতে পারে। একটা হলো, তার সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে আলোচনা করা। এই পথ অনেকেই নিয়েছে। অন্যটা হলো, চীনের মতো নীতি। অ্যামেরিকার সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে, আবার সমস্যা হলে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।''

তিনি বলেছেন, ''মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতিতে ট্রাম্প ডাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী মোদী যাননি। গেলে হয়ত, ট্রাম্প বলতেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হাত মেলাও। ট্রাম্পের সঙ্গে কীভাবে চলতে হয়, তা বোঝা দরকার। মোদী এক্ষেত্রে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।''

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, ট্রাম্পের সঙ্গে এরকম ঘটনা অন্য দেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ট্রাম্প যা বলছেন তা তো জেলেনস্কিও মানতে চাইছেন না।''

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ''ট্রাম্প বিদেশনীতির ক্ষেত্রে এবং ঘরোয়া নীতিতেও সমানে গোলপোস্ট পরিবর্তন করেন। তবে ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই চাইছেন, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করুক। তাই তিনি নানাভাবে চাপ দিচ্ছেন।''

প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''দীর্ঘদিন ধরে আমরা জেনে এসেছি, কূটনীতি গোপনে হয়। আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে হয়। এখন অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান প্রকাশ্য ঘোষণার মধ্যে দিয়ে বড় কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত একতরফা ঘোষণা করছেন। এর ফল ভালো হবে না খারাপ, সেটা অন্য প্রশ্ন, ঘটনা হলো এই প্রবণতা বাড়ছে ও ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে।''

ভারত কি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করবে?

ট্রাম্প দাবি করেছেন, ভারত এখনই তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে না। তবে তারা দ্রুত তা বন্ধ করবে।

এর জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ভারতের নীতিই হলো, তারা দেশ ও জনগণের স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়। তারা সেই পথেই চলবে।

গত ছয় মাসের হিসাব বলছে, ভারত রাশিয়া থেকে তাদের প্রয়োজনের ৩৫ শতাংশ তেল কিনছে।

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ''ট্রাম্প চাপ দিয়ে রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনা বন্ধ করতে চান। কিন্তু ভারত এখনো সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেনি। হয়ত, ভবিষ্যতে ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমাতে পারে, কিন্তু তা বন্ধ হবে না। রাশিয়া আমাদের বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু। তাদের সঙ্গে তো সম্পর্ক শুধু তেল কেনা নিয়ে নয়, তারা প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অন্যতম বড় সহযোগী।''

বিশ্বনাথের দাবি, ''ট্রাম্পের চাপের নীতি ভারতের ক্ষেত্রে সেভাবে কার্যকর হয়নি। সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ভারত ২৪টি দেশে রপ্তানি বাড়িয়েছে। অ্যামেরিকার উপর নির্ভরতা থেকে ভারতও তো বের হয়ে আসতে চাইবে।''

জয়ন্ত বলেছেন, ''একটা কথা ভারতে প্রশাসনিক স্তরে সম্প্রতি খুব বেশি করে শোনা যাচ্ছে, তা হলো, ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কম করবে। তবে তারা কখনোই বন্ধ করবে না। আগেও তারা রাশিয়া থেকে তেল কম কিনত। রাশিয়া বিশাল অংকের ছাড় দেওয়ায় তেল কেনা বাড়ে। এখন রাশিয়া ছাড়ের পরিমাণ কম করে দিয়েছে।''

জয়ন্তের মতে, ''অ্যামেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। সেখানে অ্যামেরিকা থেকে তেল কেনার বিষয়েও কথা হতে পারে। তবে ভারত চাইবে অ্যামেরিকাকেও তেলের দামে ছাড় দিক। বাণিজ্য চুক্তি হলে, বাড়তি মাসুল বন্ধের কথা উঠবে। হতে পারে, ট্রাম্প সেই পথটা খুলে রাখতে চাইছেন।''

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

শ্রীরাধা মনে করেন, ''এই ধরনের ঘটনা ও বিতর্ক হলে দক্ষিণপন্থা বেশি করে মাথা চাড়া দেওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। এটা মাথায় রাখা দরকার।''

জয়ন্ত বলেছেন, ''সামনেই বিহারের নির্বাচন। সেখানে বিজেপি কোনোভাবেই চাইবে না, আরজেডি, কংগ্রেসের নেতৃত্বে মহাজোট কোনো বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাক। কংগ্রেস তো ট্রাম্পের এই দুই দাবি নিয়ে ভরপুর প্রচার করছে। কংগ্রেস নেতারা প্রশ্ন করছেন, ট্রাম্পের নির্দেশে কি ভারত চলবে? ট্রাম্পের কাছে কি ভারত আত্মসমর্পণ করেছে?''

বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যামেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকা দরকার, রাশিয়ার থেকে তেল কেনাও বন্ধ হওয়া উচিত নয়। দেশের স্বার্থের নীতি নিয়ে গোটা বিশ্ব চলে। ফলে দুই শিবিরের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ভারসাম্যের কূটনীতিই ভারতের কাছে চ্যালেঞ্জ।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হাসপাতালে বোরকা বাধ্যতামূলক করেছে তালেবান সরকার

এমএসএফ-এর দাবি, এই কড়াকড়ির কারণে জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন এমন নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার পর হাসপাতালের জরুরি রোগী ভর্তি ২৮ শতাংশ কমে গেছে। যদিও তালেবানের 'প্রচার ও নৈতিকতা রক্ষা মন্ত্রণালয়' জোর করে বোরকা পরানোর বিষয়টি অস্বীকার করে শুধু 'হিজাব' পরিধানের কথা বলছে। সংবাদমাধ্

১ দিন আগে

পাকিস্তানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত ১২

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে জেলা ও দায়রা আদালত ভবনের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামালায় ১২ জন নিহত ও অন্তত ২৭ জন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ইসলামাবাদ পুলিশের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা দেশটির সংবাদমাধ্যম ডন নিউজকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

২ দিন আগে

দিল্লি বিস্ফোরণে অমিত শাহের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মহুয়া মৈত্র

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ তিনি লিখেছেন, “ভারতের একজন দক্ষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রয়োজন, এমন ব্যক্তি নয় যিনি পূর্ণকালীন ঘৃণা ছড়িয়ে বেড়ান। আমাদের সীমান্ত এবং শহর দুটোকেই রক্ষা করা কি অমিত শাহের কর্তব্য নয়? প্রতিটি ফ্রন্টে তিনি কেন এমন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন?"

২ দিন আগে

বিবিসির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলার হুমকি ট্রাম্পের

বিবিসির একটি অভ্যন্তরীণ স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে যে, অনুষ্ঠানটিতে ২০২১ সালের ছয়ই জানুয়ারি ট্রাম্পের ভাষণের দুটি আলাদা অংশ একসাথে মিশিয়ে দর্শকদের বিভ্রান্ত করেছে, যা দেখে মনে হচ্ছে তিনি তার নির্বাচনী পরাজয়ের পর মার্কিন ক্যাপিটলে আক্রমণ করার জন্য জনগণকে স্পষ্টভাবে আহ্বান জানাচ্ছিলেন।

২ দিন আগে