ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
১৫৬০ সালের দিকে আকবর ধীরে ধীরে তাঁর অধীনে থাকা প্রধান আমলাদের মধ্যে বায়রামবিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বায়রাম খাঁকে রাজনীতি থেকে সরে যেতে বলা হয়। প্রথমে তিনি মক্কায় হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু পথে গুজরাটে এক ব্যক্তিগত শত্রুর হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে আকবরের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে যায়—একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও পরীক্ষাধর্মী শাসনের।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়—হেমু পরাজিত হয়ে গেলেও কেন এই যুদ্ধ ভারতীয় ইতিহাসে এত তাৎপর্যপূর্ণ?
উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যায় দুটি দিক থেকে—এক, আকবরের রাজনৈতিক অভিযাত্রা; দুই, ভারতবর্ষে ধর্মীয় সহনশীলতা ও রাজনীতির একটি নতুন ধারা।
আকবর খুব শিগগিরই তাঁর সাম্রাজ্যে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খ্রিস্টান, পারসি—সব ধর্মের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেন। তিনি রাজপুত রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তাঁদের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান, এবং ‘সুলহ-ই-কুল’ অর্থাৎ ‘সর্বজনীন সহনশীলতা’র নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। তাঁর এই ধারার সূচনা কিন্তু অনেকে মনে করেন পানি পথ যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকেই শুরু হয়, যখন তিনি উপলব্ধি করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সাম্রাজ্য টেকানো সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন—“আকবর হেমুর পরাজয়ের পর ধর্মীয় কর্তৃত্বের ওপর না ভরসা করে রাজ্যের স্থায়িত্বের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন প্রশাসনিক দক্ষতা, ন্যায়বিচার আর অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির মধ্যে।”
অন্যদিকে, হেমু নামটি কিছু ইতিহাসে ‘হারিয়ে যাওয়া নায়ক’ হিসেবেও বিবেচিত হয়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জর্জ ব্রুস ম্যালসন বলেন—“যদি হেমু বেঁচে থাকতেন এবং দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন, তবে হয়তো ভারত এক ভিন্ন গতিপথ দেখত—সম্ভবত এক হিন্দু সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান।”
তবে বাস্তবতা হলো, হেমুর পতনের মধ্য দিয়েই মুঘলরা দিল্লির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। এই জয় ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার মূলে। আকবরের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজত্ব ভারতকে এমন এক প্রশাসনিক কাঠামো দেয়, যা বহুদিন ধরে অটুট থাকে। এই কাঠামোর ভিত কিন্তু গড়া হয় পানি পথের সেই রক্তাক্ত মাঠে।
এই যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল—মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানচিহ্ন স্থায়ী করে দেওয়া। বাবরের সময়কালীন যুদ্ধ ছিল অনেকটাই এক বিদেশি অভিযানের মতো। কিন্তু পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে মুঘলরা ক্রমেই নিজেকে ‘এই দেশের রাজা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। আকবরের শাসন ছিল মুঘলদের ভারতীয় হওয়ার এক প্রক্রিয়া—যা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসে তাঁদের এক বিশাল ‘ভারতীয় ইসলামি সাম্রাজ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
ইতিহাসবিদ পিটার হার্ভে বলেন—“পানি পথই ছিল সেই স্থান, যেখানে মুঘল স্থায়িত্বের ধারণাটি প্রথম পরীক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।”
তাই ১৫৫৬ সালের পানি পথের যুদ্ধকে কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ব্যাকরণ পুনর্লিখনের প্রক্রিয়া। হেমুর আত্মবিশ্বাস ও আকবরের কৌশল, বায়রাম খাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং ভাগ্যের নির্মমতা—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অনিবার্য বাঁক।
পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ চিরকালীন। যদিও এটি আকবরের বিজয় হিসেবে পড়ানো হয় ভারতীয় ইতিহাসে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে—এই যুদ্ধ কি শুধু একটি সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের যুদ্ধ, না কি একটি সম্ভাব্য বিকল্প ইতিহাসের পথ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা? বিশেষত হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য, সংক্ষেপে হেমু, যাঁর জীবনগাথা যেন কোনও রূপকথার মতো—বাণিজ্যের জগৎ থেকে যুদ্ধক্ষেত্র, সেনাপতি থেকে সম্রাট—তাঁকে নিয়ে বিতর্ক সবচেয়ে তীব্র।
উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ লেখক ও ইতিহাসবিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম লিখেছিলেন— “হেমুর কাহিনি মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত, যেখানে জন্ম নয়, গন্তব্য নির্ধারিত হয়েছিল যোগ্যতায়।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আবির্ভাবের সময় আরও জোরালো হয়। বিশেষ করে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে, যখন উপনিবেশবিরোধী চেতনার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারাও মাথা তোলে, তখন হেমুকে উপস্থাপন করা হয় এক ‘হিন্দু বীর’ হিসেবে, যিনি ভারতীয় পরিচয়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এক বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে।
কিন্তু এখানে আরও এক ধরনের ঐতিহাসিক জটিলতা তৈরি হয়। আকবরকে প্রায়শই দেখা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল সম্রাট’ হিসেবে, যাঁর ‘দীন-ই-ইলাহী’ মতবাদ ও ‘সুলহ-ই-কুল’ নীতিকে অনেকেই ভারতীয় বহুত্ববাদের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ শুধু এক তরুণের শাসন প্রতিষ্ঠার ঘটনা নয়, এটি ছিল ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের নতুন এক ভিত্তি স্থাপন।
এই দুই বিপরীত ব্যাখ্যার মাঝখানে পড়ে হেমু হয়ে ওঠেন ‘ভুলে যাওয়া নায়ক’। তাঁর বীরত্ব স্বীকৃতি পেলেও, পরবর্তী মুঘল ইতিহাসে তাঁকে প্রায় অবজ্ঞার সঙ্গেই উল্লেখ করা হয়। কারণ আকবরের শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইতিহাস প্রায় পুরোটাই মুঘল দরবারের লেখকদের হাতে লেখা। ফলে হেমু হয়ে পড়েন ‘বিপক্ষের এক বিদ্রোহী’, যাঁকে যতটা সম্ভব ছোট করে দেখানো হয়েছে।
তবে হেমুর মৃত্যুর মুহূর্তটি নিয়ে নানা ইতিহাসে উঠে আসে এক নৃশংস চিত্র। অনেকেই বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে হেমু চোখে তীরবিদ্ধ হয়ে অচেতন হন এবং বন্দি অবস্থায় আকবরের সামনে আনা হয়। ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর ‘আকবর দ্য গ্রেট মুঘল’ গ্রন্থে লেখেন— “বায়রাম খাঁ জোর দেন যে তরুণ সম্রাট নিজ হাতে পরাজিত শত্রুকে প্রথম আঘাত করবেন, যেমন রীতি ছিল।”
যদিও কিছু আধুনিক ইতিহাসবিদ, যেমন ইরফান হাবিব কিংবা রণজিৎ গুহ, এই বর্ণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁদের মতে, এটি হতে পারে একটি ‘রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা’, যা বিজয়কে মহিমান্বিত করার জন্য তৈরি।
এই দ্বন্দ্ব থেকেই প্রশ্ন ওঠে—আসলে কে ছিলেন হেমু? এক রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্ষমতালোভী সেনাপতি, নাকি একটি বিকল্প আধুনিক ভারতের সম্ভাব্য সূচনাকারী? আর আকবর—তিনিও কি একজন সংবেদনশীল রাষ্ট্রনায়ক, না কি নিছক একজন বিজয়ী সম্রাট, যার সহনশীলতা ছিল ক্ষমতা স্থায়ী করার কৌশল?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর হয়তো ইতিহাসের পাতায় সম্পূর্ণভাবে মেলে না, কিন্তু এই বিতর্কই প্রমাণ করে—পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল কেবল একটি যুদ্ধ নয়, এটি ছিল ইতিহাসের এক চিরন্তন নৈতিক জিজ্ঞাসা।
আজকের দিনেও হেমুর স্মৃতি কিছু জায়গায় বেঁচে আছে—বিশেষ করে হরিয়ানা ও বিহারে, যেখানে তাঁকে স্থানীয় বীর হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়। পানিপথ শহরের কাছাকাছি একটি স্থান আছে ‘সম্রাট হেমু বিক্রমাদিত্য স্মারক’, যেখানে তাঁর সম্মানে একটি ছোট স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এটি সরকারি পর্যায়ে যতটা না সংরক্ষিত, তার চেয়ে অনেক বেশি বেসরকারি উৎসাহে টিকে আছে।
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার বলেন—‘‘বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “ইতিহাস বিজয়ীদের মনে রাখে, কিন্তু হারাদের স্মৃতির মধ্যেই অনেক সময় একটি জাতির পরিচয়ের বীজ রোপিত হয়।”
পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ তাই একযোগে জয়ের ইতিহাস এবং বিস্মৃতির ট্র্যাজেডি। আকবরের জন্য এটি ছিল তাঁর রাজত্বের ভিত্তি, হেমুর জন্য এটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ।
চলবে..
এই লেখার আগের দুই পর্ব পড়ুন:
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ১
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ২
১৫৬০ সালের দিকে আকবর ধীরে ধীরে তাঁর অধীনে থাকা প্রধান আমলাদের মধ্যে বায়রামবিরোধী শক্তিকে সমর্থন দিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বায়রাম খাঁকে রাজনীতি থেকে সরে যেতে বলা হয়। প্রথমে তিনি মক্কায় হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু পথে গুজরাটে এক ব্যক্তিগত শত্রুর হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে আকবরের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে যায়—একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও পরীক্ষাধর্মী শাসনের।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়—হেমু পরাজিত হয়ে গেলেও কেন এই যুদ্ধ ভারতীয় ইতিহাসে এত তাৎপর্যপূর্ণ?
উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যায় দুটি দিক থেকে—এক, আকবরের রাজনৈতিক অভিযাত্রা; দুই, ভারতবর্ষে ধর্মীয় সহনশীলতা ও রাজনীতির একটি নতুন ধারা।
আকবর খুব শিগগিরই তাঁর সাম্রাজ্যে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খ্রিস্টান, পারসি—সব ধর্মের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেন। তিনি রাজপুত রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তাঁদের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান, এবং ‘সুলহ-ই-কুল’ অর্থাৎ ‘সর্বজনীন সহনশীলতা’র নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। তাঁর এই ধারার সূচনা কিন্তু অনেকে মনে করেন পানি পথ যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকেই শুরু হয়, যখন তিনি উপলব্ধি করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সাম্রাজ্য টেকানো সম্ভব নয়।
এই প্রসঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বলেন—“আকবর হেমুর পরাজয়ের পর ধর্মীয় কর্তৃত্বের ওপর না ভরসা করে রাজ্যের স্থায়িত্বের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন প্রশাসনিক দক্ষতা, ন্যায়বিচার আর অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির মধ্যে।”
অন্যদিকে, হেমু নামটি কিছু ইতিহাসে ‘হারিয়ে যাওয়া নায়ক’ হিসেবেও বিবেচিত হয়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জর্জ ব্রুস ম্যালসন বলেন—“যদি হেমু বেঁচে থাকতেন এবং দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন, তবে হয়তো ভারত এক ভিন্ন গতিপথ দেখত—সম্ভবত এক হিন্দু সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান।”
তবে বাস্তবতা হলো, হেমুর পতনের মধ্য দিয়েই মুঘলরা দিল্লির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। এই জয় ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার মূলে। আকবরের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের রাজত্ব ভারতকে এমন এক প্রশাসনিক কাঠামো দেয়, যা বহুদিন ধরে অটুট থাকে। এই কাঠামোর ভিত কিন্তু গড়া হয় পানি পথের সেই রক্তাক্ত মাঠে।
এই যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল—মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থানচিহ্ন স্থায়ী করে দেওয়া। বাবরের সময়কালীন যুদ্ধ ছিল অনেকটাই এক বিদেশি অভিযানের মতো। কিন্তু পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর থেকে মুঘলরা ক্রমেই নিজেকে ‘এই দেশের রাজা’ হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। আকবরের শাসন ছিল মুঘলদের ভারতীয় হওয়ার এক প্রক্রিয়া—যা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসে তাঁদের এক বিশাল ‘ভারতীয় ইসলামি সাম্রাজ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে।
ইতিহাসবিদ পিটার হার্ভে বলেন—“পানি পথই ছিল সেই স্থান, যেখানে মুঘল স্থায়িত্বের ধারণাটি প্রথম পরীক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।”
তাই ১৫৫৬ সালের পানি পথের যুদ্ধকে কেবল একটি সামরিক সংঘর্ষ হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি ছিল একটি রাজনৈতিক ব্যাকরণ পুনর্লিখনের প্রক্রিয়া। হেমুর আত্মবিশ্বাস ও আকবরের কৌশল, বায়রাম খাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং ভাগ্যের নির্মমতা—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অনিবার্য বাঁক।
পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ চিরকালীন। যদিও এটি আকবরের বিজয় হিসেবে পড়ানো হয় ভারতীয় ইতিহাসে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে—এই যুদ্ধ কি শুধু একটি সাম্রাজ্যের পুনর্গঠনের যুদ্ধ, না কি একটি সম্ভাব্য বিকল্প ইতিহাসের পথ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা? বিশেষত হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য, সংক্ষেপে হেমু, যাঁর জীবনগাথা যেন কোনও রূপকথার মতো—বাণিজ্যের জগৎ থেকে যুদ্ধক্ষেত্র, সেনাপতি থেকে সম্রাট—তাঁকে নিয়ে বিতর্ক সবচেয়ে তীব্র।
উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ লেখক ও ইতিহাসবিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম লিখেছিলেন— “হেমুর কাহিনি মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত, যেখানে জন্ম নয়, গন্তব্য নির্ধারিত হয়েছিল যোগ্যতায়।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আবির্ভাবের সময় আরও জোরালো হয়। বিশেষ করে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে, যখন উপনিবেশবিরোধী চেতনার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারাও মাথা তোলে, তখন হেমুকে উপস্থাপন করা হয় এক ‘হিন্দু বীর’ হিসেবে, যিনি ভারতীয় পরিচয়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এক বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে।
কিন্তু এখানে আরও এক ধরনের ঐতিহাসিক জটিলতা তৈরি হয়। আকবরকে প্রায়শই দেখা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল সম্রাট’ হিসেবে, যাঁর ‘দীন-ই-ইলাহী’ মতবাদ ও ‘সুলহ-ই-কুল’ নীতিকে অনেকেই ভারতীয় বহুত্ববাদের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ শুধু এক তরুণের শাসন প্রতিষ্ঠার ঘটনা নয়, এটি ছিল ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থানের নতুন এক ভিত্তি স্থাপন।
এই দুই বিপরীত ব্যাখ্যার মাঝখানে পড়ে হেমু হয়ে ওঠেন ‘ভুলে যাওয়া নায়ক’। তাঁর বীরত্ব স্বীকৃতি পেলেও, পরবর্তী মুঘল ইতিহাসে তাঁকে প্রায় অবজ্ঞার সঙ্গেই উল্লেখ করা হয়। কারণ আকবরের শাসন প্রতিষ্ঠার পর ইতিহাস প্রায় পুরোটাই মুঘল দরবারের লেখকদের হাতে লেখা। ফলে হেমু হয়ে পড়েন ‘বিপক্ষের এক বিদ্রোহী’, যাঁকে যতটা সম্ভব ছোট করে দেখানো হয়েছে।
তবে হেমুর মৃত্যুর মুহূর্তটি নিয়ে নানা ইতিহাসে উঠে আসে এক নৃশংস চিত্র। অনেকেই বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে হেমু চোখে তীরবিদ্ধ হয়ে অচেতন হন এবং বন্দি অবস্থায় আকবরের সামনে আনা হয়। ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর ‘আকবর দ্য গ্রেট মুঘল’ গ্রন্থে লেখেন— “বায়রাম খাঁ জোর দেন যে তরুণ সম্রাট নিজ হাতে পরাজিত শত্রুকে প্রথম আঘাত করবেন, যেমন রীতি ছিল।”
যদিও কিছু আধুনিক ইতিহাসবিদ, যেমন ইরফান হাবিব কিংবা রণজিৎ গুহ, এই বর্ণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁদের মতে, এটি হতে পারে একটি ‘রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা’, যা বিজয়কে মহিমান্বিত করার জন্য তৈরি।
এই দ্বন্দ্ব থেকেই প্রশ্ন ওঠে—আসলে কে ছিলেন হেমু? এক রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্ষমতালোভী সেনাপতি, নাকি একটি বিকল্প আধুনিক ভারতের সম্ভাব্য সূচনাকারী? আর আকবর—তিনিও কি একজন সংবেদনশীল রাষ্ট্রনায়ক, না কি নিছক একজন বিজয়ী সম্রাট, যার সহনশীলতা ছিল ক্ষমতা স্থায়ী করার কৌশল?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর হয়তো ইতিহাসের পাতায় সম্পূর্ণভাবে মেলে না, কিন্তু এই বিতর্কই প্রমাণ করে—পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল কেবল একটি যুদ্ধ নয়, এটি ছিল ইতিহাসের এক চিরন্তন নৈতিক জিজ্ঞাসা।
আজকের দিনেও হেমুর স্মৃতি কিছু জায়গায় বেঁচে আছে—বিশেষ করে হরিয়ানা ও বিহারে, যেখানে তাঁকে স্থানীয় বীর হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়। পানিপথ শহরের কাছাকাছি একটি স্থান আছে ‘সম্রাট হেমু বিক্রমাদিত্য স্মারক’, যেখানে তাঁর সম্মানে একটি ছোট স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এটি সরকারি পর্যায়ে যতটা না সংরক্ষিত, তার চেয়ে অনেক বেশি বেসরকারি উৎসাহে টিকে আছে।
এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার বলেন—‘‘বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “ইতিহাস বিজয়ীদের মনে রাখে, কিন্তু হারাদের স্মৃতির মধ্যেই অনেক সময় একটি জাতির পরিচয়ের বীজ রোপিত হয়।”
পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ তাই একযোগে জয়ের ইতিহাস এবং বিস্মৃতির ট্র্যাজেডি। আকবরের জন্য এটি ছিল তাঁর রাজত্বের ভিত্তি, হেমুর জন্য এটি ছিল তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ।
চলবে..
এই লেখার আগের দুই পর্ব পড়ুন:
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ১
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ২
বিবিসি জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসননীতি ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর নজরদারির অংশ হিসেবেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও ‘সন্ত্রাসবাদে সহায়তা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তা পরিষ্কার করেনি স্টেট ডিপার্টমেন্ট।
১৩ ঘণ্টা আগেগাজায় উদ্ধার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগী এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন অথবা রাস্তায় পড়ে আছেন তবে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ এবং সরঞ্জামের অভাবে জরুরি দল তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।
১৪ ঘণ্টা আগেএ বৈঠকের দিন-তারিখ নিয়ে অবশ্য কোনো তরহ্য মেলেনি। নির্ধারণ হয়নি বৈঠকের স্থানও। তবে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস আভাস দিয়েছেন, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি হতে পারে।
১৫ ঘণ্টা আগেবৈঠকের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধে অনেক অগ্রগতি হচ্ছে। এ সময় জেলেনস্কি বলেন, কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সমর্থন আছে।
১ দিন আগে