ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
যুদ্ধ হয়, রক্ত ঝরে, বিজয়ী হাসে, পরাজিত হারিয়ে যায়—এটাই ইতিহাসের চিরন্তন সূত্র। কিন্তু কিছু যুদ্ধ থাকে, যেগুলোর প্রতিধ্বনি ইতিহাসের পাতায় নয়, কালের অতলে বহমান জনস্মৃতিতে বাজতে থাকে। ১৫৫৬ সালের পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ তেমনি এক অধ্যায়, যা শুধু একটি তরুণ সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণ নয়, বরং একটি সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
এই যুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব হলো মুঘল সাম্রাজ্যের পুনর্গঠন। বাবরের মৃত্যু ও হুমায়ুনের দীর্ঘ নির্বাসনের পর ভারতবর্ষে মুঘল কর্তৃত্ব কার্যত বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। শেরশাহ সুরির মতো শক্তিশালী প্রশাসক ও তাঁর উত্তরসূরিদের শাসন ছিল বেশষ সফল। তাঁরা প্রশাসনিক দক্ষতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কৃষি সংস্কারে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। হেমু সেই ধারার শেষ প্রতিনিধি, যিনি চেষ্টা করেছিলেন সুর সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং এক স্বাধীন, অ-মুঘল ভারত গঠনের।
কিন্তু ভাগ্য, রাজনীতি ও ধর্মের মিশেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। আকবরের বিজয়ের মাধ্যমে শুধু মুঘলরা নয়, বরং মধ্য এশিয়া থেকে আসা এক সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক-সামরিক সংস্কৃতি আবার প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় উপমহাদেশে। সেই সংস্কৃতি শুধু প্রশাসন নয়, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যে গভীর ছাপ ফেলে দেয়।
আকবর তাঁর দীর্ঘ শাসনকালে শুধু এক সাম্রাজ্য বিস্তারকারী ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক সংস্কৃতি নির্মাতা। দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-র লেখক ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেন, এর বাংলা অনুবাদ, “পানিপথের বিজয়ের মাধ্যমে আকবর শুধু রাজনৈতিক কর্তৃত্বই প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং উপমহাদেশে এক সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ভিত্তিও স্থাপন করেছিলেন।”
এই নবজাগরণ ছিল বহুমুখী। হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান, সুফিবাদ ও ভক্তি আন্দোলনের সমন্বয়, তীর্থযাত্রা কর, গো হত্যা নিষেধাজ্ঞা কিংবা মসজিদ-মন্দির নির্মাণে সমান উৎসাহ—এই সবকিছুর মধ্যেই আকবরের সাম্রাজ্যবাদী বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তবতাবাদ কাজ করেছিল।
অন্যদিকে, হেমুর পরাজয় শুধু একটি ব্যক্তির পতন নয়, বরং বিকল্প ইতিহাসের একটি সম্ভাব্য পথের অকালবিলুপ্তি। যদি হেমু বিজয়ী হতেন, তবে কি ভারতের ইতিহাস ভিন্ন হতো? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে না। কিন্তু এটুকু বলা যায়, ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে এক পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্রাট হওয়া—তা মধ্যযুগীয় ভারতেই হোক বা আধুনিক কালেই—এ এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত।
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার বলেন—“যদি হেমু সফল হতেন, তবে হয়তো ভারত এক ভিন্নধর্মী সংহতির অভিজ্ঞতা পেত—যেটি হতো আরও আঞ্চলিক এবং দেশজ ভিত্তির।”
এখানেই উঠে আসে ‘স্মৃতির রাজনীতি’র প্রসঙ্গ। ব্রিটিশ শাসনামলে আকবরকে দেখানো হয় ‘আদর্শ ভারতীয় রাজা’ হিসেবে—যে রাজতন্ত্র সংহতির প্রতীক, যা ব্রিটিশরা নিজেরা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অন্যদিকে হেমু, যিনি ‘স্বদেশি পরিপ্রেক্ষিত’-এর প্রতিনিধি, ধীরে ধীরে হারিয়ে যান সরকারি ইতিহাসচর্চা থেকে।
এমনকি আধুনিক ভারতের ইতিহাসপাঠ্যক্রমেও পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব প্রায়শই আকবরের রাজ্য পুনরুদ্ধারের সফলতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, হেমুর ভূমিকাকে প্রায় উপেক্ষা করেই। অথচ সমসাময়িক জাতীয়তাবাদী আবেগ, বিশেষ করে উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলগুলিতে, হেমুকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। বিহার ও হরিয়ানায় অনেক জায়গায় তাঁর নামে মূর্তি, রাস্তা ও স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্তরে তিনি এখনো ‘অপ্রয়োজনীয়’ ইতিহাসের একটি পরিচ্ছন্ন পাতা।
আজকের ভারতীয় সমাজে যখন ইতিহাসের পাঠ রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, তখন পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ এক গভীর প্রাসঙ্গিকতা ধারণ করে। এটি মনে করিয়ে দেয়—ইতিহাস কেবল তারিখ ও তথ্য নয়, এটি দৃষ্টিভঙ্গির এক শক্তিশালী খেলা। কে বিজয়ী, কে পরাজিত, কে নায়ক, কে ভিলেন—তা নির্ধারিত হয় কেবল যুদ্ধের ফলাফলে নয়, বরং কে সেই ইতিহাস লিখেছে তার উপরও।
বিশিষ্ট লেখক রামচন্দ্র গুহ-র বলেছেন,“ইতিহাস শুধু অতীতের কথা নয়, এটি ভবিষ্যতের কথা কথাও বলে, যে ভবিষ্যৎ আমরা কল্পনা করতে চাই।”
পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ তাই আজও আমাদের সামনে একটি আয়নার মতো দাঁড়িয়ে থাকে—যেখানে আমরা নিজের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় খুঁজি, হারানো ইতিহাসের ছায়ায় বর্তমানকে ব্যাখ্যা করি, আর ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হই।
আগের তিন পর্ব:
১. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ১
২. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ২
৩. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ৩
যুদ্ধ হয়, রক্ত ঝরে, বিজয়ী হাসে, পরাজিত হারিয়ে যায়—এটাই ইতিহাসের চিরন্তন সূত্র। কিন্তু কিছু যুদ্ধ থাকে, যেগুলোর প্রতিধ্বনি ইতিহাসের পাতায় নয়, কালের অতলে বহমান জনস্মৃতিতে বাজতে থাকে। ১৫৫৬ সালের পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ তেমনি এক অধ্যায়, যা শুধু একটি তরুণ সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণ নয়, বরং একটি সভ্যতার গতিপথ নির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
এই যুদ্ধের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব হলো মুঘল সাম্রাজ্যের পুনর্গঠন। বাবরের মৃত্যু ও হুমায়ুনের দীর্ঘ নির্বাসনের পর ভারতবর্ষে মুঘল কর্তৃত্ব কার্যত বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। শেরশাহ সুরির মতো শক্তিশালী প্রশাসক ও তাঁর উত্তরসূরিদের শাসন ছিল বেশষ সফল। তাঁরা প্রশাসনিক দক্ষতা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কৃষি সংস্কারে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। হেমু সেই ধারার শেষ প্রতিনিধি, যিনি চেষ্টা করেছিলেন সুর সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং এক স্বাধীন, অ-মুঘল ভারত গঠনের।
কিন্তু ভাগ্য, রাজনীতি ও ধর্মের মিশেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। আকবরের বিজয়ের মাধ্যমে শুধু মুঘলরা নয়, বরং মধ্য এশিয়া থেকে আসা এক সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক-সামরিক সংস্কৃতি আবার প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় উপমহাদেশে। সেই সংস্কৃতি শুধু প্রশাসন নয়, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যে গভীর ছাপ ফেলে দেয়।
আকবর তাঁর দীর্ঘ শাসনকালে শুধু এক সাম্রাজ্য বিস্তারকারী ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক সংস্কৃতি নির্মাতা। দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-র লেখক ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেন, এর বাংলা অনুবাদ, “পানিপথের বিজয়ের মাধ্যমে আকবর শুধু রাজনৈতিক কর্তৃত্বই প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং উপমহাদেশে এক সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ভিত্তিও স্থাপন করেছিলেন।”
এই নবজাগরণ ছিল বহুমুখী। হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থান, সুফিবাদ ও ভক্তি আন্দোলনের সমন্বয়, তীর্থযাত্রা কর, গো হত্যা নিষেধাজ্ঞা কিংবা মসজিদ-মন্দির নির্মাণে সমান উৎসাহ—এই সবকিছুর মধ্যেই আকবরের সাম্রাজ্যবাদী বুদ্ধিমত্তা ও বাস্তবতাবাদ কাজ করেছিল।
অন্যদিকে, হেমুর পরাজয় শুধু একটি ব্যক্তির পতন নয়, বরং বিকল্প ইতিহাসের একটি সম্ভাব্য পথের অকালবিলুপ্তি। যদি হেমু বিজয়ী হতেন, তবে কি ভারতের ইতিহাস ভিন্ন হতো? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে না। কিন্তু এটুকু বলা যায়, ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে এক পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্রাট হওয়া—তা মধ্যযুগীয় ভারতেই হোক বা আধুনিক কালেই—এ এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত।
ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার বলেন—“যদি হেমু সফল হতেন, তবে হয়তো ভারত এক ভিন্নধর্মী সংহতির অভিজ্ঞতা পেত—যেটি হতো আরও আঞ্চলিক এবং দেশজ ভিত্তির।”
এখানেই উঠে আসে ‘স্মৃতির রাজনীতি’র প্রসঙ্গ। ব্রিটিশ শাসনামলে আকবরকে দেখানো হয় ‘আদর্শ ভারতীয় রাজা’ হিসেবে—যে রাজতন্ত্র সংহতির প্রতীক, যা ব্রিটিশরা নিজেরা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অন্যদিকে হেমু, যিনি ‘স্বদেশি পরিপ্রেক্ষিত’-এর প্রতিনিধি, ধীরে ধীরে হারিয়ে যান সরকারি ইতিহাসচর্চা থেকে।
এমনকি আধুনিক ভারতের ইতিহাসপাঠ্যক্রমেও পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব প্রায়শই আকবরের রাজ্য পুনরুদ্ধারের সফলতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, হেমুর ভূমিকাকে প্রায় উপেক্ষা করেই। অথচ সমসাময়িক জাতীয়তাবাদী আবেগ, বিশেষ করে উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলগুলিতে, হেমুকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। বিহার ও হরিয়ানায় অনেক জায়গায় তাঁর নামে মূর্তি, রাস্তা ও স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্তরে তিনি এখনো ‘অপ্রয়োজনীয়’ ইতিহাসের একটি পরিচ্ছন্ন পাতা।
আজকের ভারতীয় সমাজে যখন ইতিহাসের পাঠ রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে, তখন পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ এক গভীর প্রাসঙ্গিকতা ধারণ করে। এটি মনে করিয়ে দেয়—ইতিহাস কেবল তারিখ ও তথ্য নয়, এটি দৃষ্টিভঙ্গির এক শক্তিশালী খেলা। কে বিজয়ী, কে পরাজিত, কে নায়ক, কে ভিলেন—তা নির্ধারিত হয় কেবল যুদ্ধের ফলাফলে নয়, বরং কে সেই ইতিহাস লিখেছে তার উপরও।
বিশিষ্ট লেখক রামচন্দ্র গুহ-র বলেছেন,“ইতিহাস শুধু অতীতের কথা নয়, এটি ভবিষ্যতের কথা কথাও বলে, যে ভবিষ্যৎ আমরা কল্পনা করতে চাই।”
পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ তাই আজও আমাদের সামনে একটি আয়নার মতো দাঁড়িয়ে থাকে—যেখানে আমরা নিজের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় খুঁজি, হারানো ইতিহাসের ছায়ায় বর্তমানকে ব্যাখ্যা করি, আর ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হই।
আগের তিন পর্ব:
১. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ১
২. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ২
৩. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ৩
গাজায় উদ্ধার প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনেক ভুক্তভোগী এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন অথবা রাস্তায় পড়ে আছেন তবে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ এবং সরঞ্জামের অভাবে জরুরি দল তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।
১১ ঘণ্টা আগেএ বৈঠকের দিন-তারিখ নিয়ে অবশ্য কোনো তরহ্য মেলেনি। নির্ধারণ হয়নি বৈঠকের স্থানও। তবে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিশ মের্ৎস আভাস দিয়েছেন, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ত্রিপাক্ষিক বৈঠকটি হতে পারে।
১২ ঘণ্টা আগেবৈঠকের আগে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধে অনেক অগ্রগতি হচ্ছে। এ সময় জেলেনস্কি বলেন, কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনায় ইউক্রেনের সমর্থন আছে।
২১ ঘণ্টা আগেইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।
১ দিন আগে