রাজনীতি

ইরান যেভাবে কর্মসূচির শুরু করে

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১৩: ২৮

বিশ্ব রাজনীতির আলোচিত এক নাম—ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। এই কর্মসূচি ঘিরে গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তেজনা, সন্দেহ, কূটনীতি ও অবরোধ একসূত্রে গাঁথা হয়ে উঠেছে। কেউ বলছে, এটি ইরানের নিরাপত্তার গ্যারান্টি, কেউ বলছে, এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের কারণ হতে পারে। কিন্তু ইরাণ ঠিক কীভাবে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করল? এর পেছনে কী উদ্দেশ্য? এবং বিশ্ব কেন এতটা উদ্বিগ্ন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় ৭০ বছর আগের এক ইতিহাসে।

ইরাণের পারমাণবিক কর্মসূচির গোড়া পত্তন হয় ১৯৫০-এর দশকে। তখন দেশটির শাসন ক্ষমতায় ছিলেন মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, ইরাণের শাহ। সে সময় ইরাণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র। পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার তখনও বিশ্বে অনেকটাই নতুন, এবং মূলত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছিল। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকা ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করে।

১৯৫৭ সালে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির আওতায় একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, যেমন—বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা ও কৃষিতে এর প্রয়োগ। এরপর ১৯৬৭ সালে আমেরিকা ইরাণকে ৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গবেষণাগার রিঅ্যাক্টর (নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর) সরবরাহ করে, যেটা স্থাপন করা হয় তেহরানের কাছে। এই সময় থেকে ইরাণ পরমাণু বিজ্ঞানে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে শুরু করে।

১৯৭০ সালে ইরাণ স্বাক্ষর করে ‘নন-প্রলিফারেশন ট্রিটি’ , অর্থাৎ ‘পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি’। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইরাণ পারমাণবিক শক্তিকে শুধু শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করতে পারবে, এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শন সংস্থা ‘আইএইএ’ —অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা—এর নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। তখন অনেকেই ধারণা করেছিল, ইরাণের কর্মসূচি নির্ভরযোগ্য ও নিয়ন্ত্রিতভাবে এগোচ্ছে।

কিন্তু ১৯৭৯ সালে ঘটে গেল এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন। ইরাণে ইসলামিক বিপ্লব ঘটে, শাহকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইন নেতৃত্বাধীন ইসলামী প্রজাতন্ত্র। নতুন এই সরকার পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি চরম বিরোধিতা প্রকাশ করে, বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে তলানিতে পৌঁছে যায়। ফলস্বরূপ, ইরাণের পারমাণবিক কর্মসূচিও থমকে যায় কিছু সময়ের জন্য।

তবে ১৯৯০-এর দশকে এসে, বিশেষ করে ইরাক-ইরাণ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, ইরাণ আবারো পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা রাশিয়ার সঙ্গে বোশেহর অঞ্চলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করে। যদিও এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য বলা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন, কিন্তু গোপনে ইরাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মতো স্পর্শকাতর গবেষণাও চালাতে থাকে।

২০০২ সালে এক বড় ধরনের মোড় নেয় ইরানের পারমাণবিক ইতিহাস। একটি ইরাণি বিরোধী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে আনে যে, ইরাণ নাতানজ ও আরাক এলাকায় গোপনে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র তৈরি করছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক পরিদর্শক দল পাঠানো হয়, তদন্ত শুরু করে আইএইএ। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, ইরাণ শুধুই শান্তিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নয়, বরং এমন প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে, যেটি ভবিষ্যতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথ খুলে দিতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে ইরান বারবার দাবি করতে থাকে, তাদের কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ এবং বৈধ। তেহরান সরকারের ভাষায়, “পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের জ্বালানির ভবিষ্যৎ নেই, এবং এটি আমাদের সার্বভৌম অধিকারের অংশ।”

তবে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখেন। মার্কিন পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ ওবামা প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের পরমাণু বিষয়ক সমন্বয়কারী ড. গ্যারি সেমোর, বলেন—
“ইরানের গোপন কার্যক্রম ও সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ দেখে স্পষ্ট হয় যে তারা একটি ‘ব্রেকআউট’ অপশন খোলা রাখছে—অর্থাৎ প্রয়োজনে অল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্র বানানো সম্ভব হবে এমন একটি অবস্থা তৈরি করা।”

এই অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—ইরাণের ওপর নানা ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাধা ইরাণের অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে।

২০১৫ সালে দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক আলোচনার পর স্বাক্ষরিত হয় এক ঐতিহাসিক চুক্তি—‘জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ , যেটি সাধারণভাবে ‘ইরান পারমাণবিক চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী, ইরান পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখবে, ইউরেনিয়ামের মাত্রা নির্দিষ্ট পর্যায়ের নিচে রাখবে, এবং আইএইএ-কে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দেবে। এর বিনিময়ে পশ্চিমা দেশগুলো ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে।

তবে ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ করে এই চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন। তিনি এই চুক্তিকে “সবচেয়ে বাজে চুক্তি” বলে অভিহিত করেন এবং পুনরায় ইরাণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে চুক্তিটি কার্যত ভেঙে পড়ে, এবং ইরান আবার ধীরে ধীরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়াতে শুরু করে।

কেন ইরান এত আগ্রহী একটি পরমাণু কর্মসূচিতে? আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ড. এলিনা স্লটম্যান বলেন—
“ইরান মনে করে, পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন মানেই পশ্চিমা চাপের বিরুদ্ধে একটি শক্তপোক্ত ঢাল। তারা উত্তর কোরিয়ার উদাহরণ দেখে বুঝেছে, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে কেউ আক্রমণ করতে সাহস পায় না।”

তবে এখানেই মূল দ্বন্দ্ব। কারণ একবার একটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে ফেললে, তা আর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর ইরান যদি অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে সৌদি আরব, তুরস্ক বা মিসরও একই পথ ধরতে পারে—ফলে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠতে পারে এক ভয়ঙ্কর ‘পারমাণবিক সংঘর্ষের সম্ভাব্য মাঠ’।

এমন প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের উদ্বেগও অমূলক নয়। কারণ ইরাণ বহুবার প্রকাশ্যে বলেছে—ইসরায়েল একটি ‘অবৈধ রাষ্ট্র’। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ দাবি করেছে, ইরান এখনও গোপনে অস্ত্র তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে—“আমরা কোনো দিনও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করিনি, করবো না।”

তবে বাস্তবতা হলো, ইরান এখন এমন এক প্রযুক্তিগত অবস্থানে পৌঁছে গেছে, যেখানে চাইলেই খুব অল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক বোমা বানানো সম্ভব।

এই পরিস্থিতিকে ঘিরে আবার শুরু হয়েছে কূটনৈতিক আলোচনা। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও রাশিয়া চেষ্টা করছে নতুন করে চুক্তি করার। কিন্তু বর্তমানে এই আলোচনার অগ্রগতি খুবই ধীর, কারণ একদিকে ইরাণের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃশ্যপট, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির জটিলতা।

ড. হ্যান্স ক্রিস্টেনসেন, স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক বলেন—
“পারমাণবিক অস্ত্রের ছায়া যত ছড়াবে, শান্তির সম্ভাবনা ততই ম্লান হবে। ইরানের ক্ষেত্রে এটি শুধু একটি দেশের সিদ্ধান্ত নয়, এটি গোটা অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে।”

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ইতিহাস আসলে একটি দীর্ঘ নাটকের মতো—যার মঞ্চ বিশ্বরাজনীতি, চরিত্রগুলো পরিবর্তনশীল, আর পরিণতি এখনও অনিশ্চিত। শান্তিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে সম্ভাব্য অস্ত্র তৈরি পর্যন্ত এই যাত্রা কেবল ইরানের নয়, এটি গোটা বিশ্বের সামনে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নৈতিকতা, নিয়ন্ত্রণ এবং ভবিষ্যতের প্রশ্নও তুলে ধরে। সেই প্রশ্নের জবাব এখনো অজানা, তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়—ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ইস্যুগুলোর একটি।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর তালিকায় নেই বিল গেটসের নাম

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সফটওয়্যার কোম্পানি মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক শীর্ষ নির্বাহী বিল গেটস আর বিশ্বের শীর্ষ ১০ ধনীর তালিকায় নেই। তার মোট সম্পদ পুনঃগণনার পর সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ।

১ দিন আগে

ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনয়নের সুপারিশ নেতানিয়াহুর

হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক নৈশভোজ অনুষ্ঠানে অংশ নেন নেতানিয়াহু। অনুষ্ঠানের শুরুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় নেতানিয়াহু বলেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে এমন দেশগুলোকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, যারা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে আগ্রহী।

১ দিন আগে

প্রবাসীদের ভোটাধিকার বিষয়ে সিডনিতে এনসিপি অস্ট্রেলিয়ার আলোচনা সভা

সভায় বক্তারা মানবাধিকার এবং আইনী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবাসী ভোটাধিকারের বিষয়টি পর্যালোচনার পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নিয়ম ও চর্চার কথা উল্লেখ করেন। মুক্ত আলোচনা এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রবাসীদের ভোট বাস্তবায়নের জন্য একটি পরিস্কার রোডম্যাপের দাবী জানানো হয়।

২ দিন আগে

বিশ্বমঞ্চে ব্রিকসের আবির্ভাব হয় যেভাবে

তবে এই ধারণা গবেষণাগারে থেমে থাকেনি। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে ব্রিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একত্রিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সূচনা করেন।

২ দিন আগে