বিনয়-বাদল-দীনেশ— অগ্নিযুগের ৩ বিপ্লবী

স ম গোলাম কিবরিয়া
অগ্নিযুগের ৩ বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ। ডানে তাদের ভাস্কর্য রাইটার্স ভবনের সামনে, বাঁয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তিন বিপ্লবীর মুখচিত্র।

ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা। রাজধানীর প্রশাসনিক কেন্দ্র ডালহৌসি স্কোয়ারে রাইটার্স বিল্ডিং। ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০। অন্যান্য দিনের মতোই কাজ শুরু হয়েছে ঠিক সময়েই। ব্রিটিশ কর্মকর্তা, কাজের জন্য আসা লোকজন, বাঙালি বাবু, কেরানি— সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ কাজে। প্রতিদিনের মতোই লোকসমাগমে গমগম করছে রাইটার্স বিল্ডিং।

এই ভবনের আরেক নাম মহাকরণ। সেখানকার একটি কামরায় বসে নিজের কাজকর্ম পরিচালনা করছেন জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন এস সিম্পসন। পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞানগুহ।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ১২টা। বিলাতি পোশাক পরিহিত তিনজন বাঙালি যুবক কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে দেখা করতে চান। কামরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জ্ঞানগুহকে ঠেলে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লেন তারা। মুখ তুলে চাইলেন কর্নেল। এরপর যা তিনি দেখলেন, তার জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলেন না।

জেলখানার বন্দিদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন কর্নেল সিম্পসন। আগত তিন যুবকই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবী। তারা এসেছেন সিম্পসনকে হত্যার মাধ্যমে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আক্রমণ করে অফিসপাড়ায় ত্রাস সৃষ্টি করতে।

সিম্পসন দেখলেন, তিনজনই তার দিকে রিভলবার তাক করে আছে। তাদের মধ্যে একজন ইংরেজিতে বললেন, ‘Pray to God, Colonel. Your last hour has come!’ এই যুবকের নাম বিনয়। তার সম্পর্কে পরে বিস্তারিত বলা যাবে। বিনয়ের কথার মর্মার্থ বোঝার জন্য তো কিছুটা সময় প্রয়োজন!

কিন্তু না, তিন যুবকের হাতে মোটেও সময় নেই। বেচারা সিম্পসন! আজীবন নিরীহ-নিরপরাধ ভারতীয়দের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এসেছেন। এ জন্য কতকিছু চিন্তা করে নির্যাতনের উপায় বের করতে হয়েছে। সেই মানুষটি নিজের শেষ সময়ে বিন্দুমাত্র ভাবনার সময়ও পেলেন না। তার দিকে তাক করা তিনটি রিভলবার থেকে ছয়টি বুলেট সিম্পসনের শরীর ভেদ করে বের হয়ে গেল।

বিস্ফারিত চোখের নিথর দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন কর্নেল। সারা ভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। যে যেমন পারছেন, পালিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। এরপর শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ, যা ‘অলিন্দের যুদ্ধ’ নামে ইতিহাসে লেখা।

রাইটার্স ভবন ও আশপাশের এলাকা, তিন বিপ্লবীর নামে যে এলাকাটি ‘বিবাদী-বাগ’ নামে পরিচিত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
রাইটার্স ভবন ও আশপাশের এলাকা, তিন বিপ্লবীর নামে যে এলাকাটি ‘বিবাদী-বাগ’ নামে পরিচিত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

অলিন্দ যুদ্ধ

কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া তিন যুবকের নাম বাদল, বিনয় ও দীনেশ। তিনজন বিপ্লবীই মাতৃভূমিকে ব্রিটিশ শোষকদের হাত থেকে মুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ব্রিটিশ প্রভুত্ব মানতে রাজি নন। তাই বেছে নেন বিপ্লবের পথ। সিদ্ধান্ত নেন— ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে হবে। তিন যুবকের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে সংক্ষেপে তাদের বলা হয় ‘বিবাদ’।

এ অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য তাদের পূরণ হয়ে গেছে। এবার কেটে পড়ার পালা। কেটে পড়া যে সহজ হবে না, সেটা জেনেই তারা অভিযানে এসেছেন। গুলির শব্দে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে এল পুলিশ বাহিনী। বিল্ডিংয়ের অলিন্দে, অর্থাৎ বারান্দায় শুরু হলো যুদ্ধ।

একদিকে মাত্র তিনজন তরুণ, অন্যদিকে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট ও ডেপুটি কমিশনার গার্ডনের নেতৃত্বে রাইফেলধারী প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধ ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এটা নিছক কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা নয়। খোদ ব্রিটিশ পত্রিকা স্টেটসম্যান এই যুদ্ধের নাম দিয়েছে ‘Veranda Battle’।

বুকে যাদের মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, মনের গহীনে যাদের জমে আছে ব্রিটিশ শোষকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা— তারা কি আর পরাভব মানেন? অমিত তেজ আর স্পর্ধিত সাহস নিয়ে পুরো একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিন বিপ্লবী। সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যান তারা।

যুদ্ধে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার টোয়াইনাম, প্রেন্টিস ও জুডিশিয়াল সেক্রেটারি নেলসনসহ অনেকেই আহত হন। উপায় না দেখে ব্রিটিশরা তলব করে গুর্খা বাহিনী। পুরো ভবন পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে।

একপর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন দীনেশ। আহত অবস্থাতেও পালটা গুলিবর্ষণ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তিন তরুণের কাছে বুলেটের সংখ্যা সীমিত। কিছুক্ষণ পর তা ফুরিয়ে যাবে। অথচ ওপর প্রান্ত থেকে অনবরত গুলি চালিয়ে যাচ্ছে গুর্খা বাহিনী। অবশেষে একটি শূন্য কামরায় প্রবেশ করলেন তিন তরুণ।

টেগার্টের পুলিশ বাহিনী পুরো ভবন ঘিরে রাখায় প্রাণ নিয়ে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই বলে আত্মসমর্পণের কোনো প্রশ্নই আসে না, এমনকি ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়াও যাবে না।

বাদলের পকেটে ছিল পটাশিয়াম সায়ানাইড। পুরো সায়ানাইড গিলে ফেললেন তিনি। দ্রুতই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। কিন্তু বিনয় ও দীনেশ কী করবেন? তাদের রিভলবারে আছে শেষ দুটি বুলেট। পুলিশের হাতে ধরা পড়া থেকে রক্ষা পেতে দুজনই নিজের মাথায় চালিয়ে দিলেন গুলি। কিন্তু এত সহজে ধরা দিল না কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। গুরুতর আহত হলেন দুজনই।

বিনয় ও দীনেশকে গ্রেপ্তার করে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখনো জ্ঞান ছিল বিনয়ের। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পথেই নানা তথ্য জানতে চায় সিআইডি কর্মকর্তা। বিনয়কে প্রশ্ন করা হয়, এতদিন সে কোথায় ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড় করল কোথা থেকে— ইত্যাদি।

এসবের উত্তরে বিনয় শুধু একটি কথাই বললেন, ‘I have saved your 5,000 rupees and what more you expect from me?’ অর্থাৎ, আমি তোমাদের পাঁচ হাজার রুপি বাঁচিয়ে দিলাম, এর চেয়ে বেশি আর কীই বা চাইতে পারো আমার কাছ থেকে?

অগ্নিযুগের তিন বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ। ছবি: সংগৃহীত
অগ্নিযুগের তিন বিপ্লবী বিনয়, বাদল ও দীনেশ। ছবি: সংগৃহীত

এর আগে ঢাকায় পুলিশ পরিদর্শক লোম্যানকে হত্যা করেছিলেন বিনয়। গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছিল। কিন্তু কোনোভাবেই ধরতে পারছিল না। তাই বিনয়কে ধরিয়ে দিতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেয় ব্রিটিশ সরকার। কারও কারও মতে পুরস্কারের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার টাকা।

অত্যাধুনিক চিকিৎসা শুরু হলো বিনয় ও দীনেশের। কারণ ব্রিটিশরা এত সহজে শত্রুকে শেষ করে দিতে চায় না। চূড়ান্ত যন্ত্রণা দিয়ে শত্রুনিধনই তাদের পছন্দ। বিপ্লবীদের মনোবল ভেঙে দিতেই গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়, যেন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার সাহস হারিয়ে ফেলে। তাই ডাক্তার-নার্সরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকেন দুই বিপ্লবীকে সুস্থ করে তুলতে।

মেডিকেলের ছাত্র বিনয়ের ভালোই দখল ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রে। পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে সবার অলক্ষ্যে নিজের ক্ষতস্থানে আঙুল চালাতে চালাতে ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত করে ফেলেন নিজেকে। ফলে চিকিৎসকদের পক্ষেও আর তার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ১৯৩০ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি আলিঙ্গন করেন মৃত্যুকে।

কিন্তু দীনেশের এ বিষয়ে জানা ছিল না। তিনি ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। মেডিকেল ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কনডেম সেলে। শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন ও বিচারকাজ। দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুর আগে তার সৌভাগ্য হয়েছিল জেলবন্দি অবস্থায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চরণ স্পর্শ করার।

বিনয়-বাদল-দীনেশ: তাদের পরিচয়

বিনয়, বাদল ও দীনেশ— তিন বিপ্লবীরই জন্মভূমি তৎকালীন বিক্রমপুর জেলা, অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলা। তিনজনই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য ছিলেন। দেশের প্রতি যেমন তাদের ছিল প্রগাঢ় ভালোবাসা, তেমনই দলের প্রতিও তারা ছিলেন অনুগত।

বিনয়ের জন্ম ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মুন্সীগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে। পুরো নাম বিনয় কৃষ্ণ বসু। পিতা রেবতীমোহন বসু ছিলেন প্রকৌশলী। বিনয়ের ইচ্ছা ছিল চিকিৎসক হওয়ার। এ জন্য ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি ভর্তি হন মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে, যা বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ।

এ সময়ই তিনি সংস্পর্শে আসেন ঢাকাকেন্দ্রিক বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের। এরপর যুক্ত হন যুগান্তর পার্টির সঙ্গে। ১৯২৮ সালে যোগ দেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ঢাকা শাখা গড়ে তোলেন।

এদিকে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মাস্টারদা আত্মগোপনে চলে যান। তাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে। গ্রেপ্তার করতে না পেরে সাধারণ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে ব্রিটিশরা। ফলে বাংলার সাধারণ মানুষ ব্রিটিশদের প্রতি অতীষ্ঠ হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে রাজবন্দিদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের ঘটনা সবার মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। এর জবাব দিতে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ছিলেন এফ জে লোম্যান এবং ঢাকার সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ ছিলেন ই হাডসন।

১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত গভর্নর হিউ স্টিফেনসনের স্ত্রী মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল ও হাসপাতাল পরিদর্শনে আসবেন— এ উপলক্ষ্যে ওই দিন সকালে হাসপাতালের প্রস্তুতি তদারক করতে যান লোম্যান ও হাডসন। তাদের হত্যা করতে বিনয় বসুর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আগে থেকেই রোগী সেজে হাসপাতালে অবস্থান নেন।

প্রস্তুতি পরিদর্শন শেষে লোম্যান ও হাডসন হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার উপক্রম করতেই বিনয়ের অব্যর্থ নিশানায় গুলিবিদ্ধ হন লোম্যান ও হাডসন। দুজনই গুরুতরভাবে আহত হন। অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিনয় হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান। লোম্যানের চিকিৎসার জন্য কলকাতা থেকে বিমানযোগে চিকিৎসক দল আসে। কিন্তু তাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। দুদিন পর লোম্যান মারা যান, হাডসন আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান।

এ ঘটনার পর ঢাকায় সর্বত্র পুলিশের অমানবিক অত্যাচার শুরু হয়। পুলিশ হন্যে হয়ে বিনয়কে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোনোভাবেই বিনয়কে ধরতে পারে না। সারা বাংলায় বিনয়ের ছবিযুক্ত পোস্টার লাগানো হয়। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার, মতান্তরে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও বিনয়কে পাওয়া যায় না।

প্রকৃতপক্ষে পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বিনয় তখন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের অ্যাকশন স্কোয়াডের প্রধান সুপতি রায়ের সাহায্যে পালিয়ে যান কলকাতায়। নানা ছদ্মবেশে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিনয় সেখানে চলাফেরা করতে থাকেন।

কলকাতায় পালিয়ে যেতে বিনয় বেশ নাটকীয়তার আশ্রয় নেন। আগস্ট মাস, বাংলাদেশে তখন বর্ষাকাল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথের মধ্যবর্তী স্টেশন দোলাইগঞ্জ। বর্ষায় জমে থাকা হাঁটু পানির মধ্য দিয়ে সকালে ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে দুজন দিনমজুর হেঁটে চলেছেন রেলস্টেশনের দিকে।

ওদিকে পুলিশের সতর্ক পাহারা। ট্রেনের প্রত্যেক কামরা তন্নতন্ন করে তল্লাশি করছে পুলিশ। দিনমজুর দুজন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠে পড়লেন তৃতীয় শ্রেণির কামরায়। বিনয় ভালোভাবেই জানতেন, নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে পুলিশের পাহারা থাকবে। সিগন্যালের কাছে ট্রেনের গতি কমাতেই সঙ্গীকে নিয়ে নেমে পড়লেন বিনয়। এরপর স্টিমারে করে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ যাবেন।

স্টিমারে জমিদারের চাপরাশি হলেন বিনয়। সঙ্গী জমিদার ছিলেন আরেক বিপ্লবী সুপতি রায়। কলকাতা পৌঁছে কেন্দ্রীয় স্টেশন শিয়ালদহের আগেই দমদমে নেমে পড়লেন। ঠাঁই হলো মধ্য কলকাতার ৭ নম্বর ওয়ালিউল্লাহ লেনের বস্তিতে।

বেশিদিন এক জায়গায় থাকা নিরাপদ নয়। পুলিশ বিনয়ের পিছু লেগে আছে। আস্তানা বদল করলেন। চলে গেলেন কাত্রাসগড় কয়লাক্ষেত্রে। অল্প কিছুদিন পর সেখান থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ উত্তর কলকাতার এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন তিনি।

কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে সেখানেও হানা দেয় পুলিশ। আগেভাগে আঁচ করতে পেরে দ্রুতই সটকে পড়েন বিনয়। কলকাতায় থাকতেই নেতাজি সুভাষ বসু ও স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায় দেশত্যাগের জন্য বিনয়কে পরামর্শ দেন। স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্ত্রী বিনয়ের বিদেশ যাওয়ার সব খরচ বহন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিনয় সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার কাছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ছিল তুচ্ছ। কলকাতায় বিনয় তখন পরবর্তী অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

বাদলের জন্মনাম সুধীর গুপ্ত। ১৯১২ সালে বিক্রমপুরের, অর্থাৎ মুন্সীগঞ্জ জেলার পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বিক্রমপুরের বানারিপাড়া স্কুলে পড়ালেখার সময় শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের মাধ্যমে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন। একপর্যায়ে তিনিও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে।

বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের জন্ম ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার যশোলঙে। পিতা সতীশচন্দ্র গুপ্ত, মাতা বিনোদিনী দেবী। দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান।

পিতা সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। চাকরিসূত্রে তিনি কিছুকাল গৌরীপুরে অবস্থান করেন। গৌরীপুরের পাঠশালাতেই দীনেশের শিক্ষাজীবন শুরু। পরে ৯ বছর বয়সে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে।

কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা ও অলিন্দ যুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে মহাকরণে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামে স্মৃতিফলক। ছবি: সংগৃহীত
কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা ও অলিন্দ যুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে মহাকরণে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামে স্মৃতিফলক। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম দিকে দীনেশ ঢাকার গেন্ডারিয়ায় দাদুর বাড়িতে থাকতেন। পরে ওয়ারীতে পৈতৃক বাসভবনে চলে আসেন। বাল্যকাল থেকেই দীনেশ ছিলেন নির্ভীক, বেপরোয়া ও বাগ্মী। তখন থেকেই তিনি স্বদেশপ্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।

১৯২৬ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন দীনেশ। এরপর তিনি মেদিনীপুরে কর্মরত বড় দাদা যতীশচন্দ্র গুপ্তের কাছে বেড়াতে যান। এ সময়ে মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার আগ্রহ জন্মে তার। কিন্তু দলের নির্দেশে তাকে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়।

১৯২৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হতে পারেননি দীনেশ। এরপর তিনি মেদিনীপুরে গিয়ে পড়ালেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। দলের তরফ থেকে দীনেশকে মেদিনীপুরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের শাখা স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেদিনীপুরে গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি দল সংগঠন ও সদস্য সংগ্রহের কাজ করতে থাকেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে নেতাজি সুভাষ বসুর গড়া বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে যোগ দেন। স্থানীয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শেখানোর জন্য দীনেশ কিছুদিন মেদিনীপুরেও ছিলেন।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের জন্ম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে। কংগ্রেসের কলকাতা সম্মেলন সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের অধিবেশন কলকাতার লেক সার্কাসে অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশন সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করতে ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব পান সুভাষ। তিনি যুবকদের সংগঠিত করে বিশাল এক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন, বাহিনীকে সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ দেন এবং অশ্বারোহী দলও গঠন করেন। বাহিনীর জন্য পৃথক পোশাকেরও ব্যবস্থা করেন সুভাষ।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অনুপ্রেরণায় সুভাষ বসুর গঠন করা এ বাহিনীই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ছিলেন নেতাজি নিজেই। অধিবেশনের দিন মতিলাল নেহরু, গান্ধীজিসহ সব নেতাদের সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে ঘোড়সওয়ার দলের পাহারায় অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে শেষ হয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশন।

সুভাষের এই ব্যবস্থাপনা অবশ্য গান্ধীজীর পছন্দ ছিল না। তাই তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, লেক সার্কাসে সুভাষ নতুন সার্কাস দেখাল! পরে সুভাষ এ সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেন মেজর সত্য গুপ্তের কাঁধে।

কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সকে আরও সংগঠিত করে তোলার তোড়জোড় শুরু করা হয়। সত্য গুপ্ত সারাবাংলা ঘুরে ঘুরে তেজোদ্দীপ্ত, উদ্যমী ও দেশপ্রেমিক তরুণদের সংগঠনে নিয়ে আসেন। সেই সূত্র ধরেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন বিনয়, বাদল ও দীনেশ।

সংগঠনটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত হয়। স্বাধীনতার প্রশ্ন এলেই অকুতোভয় ত্রয়ী— বিনয়, বাদল, দীনেশের নাম বারবার আসে বাঙালির মুখে।

Feature-Writer-S-M-Golam-Kibria-03-12-2025

তথ্যসূত্র

  • স্বাধীনতা যুদ্ধে অচেনা লালবাজার — সুপ্রতিম সরকার
  • আমি সুভাষ বলছি
  • বাংলাপিডিয়া, এশিয়াটিক সোসাইটি

লেখক: চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক

ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

বিজয়ের মাসে ৩১টি যাত্রাপালা দেখাবে শিল্পকলা একাডেমি

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসব পরিণত হয়েছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির এক অনন্য মিলনমেলায়।

৩ দিন আগে

‘পাকিস্তান আজ মৃত’— এক ভেটো ও আকাশজয়ের আখ্যান

পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কামাল ও তার সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশনের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।

৩ দিন আগে

অবরোধের নিখুঁত কৌশলে পতন ‘দুর্ভেদ্য দুর্গে’র, মুক্ত ঢাকার প্রবেশদ্বার

কামালপুর কেবল একটি বিওপি বা বর্ডার আউটপোস্ট ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের প্রতীক এবং ঢাকা বিজয়ের চাবিকাঠি। এ যুদ্ধের কাহিনি কোনো সাধারণ যুদ্ধের বিবরণ নয়; বারুদ, কাদা, রক্ত ও মানুষের অকল্পনীয় জেদের এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।

৪ দিন আগে

কী কী সুবিধা আছে কাতার আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে

সব প্রস্তুতি শেষ হলে আজ মধ্যরাত অথবা শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালের মধ্যে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

৪ দিন আগে