ডিসেম্বরের দিনলিপি: ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১

মেঘনা পাড়ে মৃত্যুফাঁদ— রাও ফরমান আলীর পালানোর আকুতি

নাজমুল ইসলাম হৃদয়
পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া ট্যাংক। ছবি: সংগৃহীত

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। এ দিন পূর্ব পাকিস্তানের রণচিত্র এক নাটকীয় মোড় নেয়। এতদিন পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশলের ওপর যে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছিলেন, ৮ ডিসেম্বরে তা ধুলিসাৎ হয়ে যায়।

এ দিন রণাঙ্গনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী আর কোনো সংঘবদ্ধ সামরিক শক্তি ছিল না, তারা পরিণত হয়েছিল এক পলাতক জনস্রোতে। একদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার মতো শক্তিশালী ঘাঁটির পতন, অন্যদিকে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আকাশ থেকে নেমে আসা সাক্ষাৎ যমদূত— সব মিলিয়ে ৮ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী ও সিদ্ধান্তমূলক দিন।

তবে এ দিনের সবচেয়ে বড় ‘নাটক’ মঞ্চস্থ হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং ঢাকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে এবং নিউইয়র্কের জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। খোদ পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী রাওয়ালপিন্ডির অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, ‘খেলা শেষ’।

বিনা বাধায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজয়

৮ ডিসেম্বর ভোরের আলো ফোটার আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ডুবে ছিল। এটি ছিল ঢাকা, কুমিল্লা ও সিলেটের সংযোগকারী এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘কৌশলগত নোড’। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তার ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে এ বিজয়ের এক রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।

পাকিস্তানি ২৭ ব্রিগেডের ওপর দায়িত্ব ছিল এই শহর রক্ষা করার। কিন্তু মিত্রবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন ও শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ‘এস ফোর্সে’র ক্ষিপ্রগতি ও কৌশল দেখে পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে।

মিত্রবাহিনী আখাউড়া জয়ের পর সোজা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের দিকে না এসে একটি ‘ফ্ল্যাংকিং মুভমেন্ট’ বা পাশ কাটানো কৌশল নেয়। ১১শ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানিরা ধারণা করে, তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। পাকিস্তানি ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কাজি আব্দুল মজিদ খান বুঝতে পারেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান করলে তার সম্পূর্ণ বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

ফলে ৭ ডিসেম্বর রাত থেকেই তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাতে শুরু করে। পালানোর সময় তারা তাদের নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর রেখে যায়, শহরের ব্যাংকগুলো লুট করা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে মেজর শফিউল্লাহ ও তার বাহিনী যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করেন, তখন শহরটি ছিল প্রায় জনশূন্য। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘শহরে ঢুকে আমরা কোনো পাকিস্তানি সেনাকে খুঁজে পেলাম না। তারা ভোরের আগেই আশুগঞ্জের দিকে পালিয়েছে।’

তবে পালানোর আগে পাকিস্তানি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর তিতাস নদীর ওপর অবস্থিত বিশাল রেলসেতুটির দুটি স্প্যান ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মিত্রবাহিনীর ভারী কামান ও ট্যাংকগুলোর গতিরোধ করা। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ বেশিক্ষণ মিত্রবাহিনীকে আটকে রাখতে পারেনি।

স্থানীয় জনতা, যারা এতদিন প্রাণের ভয়ে গ্রাম ও চরাঞ্চলে লুকিয়ে ছিল, তারা মুক্তিুবাহিনীকে শহরে ঢুকতে দেখে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাস্তায় নেমে আসে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয় তিতাসের পার। এ দিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুরোনো কাচারি ভবনে ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা।

কুমিল্লার মুক্তি: ময়নামতির দুর্গভেদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতনের প্রায় কাছাকাছি সময়েই কুমিল্লায় ঘটে আরেক ইতিহাস। কুমিল্লা ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অন্যতম শক্ত ঘাঁটি বা ‘গ্যারিসন টাউন’। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ভূগর্ভস্থ বাংকারগুলো ছিল দুর্ভেদ্য। কিন্তু ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি ১১৭ ব্রিগেডের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে।

ভারতীয় ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আর ডি হিরা ও মিত্রবাহিনীর কর্মকর্তারা একটি চতুর সিদ্ধান্ত নেন। তারা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট দখল করার জন্য সময় নষ্ট না করে ক্যান্টনমেন্টটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেন বা ‘আইসোলেট’ করে ফেলেন এবং মূল কুমিল্লা শহরের দিকে অগ্রসর হন। ৮ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সেনারা শহর ছেড়ে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আশ্রয় নেয়। ফলে কুমিল্লা শহর সম্পূর্ণ অরক্ষিত ও শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনী বীরদর্পে কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে।

কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার সংবাদে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কিন্তু এই উল্লাসের আড়ালে ছিল গভীর বেদনা। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন স্থানে ও ময়নামতির আশেপাশের বধ্যভূমিগুলোতে পাওয়া যাচ্ছিল অসংখ্য বাঙালির লাশ। পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার আগে বহু বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে গেছে।

তবু ৮ ডিসেম্বর বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়, তখন সেই দৃশ্য ছিল এক নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক। এ বিজয়ের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বা ‘লাইফলাইন’ চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা ঢাকার পতনকে ত্বরান্বিত করে।

চাঁদপুরের ‘মৃত্যুফাঁদ’ ও মেঘনা নদীতে রক্তের স্রোত

৮ ডিসেম্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ ও নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে চাঁদপুরে। এ নদীবন্দর ছিল ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র। পাকিস্তানি ৩৯ অ্যাডহক ডিভিশনের সৈন্য, যারা লাকসাম ও মুদাফফরগঞ্জ থেকে পিছু হটছিল, তারা চাঁদপুরে জড়ো হয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, এখান থেকে স্টিমার, লঞ্চ ও গানবোট যোগে নদীপথে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে সেখানে আত্মরক্ষা করবে। কিন্তু তাদের এই পলায়ন পরিকল্পনা পরিণত হয় এক ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদে।

মেজর জেনারেল ডি কে পালিতের ‘দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন’ ও ভারতীয় বিমান বাহিনীর ‘অপারেশনাল রেকর্ড’ অনুযায়ী, ৮ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ভারতীয় বিমান বাহিনীর সুখোই-৭ ও ন্যাট (Gnat) যুদ্ধবিমানগুলো মেঘনা নদীর ওপর চক্কর দিতে শুরু করে। যখনই পাকিস্তানি সৈন্যবোঝাই স্টিমার, কার্গোশিপ ও লঞ্চগুলো মাঝনদীতে পৌঁছায়, ঠিক তখনই বিমানগুলো তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে পাকিস্তানিদের একটি বড় জাহাজ ‘এমভি গাজী’ সহ একাধিক জলযান রকেট ও কামানের গোলায় ধ্বংস হয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, মেঘনা নদীর পানি সেদিন আক্ষরিক অর্থেই লাল হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নদীতে ডুবে মারা যায় অথবা তীরে ওঠার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। যারা সাঁতরে পাড়ে উঠতে পেরেছিল, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী তাদের পিটিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনার পর পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে নদীপথে পালানোর সাহস চিরতরে হারিয়ে যায়। চাঁদপুর শত্রুমুক্ত হয় এবং মিত্রবাহিনী মেঘনা নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

মৌলভীবাজার ও সিলেটের অবরুদ্ধ দশা

সিলেট রণাঙ্গনে ৮ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য শ্বাসরুদ্ধকর দিন। আগের দিন হেলিকপ্টার অপারেশনের মাধ্যমে সিলেটে সৈন্য নামানোর পর ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়। মৌলভীবাজারের শমশেরনগর বিমানবন্দরটি মিত্রবাহিনীর দখলে আসার পর ৮ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর ছোট বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো অপারেশন চালানো শুরু করে সেখান থেকে।

পাকিস্তানি ২২ বালুচ রেজিমেন্ট ও ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা মৌলভীবাজার ছেড়ে শেরপুর ফেরিঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও তারা আটকা পড়ে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা আগেই ফেরিঘাট অকেজো করে রেখেছিল। সিলেট শহর তখন কার্যত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে, যেখানে পালানোর আর কোনো পথ খোলা নেই।

জেনারেল রাও ফরমান আলীর গোপন চিঠি: পরাজয়ের স্বীকারোক্তি

রণাঙ্গনে যখন এ বিপর্যয়, তখন ঢাকায় চলছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র ও বাঁচার আকুতি। ৮ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) এমন এক ঘটনা ঘটে, যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো ছিল। মঈদুল হাসানের কালজয়ী গ্রন্থ ‘মূলধারা ’৭১’ এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে এই ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।

গভর্নরের উপদেষ্টা ও ইস্টার্ন কমান্ডের অন্যতম নীতিনির্ধারক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী বুঝতে পারেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোনো সাহায্য আসবে না এবং সপ্তম নৌবহ র পৌঁছাতেও অনেক দেরি হবে। তাই তিনি সেনাপ্রধান বা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনুমতি ছাড়াই জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরির কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠান। এ বার্তায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন এবং পাকিস্তানি সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর নিশ্চয়তা চান।

এ বার্তাটি যখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর এবং ওয়াশিংটনে পৌঁছায়, তখন তা গোপন থাকেনি। বার্তাটি লিক হওয়ার পর রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হন। তিনি মনে করেন, এটি তার কর্তৃত্বের ওপর আঘাত। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন এবং জেনারেল নিয়াজিকে কড়া নির্দেশ পাঠান, ‘যুদ্ধ চালিয়ে যাও। কোনো আপস নেই। আমরা আন্তর্জাতিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি।’

রাও ফরমান আলীর এ উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও এটি প্রমাণ করে, ৮ ডিসেম্বরেই ঢাকার শীর্ষ পাকিস্তানি জেনারেলরা মানসিকভাবে পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। তারা কেবল নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর পথ খুঁজছিলেন।

জেনারেল মানেকশের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ: ‘সারেন্ডার অর ডাই’

৮ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ (পরে ফিল্ড মার্শাল) পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এক অভিনব মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বা ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ শুরু করেন। আকাশবাণী কলকাতা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার মানেকশের একটি বার্তা প্রচার করা হয়। জেনারেল মানেকশ তার গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করেন—

‘অফিসার্স অ্যান্ড জওয়ানস অব পাকিস্তান আর্মি ইন ইস্ট পাকিস্তান, তোমরা চারদিক থেকে অবরুদ্ধ। তোমাদের পালানোর সব পথ— আকাশ, জল ও স্থলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তোমাদের বাঁচার কোনো আশা নেই। অনর্থক যুদ্ধ করে প্রাণ দিও না। আত্মসমর্পণ করো। আমি কথা দিচ্ছি, আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তোমাদের সৈনিকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেওয়া হবে। আর যদি তা না করো, তবে তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।’

এ বার্তা ও সঙ্গে লাখ লাখ লিফলেট বিমান থেকে পাকিস্তানি ক্যাম্পগুলোর ওপর ফেলা হয়। এই লিফলেটগুলোতে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পদ্ধতি ও নিরাপদ করিডোরের ম্যাপ এঁকে দেওয়া ছিল। ৮ ডিসেম্বরের এ বার্তা পাকিস্তানি সাধারণ সৈনিকদের মনোবল বা একেবারে ধসিয়ে দেয়। তারা বুঝতে পারে, তাদের সেনাপতিরা তাদের মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে।

ঢাকার রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি: জাহানারা ইমামের দিনলিপি

৮ ডিসেম্বরের ঢাকা ছিল গুজব, আতঙ্ক ও আশার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে এই দিনের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন—

“আজ ৮ ডিসেম্বর। চারদিকে জোর গুজব। যশোরের পর নাকি কুমিল্লা আর ব্রাহ্মণবাড়িয়াও মুক্ত হয়েছে। কিন্তু কনফার্ম করার উপায় নেই। রেডিও পাকিস্তান তো অনবরত মিথ্যে বলে যাচ্ছে। তারা বলছে, ‘আমাদের বীর জওয়ানরা সব ফ্রন্টে দুশমনকে প্রতিহত করছে।’ কিন্তু জানালার কাঁচ থরথর করে কাঁপছে বিমানের বোমার শব্দে। কার্ফু আর সাইরেনের শব্দে কান ঝালাপালা। রুমি নেই, কিন্তু রুমির স্বপ্নের দেশ কি স্বাধীন হতে চলেছে?”

অবরুদ্ধ ঢাকার মানুষ তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র ও বিবিসির সংবাদের ওপর নির্ভর করে দিন কাটাচ্ছিল। প্রতিটি সাইরেনের শব্দে তাদের মনে একাধারে ভয় এবং মুক্তির আনন্দ কাজ করছিল।

আন্তর্জাতিক অঙ্গন: জাতিসংঘে বিতর্ক ও সপ্তম নৌ বহর

৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ছিল উত্তেজনার তুঙ্গে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির জন্য একের পর এক প্রস্তাব আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এ দিনও পাকিস্তানের পক্ষে আসা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে ঢাকার কাজ শেষ করার জন্য আরও কিছু সময় দেওয়া।

হেনরি কিসিঞ্জার ও নিক্সন প্রশাসন মরিয়া হয়ে সপ্তম নৌ বহর বা ‘টাস্ক ফোর্স ৭৪’কে বঙ্গোপসাগরের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। ৮ ডিসেম্বর ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ মালাক্কা প্রণালীর দিকে যাত্রা শুরু করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতকে ভয় দেখানো, কিন্তু তাদের এই যাত্রা ছিল অনেক বিলম্বিত।

দেশের অন্যান্য প্রান্তের খণ্ডচিত্র

এ দিন এরই মধ্যে যশোর, ঝিনাইদহ ও মাগুরা মুক্ত হয়ে গেছে এবং পাকিস্তানিরা পিছু হটছে। যশোর পতনের পর পাকিস্তানিরা এ অঞ্চলে আর দাঁড়াতে পারেনি। বরিশালে অবস্থানরত পাকিস্তানিরা নদীপথে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিমান হামলায় তাদের গানবোটগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পিরোজপুর কার্যত মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। মোংলা বন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি জাহাজগুলোর ওপর মিত্রবাহিনীর বিমান ও নৌ কমান্ডোদের আক্রমণ অব্যাহত থাকে, ফলে বন্দরটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।

তথ্যসূত্র

  • মূলধারা ’৭১ – মঈদুল হাসান
  • দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign) – মেজর জেনারেল ডি কে পালিত
  • মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম
  • উইটনেস টু সারেন্ডার (Witness to Surrender) – ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক
  • সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা (Surrender at Dacca) – লেফট্যানেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব
  • দ্য নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ (৮-৯ ডিসেম্বর ১৯৭১)
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড)
  • একাত্তরের রণাঙ্গন – শামসুল হুদা চৌধুরী
  • লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম
  • বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ – এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ
  • একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম
  • টাইম ম্যাগাজিন আর্কাইভ (ডিসেম্বর ১৯৭১)
  • এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী
  • অপারেশনাল রেকর্ডস অব ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স (১৯৭১)
ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

বিজয়ের মাসে ৩১টি যাত্রাপালা দেখাবে শিল্পকলা একাডেমি

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসব পরিণত হয়েছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির এক অনন্য মিলনমেলায়।

৩ দিন আগে

‘পাকিস্তান আজ মৃত’— এক ভেটো ও আকাশজয়ের আখ্যান

পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কামাল ও তার সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশনের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।

৩ দিন আগে

অবরোধের নিখুঁত কৌশলে পতন ‘দুর্ভেদ্য দুর্গে’র, মুক্ত ঢাকার প্রবেশদ্বার

কামালপুর কেবল একটি বিওপি বা বর্ডার আউটপোস্ট ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের প্রতীক এবং ঢাকা বিজয়ের চাবিকাঠি। এ যুদ্ধের কাহিনি কোনো সাধারণ যুদ্ধের বিবরণ নয়; বারুদ, কাদা, রক্ত ও মানুষের অকল্পনীয় জেদের এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।

৪ দিন আগে

কী কী সুবিধা আছে কাতার আমিরের এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে

সব প্রস্তুতি শেষ হলে আজ মধ্যরাত অথবা শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) সকালের মধ্যে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।

৪ দিন আগে