
নাজমুল ইসলাম হৃদয়

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিচিত্র ও শ্বাসরুদ্ধকর অধ্যায়, যেখানে বিজয়ের চূড়ান্ত আনন্দ আর ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণ একই সমান্তরালে চলছিল। ক্যালেন্ডারের পাতায় এটি ছিল বিজয়ের ঠিক আগের দিন। কিন্তু রণাঙ্গনের বাস্তবতায় এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর মানসিক মৃত্যু ও যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তারের দিন।
এ দিন সকাল থেকেই ঢাকার আকাশ ও বাতাস এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করে, যা ছিল আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৫ ডিসেম্বর এমন এক সন্ধিক্ষণ হয়ে আসে, যখন পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের নিশ্চিত পরাজয় মেনে নিয়ে সম্মানজনক প্রস্থানের পথ খুঁজছিলেন। অন্যদিকে ভারতীয় হাইকমান্ড ব্যস্ত ছিল যুদ্ধের কৃতিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার চূড়ান্ত ছক কষতে।
ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ তখন এতটাই সংকুচিত হয়ে এসেছিল যে জেনারেল নিয়াজির ‘ইস্টার্ন কমান্ড’ আক্ষরিক অর্থেই তার ক্যান্টনমেন্টের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে পড়েছিল। উত্তরে টঙ্গী ও জয়দেবপুর হয়ে মিত্রবাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনী তখন ঢাকার মিরপুর ব্রিজের দিকে অগ্রসরমান, পূর্বে ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী দিয়ে ‘এস ফোর্স’ এবং ভারতীয় বাহিনী ঢাকার প্রবেশদ্বারে। ওদিকে পশ্চিমে সাভার ও আমিনবাজার দিয়ে যৌথ বাহিনী রাজধানীতে ঢোকার অপেক্ষায়। তবে এই সামরিক অগ্রগতির আড়ালে চলছিল এক ভিন্ন রাজনৈতিক খেলা, যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘ইমেজ’ ও ‘কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টাও চলছিল সমানতালে।
১৫ ডিসেম্বরের সকাল শুরু হয় ঢাকার উপকণ্ঠে এক নাটকীয় সামরিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। টাঙ্গাইল থেকে বিজয়ের বেশে ধেয়ে আসা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ও ভারতীয় মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড তখন সাভার ও কালিয়াকৈরের বাধা অতিক্রম করে ঢাকার মিরপুর ব্রিজের (বর্তমান গাবতলী এলাকা) দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
আগের দিনগুলোতে টাঙ্গাইল ও কালিয়াকৈরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর তারা ঢাকার প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছায়। জেনারেল নাগরার বাহিনীর সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলেও কমান্ড বা নেতৃত্ব ছিল ভারতীয় জেনারেলদের হাতে।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার এই চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারতীয় হাইকমান্ড খুব সচেতনভাবেই চেয়েছিলেন যেন ঢাকার পতন ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ তাদের নিয়ন্ত্রণেই ঘটে। এ কারণেই হয়তো ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছানোর পর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতন্ত্র অভিযানের চেয়ে যৌথ কমান্ডের নির্দেশনার ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছিল।
১৫ ডিসেম্বর সকালে মিরপুর ব্রিজের ওপারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যৌথ বাহিনীর এক সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তীব্র গোলাগুলি হয়। পাকিস্তানিরা ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ত্বরিত পদক্ষেপে তারা ব্যর্থ হয়। ঢাকার পূর্ব প্রান্তে ‘এস ফোর্সের’ অধিনায়ক মেজর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ও ১১তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ডেমরা ও রূপগঞ্জ এলাকা মুক্ত করে ঢাকার বালু নদীর তীরে অবস্থান নেয়।
ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে আগের দুই দিনের যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পুরোপুরি পিছু হটে ঢাকার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে শফিউল্লাহর বাহিনী বালু নদী অতিক্রম করার প্রস্তুতি নেয় এবং ঢাকার গুলশান ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার দিকে তাদের কামানের মুখ ঘুরিয়ে দেয়।
রণাঙ্গনের এই চূড়ান্ত অবরোধের মুখে ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হাইকমান্ডের অন্দরমহলে চলছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজে বিমান হামলার পর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পতন ঘটেছিল। ১৫ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে এবং পরে সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন।
হামিদ খান তাকে ফোনে বলেন, ‘তুমি এখন মাঠের কমান্ডার, পরিস্থিতি বুঝে যা ভালো মনে করো, তাই করো।’ রাওয়ালপিন্ডির এই বার্তার অর্থ ছিল পরিষ্কার। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের হাত ধুয়ে ফেলেছে!
এ বার্তা পাওয়ার পর নিয়াজি বুঝতে পারেন, তার সাধের ‘ফোর্ট্রেস ঢাকা’র পতন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। তিনি তখন ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাকের শরণাপন্ন হন। নিয়াজির উদ্দেশ্য ছিল, মার্কিনিদের মধ্যস্থতায় একটি সম্মানজনক ‘যুদ্ধবিরতি’ বা ‘সিজফায়ার’ কার্যকর করা, যেন পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রসহ বা অস্ত্র ছাড়া নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারে।
নিয়াজি তখনো ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাইছিলেন না। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের মাধ্যমে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশের কাছে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন।
এ বার্তাটি দিল্লিতে পৌঁছালে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা কঠোর ও কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেন। জেনারেল মানেকশ ও ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফট্যানেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি বা শর্তসাপেক্ষ সমঝোতা সম্ভব নয়। জেনারেল মানেকশ ফিরতি বার্তায় বলেন, ‘কোনো যুদ্ধবিরতি নয়, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ।’
তবে আত্মসমর্পণের আলোচনার সুবিধার্থে জেনারেল মানেকশ ঘোষণা করেন, ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর ভারতীয় বিমান বাহিনী কোনো ধরনের বিমান হামলা চালাবে না।
আপাতদৃষ্টিতে এটি মানবিক সুযোগ মনে হলেও এর পেছনে ছিল কৌশল। তারা চেয়েছিল, এই সময়ের মধ্যে নিয়াজির মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দিতে এবং আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি এমনভাবে সম্পন্ন করতে, যেন তা আন্তর্জাতিকভাবে ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়’ হিসেবেই স্বীকৃত হয়।
আত্মসমর্পণের এই পুরো প্রক্রিয়া ও শর্ত নির্ধারণে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আলোচনার খুব একটা নজির পাওয়া যায় না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর উপস্থিতি বা মতামতও এ সময়টায় কিছুটা আড়ালে রাখা হয়েছিল, যা পরে নানা প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার পর থেকে ঢাকার রণাঙ্গনে গুলির শব্দ কমতে শুরু করে এবং আকাশে ভারতীয় মিগ ও ন্যাট বিমানের চক্কর বন্ধ হয়ে যায়। এটি ছিল এক অঘোষিত আত্মসমর্পণের শুরু।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে ১৫ ডিসেম্বর ছিল চরম উত্তেজনার দিন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা ও চীন যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছিল। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে সেই প্রচেষ্টা রুখে দিচ্ছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এ দিন নিরাপত্তা পরিষদে এক নাটকীয় ও উগ্র ভাষণ দেন। মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ অনুযায়ী, ভুট্টো চিৎকার করে বলেন, ‘আমার দেশ জ্বলছে, আর আপনারা এখানে সময় নষ্ট করছেন।’ এ বলে তিনি জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের খসড়া কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন এবং সদলবলে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। এটি ছিল পাকিস্তানের কূটনৈতিক পরাজয়ের চূড়ান্ত দলিল।
অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে আসা মার্কিন সপ্তম নৌ বহর ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ ১৫ ডিসেম্বরও তার গতি অব্যাহত রাখে। তবে ভারতের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল, সোভিয়েত নৌ বহর তাদের সমর্থনে ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিয়েছিল। ভারত সরকার খুব ভালোভাবেই জানত, যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়, তবে অর্জিত বিজয় হাতছাড়া হতে পারে। তাই ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে দ্রুততম সময়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। এই তাড়াহুড়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের পাকিস্তানি পকেটগুলো (যেমন— খুলনা, রংপুর) পুরোপুরি নির্মূল না করেই সব মনোযোগ ঢাকায় নিবদ্ধ করা হয়।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ১৫ ডিসেম্বর ছিল ভিন্ন চিত্র। সেখানে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রভাব পড়েনি, বরং চলছিল মরণপণ লড়াই। খুলনার শিরোমণি এলাকায় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধ বা ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’ চলছিল। পাকিস্তানি ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার বিশাল বাহিনী ও ৩২টি ট্যাংক নিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইয়ের ভাষ্যমতে, ১৫ ডিসেম্বর সেখানে তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে আক্রমণ চালালেও পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের কারণে সেখানে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছিল।
বগুড়া শহরেও ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি ২০৫ ব্রিগেডের পতন ঘটে। সেখানেও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র লড়াই হয় এবং অবশেষে ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হোসেন মালিক মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নেন। চট্টগ্রাম রণাঙ্গনেও ১৫ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়া পাকিস্তানি নৌ সেনারা তখন পালানোর সব পথ বন্ধ দেখে সাদা পতাকা ওড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা সদর শত্রুমুক্ত হয়ে যায়, বাকি ছিল ঢাকা।
অবরুদ্ধ ঢাকার জনজীবনে ১৫ ডিসেম্বর ছিল এক অদ্ভুত অনুভূতি ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার দিন। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার আতঙ্ক তখনো কাটেনি। রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোতে তখনো তাজা রক্তের দাগ শুকায়নি। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আসন্ন মুক্তির প্রবল উত্তেজনা।
শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে লিখেছেন, ‘আজ ১৫ ডিসেম্বর। বুধবার। সকাল থেকেই শুনছি ওরা নাকি যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। প্লেন আর বোমা ফেলছে না। রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মিদের জিপগুলো আর দানবের মতো ছুটছে না।’
ঢাকার সাধারণ মানুষ ১৫ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই ছাদ থেকে নামতে শুরু করে এবং সাবধানে রাস্তায় উঁকি দিতে থাকে। কারফিউ পুরোপুরি না উঠলেও মানুষের মন থেকে ভয় কেটে গিয়েছিল। তবে সাধারণ মানুষের অগোচরে শহরে অন্য এক ঘটনা ঘটছিল।
‘মুজিব বাহিনী’ বা বিএলএফ সদস্যরা ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রশাসনিক এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিচ্ছিল। মূলধারার মুক্তিযোদ্ধা বা সেক্টর কমান্ডারদের বাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর এই পৃথক অবস্থান ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ও সন্ধ্যা ছিল বিষাদগ্রস্ত ও বিশৃঙ্খল। জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল রাও ফরমান আলী তখন ব্যস্ত ছিলেন কীভাবে নিজেদের প্রাণ বাঁচানো যায় সেই চিন্তায়। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিয়াজির অফিসে এক শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছিল।
যে নিয়াজি কিছুদিন আগেও বলতেন ‘আমি বাংলার বাঘ’, সেই নিয়াজি তখন বিড়ালের মতো কুঁকড়ে ছিলেন। তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন, যেন মুক্তি বাহিনী বা কাদেরিয়া বাহিনীর কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে না হয়। তাদের ভয় ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর ৯ মাসের নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে পারে।
পরে ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব তাদের আশ্বস্ত করেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ১৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিয়াজিকে জানায়, পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল জ্যাকব ঢাকায় এসে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত দলিল ঠিক করবেন। পাকিস্তানিরা তখন তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ব্যাংক থেকে টাকা পুড়িয়ে ফেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি নষ্ট করার কাজ চলে রাতভর।
তথ্যসূত্র

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিচিত্র ও শ্বাসরুদ্ধকর অধ্যায়, যেখানে বিজয়ের চূড়ান্ত আনন্দ আর ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণ একই সমান্তরালে চলছিল। ক্যালেন্ডারের পাতায় এটি ছিল বিজয়ের ঠিক আগের দিন। কিন্তু রণাঙ্গনের বাস্তবতায় এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর মানসিক মৃত্যু ও যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তারের দিন।
এ দিন সকাল থেকেই ঢাকার আকাশ ও বাতাস এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করে, যা ছিল আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৫ ডিসেম্বর এমন এক সন্ধিক্ষণ হয়ে আসে, যখন পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের নিশ্চিত পরাজয় মেনে নিয়ে সম্মানজনক প্রস্থানের পথ খুঁজছিলেন। অন্যদিকে ভারতীয় হাইকমান্ড ব্যস্ত ছিল যুদ্ধের কৃতিত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার চূড়ান্ত ছক কষতে।
ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ তখন এতটাই সংকুচিত হয়ে এসেছিল যে জেনারেল নিয়াজির ‘ইস্টার্ন কমান্ড’ আক্ষরিক অর্থেই তার ক্যান্টনমেন্টের চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে পড়েছিল। উত্তরে টঙ্গী ও জয়দেবপুর হয়ে মিত্রবাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনী তখন ঢাকার মিরপুর ব্রিজের দিকে অগ্রসরমান, পূর্বে ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী দিয়ে ‘এস ফোর্স’ এবং ভারতীয় বাহিনী ঢাকার প্রবেশদ্বারে। ওদিকে পশ্চিমে সাভার ও আমিনবাজার দিয়ে যৌথ বাহিনী রাজধানীতে ঢোকার অপেক্ষায়। তবে এই সামরিক অগ্রগতির আড়ালে চলছিল এক ভিন্ন রাজনৈতিক খেলা, যেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘ইমেজ’ ও ‘কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টাও চলছিল সমানতালে।
১৫ ডিসেম্বরের সকাল শুরু হয় ঢাকার উপকণ্ঠে এক নাটকীয় সামরিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। টাঙ্গাইল থেকে বিজয়ের বেশে ধেয়ে আসা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী ও ভারতীয় মেজর জেনারেল গন্ধর্ব নাগরার ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড তখন সাভার ও কালিয়াকৈরের বাধা অতিক্রম করে ঢাকার মিরপুর ব্রিজের (বর্তমান গাবতলী এলাকা) দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
আগের দিনগুলোতে টাঙ্গাইল ও কালিয়াকৈরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের তীব্র যুদ্ধ হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর তারা ঢাকার প্রবেশদ্বারে এসে পৌঁছায়। জেনারেল নাগরার বাহিনীর সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলেও কমান্ড বা নেতৃত্ব ছিল ভারতীয় জেনারেলদের হাতে।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার এই চূড়ান্ত মুহূর্তে ভারতীয় হাইকমান্ড খুব সচেতনভাবেই চেয়েছিলেন যেন ঢাকার পতন ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ তাদের নিয়ন্ত্রণেই ঘটে। এ কারণেই হয়তো ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছানোর পর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতন্ত্র অভিযানের চেয়ে যৌথ কমান্ডের নির্দেশনার ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছিল।
১৫ ডিসেম্বর সকালে মিরপুর ব্রিজের ওপারে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যৌথ বাহিনীর এক সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তীব্র গোলাগুলি হয়। পাকিস্তানিরা ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের ত্বরিত পদক্ষেপে তারা ব্যর্থ হয়। ঢাকার পূর্ব প্রান্তে ‘এস ফোর্সের’ অধিনায়ক মেজর কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ও ১১তম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ডেমরা ও রূপগঞ্জ এলাকা মুক্ত করে ঢাকার বালু নদীর তীরে অবস্থান নেয়।
ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে আগের দুই দিনের যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পুরোপুরি পিছু হটে ঢাকার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরে শফিউল্লাহর বাহিনী বালু নদী অতিক্রম করার প্রস্তুতি নেয় এবং ঢাকার গুলশান ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার দিকে তাদের কামানের মুখ ঘুরিয়ে দেয়।
রণাঙ্গনের এই চূড়ান্ত অবরোধের মুখে ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হাইকমান্ডের অন্দরমহলে চলছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজে বিমান হামলার পর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পতন ঘটেছিল। ১৫ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে এবং পরে সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খানের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন।
হামিদ খান তাকে ফোনে বলেন, ‘তুমি এখন মাঠের কমান্ডার, পরিস্থিতি বুঝে যা ভালো মনে করো, তাই করো।’ রাওয়ালপিন্ডির এই বার্তার অর্থ ছিল পরিষ্কার। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের হাত ধুয়ে ফেলেছে!
এ বার্তা পাওয়ার পর নিয়াজি বুঝতে পারেন, তার সাধের ‘ফোর্ট্রেস ঢাকা’র পতন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। তিনি তখন ঢাকার মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাকের শরণাপন্ন হন। নিয়াজির উদ্দেশ্য ছিল, মার্কিনিদের মধ্যস্থতায় একটি সম্মানজনক ‘যুদ্ধবিরতি’ বা ‘সিজফায়ার’ কার্যকর করা, যেন পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রসহ বা অস্ত্র ছাড়া নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারে।
নিয়াজি তখনো ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাইছিলেন না। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে জেনারেল নিয়াজি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের মাধ্যমে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশের কাছে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন।
এ বার্তাটি দিল্লিতে পৌঁছালে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা কঠোর ও কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করেন। জেনারেল মানেকশ ও ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফট্যানেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব স্পষ্ট জানিয়ে দেন, কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি বা শর্তসাপেক্ষ সমঝোতা সম্ভব নয়। জেনারেল মানেকশ ফিরতি বার্তায় বলেন, ‘কোনো যুদ্ধবিরতি নয়, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই একমাত্র পথ।’
তবে আত্মসমর্পণের আলোচনার সুবিধার্থে জেনারেল মানেকশ ঘোষণা করেন, ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা থেকে পরদিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর ভারতীয় বিমান বাহিনী কোনো ধরনের বিমান হামলা চালাবে না।
আপাতদৃষ্টিতে এটি মানবিক সুযোগ মনে হলেও এর পেছনে ছিল কৌশল। তারা চেয়েছিল, এই সময়ের মধ্যে নিয়াজির মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দিতে এবং আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি এমনভাবে সম্পন্ন করতে, যেন তা আন্তর্জাতিকভাবে ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিজয়’ হিসেবেই স্বীকৃত হয়।
আত্মসমর্পণের এই পুরো প্রক্রিয়া ও শর্ত নির্ধারণে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আলোচনার খুব একটা নজির পাওয়া যায় না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর উপস্থিতি বা মতামতও এ সময়টায় কিছুটা আড়ালে রাখা হয়েছিল, যা পরে নানা প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টার পর থেকে ঢাকার রণাঙ্গনে গুলির শব্দ কমতে শুরু করে এবং আকাশে ভারতীয় মিগ ও ন্যাট বিমানের চক্কর বন্ধ হয়ে যায়। এটি ছিল এক অঘোষিত আত্মসমর্পণের শুরু।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে ১৫ ডিসেম্বর ছিল চরম উত্তেজনার দিন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা ও চীন যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছিল। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দিয়ে সেই প্রচেষ্টা রুখে দিচ্ছিল।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এ দিন নিরাপত্তা পরিষদে এক নাটকীয় ও উগ্র ভাষণ দেন। মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ অনুযায়ী, ভুট্টো চিৎকার করে বলেন, ‘আমার দেশ জ্বলছে, আর আপনারা এখানে সময় নষ্ট করছেন।’ এ বলে তিনি জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের খসড়া কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন এবং সদলবলে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন। এটি ছিল পাকিস্তানের কূটনৈতিক পরাজয়ের চূড়ান্ত দলিল।
অন্যদিকে বঙ্গোপসাগরের দিকে ধেয়ে আসা মার্কিন সপ্তম নৌ বহর ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ ১৫ ডিসেম্বরও তার গতি অব্যাহত রাখে। তবে ভারতের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল, সোভিয়েত নৌ বহর তাদের সমর্থনে ভারত মহাসাগরে অবস্থান নিয়েছিল। ভারত সরকার খুব ভালোভাবেই জানত, যদি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় এবং আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়, তবে অর্জিত বিজয় হাতছাড়া হতে পারে। তাই ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে দ্রুততম সময়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। এই তাড়াহুড়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের পাকিস্তানি পকেটগুলো (যেমন— খুলনা, রংপুর) পুরোপুরি নির্মূল না করেই সব মনোযোগ ঢাকায় নিবদ্ধ করা হয়।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ১৫ ডিসেম্বর ছিল ভিন্ন চিত্র। সেখানে যুদ্ধবিরতির কোনো প্রভাব পড়েনি, বরং চলছিল মরণপণ লড়াই। খুলনার শিরোমণি এলাকায় ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধ বা ‘ব্যাটল অব শিরোমণি’ চলছিল। পাকিস্তানি ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান তার বিশাল বাহিনী ও ৩২টি ট্যাংক নিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইয়ের ভাষ্যমতে, ১৫ ডিসেম্বর সেখানে তুমুল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে আক্রমণ চালালেও পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের কারণে সেখানে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছিল।
বগুড়া শহরেও ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি ২০৫ ব্রিগেডের পতন ঘটে। সেখানেও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র লড়াই হয় এবং অবশেষে ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হোসেন মালিক মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নেন। চট্টগ্রাম রণাঙ্গনেও ১৫ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়া পাকিস্তানি নৌ সেনারা তখন পালানোর সব পথ বন্ধ দেখে সাদা পতাকা ওড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা সদর শত্রুমুক্ত হয়ে যায়, বাকি ছিল ঢাকা।
অবরুদ্ধ ঢাকার জনজীবনে ১৫ ডিসেম্বর ছিল এক অদ্ভুত অনুভূতি ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার দিন। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার আতঙ্ক তখনো কাটেনি। রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিগুলোতে তখনো তাজা রক্তের দাগ শুকায়নি। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আসন্ন মুক্তির প্রবল উত্তেজনা।
শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে লিখেছেন, ‘আজ ১৫ ডিসেম্বর। বুধবার। সকাল থেকেই শুনছি ওরা নাকি যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। প্লেন আর বোমা ফেলছে না। রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মিদের জিপগুলো আর দানবের মতো ছুটছে না।’
ঢাকার সাধারণ মানুষ ১৫ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই ছাদ থেকে নামতে শুরু করে এবং সাবধানে রাস্তায় উঁকি দিতে থাকে। কারফিউ পুরোপুরি না উঠলেও মানুষের মন থেকে ভয় কেটে গিয়েছিল। তবে সাধারণ মানুষের অগোচরে শহরে অন্য এক ঘটনা ঘটছিল।
‘মুজিব বাহিনী’ বা বিএলএফ সদস্যরা ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রশাসনিক এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিচ্ছিল। মূলধারার মুক্তিযোদ্ধা বা সেক্টর কমান্ডারদের বাহিনীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর এই পৃথক অবস্থান ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ও সন্ধ্যা ছিল বিষাদগ্রস্ত ও বিশৃঙ্খল। জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল রাও ফরমান আলী তখন ব্যস্ত ছিলেন কীভাবে নিজেদের প্রাণ বাঁচানো যায় সেই চিন্তায়। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিয়াজির অফিসে এক শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছিল।
যে নিয়াজি কিছুদিন আগেও বলতেন ‘আমি বাংলার বাঘ’, সেই নিয়াজি তখন বিড়ালের মতো কুঁকড়ে ছিলেন। তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছিলেন, যেন মুক্তি বাহিনী বা কাদেরিয়া বাহিনীর কাছে তাদের আত্মসমর্পণ করতে না হয়। তাদের ভয় ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর ৯ মাসের নৃশংসতার প্রতিশোধ নিতে পারে।
পরে ভারতীয় জেনারেল জ্যাকব তাদের আশ্বস্ত করেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ১৫ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিয়াজিকে জানায়, পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল জ্যাকব ঢাকায় এসে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত দলিল ঠিক করবেন। পাকিস্তানিরা তখন তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে, ব্যাংক থেকে টাকা পুড়িয়ে ফেলা এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি নষ্ট করার কাজ চলে রাতভর।
তথ্যসূত্র

কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা প্যারাট্রুপারদের পথ দেখিয়ে পুংলি ব্রিজের দিকে নিয়ে যায় এবং ব্রিজটি দখল করে নেয়। এর ফলে ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকে পিছু হটা পাকিস্তানি ৯৩ ব্রিগেডের সৈন্যরা ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে আটকা পড়ে।
৫ দিন আগে
ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়ে যায়। উত্তরে ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে ছুটছে, পূর্বে মেঘনা পাড় হয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিশাল বহর, আর পশ্চিমে পদ্মার পাড়ে চলছে তুমুল প্রস্তুতি।
৫ দিন আগে
পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের তথাকথিত ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশলের ওপর যে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছিল, তা তখন অন্ধের মতোই তাদের হোঁচট খাওয়াচ্ছিল। একদিকে বিশ্বরাজনীতির দাবার বোর্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে বাংলার
৭ দিন আগে
তিন যুবকের হাতে মোটেও সময় নেই। বেচারা সিম্পসন! আজীবন নিরীহ-নিরপরাধ ভারতীয়দের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এসেছেন। এ জন্য কতকিছু চিন্তা করে নির্যাতনের উপায় বের করতে হয়েছে। সেই মানুষটি নিজের শেষ সময়ে বিন্দুমাত্র ভাবনার সময়ও পেলেন না। তার দিকে তাক করা তিনটি রিভলবার থেকে ছয়টি বুলেট সিম্পসনের শরীর ভেদ করে
৭ দিন আগে