
নাজমুল ইসলাম হৃদয়

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। শেষ হয় সামরিক ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী, দীর্ঘস্থায়ী ও মনস্তাত্ত্বিক এক যুদ্ধের আখ্যান, যার নাম ‘ব্যাটল অব কামালপুর’। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটিমাত্র রণাঙ্গন সাক্ষী হয়ে আছে বীরত্বের সর্বোচ্চ নজিরের। কেবল এই একটি যুদ্ধের জন্যই বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২৯টি বীরত্বসূচক পদক দিয়েছে, যা একক কোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। তাদের মধ্যে রয়েছেন বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধারা, যাদের রক্তে ভেজা কামালপুরের মাটি আজও বহন করে চলেছে এক দগদগে ইতিহাসের ক্ষত।
কামালপুর কেবল একটি বিওপি বা বর্ডার আউটপোস্ট ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের প্রতীক এবং ঢাকা বিজয়ের চাবিকাঠি। এ যুদ্ধের কাহিনি কোনো সাধারণ যুদ্ধের বিবরণ নয়; বারুদ, কাদা, রক্ত ও মানুষের অকল্পনীয় জেদের এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে একাত্তরের রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল ‘গেটওয়ে টু ঢাকা’ বা ঢাকার প্রবেশদ্বারে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট এখানে গড়ে তুলেছিল দুর্ভেদ্য এক দুর্গ। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই দুর্গ ভেদ করা তো দূরের কথা, এর কাছে ঘেঁষলে মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল লাশ হয়ে ফিরতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের বিভিন্ন দলিলপত্র ও ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ের ভাষ্যমতে, কামালপুর ছিল এমন এক ডিফেন্সিভ পজিশন যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘মাজিনো লাইন’-এর ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এখানে মাটির গভীরে কংক্রিট ও রেলওয়ের স্লিপার দিয়ে তৈরি বাংকারগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সাধারণ কামানের গোলা বা মর্টারের আঘাত সেখানে আঁচড়ও কাটতে পারত না। প্রতিটি বাংকার মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ বা কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ দ্বারা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে যুদ্ধের সময় একজন সেনাকেও মাটির ওপরে মাথা তুলতে হতো না।
আর এই মৃত্যুপুরীর চারপাশ ঘিরে ছিল হাজার হাজার অ্যান্টি-পারসোনাল ও অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, কাঁটাতারের বেড়া ও তীক্ষ্ণ বাঁশের কঞ্চি। বাংকারের সামনে প্রায় ৫০০ গজ এলাকা পর্যন্ত সব গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছিল, যাকে সামরিক ভাষায় বলা হয় ‘ক্লিয়ারিং জোন’ বা ‘কিলিং জোন’— যেখানে পা দেওয়ামাত্রই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নিশ্চিত।
এ যুদ্ধ কেবল জুলাই বা ডিসেম্বরের ঘটনা ছিল না, দুর্ভেদ্য এ ঘাঁটিতে আঘাত হানা শুরু হয় জুন মাস থেকেই। ১২ জুন নায়েক সুবেদার সিরাজের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে ১৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সর্বপ্রথম এখানে গেরিলা আক্রমণ চালান। ঠিক তিন দিন পর, ১৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা রইচ উদ্দিনের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে বকশীগঞ্জ-কামালপুর রোডে মাইন পুঁতে পাকিস্তানি ট্রাক ধ্বংস করা হয়। ২০ জুন হাবিলদার হাকিমের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বেও একটি বড় আক্রমণ পরিচালিত হয়। এই প্রাথমিক গেরিলা আঘাতগুলোই বুঝিয়ে দিয়েছিল সামনে বড় কিছু ঘটতে চলেছে।
জুলাই মাসের শেষ দিক। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে অবিরাম। জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) সিদ্ধান্ত নিলেন কামালপুর আক্রমণের। দায়িত্ব পড়ল ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর, যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীর বিক্রম)।
মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বই থেকে জানা যায়, এ আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে শুরুতেই ছিল ঘোর দ্বিমত। মেজর মইনুল চেয়েছিলেন গেরিলা কায়দায় ছোট ছোট হিট-অ্যান্ড-রান অপারেশন চালিয়ে শত্রুকে দুর্বল করতে। তিনি জানতেন, কনভেনশনাল বা সম্মুখ যুদ্ধের জন্য তার ছেলেরা পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। কিন্তু হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত সরাসরি আক্রমণের ছকই চূড়ান্ত হয়।
গারো পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্পে কঠোর প্রশিক্ষণ নেওয়া ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা প্রস্তুত হয় এই মরণপণ লড়াইয়ের জন্য। কিন্তু এ আক্রমণ ছিল আত্মঘাতী। মূল আক্রমণের আগে ২৮ জুলাই গভীর রাতে রেকি করতে যান ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান (বীর বিক্রম), নায়েক সুবেদার আব্দুল হাই (বীর প্রতীক), সুবেদার আবুল হাশেম ও নায়েক শফি (বীর প্রতীক)।
সেখানে পাকিস্তানি প্যাট্রল পার্টির মুখোমুখি হলে ঘটে এক শ্বাসরুদ্ধকর হাতাহাতি যুদ্ধ। সুবেদার হাই (বীর প্রতীক) রাইফেলের বাঁট দিয়ে এবং লেফটেন্যান্ট মান্নান (বীর বিক্রম) স্টেনগানের ব্যারেল দিয়ে পিটিয়ে শত্রুকে ধরাশায়ী করেন। সে রাতেই ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (বীর উত্তম) ও তার দল পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন।

৩১ জুলাইয়ের সেই রাতটি ছিল যেন কেয়ামতের মতো। শত্রু ঘাঁটির পেছনে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (বীর উত্তম), সম্মুখভাগে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), পাটক্ষেতে মেজর মইনুল হোসেন (বীর বিক্রম) ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম) এবং একটু দূরের টিলায় মেশিনগানসহ মেজর জিয়া (বীর উত্তম)।
বৃষ্টির পানিতে ওয়্যারলেস সেটগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ায় আক্রমণের নির্ধারিত সময়ে চরম সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। মেজর মইনুল তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাই ছিল সেই রাতের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ঠিক সে সময়েই পাকিস্তানি আর্টিলারি গর্জে ওঠে।
একদিকে প্রবল বৃষ্টি, পিচ্ছিল কাদা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার; অন্যদিকে এক কোম্পানির সঙ্গে আরেক কোম্পানির যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন— অন্ধকারে নিজেদের সেনাদের পায়ের শব্দ আর কামানের গর্জনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। কাদায় পা আটকে যাচ্ছে, সামনে মাইনফিল্ড বিস্ফোরিত হচ্ছে, আর ওপর থেকে বৃষ্টির মতো ঝরছে মেশিনগানের গুলি। এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে সদ্য রিক্রুট হওয়া তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ইতিহাসের পাতায় জন্ম নেন এক অতিমানব, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)। যখন সবাই পিছু হটছিল, মৃত্যুর ভয় যখন গ্রাস করছিল সবাইকে, তখন মাইনফিল্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডমাইক হাতে গর্জে ওঠেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)। পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আভি তক ওয়াক্ত হ্যায়, শালালোক সারেন্ডার করো, নেহিত জিন্দা নেহি ছোড়েঙ্গা! ইয়াহিয়া খান এখনো এমন বুলেট তৈরি করতে পারে নাই যা মমতাজকে ভেদ করবে!’
তার এই হুংকার বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধমনীতে। ভয় কেটে যায় মুহূর্তেই। এক হাত মাইনের আঘাতে উড়ে যাওয়ার পরও থামেননি নায়েক শফি (বীর প্রতীক)। যুদ্ধের ঠিক এই ভয়াবহ মুহূর্তে সম্মুখভাগে থাকা বীর বিক্রম ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (পরে মেজর) গলায় গুলিবিদ্ধ হন। বুলেটটি তার গলার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
মৃত্যুশয্যায় থাকা অধিনায়ককে বাঁচাতে নিজের জীবন তুচ্ছ করে ছুটে যান তার রানার নায়েক রবিউল (বীর প্রতীক)। ক্যাপ্টেন হাফিজকে কাঁধে তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পথেই শত্রুর গুলিতে শাহাদত বরণ করেন।
এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংকারের ওপর। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গ্রেনেড ছুড়ে তারা তছনছ করে দিতে থাকে পাকিস্তানি ডিফেন্স। সালাহউদ্দিন মমতাজ নিজে স্টেনগান হাতে বাংকারের ভেতরে ঢুকে পড়েন।
যুদ্ধের এ উন্মাদনার মধ্যেই ঘটে ট্র্যাজেডি। একের পর এক গুলি এসে বিদ্ধ করে তাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তিনি তার সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে শেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই, আমার কলেমা আগেই হয়ে গেছে। খোদার কসম, যে পেছনে হটবি তাকেই গুলি করব। মরতে যদি হয় দেশের মাটিতে মর, এদের মেরে তারপর মর।’
সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) ফিরে আসেননি, তার লাশটিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন লড়াইয়ের বারুদ। মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষের তথ্যমতে, এ রাতে প্রায় ৩৫ জন, কিছু কিছু দলিলপত্র অনুযায়ী ৩০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। জীবন দিলেও তারা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙালিরা কেবল গেরিলা যুদ্ধ নয়, সম্মুখ সমরেও মৃত্যুকে ভৃত্য বানাতে জানে।
আগস্ট মাসে ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে আসেন এক ধূমকেতু, বীর উত্তম মেজর আবু তাহের (পরে কর্নেল), সামরিক একাডেমিগুলোতে আজও যার যুদ্ধকৌশল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তাহের কেবল একজন কমান্ডার ছিলেন না, ছিলেন যুদ্ধের এক নিখুঁত শিল্পী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি ছিলেন ‘এলিট স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ’ (এসএসজি) বা ব্ল্যাক কমান্ডো অফিসার। কামালপুর তার কাছে কেবল একটি শত্রুঘাঁটি ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল তার ব্যক্তিগত জেদ, এক প্রকার উন্মাদনা।
মেজর তাহের বিশ্বাস করতেন, কামালপুরের পতন ঘটাতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে। তিনি জানতেন, এ দুর্গ ভাঙা মানেই ঢাকা যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার। তাহের গতানুগতিক যুদ্ধের কৌশল আমূল বদলে ফেললেন। তিনি বুঝলেন, কামালপুরের মতো দুর্গে সরাসরি আক্রমণ মানেই আত্মহত্যা। তাই তিনি প্রয়োগ করলেন তার মস্তিষ্কপ্রসূত এক মারণঘাতী ছক— ‘ইনফিলট্রেশন অ্যান্ড সিজ’ বা অনুপ্রবেশ ও অবরোধ।
মেজর তাহের তার বাহিনীকে আদেশ দিলেন কামালপুরকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করতে। বকশীগঞ্জ থেকে রসদ আসার রাস্তাগুলোতে রাতের আঁধারে মাইন পুঁতে রাখা হলো, প্রতিটি মোড়ে বসানো হলো ‘কাট-অফ পার্টি’। মুক্তিযোদ্ধারা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, যেন কেউ ওই পথে গেলেই আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। ঢাকা থেকে শেরপুর বা জামালপুর শহরে যেতে না পারায় এবং কোনো ধরনের সরবরাহ না পাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ে কামালপুরের পাকিস্তানি সৈন্যরা।
তাহেরের প্ল্যান ছিল পরিষ্কার শত্রুকে কামানের গোলায় না মেরে ভাতে মারতে হবে, ভয়ে মারতে হবে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তিনি তার ছেলেদের দিয়ে ছোট ছোট ‘হ্যারাসিং ফায়ার’ বা আচমকা গুলি ছুড়াতেন। জ্ঞানকোষের তথ্য অনুযায়ী, তাহেরের এ কৌশলের অংশ হিসেবে ২৮ আগস্ট, ৬ সেপ্টেম্বর ও ১০ সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যেখানে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান (বীর প্রতীক) ও লেফটেন্যান্ট মান্নানের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার পরিচয় দেন। তাহেরের উদ্দেশ্য ছিল একটাই— পাকিস্তানিদের এক মুহূর্তও ঘুমাতে না দেওয়া। তিনি চেয়েছিলেন ওরা যেন ক্লান্তিতে, অনিদ্রায় আর আতঙ্কে পাগল হয়ে যায়।
যুদ্ধের তীব্রতা যখন চরমে, তখন কামালপুর ঘাঁটির ভেতরে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থা শোচনীয়। তাদের ওয়্যারলেস সেটগুলো তখন কেবল হতাশার বার্তা পাঠাচ্ছিল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় সিগন্যাল কোরে ধরা পড়া একটি রেডিও ইন্টারসেপ্ট থেকে জানা যায় কামালপুরের ভেতরের হাহাকার।
কামালপুর পোস্টের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক মরিয়া হয়ে হেডকোয়ার্টার ৯৩ ব্রিগেডের কাছে বার্তা পাঠান— ‘হ্যালো, এইচকিউ। আমাদের রসদ শেষ। ওষুধ নেই। আহতরা কাতরাচ্ছে। এয়ার সাপোর্ট পাঠাও, অথবা আমাদের পিছু হটার অনুমতি দাও। ওভার।’
ও পাশ থেকে জামালপুর হেডকোয়ার্টারের উত্তর ছিল নির্মম এবং যান্ত্রিক— ‘হোল্ড অন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাও। রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো সম্ভব নয়। ওভার অ্যান্ড আউট।’
এই একটি বার্তাই বলে দেয়, পাকিস্তান হাইকমান্ড কামালপুরকে ‘ডেথ ট্র্যাপ’ জেনেও তাদের সৈন্যদের মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখেছিল। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আহসান মালিকের সেনারা তখন বুঝতে পারছিল, তাদের পিঠ কেবল দেয়ালে ঠেকেনি, দেয়ালটাই ভেঙে পড়ছে।
১৪ নভেম্বর। শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাসের আখ্যানে দিনটি উঠে এসেছে এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি হিসেবে। দিনটি ছিল মেজর তাহেরের ৩৩তম জন্মদিন। তাহের তার সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। তোরা আমাকে কী দিবি? আমি কামালপুর চাই। আজই কামালপুর পতন ঘটাতে হবে।’
তাহের তার জন্মদিনের উপহার হিসেবে চাইলেন কামালপুরের পতন। আবারও চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলো। ঐতিহাসিক এ অপারেশনে মেজর তাহেরের কোডনেম নির্ধারণ করা হয় ‘কর্তা’। হারুন হাবীব তার ‘জনযুদ্ধ ৭১’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মূলত ১৩ নভেম্বর রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, কামালপুর বিওপির উত্তর দিকের কিছু বাংকার পাকিস্তানিরা পরিত্যাগ করেছে। সে সুযোগটি কাজে লাগাতেই মেজর তাহের ঝটিকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
ভারতীয় আর্টিলারি ব্রিগেডিয়ার ক্লের সহায়তায় শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। মেজর তাহের কেবল নির্দেশ দিয়ে তাঁবুতে বসে থাকার লোক ছিলেন না, তিনি জানতেন, কমান্ডারের সশরীরে উপস্থিতি সৈন্যদের শিরায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তাই তিনি জিপ নিরাপদ দূরত্বে রেখে পায়ে চলে গেলেন ফ্রন্টলাইনের একদম সামনে, একেবারে ফরোয়ার্ড পজিশনে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব তার লেখনীতে জানিয়েছেন, সে রাতে তিনিও মেজর তাহেরের সঙ্গে একই ট্রেঞ্চে অবস্থান করছিলেন। ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১৩ গার্ডস রেজিমেন্ট যখন নিখুঁত নিশানায় আর্টিলারি ফায়ারিং বা গোলাবর্ষণ শুরু করে, সেই দৃশ্য দেখে মেজর তাহের শিশুদের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই গোলার আঘাতেই শত্রুর মনোবল ভেঙে যাবে।
সকালের দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন বাংকার ছেড়ে ভেতরে সরে যেতে থাকে, মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন বিজয় আসন্ন। কিন্তু ঠিক সেই চরম মুহূর্তে, সকাল ৯টার দিকে ট্রেঞ্চের খুব কাছেই একটি মর্টারের গোলা বা মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে তাহেরের বাম পা শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তাহেরের সঙ্গে ছিলেন তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক)। গোলার আঘাতে তাহের যখন লুটিয়ে পড়েন বেলালের গায়ের ওপর, তখন বিচ্ছিন্ন পা আর রক্তের স্রোত দেখে বেলাল ধরে নিয়েছিলেন তার ভাই আর বেঁচে নেই। তীব্র শোক আর আতঙ্কে বেলাল তৎক্ষণাৎ ওয়্যারলেসে আর্তনাদ করে বার্তা পাঠান, ‘কর্তা ইজ ডেড’।
মুহূর্তের মধ্যে এ দুঃসংবাদ ইথারে ভেসে বেড়াতে থাকে। চারদিকে হাহাকার পড়ে যায়। পরে অবশ্য জানা যায় তিনি শহিদ হননি, আহত হয়েছেন। সে রণাঙ্গনের অন্যতম যোদ্ধা হারুন হাবীবের ভাষায়, কমান্ডারের আহত হওয়ার ওই খবর এবং ‘কর্তা ইজ ডেড’ বার্তাটি যোদ্ধাদের মনে গভীর ‘ডিমোরালাইজিং ইফেক্ট’ তৈরি করে। এ খবরটি যেন যুদ্ধের ওই আসন্ন জয়কে ম্লান করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ রেখে সবাই বিচলিত হয়ে বলতে থাকে, ‘কী হলো, আমাদের তাহের ভাইয়ের? সেক্টর কমান্ডারের কী হলো?’
হারুন হাবীব দেখলেন, তার কমান্ডারের বাঁ পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তারপরও তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। হাবীবের উদ্দেশে তাহের বললেন, ‘কই হাবীব, ওরা তো আমার মাথায় আঘাত করতে পারল না। পারল বাঁ পায়ে লাগাতে।’
এরপর তাহের উত্তেজিত হয়ে গেলেন, চিৎকার করে বলতে লাগলেন— ‘সবাই যুদ্ধ থেকে চলে আসছে কেন? গো অ্যান্ড অকুপাই কামালপুর!’ তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না, ওরা পজিশন দেখে ফেলবে। যুদ্ধ চালিয়ে যাও!’
কমান্ডারের সেই মরণপণ নির্দেশের পরেও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েন যে ঘাঁটির ভেতরে আর এগোতে পারেননি কেউ। বিজয়ের ঠিক দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও সে দিন মুক্তিবাহিনীর কামালপুর দখল বিলম্বিত হয়। অথচ স্ট্রেচারে করে যখন তাহেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনো তার মাথায় কেবল যুদ্ধের চিন্তা।
হাসপাতালে পুরোপুরি জ্ঞান ফেরার পর তাহের লেফট্যানেন্ট মান্নানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যা আজও যুদ্ধের ইতিহাসের এক আবেগঘন ও অনুপ্রেরণাদায়ী দলিল হিসেবে স্বীকৃত। তিনি লিখেছিলেন, ‘Clear the road from here to Dacca. Look after my boys. I leave everything to you. God bless you.’ পা হারিয়েও তার জেদ কমেনি, বরং তার রক্তে ভেজা সেই চিঠি এবং তার ফিরে আসার সংবাদ পরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিশোধের স্পৃহাকে বারুদের মতো জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
তাহের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলেন বটে, কিন্তু রেখে গেলেন তার অমোঘ মারণফাঁদ। তার অনুপস্থিতিতেও যুদ্ধ চলল ঠিক তার এঁকে দেওয়া ছক মেনেই। তাহেরের ‘সিজ’ বা অবরোধ কৌশল এতটাই নিখুঁত ছিল যে ২৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী কার্যত কবরের অন্ধকারে দিন কাটাতে থাকে। বাইরে বেরোলেই মৃত্যু, ভেতরে থাকলে অনাহার।
তাহেরের পরিকল্পনা মতোই কামালপুর বিওপি তখন সারা বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তানি ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ সৈন্যরা ক্ষুধার জ্বালায় কলাগাছের শেকড় ও কাঁচা পেঁপে চিবিয়ে খাচ্ছিল। তাদের গোলাবারুদ শেষ, মনোবল চূর্ণ-বিচূর্ণ। তাহের জানতেন, একটি দুর্গ ভাঙতে হলে আগে সেখানকার সৈন্যদের মন ভাঙতে হয়। তিনি শারীরিকভাবে সেখানে ছিলেন না, কিন্তু কামালপুরের প্রতিটি মাইন, প্রতিটি ট্রেঞ্চ, আর প্রতিটি অ্যামবুশ ছিল তার অদৃশ্য উপস্থিতির স্বাক্ষর।
এই যুদ্ধকৌশল, বিশেষ করে ‘অবরোধের মাধ্যমে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি দখল’ আজ সামরিক ইতিহাসে এক ধ্রুপদী উদাহরণ। মেজর তাহের প্রমাণ করেছিলেন, কেবল কামানের গোলা দিয়ে নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ‘অবরোধ কৌশল’ বা ‘Tactics of Siege Warfare’ প্রয়োগ করে কীভাবে একটি সুসজ্জিত বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা যায়। কামালপুর যুদ্ধ তাই কেবল শক্তির লড়াই ছিল না, এটি ছিল সামরিক মেধার এক জীবন্ত পাঠ্যবই।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। টানা ২১ দিনের অবরোধের পর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন আহসান মালিক আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ভারতীয় অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরবক্স সিংয়ের পাঠানো একটি চিঠি বাহক মারফত তার হাতে পৌঁছায়।
চিঠির ভাষা ছিল স্পষ্ট ও চূড়ান্ত— ‘ক্যাপ্টেন মালিক, আপনারা বীরের মতো লড়েছেন। কিন্তু আপনাদের পালানোর সব পথ বন্ধ। জামালপুর বা ঢাকা থেকে কোনো সাহায্য আসবে না। বাঁচার আশা ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করুন। আমরা আপনাদের সৈনিকের মর্যাদা দেবো।’
বিকেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (বীর প্রতীক) ও আনিসুর রহমান সঞ্জু (বীর প্রতীক) সাদা পতাকা হাতে বার্তা নিয়ে গেলেন পাকিস্তানি ক্যাম্পে। যে ক্যাম্পের দিকে তাকালে একসময় মৃত্যু নিশ্চিত ছিল, সেখানে আজ সাদা পতাকার হাহাকার। সন্ধ্যা ৭টায় ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১৬০ জন সৈন্য ও তাদের অফিসাররা বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবনত মস্তকে বেরিয়ে এলো।
এ চূড়ান্ত লড়াইয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুব খানসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হন। ক্যাপ্টেন আহসান মালিক যখন তার পিস্তলটি তুলে দিচ্ছিলেন, সে দৃশ্য দেখার জন্য মেজর তাহের সেখানে ছিলেন না। তিনি তখন হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে ছিল বিজয়ের হাসি। কারণ তিনি জানতেন, এই বিজয় তার মস্তিষ্কের, তার ত্যাগের। তিনি পা হারিয়েছেন, কিন্তু জাতিকে দিয়েছেন ঢাকা বিজয়ের চাবি।
কামালপুরের পতন কেবল একটি বিওপির পতন ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর দম্ভের পতন। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তার ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইয়ে এ বিজয়কে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অন্যতম ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও কামালপুরের পতনের খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়, যা প্রমাণ করে যে ঢাকায় মিত্রবাহিনীর প্রবেশ কেবল সময়ের ব্যাপার।
এ যুদ্ধে ১৯৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন। তাদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত হয়েছিল জামালপুর-ময়মনসিংহের পথ। সে পথ ধরেই পরে মিত্রবাহিনী দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
কামালপুরের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে বারুদের গন্ধ আর শহিদের রক্ত। আজও যদি কেউ কামালপুরের সেই পুরোনো বাংকারগুলোর পাশে দাঁড়ায়, হয়তো বাতাসের কানে কানে শুনতে পাবে বীর উত্তম ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের সেই গর্জন কিংবা বীর উত্তম মেজর তাহেরের সেই আকুতি, ‘রাস্তা পরিষ্কার করো, ঢাকা যেতে হবে।’
এটি কোনো সাধারণ যুদ্ধের গল্প নয়, এটি একটি জাতির জেগে ওঠার এবং নিজের রক্ত দিয়ে মানচিত্র আঁকার এক রক্তাক্ত উপাখ্যান, যেখানে এক পা হারিয়ে এক মহাবীর পথ করে দিয়েছিলেন গোটা একটি দেশের স্বাধীনতার।
তথ্যসূত্র

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। শেষ হয় সামরিক ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী, দীর্ঘস্থায়ী ও মনস্তাত্ত্বিক এক যুদ্ধের আখ্যান, যার নাম ‘ব্যাটল অব কামালপুর’। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটিমাত্র রণাঙ্গন সাক্ষী হয়ে আছে বীরত্বের সর্বোচ্চ নজিরের। কেবল এই একটি যুদ্ধের জন্যই বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২৯টি বীরত্বসূচক পদক দিয়েছে, যা একক কোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ। তাদের মধ্যে রয়েছেন বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধারা, যাদের রক্তে ভেজা কামালপুরের মাটি আজও বহন করে চলেছে এক দগদগে ইতিহাসের ক্ষত।
কামালপুর কেবল একটি বিওপি বা বর্ডার আউটপোস্ট ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের প্রতীক এবং ঢাকা বিজয়ের চাবিকাঠি। এ যুদ্ধের কাহিনি কোনো সাধারণ যুদ্ধের বিবরণ নয়; বারুদ, কাদা, রক্ত ও মানুষের অকল্পনীয় জেদের এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।
জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে একাত্তরের রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল ‘গেটওয়ে টু ঢাকা’ বা ঢাকার প্রবেশদ্বারে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট এখানে গড়ে তুলেছিল দুর্ভেদ্য এক দুর্গ। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই দুর্গ ভেদ করা তো দূরের কথা, এর কাছে ঘেঁষলে মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল লাশ হয়ে ফিরতে হবে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের বিভিন্ন দলিলপত্র ও ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ের ভাষ্যমতে, কামালপুর ছিল এমন এক ডিফেন্সিভ পজিশন যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘মাজিনো লাইন’-এর ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে গণ্য হতে পারে। এখানে মাটির গভীরে কংক্রিট ও রেলওয়ের স্লিপার দিয়ে তৈরি বাংকারগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সাধারণ কামানের গোলা বা মর্টারের আঘাত সেখানে আঁচড়ও কাটতে পারত না। প্রতিটি বাংকার মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ বা কমিউনিকেশন ট্রেঞ্চ দ্বারা একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে যুদ্ধের সময় একজন সেনাকেও মাটির ওপরে মাথা তুলতে হতো না।
আর এই মৃত্যুপুরীর চারপাশ ঘিরে ছিল হাজার হাজার অ্যান্টি-পারসোনাল ও অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন, কাঁটাতারের বেড়া ও তীক্ষ্ণ বাঁশের কঞ্চি। বাংকারের সামনে প্রায় ৫০০ গজ এলাকা পর্যন্ত সব গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছিল, যাকে সামরিক ভাষায় বলা হয় ‘ক্লিয়ারিং জোন’ বা ‘কিলিং জোন’— যেখানে পা দেওয়ামাত্রই মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নিশ্চিত।
এ যুদ্ধ কেবল জুলাই বা ডিসেম্বরের ঘটনা ছিল না, দুর্ভেদ্য এ ঘাঁটিতে আঘাত হানা শুরু হয় জুন মাস থেকেই। ১২ জুন নায়েক সুবেদার সিরাজের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে ১৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা সর্বপ্রথম এখানে গেরিলা আক্রমণ চালান। ঠিক তিন দিন পর, ১৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা রইচ উদ্দিনের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে বকশীগঞ্জ-কামালপুর রোডে মাইন পুঁতে পাকিস্তানি ট্রাক ধ্বংস করা হয়। ২০ জুন হাবিলদার হাকিমের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বেও একটি বড় আক্রমণ পরিচালিত হয়। এই প্রাথমিক গেরিলা আঘাতগুলোই বুঝিয়ে দিয়েছিল সামনে বড় কিছু ঘটতে চলেছে।
জুলাই মাসের শেষ দিক। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে অবিরাম। জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) সিদ্ধান্ত নিলেন কামালপুর আক্রমণের। দায়িত্ব পড়ল ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর, যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী (বীর বিক্রম)।
মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ বই থেকে জানা যায়, এ আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে শুরুতেই ছিল ঘোর দ্বিমত। মেজর মইনুল চেয়েছিলেন গেরিলা কায়দায় ছোট ছোট হিট-অ্যান্ড-রান অপারেশন চালিয়ে শত্রুকে দুর্বল করতে। তিনি জানতেন, কনভেনশনাল বা সম্মুখ যুদ্ধের জন্য তার ছেলেরা পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। কিন্তু হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত সরাসরি আক্রমণের ছকই চূড়ান্ত হয়।
গারো পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্পে কঠোর প্রশিক্ষণ নেওয়া ১, ৩ ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানরা প্রস্তুত হয় এই মরণপণ লড়াইয়ের জন্য। কিন্তু এ আক্রমণ ছিল আত্মঘাতী। মূল আক্রমণের আগে ২৮ জুলাই গভীর রাতে রেকি করতে যান ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), লেফটেন্যান্ট আব্দুল মান্নান (বীর বিক্রম), নায়েক সুবেদার আব্দুল হাই (বীর প্রতীক), সুবেদার আবুল হাশেম ও নায়েক শফি (বীর প্রতীক)।
সেখানে পাকিস্তানি প্যাট্রল পার্টির মুখোমুখি হলে ঘটে এক শ্বাসরুদ্ধকর হাতাহাতি যুদ্ধ। সুবেদার হাই (বীর প্রতীক) রাইফেলের বাঁট দিয়ে এবং লেফটেন্যান্ট মান্নান (বীর বিক্রম) স্টেনগানের ব্যারেল দিয়ে পিটিয়ে শত্রুকে ধরাশায়ী করেন। সে রাতেই ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (বীর উত্তম) ও তার দল পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন।

৩১ জুলাইয়ের সেই রাতটি ছিল যেন কেয়ামতের মতো। শত্রু ঘাঁটির পেছনে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (বীর উত্তম), সম্মুখভাগে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম), পাটক্ষেতে মেজর মইনুল হোসেন (বীর বিক্রম) ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান (বীর উত্তম) এবং একটু দূরের টিলায় মেশিনগানসহ মেজর জিয়া (বীর উত্তম)।
বৃষ্টির পানিতে ওয়্যারলেস সেটগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ায় আক্রমণের নির্ধারিত সময়ে চরম সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। মেজর মইনুল তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাই ছিল সেই রাতের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ঠিক সে সময়েই পাকিস্তানি আর্টিলারি গর্জে ওঠে।
একদিকে প্রবল বৃষ্টি, পিচ্ছিল কাদা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার; অন্যদিকে এক কোম্পানির সঙ্গে আরেক কোম্পানির যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন— অন্ধকারে নিজেদের সেনাদের পায়ের শব্দ আর কামানের গর্জনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। কাদায় পা আটকে যাচ্ছে, সামনে মাইনফিল্ড বিস্ফোরিত হচ্ছে, আর ওপর থেকে বৃষ্টির মতো ঝরছে মেশিনগানের গুলি। এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে সদ্য রিক্রুট হওয়া তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ইতিহাসের পাতায় জন্ম নেন এক অতিমানব, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)। যখন সবাই পিছু হটছিল, মৃত্যুর ভয় যখন গ্রাস করছিল সবাইকে, তখন মাইনফিল্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডমাইক হাতে গর্জে ওঠেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)। পাকিস্তানি বাংকার লক্ষ্য করে তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘আভি তক ওয়াক্ত হ্যায়, শালালোক সারেন্ডার করো, নেহিত জিন্দা নেহি ছোড়েঙ্গা! ইয়াহিয়া খান এখনো এমন বুলেট তৈরি করতে পারে নাই যা মমতাজকে ভেদ করবে!’
তার এই হুংকার বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ধমনীতে। ভয় কেটে যায় মুহূর্তেই। এক হাত মাইনের আঘাতে উড়ে যাওয়ার পরও থামেননি নায়েক শফি (বীর প্রতীক)। যুদ্ধের ঠিক এই ভয়াবহ মুহূর্তে সম্মুখভাগে থাকা বীর বিক্রম ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (পরে মেজর) গলায় গুলিবিদ্ধ হন। বুলেটটি তার গলার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
মৃত্যুশয্যায় থাকা অধিনায়ককে বাঁচাতে নিজের জীবন তুচ্ছ করে ছুটে যান তার রানার নায়েক রবিউল (বীর প্রতীক)। ক্যাপ্টেন হাফিজকে কাঁধে তুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পথেই শত্রুর গুলিতে শাহাদত বরণ করেন।
এদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংকারের ওপর। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গ্রেনেড ছুড়ে তারা তছনছ করে দিতে থাকে পাকিস্তানি ডিফেন্স। সালাহউদ্দিন মমতাজ নিজে স্টেনগান হাতে বাংকারের ভেতরে ঢুকে পড়েন।
যুদ্ধের এ উন্মাদনার মধ্যেই ঘটে ট্র্যাজেডি। একের পর এক গুলি এসে বিদ্ধ করে তাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে তিনি তার সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে শেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমার কলেমা পড়ার দরকার নেই, আমার কলেমা আগেই হয়ে গেছে। খোদার কসম, যে পেছনে হটবি তাকেই গুলি করব। মরতে যদি হয় দেশের মাটিতে মর, এদের মেরে তারপর মর।’
সালাহউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম) ফিরে আসেননি, তার লাশটিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন লড়াইয়ের বারুদ। মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষের তথ্যমতে, এ রাতে প্রায় ৩৫ জন, কিছু কিছু দলিলপত্র অনুযায়ী ৩০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। জীবন দিলেও তারা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙালিরা কেবল গেরিলা যুদ্ধ নয়, সম্মুখ সমরেও মৃত্যুকে ভৃত্য বানাতে জানে।
আগস্ট মাসে ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে আসেন এক ধূমকেতু, বীর উত্তম মেজর আবু তাহের (পরে কর্নেল), সামরিক একাডেমিগুলোতে আজও যার যুদ্ধকৌশল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তাহের কেবল একজন কমান্ডার ছিলেন না, ছিলেন যুদ্ধের এক নিখুঁত শিল্পী। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তিনি ছিলেন ‘এলিট স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ’ (এসএসজি) বা ব্ল্যাক কমান্ডো অফিসার। কামালপুর তার কাছে কেবল একটি শত্রুঘাঁটি ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল তার ব্যক্তিগত জেদ, এক প্রকার উন্মাদনা।
মেজর তাহের বিশ্বাস করতেন, কামালপুরের পতন ঘটাতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙে যাবে। তিনি জানতেন, এ দুর্গ ভাঙা মানেই ঢাকা যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার। তাহের গতানুগতিক যুদ্ধের কৌশল আমূল বদলে ফেললেন। তিনি বুঝলেন, কামালপুরের মতো দুর্গে সরাসরি আক্রমণ মানেই আত্মহত্যা। তাই তিনি প্রয়োগ করলেন তার মস্তিষ্কপ্রসূত এক মারণঘাতী ছক— ‘ইনফিলট্রেশন অ্যান্ড সিজ’ বা অনুপ্রবেশ ও অবরোধ।
মেজর তাহের তার বাহিনীকে আদেশ দিলেন কামালপুরকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করতে। বকশীগঞ্জ থেকে রসদ আসার রাস্তাগুলোতে রাতের আঁধারে মাইন পুঁতে রাখা হলো, প্রতিটি মোড়ে বসানো হলো ‘কাট-অফ পার্টি’। মুক্তিযোদ্ধারা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, যেন কেউ ওই পথে গেলেই আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। ঢাকা থেকে শেরপুর বা জামালপুর শহরে যেতে না পারায় এবং কোনো ধরনের সরবরাহ না পাওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়ে কামালপুরের পাকিস্তানি সৈন্যরা।
তাহেরের প্ল্যান ছিল পরিষ্কার শত্রুকে কামানের গোলায় না মেরে ভাতে মারতে হবে, ভয়ে মারতে হবে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তিনি তার ছেলেদের দিয়ে ছোট ছোট ‘হ্যারাসিং ফায়ার’ বা আচমকা গুলি ছুড়াতেন। জ্ঞানকোষের তথ্য অনুযায়ী, তাহেরের এ কৌশলের অংশ হিসেবে ২৮ আগস্ট, ৬ সেপ্টেম্বর ও ১০ সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের শেষ সপ্তাহেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, যেখানে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ খান (বীর প্রতীক) ও লেফটেন্যান্ট মান্নানের (বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার পরিচয় দেন। তাহেরের উদ্দেশ্য ছিল একটাই— পাকিস্তানিদের এক মুহূর্তও ঘুমাতে না দেওয়া। তিনি চেয়েছিলেন ওরা যেন ক্লান্তিতে, অনিদ্রায় আর আতঙ্কে পাগল হয়ে যায়।
যুদ্ধের তীব্রতা যখন চরমে, তখন কামালপুর ঘাঁটির ভেতরে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থা শোচনীয়। তাদের ওয়্যারলেস সেটগুলো তখন কেবল হতাশার বার্তা পাঠাচ্ছিল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় সিগন্যাল কোরে ধরা পড়া একটি রেডিও ইন্টারসেপ্ট থেকে জানা যায় কামালপুরের ভেতরের হাহাকার।
কামালপুর পোস্টের কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক মরিয়া হয়ে হেডকোয়ার্টার ৯৩ ব্রিগেডের কাছে বার্তা পাঠান— ‘হ্যালো, এইচকিউ। আমাদের রসদ শেষ। ওষুধ নেই। আহতরা কাতরাচ্ছে। এয়ার সাপোর্ট পাঠাও, অথবা আমাদের পিছু হটার অনুমতি দাও। ওভার।’
ও পাশ থেকে জামালপুর হেডকোয়ার্টারের উত্তর ছিল নির্মম এবং যান্ত্রিক— ‘হোল্ড অন। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাও। রিইনফোর্সমেন্ট পাঠানো সম্ভব নয়। ওভার অ্যান্ড আউট।’
এই একটি বার্তাই বলে দেয়, পাকিস্তান হাইকমান্ড কামালপুরকে ‘ডেথ ট্র্যাপ’ জেনেও তাদের সৈন্যদের মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখেছিল। বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আহসান মালিকের সেনারা তখন বুঝতে পারছিল, তাদের পিঠ কেবল দেয়ালে ঠেকেনি, দেয়ালটাই ভেঙে পড়ছে।
১৪ নভেম্বর। শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাসের আখ্যানে দিনটি উঠে এসেছে এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজেডি হিসেবে। দিনটি ছিল মেজর তাহেরের ৩৩তম জন্মদিন। তাহের তার সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ আমার জন্মদিন। তোরা আমাকে কী দিবি? আমি কামালপুর চাই। আজই কামালপুর পতন ঘটাতে হবে।’
তাহের তার জন্মদিনের উপহার হিসেবে চাইলেন কামালপুরের পতন। আবারও চূড়ান্ত আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলো। ঐতিহাসিক এ অপারেশনে মেজর তাহেরের কোডনেম নির্ধারণ করা হয় ‘কর্তা’। হারুন হাবীব তার ‘জনযুদ্ধ ৭১’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মূলত ১৩ নভেম্বর রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, কামালপুর বিওপির উত্তর দিকের কিছু বাংকার পাকিস্তানিরা পরিত্যাগ করেছে। সে সুযোগটি কাজে লাগাতেই মেজর তাহের ঝটিকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।
ভারতীয় আর্টিলারি ব্রিগেডিয়ার ক্লের সহায়তায় শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। মেজর তাহের কেবল নির্দেশ দিয়ে তাঁবুতে বসে থাকার লোক ছিলেন না, তিনি জানতেন, কমান্ডারের সশরীরে উপস্থিতি সৈন্যদের শিরায় আগুন ধরিয়ে দেয়। তাই তিনি জিপ নিরাপদ দূরত্বে রেখে পায়ে চলে গেলেন ফ্রন্টলাইনের একদম সামনে, একেবারে ফরোয়ার্ড পজিশনে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব তার লেখনীতে জানিয়েছেন, সে রাতে তিনিও মেজর তাহেরের সঙ্গে একই ট্রেঞ্চে অবস্থান করছিলেন। ভোর ৩টা ৪৫ মিনিটে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ১৩ গার্ডস রেজিমেন্ট যখন নিখুঁত নিশানায় আর্টিলারি ফায়ারিং বা গোলাবর্ষণ শুরু করে, সেই দৃশ্য দেখে মেজর তাহের শিশুদের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই গোলার আঘাতেই শত্রুর মনোবল ভেঙে যাবে।
সকালের দিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন বাংকার ছেড়ে ভেতরে সরে যেতে থাকে, মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে পারেন বিজয় আসন্ন। কিন্তু ঠিক সেই চরম মুহূর্তে, সকাল ৯টার দিকে ট্রেঞ্চের খুব কাছেই একটি মর্টারের গোলা বা মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে তাহেরের বাম পা শরীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তাহেরের সঙ্গে ছিলেন তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক)। গোলার আঘাতে তাহের যখন লুটিয়ে পড়েন বেলালের গায়ের ওপর, তখন বিচ্ছিন্ন পা আর রক্তের স্রোত দেখে বেলাল ধরে নিয়েছিলেন তার ভাই আর বেঁচে নেই। তীব্র শোক আর আতঙ্কে বেলাল তৎক্ষণাৎ ওয়্যারলেসে আর্তনাদ করে বার্তা পাঠান, ‘কর্তা ইজ ডেড’।
মুহূর্তের মধ্যে এ দুঃসংবাদ ইথারে ভেসে বেড়াতে থাকে। চারদিকে হাহাকার পড়ে যায়। পরে অবশ্য জানা যায় তিনি শহিদ হননি, আহত হয়েছেন। সে রণাঙ্গনের অন্যতম যোদ্ধা হারুন হাবীবের ভাষায়, কমান্ডারের আহত হওয়ার ওই খবর এবং ‘কর্তা ইজ ডেড’ বার্তাটি যোদ্ধাদের মনে গভীর ‘ডিমোরালাইজিং ইফেক্ট’ তৈরি করে। এ খবরটি যেন যুদ্ধের ওই আসন্ন জয়কে ম্লান করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ রেখে সবাই বিচলিত হয়ে বলতে থাকে, ‘কী হলো, আমাদের তাহের ভাইয়ের? সেক্টর কমান্ডারের কী হলো?’
হারুন হাবীব দেখলেন, তার কমান্ডারের বাঁ পা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তারপরও তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। হাবীবের উদ্দেশে তাহের বললেন, ‘কই হাবীব, ওরা তো আমার মাথায় আঘাত করতে পারল না। পারল বাঁ পায়ে লাগাতে।’
এরপর তাহের উত্তেজিত হয়ে গেলেন, চিৎকার করে বলতে লাগলেন— ‘সবাই যুদ্ধ থেকে চলে আসছে কেন? গো অ্যান্ড অকুপাই কামালপুর!’ তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না, ওরা পজিশন দেখে ফেলবে। যুদ্ধ চালিয়ে যাও!’
কমান্ডারের সেই মরণপণ নির্দেশের পরেও মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েন যে ঘাঁটির ভেতরে আর এগোতে পারেননি কেউ। বিজয়ের ঠিক দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও সে দিন মুক্তিবাহিনীর কামালপুর দখল বিলম্বিত হয়। অথচ স্ট্রেচারে করে যখন তাহেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনো তার মাথায় কেবল যুদ্ধের চিন্তা।
হাসপাতালে পুরোপুরি জ্ঞান ফেরার পর তাহের লেফট্যানেন্ট মান্নানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যা আজও যুদ্ধের ইতিহাসের এক আবেগঘন ও অনুপ্রেরণাদায়ী দলিল হিসেবে স্বীকৃত। তিনি লিখেছিলেন, ‘Clear the road from here to Dacca. Look after my boys. I leave everything to you. God bless you.’ পা হারিয়েও তার জেদ কমেনি, বরং তার রক্তে ভেজা সেই চিঠি এবং তার ফিরে আসার সংবাদ পরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিশোধের স্পৃহাকে বারুদের মতো জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
তাহের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গেলেন বটে, কিন্তু রেখে গেলেন তার অমোঘ মারণফাঁদ। তার অনুপস্থিতিতেও যুদ্ধ চলল ঠিক তার এঁকে দেওয়া ছক মেনেই। তাহেরের ‘সিজ’ বা অবরোধ কৌশল এতটাই নিখুঁত ছিল যে ২৪ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী কার্যত কবরের অন্ধকারে দিন কাটাতে থাকে। বাইরে বেরোলেই মৃত্যু, ভেতরে থাকলে অনাহার।
তাহেরের পরিকল্পনা মতোই কামালপুর বিওপি তখন সারা বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। পাকিস্তানি ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ সৈন্যরা ক্ষুধার জ্বালায় কলাগাছের শেকড় ও কাঁচা পেঁপে চিবিয়ে খাচ্ছিল। তাদের গোলাবারুদ শেষ, মনোবল চূর্ণ-বিচূর্ণ। তাহের জানতেন, একটি দুর্গ ভাঙতে হলে আগে সেখানকার সৈন্যদের মন ভাঙতে হয়। তিনি শারীরিকভাবে সেখানে ছিলেন না, কিন্তু কামালপুরের প্রতিটি মাইন, প্রতিটি ট্রেঞ্চ, আর প্রতিটি অ্যামবুশ ছিল তার অদৃশ্য উপস্থিতির স্বাক্ষর।
এই যুদ্ধকৌশল, বিশেষ করে ‘অবরোধের মাধ্যমে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি দখল’ আজ সামরিক ইতিহাসে এক ধ্রুপদী উদাহরণ। মেজর তাহের প্রমাণ করেছিলেন, কেবল কামানের গোলা দিয়ে নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ‘অবরোধ কৌশল’ বা ‘Tactics of Siege Warfare’ প্রয়োগ করে কীভাবে একটি সুসজ্জিত বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা যায়। কামালপুর যুদ্ধ তাই কেবল শক্তির লড়াই ছিল না, এটি ছিল সামরিক মেধার এক জীবন্ত পাঠ্যবই।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। টানা ২১ দিনের অবরোধের পর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন আহসান মালিক আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলেন। ভারতীয় অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরবক্স সিংয়ের পাঠানো একটি চিঠি বাহক মারফত তার হাতে পৌঁছায়।
চিঠির ভাষা ছিল স্পষ্ট ও চূড়ান্ত— ‘ক্যাপ্টেন মালিক, আপনারা বীরের মতো লড়েছেন। কিন্তু আপনাদের পালানোর সব পথ বন্ধ। জামালপুর বা ঢাকা থেকে কোনো সাহায্য আসবে না। বাঁচার আশা ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করুন। আমরা আপনাদের সৈনিকের মর্যাদা দেবো।’
বিকেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (বীর প্রতীক) ও আনিসুর রহমান সঞ্জু (বীর প্রতীক) সাদা পতাকা হাতে বার্তা নিয়ে গেলেন পাকিস্তানি ক্যাম্পে। যে ক্যাম্পের দিকে তাকালে একসময় মৃত্যু নিশ্চিত ছিল, সেখানে আজ সাদা পতাকার হাহাকার। সন্ধ্যা ৭টায় ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১৬০ জন সৈন্য ও তাদের অফিসাররা বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবনত মস্তকে বেরিয়ে এলো।
এ চূড়ান্ত লড়াইয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুব খানসহ বেশ কয়েকজন হতাহত হন। ক্যাপ্টেন আহসান মালিক যখন তার পিস্তলটি তুলে দিচ্ছিলেন, সে দৃশ্য দেখার জন্য মেজর তাহের সেখানে ছিলেন না। তিনি তখন হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে ছিল বিজয়ের হাসি। কারণ তিনি জানতেন, এই বিজয় তার মস্তিষ্কের, তার ত্যাগের। তিনি পা হারিয়েছেন, কিন্তু জাতিকে দিয়েছেন ঢাকা বিজয়ের চাবি।
কামালপুরের পতন কেবল একটি বিওপির পতন ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর দম্ভের পতন। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তার ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইয়ে এ বিজয়কে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অন্যতম ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একই সঙ্গে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও কামালপুরের পতনের খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়, যা প্রমাণ করে যে ঢাকায় মিত্রবাহিনীর প্রবেশ কেবল সময়ের ব্যাপার।
এ যুদ্ধে ১৯৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন। তাদের রক্তের বিনিময়ে মুক্ত হয়েছিল জামালপুর-ময়মনসিংহের পথ। সে পথ ধরেই পরে মিত্রবাহিনী দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
কামালপুরের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে বারুদের গন্ধ আর শহিদের রক্ত। আজও যদি কেউ কামালপুরের সেই পুরোনো বাংকারগুলোর পাশে দাঁড়ায়, হয়তো বাতাসের কানে কানে শুনতে পাবে বীর উত্তম ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজের সেই গর্জন কিংবা বীর উত্তম মেজর তাহেরের সেই আকুতি, ‘রাস্তা পরিষ্কার করো, ঢাকা যেতে হবে।’
এটি কোনো সাধারণ যুদ্ধের গল্প নয়, এটি একটি জাতির জেগে ওঠার এবং নিজের রক্ত দিয়ে মানচিত্র আঁকার এক রক্তাক্ত উপাখ্যান, যেখানে এক পা হারিয়ে এক মহাবীর পথ করে দিয়েছিলেন গোটা একটি দেশের স্বাধীনতার।
তথ্যসূত্র

কয়েকদিন ধরেই ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু নিয়ে গভীর ধোঁয়াশা। গভীর সংকটে ধর্মেন্দ্র, নাকি সত্যিই মৃত্যু হয়েছে মেগাস্টারের? কিছুদিন আগেই খবর ছড়ায়- মৃত্যু হয়েছে অভিনেতার। তবে সেই খবর সত্যি নয় বলে দাবি করেছিলেন হেমা মালিনী ও এষা দেওল।
১০ দিন আগে
এমন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত—কী করা উচিত না তা নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একগুচ্ছ পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত।
১২ দিন আগে
ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ, হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এ ঘটনায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেছেন মডেল ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী এবং তার ভাই আলিসান চৌধুরী।
১৮ দিন আগে
ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। এই অভিনেত্রী ও তার ভাই আলিসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার একটি আদালত। পারিবারিক ব্যবসার পার্টনার হিসেবে রাখার বিনিময়ে ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ, হুমকি-ধামকি এবং ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে করা মামলায় এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
১৮ দিন আগে