উত্তরে চীন, দক্ষিণে আমেরিকা— ইয়াহিয়ার ‘গালগপ্পো’ আর রূপসায় স্বজনের গোলা!

নাজমুল ইসলাম হৃদয়

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর। একদিকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বাঙালির বাঁধভাঙা উল্লাস, অন্যদিকে খুলনা রণাঙ্গনে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে এক সূর্যসন্তানের করুণ মৃত্যু। এর মধ্যে এ দিনেই পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের ‘কফিন’ তৈরির কাজ কার্যত শেষ হয়ে যায়। বাকি ছিল শুধু শেষ পেরেকটি ঠোকা।

ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়ে যায়। উত্তরে ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে ছুটছে, পূর্বে মেঘনা পাড় হয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিশাল বহর, আর পশ্চিমে পদ্মার পাড়ে চলছে তুমুল প্রস্তুতি।

এই নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়েও পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলরা ‘মিলিটারি ব্লাফে’র নামে এক জঘন্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বারবার বার্তা পাঠানো হচ্ছিল, ‘উত্তরের হলুদ বন্ধু (চীন) ও দক্ষিণের সাদা বন্ধু (আমেরিকা) সাহায্য নিয়ে আসছে, তোমরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকো।’ এ মিথ্যা আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানি বাহিনী তখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, যদিও তাদের পায়ের নিচের মাটি অনেক আগেই সরে গেছে।

১০ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন, যেদিন খুলনার রূপসা নদীতে মিত্রবাহিনীর ভুলে বা ‘কমিউনিকেশন গ্যাপে’র কারণে ধ্বংস হয় স্বাধীন বাংলার গানবোট ‘পলাশ’, জন্ম নেয় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের অমর ও শোকাবহ গাঁথা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নোংরা খেলা, জেনারেলদের মিথ্যাচার আর স্বজনের গোলায় শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১০ ডিসেম্বর দিনটি ইতিহাসের পাতায় এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে আছে।

এ দিন সকাল শুরু হয় ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার আনন্দ সংবাদ দিয়ে। আগের দিন জামালপুরে পাকিস্তানি ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ভয়াবহ পতনের পর ময়মনসিংহ রক্ষা করা তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’ ও মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী, ১০ ডিসেম্বর ভোরেই পাকিস্তানি বাহিনী ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে টাঙ্গাইলের দিকে পালাতে শুরু করে।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকায় গিয়ে ‘ফোর্ট্রেস ঢাকা’র প্রতিরক্ষায় যোগ দেওয়া। কিন্তু তাদের এই পলায়নও নির্বিঘ্ন ছিল না। পালানোর সময় তারা ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর শম্ভুগঞ্জ ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, যেন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধাওয়া করতে না পারে। তবে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতিরোধের মুখে তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেনি।

১০ ডিসেম্বর সকালে হাজার হাজার মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে। ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, কারণ এর ফলে ঢাকা প্রবেশের উত্তরাঞ্চলীয় দরজা বা ‘নর্দান গেট’ পুরোপুরি খুলে যায়। এ দিনই ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজে ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। শহরবাসী তখন রাস্তায় নেমে তাদের মুক্তিদাতাদের জড়িয়ে ধরছিল, আর ওদিকে পলায়নপর পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইলের পথে কাদেরিয়া বাহিনীর পাতা নতুন ফাঁদে পা দিচ্ছিল।

উত্তরে যখন বিজয়ের উল্লাস, তখন দক্ষিণের খুলনা রণাঙ্গনে ১০ ডিসেম্বর ঘটেছিল এক হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিশাল ক্ষত হয়ে আছে। এ দিনেই বাংলাদেশ হারায় তার নৌ কমান্ডো ও সূর্যসন্তান, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিনকে।

মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ ও ভারতীয় নৌ বাহিনীর দলিল ‘ট্রানজিশন টু ট্রায়াম্ফ’ থেকে জানা যায়, ১০ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর গানবোট ‘আইএনএস পানভেলে’র নেতৃত্বে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর গানবোট ‘পলাশ’ ও ‘পদ্মা’ মোংলা বন্দর থেকে খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল খুলনা শিপইয়ার্ড ও ঘাঁটি দখল করা।

রূপসা নদীতে ঢোকার মুখে বহরটি এক অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির শিকার হয়। আকাশে টহলরত ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনটি ন্যাট (Gnat) বিমান ভুলবশত নিজেদের পক্ষের গানবোট চিনতে না পেরে সেগুলোকে পাকিস্তানি জাহাজ মনে করে ডাইভ দেয়।

ভারতীয় নৌ কমান্ডো অভিযানের অন্যতম অধিনায়ক ও সেই বহরে থাকা ‘আইএনএস পানভেলে’র কমান্ডার এম এন সামন্ত তার লেখা ‘অপারেশন এক্স’ বইয়ে এ ভুলের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। লিখেছেন, জাহাজের ছাদে হলুদ কাপড় বিছিয়ে সংকেত দেওয়া হচ্ছিল যে তারা মিত্রপক্ষ। কিন্তু ভারতীয় পাইলটরা হয়তো ওপর থেকে তা খেয়াল করেননি অথবা সেটিকে পাকিস্তানি ধোঁকা বা ‘ডিকয়’ ভেবেছিলেন।

কমান্ডার সামন্ত পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে দেখেন যে তিনি তার নিজের জাহাজের গানারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ভারতীয় বিমানগুলোর দিকেই গুলি ছুড়তে, যেন তারা ভয় পেয়ে চলে যায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বিমানের বোমাবর্ষণে ‘পলাশ’ গানবোটটিতে আগুন ধরে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে।

ইঞ্জিনরুমের আর্টিফিসার রুহুল আমিন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা জাহাজে থেকেও নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি আহত অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পাড়ে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু রূপসা নদীর পাড়ে আগে থেকেই ওঁৎ পেতে ছিল পাকিস্তানি সহযোগী রাজাকার ও আল-বদর বাহিনী।

ক্লান্ত ও আহত রুহুল আমিন যখন পাড়ে ওঠেন, তখন এই দেশীয় নরপিশাচরা তাকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। মিত্রবাহিনীর সমন্বয়হীনতা ও রাজাকারদের পৈশাচিকতায় বিজয়ের মাত্র ছয় দিন আগে নিভে যায় এই বীরের জীবনপ্রদীপ। ১০ ডিসেম্বর খুলনার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল এক বীরশ্রেষ্ঠর রক্তে।

রণাঙ্গনের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পাশাপাশি ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও পাকিস্তানি হাইকমান্ডের অন্দরমহলে চলছিল এক স্নায়ুক্ষয়ী নাটক। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। জেনারেল নিয়াজি ও তার অফিসাররা তখন অনেকটা নেশাগ্রস্তের মতো আচরণ করছিলেন— বাস্তবতা অস্বীকার করার নেশা।

রাওয়ালপিন্ডি থেকে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান এ দিন নিয়াজিকে এক তারবার্তায় বলেন, ‘চিন্তা করো না, সপ্তম নৌ বহর খুব কাছেই এবং চীনও সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে। তোমরা শুধু আর ২৪ ঘণ্টা টিকে থাকো।’ এ বার্তাটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ধোঁকাবাজি।

মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ অনুযায়ী, চীন তখন সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছাই পোষণ করছিল না এবং মার্কিন সপ্তম নৌ বহর তখনো বঙ্গোপসাগর থেকে হাজার মাইল দূরে মালাক্কা প্রণালীর কাছে। কিন্তু এ মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল।

জেনারেল রাও ফরমান আলী, যিনি আগের দিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এবং ইয়াহিয়া কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, তিনি ১০ ডিসেম্বর চুপচাপ বসে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তান তাদের ‘বলির পাঁঠা’ বানাচ্ছে।

এ দিনেই রাও ফরমান আলী আল-বদর বাহিনীর নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। তারা জানতেন, তাদের সময় শেষ। তাই তারা চেয়েছিলেন জাতির মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করতে। ১০ ডিসেম্বরের এই গোপন ষড়যন্ত্রই ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

অবরুদ্ধ ঢাকার জনজীবনে ১০ ডিসেম্বর ছিল এক চরম অনিশ্চয়তা ও গুজবের দিন। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে এই দিনের যে বর্ণনা দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘আজ ১০ ডিসেম্বর। শুক্রবার। জুম্মাবার। আজ নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। শোনা যাচ্ছে ভারতীয় বাহিনী নাকি ঢাকার খুব কাছে এসে পড়েছে। কিন্তু রেডিও পাকিস্তান সমানে চিৎকার করছে যে তারা সব ফ্রন্টে জিতছে। এদিকে পাড়ার বিহারীরা হঠাৎ খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। তাদের চোখেমুখে একটা ভয়ের ছায়া। রুমি নেই, কিন্তু রুমির বন্ধুরা নিশ্চয়ই এখন ঢাকার গেটে।’

জাহানারা ইমামের লেখায় স্পষ্ট, ঢাকার সাধারণ মানুষ তখন দুই ভাগে বিভক্ত— একদল ভয়ে কাঁপছে (রাজাকার ও পাকিস্তানিরা), আর অন্যদল গোপনে বিজয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১০ ডিসেম্বর ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে ‘নিউট্রাল জোন’ বা নিরপেক্ষ এলাকা ঘোষণা করা হয়। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও জাতিসংঘের কর্মীরা সেখানে আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বুঝতে পারছিলেন, গভর্নর হাউজ বা ক্যান্টনমেন্ট আর নিরাপদ নয়। তাই তারা অনেকেই বেসামরিক পোশাকে পালানোর পথ খুঁজছিলেন।

ঢাকার আকাশে এ দিন মিত্রবাহিনীর মিগ ও সুখোই বিমানগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর কোনো অস্তিত্বই আর আকাশে ছিল না। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিশাল বিশাল গর্ত, যা মেরামত করার মতো জনবলও পাকিস্তানিদের ছিল না।

মেঘনা পাড়ের রণাঙ্গনে ১০ ডিসেম্বর ছিল মিত্রবাহিনীর এগিয়ে যাওয়ার দিন। আগের দিন হেলিকপ্টারে করে মেঘনা পার হওয়া সৈন্যরা ১০ ডিসেম্বর নরসিংদী ও রায়পুরা এলাকায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করে বা ‘কনসোলিডেট’ করে। তারা স্থানীয় জনগণের সহায়তায় ভারী কামান ও আর্টিলারি সামনে নিয়ে আসতে শুরু করে।

মেজর জেনারেল সগত সিং এদিন ভৈরব বাজারে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর দিকে আর নজর না দিয়ে সোজা ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। এ কৌশলটি ছিল দুর্দান্ত। ভৈরবে থাকা হাজার হাজার পাকিস্তানি সৈন্য কার্যত যুদ্ধের বাইরে চলে যায়। কারণ তারা না পারছে সামনে এগোতে, না পারছে পিছু হটতে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ভৈরব ও আশুগঞ্জের চারপাশ ঘিরে রেখেছিল।

১০ ডিসেম্বর নরসিংদীর সাধারণ মানুষ মিত্রবাহিনীকে স্বাগত জানায় এবং তাদের খাদ্য ও রসদ দিয়ে সাহায্য করে। ঢাকার দিকে অগ্রসরমান এ বিশাল বাহিনীকে ঠেকানোর মতো কোনো শক্তি তখন আর পাকিস্তানিদের ছিল না। লাখ লাখ বাংকার খুঁড়েও তারা জনরোষ থেকে বাঁচতে পারছিল না।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর ফ্রন্টেও ১০ ডিসেম্বর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। কুষ্টিয়া পতনের পর পাকিস্তানি বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হয়ে পাবনার দিকে ও কিছু অংশ গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে পালিয়ে যায়।

১০ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী মধুমতি নদী অতিক্রম করার প্রস্তুতি নেয়। মেজর জেনারেল ডি কে পালিতের ‘দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন’ বইতে উল্লেখ আছে, মধুমতি নদী পার হওয়াটা ছিল ঢাকার দিকে এগোনোর শেষ বড় বাধা। স্থানীয় জনগণ এখানেও নৌকা ও ভেলা দিয়ে মিত্রবাহিনীকে নদী পার হতে সাহায্য করে। ফরিদপুরের দিকে অগ্রসরমান যৌথ বাহিনীর চাপে পাকিস্তানিরা পিছু হটতে থাকে।

যশোর রোড দিয়ে তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর শত শত ট্রাক ও সাঁজোয়া যান ঢাকার দিকে আসছিল। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্বাগত জানাচ্ছিল।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ফের উত্তপ্ত বিতর্ক হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার ধুয়া তুলে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কোনো সমাধান চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।

১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের এ ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের বিজয়ের পথকে আরও সুগম করে দেয়। কারণ যুদ্ধবিরতি হলে পাকিস্তানি বাহিনী পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেত। সোভিয়েত ভেটোর কারণে মিত্রবাহিনী তাদের অভিযান শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু পেয়ে যায়। হেনরি কিসিঞ্জার তখন ওয়াশিংটনে বসে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন, কিন্তু রণাঙ্গনের বাস্তবতা ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

তথ্যসূত্র

  • একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম;
  • উইটনেস টু সারেন্ডার (Witness to Surrender) – ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক;
  • মূলধারা ’৭১ – মঈদুল হাসান;
  • লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম;
  • অপারেশন এক্স (Operation X) – ক্যাপ্টেন এম. এন. সামন্ত ও সন্দীপ উন্নিথান;
  • ট্রানজিশন টু ট্রায়াম্ফ (Transition to Triumph) – ভারতীয় নৌবাহিনীর ইতিহাস;
  • মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম;
  • এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম;
  • দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign) – মেজর জেনারেল ডি কে পালিত;
  • বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ – এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ;
  • সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা (Surrender at Dacca) – লেফট্যানেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব;
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড);
  • একাত্তরের রণাঙ্গন – শামসুল হুদা চৌধুরী
ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

‘মানচিত্রে নতুন দেশ’— চূর্ণ দখলদার বাহিনীর মেরুদণ্ড

এদিন বিশ্ব মানচিত্রে প্রথমবারের মতো একটি নতুন রাষ্ট্রের নাম খোদাই করা হলো, ‘বাংলাদেশ’। একদিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তানের মিথ্যাচারের ফানুস ফুটো হয়ে গেল, অন্যদিকে রণাঙ্গনে ভেঙে পড়ল তাদের অহংকারের প্রতীক ‘যশোর ক্যান্টনমেন্ট’।

৪ দিন আগে

খালেদা জিয়ার জন্য আসছে জার্মান এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, কী আছে তাতে

খালেদা জিয়ার জন্য কাতার আমিরের একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় পাঠানোর কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে শেষ মুহূর্তে তা সম্ভব হয়নি। এর বদলে কাতারই জার্মানির একটি প্রাইভেট এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে।

৫ দিন আগে

বিজয়ের মাসে ৩১টি যাত্রাপালা দেখাবে শিল্পকলা একাডেমি

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসব পরিণত হয়েছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির এক অনন্য মিলনমেলায়।

৫ দিন আগে

‘পাকিস্তান আজ মৃত’— এক ভেটো ও আকাশজয়ের আখ্যান

পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কামাল ও তার সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশনের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।

৫ দিন আগে