
নাজমুল ইসলাম হৃদয়

একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চূড়ান্ত এক সন্ধিক্ষণ, যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দীর্ঘ ৯ মাসের সাজানো ‘রণকৌশল’ বা ‘ওয়ার স্ট্র্যাটেজি’ বাংলার নদী, মাটি ও মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। রণাঙ্গনের প্রতিটি প্রান্তে, মেঘনার উত্তাল ঢেউ থেকে শুরু করে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদের তীর, কুষ্টিয়ার সমতল ভূমি থেকে শুরু করে উপকূলীয় বদ্বীপ— সবখানেই হানাদার বাহিনীর জন্য রচিত হয়েছিল এক অনিবার্য মৃত্যুফাঁদ।
পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের তথাকথিত ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশলের ওপর যে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছিল, তা তখন অন্ধের মতোই তাদের হোঁচট খাওয়াচ্ছিল। একদিকে বিশ্বরাজনীতির দাবার বোর্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে বাংলার সাধারণ মাঝিমাল্লা আর কৃষকরা হেলিকপ্টার থেকে নামা মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের পথ দেখিয়ে সেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছিল।
৯ ডিসেম্বরের সকাল শুরু হয় মেঘনা নদীর তীরে এক বিস্ময়কর সামরিক অধ্যায় দিয়ে, যা পরে ‘দ্য গ্রেট মেঘনা হেলি-ব্রিজ’ অপারেশন নামে সামরিক ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাতছাড়া হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরব বাজারে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। আশুগঞ্জ ও ভৈরবের সংযোগকারী রাজা ষষ্ঠ জর্জ রেলসেতুটির (বর্তমান ভৈরব সেতু) একটি বিশাল অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
মেঘনা নদী এখানে প্রায় চার হাজার গজ চওড়া ও স্রোতস্বিনী। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজি ও তার উপদেষ্টারা নিশ্চিত ছিলেন, সেতু ছাড়া এই বিশাল নদী পার হয়ে ভারী কামান, ট্যাংক ও হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া মিত্রবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব। তারা হিসাব করেছিলেন, নদী পার হতে যৌথ বাহিনীর অন্তত দুই সপ্তাহ লাগবে।
কিন্তু ৯ ডিসেম্বর মেঘনা পাড়ে যা ঘটল, তা ছিল প্রচলিত যুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মিত্রবাহিনীর জেনারেল সগত সিং ও সেক্টর কমান্ডাররা এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেন। নদী পাড়ি দেওয়া হবে আকাশপথে!
ভারতীয় বিমান বাহিনীর এমআই-৪ হেলিকপ্টারগুলো যখন মেঘনার আকাশে ডানা মেলল, তখন ভৈরব বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তবে এই অপারেশন কেবল প্রযুক্তির জয় ছিল না, এটি ছিল স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের এক অনন্য নজির।
হেলিকপ্টারগুলো নামার জন্য মেঘনার পশ্চিম পাড়ে, রায়পুরা, নরসিংদী ও নবীনগরের চরাঞ্চলে নিরাপদ ল্যান্ডিং জোন বা অবতরণ ক্ষেত্র প্রয়োজন ছিল। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইয়ের ভাষ্য, এই কঠিন কাজটি করে দিয়েছিল স্থানীয় গ্রামবাসী ও মুক্তিপাগল জনতা। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফসলি জমি পরিষ্কার করে, মশাল জ্বালিয়ে এবং রঙিন কাপড় ও গামছা নেড়ে আকাশ থেকে আসা হেলিকপ্টারগুলোকে পথ দেখিয়েছিল।
শুধু তাই নয়, হেলিকপ্টার থেকে নামা মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের কাঁধ থেকে ভারী রসদ ও গোলাবারুদ নিজেদের মাথায় তুলে নিয়েছিল এসব সাধারণ মানুষ। সারা দিন এবং সারা রাত ধরে চলা এ অপারেশনে হাজার হাজার সৈন্য মেঘনা পার হয়। পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারল, তাদের সামনে নদী বা পেছনের আকাশ কোনোটিই আর বাধা নয় এবং পুরো দেশের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, তখন তাদের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে যায়।
এদিকে উত্তরের দিকে জামালপুর রণাঙ্গনে ৯ ডিসেম্বর ঘটেছিল সাহসিকতা ও ধূর্ততার এক চূড়ান্ত লড়াই। আগের দিন পাকিস্তানি দুর্গের কমান্ডার কর্নেল সুলতান মাহমুদ বুলেটের মাধ্যমে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দিয়েছিলেন, ৯ ডিসেম্বর তার করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়।
সকাল থেকেই মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো জামালপুর পিটিআই ভবনে পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর নাপাম বোমা বর্ষণ শুরু করে। কংক্রিটের শক্তিশালী বাংকারগুলো আগুনের গোলায় পরিণত হয়। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জামালপুর শহরকে আগে থেকেই চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে তারা শহরটিকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করেছিল।
৯ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি কমান্ড বুঝতে পারে, আকাশ ও স্থল উভয় দিক থেকেই তারা অবরুদ্ধ। তাই কর্নেল সুলতান তার অবশিষ্ট প্রায় ১৫০০ সৈন্য নিয়ে রাতের আঁধারে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় দিয়ে ঢাকার দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই পলায়ন ছিল তাদের জন্য আত্মঘাতী।
টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের সংযোগস্থলে কাদেরিয়া বাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ‘অ্যামবুশ’ বা মরণফাঁদ পেতে রেখেছিল। পালানোর পথে পাকিস্তানি কনভয় যখন গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছিল, তখন প্রতিটি ঝোপঝাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জে ওঠে। একই সঙ্গে সাধারণ গ্রামবাসী, যারা এতদিন ভয়ে তটস্থ ছিল, তারা সাহস সঞ্চয় করে হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালায়।
জামালপুরের এ যুদ্ধ প্রমাণ করে, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি নিয়মিত বাহিনীও গেরিলা কায়দায় লড়তে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তির কাছে কতটা অসহায়। জামালপুর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের পতনও নিশ্চিত হয়ে যায়। নেত্রকোনা শহরও এ দিন সকালে শত্রুমুক্ত হয়। স্থানীয় জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে নেত্রকোনা কৃষি ফার্ম ও থানা দখল করে নেয়। উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ বা ‘রোড টু ঢাকা’ এ দিন পুরোপুরি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে ৯ ডিসেম্বর সংঘটিত হয় এক ব্যতিক্রমী ট্যাংক যুদ্ধ। সাধারণত মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ ট্যাংক যুদ্ধ খুব কমই দেখা গেছে, কিন্তু কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শেষ শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল। পাকিস্তানি ২২ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের শ্যাফি ট্যাংকগুলো মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে।
মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বই থেকে জানা যায়, এখানেও প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় জনগণ ও ভৌগোলিক প্রতিকূলতা। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের সাধারণ মানুষ যশোর রোডের বিশাল বিশাল গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল। ফলে পাকিস্তানি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানগুলো দ্রুত মুভ করতে পারছিল না এবং সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছিল।
মিত্রবাহিনীর টি-৫৫ ট্যাংক ও বিমান বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি ট্যাংক বহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কুষ্টিয়ার এ যুদ্ধে পাকিস্তানিরা এতটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল যে তারা তাদের মৃত ও আহত সঙ্গীদের ফেলেই পালিয়ে যায়।
ওদিকে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ মুক্ত হওয়ার পর যৌথ বাহিনী দ্রুত মাগুরা হয়ে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পদ্মার ওপারে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া পাকিস্তানিদের আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু গোয়ালন্দ ঘাটও তখন নিরাপদ ছিল না, কারণ আকাশ থেকে বিমান হামলা সেখানেও তাড়া করে ফিরছিল।
মেঘনা পাড়ের বিজয়ের রেশ ধরে ৯ ডিসেম্বর দাউদকান্দি রণাঙ্গনেও আসে চূড়ান্ত সাফল্য। আগের দিন চাঁদপুর মুক্ত হওয়ার পর ৯ ডিসেম্বর দাউদকান্দি সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। দাউদকান্দি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল এবং মেঘনা-গোমতী নদীর সংযোগস্থল। পাকিস্তানি বাহিনী এখানে শক্ত প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের মনোবল আগের দিনই ভেঙে গিয়েছিল।
৯ ডিসেম্বর তীব্র যুদ্ধের পর দাউদকান্দি পতনের ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা যাওয়ার সব পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দাউদকান্দিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তখন ঢাকার দিগন্তরেখা দেখতে পাচ্ছিলেন। এ দিন মেঘনা নদীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর শেষ পথটুকুও বন্ধ হয়ে যায়।
নদীতে তখন ভারতীয় নৌ বাহিনীর গানবোট এবং মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডোরা টহল দিচ্ছিল, যেন কোনো পাকিস্তানি নৌ যান নদীপথে পালাতে না পারে। চাঁদপুর থেকে পালিয়ে আসা বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি সৈন্যরা দাউদকান্দির দিকে আসার চেষ্টা করে ধরা পড়ে অথবা স্থানীয় জনতার রোষানলে প্রাণ হারায়।
অবরুদ্ধ ঢাকার ভেতরের চিত্রটি আগের কয়েক দিনের মতোই ছিল একাধারে ভীতি ও আশার দোলাচলে দোদুল্যমান। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ৯ ডিসেম্বরের ঢাকার চিত্র তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আজ ৯ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার। চারদিক থেকে খবর আসছে যশোরের পর নাকি দাউদকান্দিও মুক্ত হয়েছে। আজ সারা দিন খুব প্লেন চলছে। মাঝে মাঝে জানালার কাঁচ থরথর করে কাঁপছে। বিকেলে শুনলাম সপ্তম নৌ বহর নাকি বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিয়েছে। খবরটা শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আবার কি সব উলটে যাবে? রুমি কি এসব দেখছে? নাকি ও অনেক দূরে নক্ষত্রের দেশে চলে গেছে?’
জাহানারা ইমাম আরও উল্লেখ করেন, ঢাকার রাস্তায় তখন রিকশা বা গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। লোকজন ভয়ে জড়োসড়ো, কিন্তু একে অন্যের চোখের দিকে তাকালে এক ধরনের দীপ্তি দেখা যায়। সন্ধ্যা নামলেই শহরে নেমে আসত কবরের নিস্তব্ধতা, যা কেবল মাঝে মাঝে প্রকম্পিত হতো মিত্রবাহিনীর বিমান হামলার শব্দে বা দূরের কোনো গেরিলার গ্রেনেড বিস্ফোরণে।
ঢাকার মানুষ বুঝতে পারছিল, তাদের মুক্তিদাতারা খুব কাছেই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আখতার মুকুল যখন ‘চরমপত্রে’ কৌতুক করে বলতেন, ‘ওরে ভোলা, ঢাকা যে আইসা পড়লাম, আর তো সময় নাই’, তখন প্রতিটি ঘরে মানুষ গোপনে হেসে উঠত এবং নতুন দিনের স্বপ্ন দেখত। জাহানারা ইমামের বাড়িতেও তখন গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা হতো, আর পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে খবর পাঠাতেন যে তারা ঢাকার খুব কাছেই আছেন।
রণাঙ্গনের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যেই ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে এক নাটকীয় ও বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা হয়। মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ বইয়ের তথ্যমতে, ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে এক মরিয়া সিদ্ধান্ত নেন। তারা প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত মার্কিন সপ্তম নৌ বহরের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘টাস্ক ফোর্স-৭৪’কে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন।
এই নৌ বহরের নেতৃত্বে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’। মার্কিন প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, ভারতকে ভয় দেখিয়ে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করা; দ্বিতীয়ত, অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীকে সমুদ্রপথে উদ্ধার করা।
এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব জুড়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সপ্তম নৌ বহর আসার খবরে সাধারণ মানুষের মনে সাময়িক ভীতির সঞ্চার হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বিন্দুমাত্র দমে যায়নি। বরং প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও রণাঙ্গনের সেক্টর কমান্ডাররা আরও কঠোর ভাষায় ঘোষণা দেন, কোনো বিদেশি শক্তিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আর আটকে রাখতে পারবে না।
সপ্তম নৌ বহরের হুমকি প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা ঢাকার দিকে তাদের অগ্রযাত্রা আরও দ্রুততর করেছিল, যেন বিদেশি শক্তি আসার আগেই পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের দিকেও ৯ ডিসেম্বর ছিল বিজয়ের দিন। নেত্রকোনা শহর এ দিন সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী নেত্রকোনা ছেড়ে ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায়। স্থানীয় জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। মুক্ত নেত্রকোনার রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে।
ময়মনসিংহের দিকেও যৌথ বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের কাছে পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের পেছনের দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করায় তারা সেই অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই ময়মনসিংহ শহরের পতন আসন্ন হয়ে পড়ে।
উত্তরাঞ্চলের এই দ্রুত পতন ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে আরও বেশি আতঙ্কিত করে তোলে। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন, টাঙ্গাইল হয়ে মিত্রবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে ঢাকার মিরপুর ব্রিজে এসে কড়া নাড়বে।
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ৯ ডিসেম্বর ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে এক ধরনের উন্মাদনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জেনারেলরা একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা কাল্পনিক সাহায্যের আশায় বসে থাকেন।
তথ্যসূত্র

একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চূড়ান্ত এক সন্ধিক্ষণ, যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দীর্ঘ ৯ মাসের সাজানো ‘রণকৌশল’ বা ‘ওয়ার স্ট্র্যাটেজি’ বাংলার নদী, মাটি ও মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। রণাঙ্গনের প্রতিটি প্রান্তে, মেঘনার উত্তাল ঢেউ থেকে শুরু করে জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদের তীর, কুষ্টিয়ার সমতল ভূমি থেকে শুরু করে উপকূলীয় বদ্বীপ— সবখানেই হানাদার বাহিনীর জন্য রচিত হয়েছিল এক অনিবার্য মৃত্যুফাঁদ।
পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের তথাকথিত ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশলের ওপর যে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছিল, তা তখন অন্ধের মতোই তাদের হোঁচট খাওয়াচ্ছিল। একদিকে বিশ্বরাজনীতির দাবার বোর্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে বাংলার সাধারণ মাঝিমাল্লা আর কৃষকরা হেলিকপ্টার থেকে নামা মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের পথ দেখিয়ে সেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে কার্যত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছিল।
৯ ডিসেম্বরের সকাল শুরু হয় মেঘনা নদীর তীরে এক বিস্ময়কর সামরিক অধ্যায় দিয়ে, যা পরে ‘দ্য গ্রেট মেঘনা হেলি-ব্রিজ’ অপারেশন নামে সামরিক ইতিহাসে স্থান করে নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাতছাড়া হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরব বাজারে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। আশুগঞ্জ ও ভৈরবের সংযোগকারী রাজা ষষ্ঠ জর্জ রেলসেতুটির (বর্তমান ভৈরব সেতু) একটি বিশাল অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
মেঘনা নদী এখানে প্রায় চার হাজার গজ চওড়া ও স্রোতস্বিনী। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজি ও তার উপদেষ্টারা নিশ্চিত ছিলেন, সেতু ছাড়া এই বিশাল নদী পার হয়ে ভারী কামান, ট্যাংক ও হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া মিত্রবাহিনীর পক্ষে অসম্ভব। তারা হিসাব করেছিলেন, নদী পার হতে যৌথ বাহিনীর অন্তত দুই সপ্তাহ লাগবে।
কিন্তু ৯ ডিসেম্বর মেঘনা পাড়ে যা ঘটল, তা ছিল প্রচলিত যুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। মিত্রবাহিনীর জেনারেল সগত সিং ও সেক্টর কমান্ডাররা এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নেন। নদী পাড়ি দেওয়া হবে আকাশপথে!
ভারতীয় বিমান বাহিনীর এমআই-৪ হেলিকপ্টারগুলো যখন মেঘনার আকাশে ডানা মেলল, তখন ভৈরব বাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তবে এই অপারেশন কেবল প্রযুক্তির জয় ছিল না, এটি ছিল স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের এক অনন্য নজির।
হেলিকপ্টারগুলো নামার জন্য মেঘনার পশ্চিম পাড়ে, রায়পুরা, নরসিংদী ও নবীনগরের চরাঞ্চলে নিরাপদ ল্যান্ডিং জোন বা অবতরণ ক্ষেত্র প্রয়োজন ছিল। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইয়ের ভাষ্য, এই কঠিন কাজটি করে দিয়েছিল স্থানীয় গ্রামবাসী ও মুক্তিপাগল জনতা। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফসলি জমি পরিষ্কার করে, মশাল জ্বালিয়ে এবং রঙিন কাপড় ও গামছা নেড়ে আকাশ থেকে আসা হেলিকপ্টারগুলোকে পথ দেখিয়েছিল।
শুধু তাই নয়, হেলিকপ্টার থেকে নামা মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের কাঁধ থেকে ভারী রসদ ও গোলাবারুদ নিজেদের মাথায় তুলে নিয়েছিল এসব সাধারণ মানুষ। সারা দিন এবং সারা রাত ধরে চলা এ অপারেশনে হাজার হাজার সৈন্য মেঘনা পার হয়। পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পারল, তাদের সামনে নদী বা পেছনের আকাশ কোনোটিই আর বাধা নয় এবং পুরো দেশের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, তখন তাদের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে যায়।
এদিকে উত্তরের দিকে জামালপুর রণাঙ্গনে ৯ ডিসেম্বর ঘটেছিল সাহসিকতা ও ধূর্ততার এক চূড়ান্ত লড়াই। আগের দিন পাকিস্তানি দুর্গের কমান্ডার কর্নেল সুলতান মাহমুদ বুলেটের মাধ্যমে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব দিয়েছিলেন, ৯ ডিসেম্বর তার করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়।
সকাল থেকেই মিত্রবাহিনীর বিমানগুলো জামালপুর পিটিআই ভবনে পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর নাপাম বোমা বর্ষণ শুরু করে। কংক্রিটের শক্তিশালী বাংকারগুলো আগুনের গোলায় পরিণত হয়। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা জামালপুর শহরকে আগে থেকেই চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে তারা শহরটিকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করেছিল।
৯ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি কমান্ড বুঝতে পারে, আকাশ ও স্থল উভয় দিক থেকেই তারা অবরুদ্ধ। তাই কর্নেল সুলতান তার অবশিষ্ট প্রায় ১৫০০ সৈন্য নিয়ে রাতের আঁধারে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় দিয়ে ঢাকার দিকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই পলায়ন ছিল তাদের জন্য আত্মঘাতী।
টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহের সংযোগস্থলে কাদেরিয়া বাহিনী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ‘অ্যামবুশ’ বা মরণফাঁদ পেতে রেখেছিল। পালানোর পথে পাকিস্তানি কনভয় যখন গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছিল, তখন প্রতিটি ঝোপঝাড় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মেশিনগান গর্জে ওঠে। একই সঙ্গে সাধারণ গ্রামবাসী, যারা এতদিন ভয়ে তটস্থ ছিল, তারা সাহস সঞ্চয় করে হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালায়।
জামালপুরের এ যুদ্ধ প্রমাণ করে, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি নিয়মিত বাহিনীও গেরিলা কায়দায় লড়তে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তির কাছে কতটা অসহায়। জামালপুর পতনের সঙ্গে সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের পতনও নিশ্চিত হয়ে যায়। নেত্রকোনা শহরও এ দিন সকালে শত্রুমুক্ত হয়। স্থানীয় জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে নেত্রকোনা কৃষি ফার্ম ও থানা দখল করে নেয়। উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ বা ‘রোড টু ঢাকা’ এ দিন পুরোপুরি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে ৯ ডিসেম্বর সংঘটিত হয় এক ব্যতিক্রমী ট্যাংক যুদ্ধ। সাধারণত মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ ট্যাংক যুদ্ধ খুব কমই দেখা গেছে, কিন্তু কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শেষ শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল। পাকিস্তানি ২২ ক্যাভালরি রেজিমেন্টের শ্যাফি ট্যাংকগুলো মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করে।
মেজর রফিকুল ইসলামের ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বই থেকে জানা যায়, এখানেও প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় স্থানীয় জনগণ ও ভৌগোলিক প্রতিকূলতা। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের সাধারণ মানুষ যশোর রোডের বিশাল বিশাল গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল। ফলে পাকিস্তানি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানগুলো দ্রুত মুভ করতে পারছিল না এবং সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছিল।
মিত্রবাহিনীর টি-৫৫ ট্যাংক ও বিমান বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি ট্যাংক বহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কুষ্টিয়ার এ যুদ্ধে পাকিস্তানিরা এতটাই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল যে তারা তাদের মৃত ও আহত সঙ্গীদের ফেলেই পালিয়ে যায়।
ওদিকে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ মুক্ত হওয়ার পর যৌথ বাহিনী দ্রুত মাগুরা হয়ে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পদ্মার ওপারে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া পাকিস্তানিদের আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু গোয়ালন্দ ঘাটও তখন নিরাপদ ছিল না, কারণ আকাশ থেকে বিমান হামলা সেখানেও তাড়া করে ফিরছিল।
মেঘনা পাড়ের বিজয়ের রেশ ধরে ৯ ডিসেম্বর দাউদকান্দি রণাঙ্গনেও আসে চূড়ান্ত সাফল্য। আগের দিন চাঁদপুর মুক্ত হওয়ার পর ৯ ডিসেম্বর দাউদকান্দি সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। দাউদকান্দি ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল এবং মেঘনা-গোমতী নদীর সংযোগস্থল। পাকিস্তানি বাহিনী এখানে শক্ত প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের মনোবল আগের দিনই ভেঙে গিয়েছিল।
৯ ডিসেম্বর তীব্র যুদ্ধের পর দাউদকান্দি পতনের ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা যাওয়ার সব পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দাউদকান্দিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তখন ঢাকার দিগন্তরেখা দেখতে পাচ্ছিলেন। এ দিন মেঘনা নদীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর পালানোর শেষ পথটুকুও বন্ধ হয়ে যায়।
নদীতে তখন ভারতীয় নৌ বাহিনীর গানবোট এবং মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডোরা টহল দিচ্ছিল, যেন কোনো পাকিস্তানি নৌ যান নদীপথে পালাতে না পারে। চাঁদপুর থেকে পালিয়ে আসা বিচ্ছিন্ন পাকিস্তানি সৈন্যরা দাউদকান্দির দিকে আসার চেষ্টা করে ধরা পড়ে অথবা স্থানীয় জনতার রোষানলে প্রাণ হারায়।
অবরুদ্ধ ঢাকার ভেতরের চিত্রটি আগের কয়েক দিনের মতোই ছিল একাধারে ভীতি ও আশার দোলাচলে দোদুল্যমান। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ৯ ডিসেম্বরের ঢাকার চিত্র তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। তিনি তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আজ ৯ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার। চারদিক থেকে খবর আসছে যশোরের পর নাকি দাউদকান্দিও মুক্ত হয়েছে। আজ সারা দিন খুব প্লেন চলছে। মাঝে মাঝে জানালার কাঁচ থরথর করে কাঁপছে। বিকেলে শুনলাম সপ্তম নৌ বহর নাকি বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা দিয়েছে। খবরটা শুনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আবার কি সব উলটে যাবে? রুমি কি এসব দেখছে? নাকি ও অনেক দূরে নক্ষত্রের দেশে চলে গেছে?’
জাহানারা ইমাম আরও উল্লেখ করেন, ঢাকার রাস্তায় তখন রিকশা বা গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। লোকজন ভয়ে জড়োসড়ো, কিন্তু একে অন্যের চোখের দিকে তাকালে এক ধরনের দীপ্তি দেখা যায়। সন্ধ্যা নামলেই শহরে নেমে আসত কবরের নিস্তব্ধতা, যা কেবল মাঝে মাঝে প্রকম্পিত হতো মিত্রবাহিনীর বিমান হামলার শব্দে বা দূরের কোনো গেরিলার গ্রেনেড বিস্ফোরণে।
ঢাকার মানুষ বুঝতে পারছিল, তাদের মুক্তিদাতারা খুব কাছেই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আখতার মুকুল যখন ‘চরমপত্রে’ কৌতুক করে বলতেন, ‘ওরে ভোলা, ঢাকা যে আইসা পড়লাম, আর তো সময় নাই’, তখন প্রতিটি ঘরে মানুষ গোপনে হেসে উঠত এবং নতুন দিনের স্বপ্ন দেখত। জাহানারা ইমামের বাড়িতেও তখন গোপনে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা হতো, আর পরিচিত মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে খবর পাঠাতেন যে তারা ঢাকার খুব কাছেই আছেন।
রণাঙ্গনের এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যেই ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে এক নাটকীয় ও বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা হয়। মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ বইয়ের তথ্যমতে, ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা হিসেবে এক মরিয়া সিদ্ধান্ত নেন। তারা প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থানরত মার্কিন সপ্তম নৌ বহরের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘টাস্ক ফোর্স-৭৪’কে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন।
এই নৌ বহরের নেতৃত্বে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’। মার্কিন প্রশাসনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, ভারতকে ভয় দেখিয়ে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করা; দ্বিতীয়ত, অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীকে সমুদ্রপথে উদ্ধার করা।
এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্ব জুড়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সপ্তম নৌ বহর আসার খবরে সাধারণ মানুষের মনে সাময়িক ভীতির সঞ্চার হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বিন্দুমাত্র দমে যায়নি। বরং প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও রণাঙ্গনের সেক্টর কমান্ডাররা আরও কঠোর ভাষায় ঘোষণা দেন, কোনো বিদেশি শক্তিই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে আর আটকে রাখতে পারবে না।
সপ্তম নৌ বহরের হুমকি প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের ক্ষুধাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা ঢাকার দিকে তাদের অগ্রযাত্রা আরও দ্রুততর করেছিল, যেন বিদেশি শক্তি আসার আগেই পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের দিকেও ৯ ডিসেম্বর ছিল বিজয়ের দিন। নেত্রকোনা শহর এ দিন সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে হানাদারমুক্ত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী নেত্রকোনা ছেড়ে ময়মনসিংহের দিকে পালিয়ে যায়। স্থানীয় জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। মুক্ত নেত্রকোনার রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে।
ময়মনসিংহের দিকেও যৌথ বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের কাছে পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের পেছনের দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করায় তারা সেই অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই ময়মনসিংহ শহরের পতন আসন্ন হয়ে পড়ে।
উত্তরাঞ্চলের এই দ্রুত পতন ঢাকায় জেনারেল নিয়াজিকে আরও বেশি আতঙ্কিত করে তোলে। কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন, টাঙ্গাইল হয়ে মিত্রবাহিনী যেকোনো মুহূর্তে ঢাকার মিরপুর ব্রিজে এসে কড়া নাড়বে।
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ৯ ডিসেম্বর ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে এক ধরনের উন্মাদনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জেনারেলরা একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকেন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা কাল্পনিক সাহায্যের আশায় বসে থাকেন।
তথ্যসূত্র

খালেদা জিয়ার জন্য কাতার আমিরের একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ঢাকায় পাঠানোর কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে শেষ মুহূর্তে তা সম্ভব হয়নি। এর বদলে কাতারই জার্মানির একটি প্রাইভেট এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে।
৪ দিন আগে
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসব পরিণত হয়েছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির এক অনন্য মিলনমেলায়।
৪ দিন আগে
পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কামাল ও তার সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশনের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।
৪ দিন আগে
কামালপুর কেবল একটি বিওপি বা বর্ডার আউটপোস্ট ছিল না, এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অহংকারের প্রতীক এবং ঢাকা বিজয়ের চাবিকাঠি। এ যুদ্ধের কাহিনি কোনো সাধারণ যুদ্ধের বিবরণ নয়; বারুদ, কাদা, রক্ত ও মানুষের অকল্পনীয় জেদের এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান।
৫ দিন আগে