বুদ্ধিজীবীদের রক্ত, গভর্নর হাউজে বোমার ভূমিকম্প আর ‘টাইগার’ এখন খাঁচাবন্দি!

নাজমুল ইসলাম হৃদয়
১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ঢাকায় তখনকার গভর্নর হাউজে বোমা বর্ষণ করে মিত্রবাহিনী। ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। একদিকে যখন ঢাকার উপকণ্ঠে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত, অন্যদিকে পরাজিত ও কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে শেষ ও জঘন্যতম কাজটি শুরু করে।

এ দিন সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে রাজাকার-আল-বদরের ঘাতক দল। তারা তালিকা ধরে ধরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী ও সাহিত্যিকদের বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায়। এই নৃশংসতা ছিল পাকিস্তানি জেনারেলদের কাপুরুষতার চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ। রণাঙ্গনে হেরে তারা জাতিকে প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ করতে চেয়েছিল।

এই ভয়াল ট্র্যাজেডির পাশাপাশি এ দিনই শুরু হয় আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক নাটকীয়তাও। ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশের চরমপত্রের পর ১৩ ডিসেম্বর রাতে জেনারেল নিয়াজি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন, যেদিন নিয়াজির আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক সিগন্যালটি দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছায়।

ঢাকার আকাশে তখন মিগ-২১ বিমানগুলোর বিকট শব্দ, গভর্নর হাউজের ছাদ ধসে পড়ছে মিত্রবাহিনীর বোমায়, আর মাটির নিচে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে চাপা পড়ছিল জাতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের রক্তস্রোত। ১৪ ডিসেম্বর ছিল আসন্ন বিজয়ের উল্লাসের ঠিক আগের এক ‘অন্ধকার অমাবস্যার রাত’। একদিকে মুক্তির আশা, অন্যদিকে অপূরণীয় ক্ষতির নীরব কান্না।

১৪ ডিসেম্বরের প্রভাতটি শুরু হয়েছিল এক গভীর ও ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, যা ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য অধ্যায়। আগের দিনগুলোতে রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে যে নীলনকশা আঁকা হয়েছিল, ১৪ ডিসেম্বর তা বাস্তবে রূপ নেয়। আল-বদর বাহিনীর অপারেশনাল ইনচার্জ চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ঘাতক দলগুলো কাদালেপা মাইক্রোবাস ও জিপ নিয়ে ঢাকার নিস্তব্ধ রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের হাতে ছিল বুদ্ধিজীবীদের নামের দীর্ঘ তালিকা।

শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ১৪ ডিসেম্বরের ঢাকার যে চিত্র এঁকেছেন, তা পড়লে গা শিউরে ওঠে। তিনি লিখেছেন, ‘আজকের দিনটা যে কী ভয়ংকর, তা আমরা তখনো জানতাম না। আজ শুধু প্লেন আসছে আর যাচ্ছে, আর গুলির শব্দ। কিন্তু এর আড়ালে কী ভয়াল ঘটনা ঘটে যাচ্ছে! কারফিউর সুযোগ নিয়ে ওরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে।’

ঘাতকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি, গুলশান ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন বাসা থেকে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, সেলিনা পারভীনসহ শত শত বুদ্ধিজীবীকে তুলে নিয়ে যায়।

ডা. ফজলে রাব্বী বা ডা. আলীম চৌধুরীর মতো প্রখ্যাত চিকিৎসকদের যখন তুলে নেওয়া হয়, তখন তারা হয়তো ভেবেছিলেন কোনো রোগীকে দেখতে যেতে হবে। কিন্তু তাদের নিয়ে যাওয়া হয় মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও মিরপুরের টর্চার সেলগুলোতে। সেখানে তাদের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়, তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়।

পাকিস্তানি জেনারেলরা বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তাই তারা চেয়েছিল এই নতুন রাষ্ট্রটি যেন মেধা ও মননশীলতায় পঙ্গু হয়ে জন্মায়। ১৪ ডিসেম্বরের এ হত্যাযজ্ঞ ছিল এক পরাজিত শক্তির শেষ কামড়, যা আমাদের জাতীয় জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষত তৈরি করে গেছে। রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পরে পাওয়া লাশগুলোর বিকৃত চেহারা সাক্ষ্য দিচ্ছিল, ঘাতকরা কতটা আক্রোশ নিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। অনেকের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল, হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, যেন তারা আর কোনোদিন লিখতে বা দেখতে না পারে।

বুদ্ধিজীবী হত্যার এই পৈশাচিকতার যখন মহড়া চলছে, ঠিক সেই সময়েই ঢাকার গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘটছিল এক নাটকীয়তায় ভরা সিদ্ধান্তমূলক ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে এক জরুরি বৈঠকে বসেন। উদ্দেশ্য ছিল পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিচার করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পরবর্তী করণীয় ঠিক করা।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানি প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ ও মেজর জেনারেল জ্যাকবের ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আগেই এ বৈঠকের খবর পেয়ে গিয়েছিল। ঠিক যখন বৈঠক চলছিল, তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ-২১ বিমানগুলো গভর্নর হাউজের ওপর পিনপয়েন্ট অ্যাটাক বা নির্ভুল বোমা হামলা চালায়। বিকট শব্দে গভর্নর হাউজের ছাদ কেঁপে ওঠে এবং ধসে পড়ে। জানালার কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ভয়ে ও আতঙ্কে ডা. মালিক ও তার মন্ত্রীরা টেবিলের নিচে আশ্রয় নেন।

সেখানে যেসব বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন, তারা এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেন। বোমার আঘাতেই ডা. মালিকের ‘পাকিস্তান রক্ষা’র শেষ ইচ্ছাটি ধুলিসাৎ হয়ে যায়। তিনি কাঁপতে কাঁপতে একটি টিস্যু পেপারে বা হাতের কাছে পাওয়া কাগজে তার পদত্যাগপত্র লিখে সই করেন এবং মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করেন। এরপর তারা প্রাণভয়ে দৌড়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেন, যা তখন রেড ক্রসের অধীনে ‘নিউট্রাল জোন’ বা নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষিত ছিল।

গভর্নর হাউজের এই পতন ছিল প্রতীকী অর্থে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। এরপর ঢাকায় আর কোনো কার্যকর সরকার ছিল না, ছিল কেবল পলায়নপর এক সেনাবাহিনী।

গভর্নর হাউজের এই ধ্বংসযজ্ঞের খবর যখন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির কাছে পৌঁছায়, তখন তার মানসিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে নিয়াজি তার অফিসে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।

১৪ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে জেনারেল নিয়াজি মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের মাধ্যমে ভারতের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ অত্যন্ত কঠোর ভাষায় জানিয়ে দেন, ‘এখন আর কোনো যুদ্ধবিরতি নয়। একমাত্র পথ হলো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। যদি ১৫ ডিসেম্বরের সকালের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করা হয়, তবে মিত্রবাহিনী ঢাকার ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানবে।’

জেনারেল মানেকশের এই বার্তা নিয়াজির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। নিয়াজি বুঝতে পারেন, তার হাতে আর কোনো তাস অবশিষ্ট নেই। তার গর্বের ‘ইস্টার্ন কমান্ড’ এখন এক খাঁচাবন্দি বাঘের মতো, যার দাঁত ও নখ সব ভেঙে গেছে। ১৪ ডিসেম্বর বিকেলেই নিয়াজি তার অধীন সব ইউনিটকে ‘সিজফায়ার’ মেনে চলার গোপন নির্দেশ দিতে শুরু করেন, যদিও তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করা হয়নি।

রণাঙ্গনের চিত্র ১৪ ডিসেম্বর ছিল আরও ভয়াবহ। ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ তখন পুরোপুরি বন্ধ। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ‘এস ফোর্সে’র সৈন্যরা ডেমরা ও রূপগঞ্জ এলাকা দিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। ডেমরার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে পাকিস্তানিরা শেষ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে তারা বালু নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে আসে।

১৪ ডিসেম্বর দুপুরে টঙ্গী ও পূবাইল এলাকায় কাদেরিয়া বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। টঙ্গী ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধারা বিকল্প পথে তুরাগ নদ পার হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাভার ও মিরপুর ব্রিজের কাছেও তখন যুদ্ধের দামামা বাজছে। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি বা কামানের রেঞ্জের মধ্যে চলে এসেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।

১৪ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনী ঢাকার ওপর সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরির জন্য কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। সারা রাত ধরে ঢাকার আকাশে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষ ভয়ে সিঁড়ির নিচে বা খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিল, কিন্তু তাদের মনে ছিল এক চাপা উত্তেজনা। মুক্তির উত্তেজনা।

দেশের অন্যান্য প্রান্তেও ১৪ ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের দিন। খুলনার শিরোমণি রণাঙ্গনে ১৩ ডিসেম্বরের ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধের পর ১৪ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি ১০৭ ব্রিগেড ও তাদের দুর্ধর্ষ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান পিছু হটতে বাধ্য হন। মেজর মঞ্জুর ও তার মুক্তিযোদ্ধারা খুলনার দিকে অগ্রসর হন। খুলনার পতন ছিল ঢাকার বাইরে পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে বড় পরাজয়গুলোর একটি।

অন্যদিকে বগুড়া ও রংপুরেও পাকিস্তানিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। বগুড়া শহরে ১৪ ডিসেম্বর সারাদিন ধরে স্ট্রিট ফাইট বা রাস্তার যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানিরা প্রতিটি দালানকে বাংকার হিসেবে ব্যবহার করছিল। কিন্তু মুক্তি পাগল জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তারা টিকতে পারেনি।

১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম রণাঙ্গনেও বিজয়ের সুর বাজছিল। সীতাকুণ্ড ও ভাটিয়ারি অতিক্রম করে যৌথ বাহিনী চট্টগ্রাম শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়া পাকিস্তানি নৌসেনারা তখন পালানোর কোনো পথ না পেয়ে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ১৪ ডিসেম্বর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ দিন পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব পেশ করে, যেখানে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হয়। পাকিস্তান বুঝতে পারে, জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি করিয়ে সময়ক্ষেপণ করার সুযোগ আর নেই।

জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি রাগে ও ক্ষোভে জাতিসংঘের সনদ ছিঁড়ে ফেলে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন এবং বলেন, ‘আমি আমার দেশের পরাজয় দেখতে এখানে আসিনি।’ তার এই নাটকীয় প্রস্থান প্রমাণ করে, পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবেও সম্পূর্ণ পরাজিত হয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এ দিনও নিরাপত্তা পরিষদে শক্ত অবস্থান বজায় রাখে এবং জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো সমাধান নেই। মার্কিন সপ্তম নৌ বহর তখনো বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু তাদের গতি ছিল শ্লথ। আসলে ১৪ ডিসেম্বরের পর আমেরিকাও বুঝতে পারে, ঢাকায় হস্তক্ষেপ করার মতো সময় আর নেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পতন এত দ্রুত ঘটছিল যে কোনো নৌ বহর এসে তাদের বাঁচাতে পারবে না।

অবরুদ্ধ ঢাকার সাধারণ মানুষের জন্য ১৪ ডিসেম্বর ছিল এক বিভীষিকাময় দিন। একদিকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক, অন্যদিকে আকাশ থেকে ফেলা বোমার শব্দ। জাহানারা ইমাম লিখেছেন, ‘আজকের দিনটা যেন শেষই হতে চাইছে না। চারদিকে আগুনের ধোঁয়া। টেলিফোন কাজ করছে না। কারেন্ট নেই। মোমবাতির আলোয় বসে আমরা ভাবছি, কাল সকালে কি আমরা বেঁচে থাকব? রুমি কি আসবে?’

ঢাকার রাস্তায় তখন কোনো জনমানুষ নেই। কেবল মাঝে মাঝে পাকিস্তানি জিপের শব্দ আর দূরে কুকুরের কান্না। আল-বদর বাহিনী তাদের কাজ শেষ করে রায়েরবাজার বধ্যভূমি পূর্ণ করে ফিরে যাচ্ছিল। তাদের গাড়ির চাকায় লেগে ছিল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্ত।

১৪ ডিসেম্বরের রাতটি ছিল এক দীর্ঘতম রাত। এই রাতে ঢাকার প্রতিটি ঘরে মানুষ রেডিওর দিকে কান পেতে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরের জন্য। এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র সেদিন আর কৌতুক করেনি, বরং দিয়েছিল চূড়ান্ত বিজয়ের ইঙ্গিত। তিনি বলেছিলেন, ‘ওরে ভোলা, ঢাকার পোলাপান সব রেডি হ। আর তো সময় নাই। পাকিস্তানিরা এখন লেজ গুটাচ্ছে।’

সব ট্র্যাজেডি ছাপিয়ে ১৪ ডিসেম্বর বিকেলেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ঢাকা এখন আর পাকিস্তানের অংশ নয়, ঢাকা এখন এক স্বাধীন দেশের রাজধানী হওয়ার অপেক্ষায়। নিয়াজির টেবিলের ওপর রাখা ছিল আত্মসমর্পণের খসড়া, আর বাইরে তখন অপেক্ষা করছিল সাত কোটি মানুষের বিজয়ের মিছিল।

তথ্যসূত্র

  • একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম
  • মূলধারা ’৭১ – মঈদুল হাসান
  • উইটনেস টু সারেন্ডার (Witness to Surrender) – ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক
  • সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা (Surrender at Dacca) – লেফট্যানেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব
  • মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম
  • এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম
  • দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign) – মেজর জেনারেল ডি.কে. পালিত
  • লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ খণ্ড) – তথ্য মন্ত্রণালয়
  • চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল
  • একাত্তরের রণাঙ্গন – শামসুল হুদা চৌধুরী
  • বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ – এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ
  • দ্য নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ (১৪-১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১)
ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

উত্তরে চীন, দক্ষিণে আমেরিকা— ইয়াহিয়ার ‘গালগপ্পো’ আর রূপসায় স্বজনের গোলা!

ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়ে যায়। উত্তরে ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে ছুটছে, পূর্বে মেঘনা পাড় হয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিশাল বহর, আর পশ্চিমে পদ্মার পাড়ে চলছে তুমুল প্রস্তুতি।

৪ দিন আগে

আকাশ থেকে নামল ‘উড়ন্ত যম’— পালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না পাকিস্তানি বাহিনীর

পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের তথাকথিত ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশলের ওপর যে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছিল, তা তখন অন্ধের মতোই তাদের হোঁচট খাওয়াচ্ছিল। একদিকে বিশ্বরাজনীতির দাবার বোর্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে বাংলার

৫ দিন আগে

বিনয়-বাদল-দীনেশ— অগ্নিযুগের ৩ বিপ্লবী

তিন যুবকের হাতে মোটেও সময় নেই। বেচারা সিম্পসন! আজীবন নিরীহ-নিরপরাধ ভারতীয়দের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে এসেছেন। এ জন্য কতকিছু চিন্তা করে নির্যাতনের উপায় বের করতে হয়েছে। সেই মানুষটি নিজের শেষ সময়ে বিন্দুমাত্র ভাবনার সময়ও পেলেন না। তার দিকে তাক করা তিনটি রিভলবার থেকে ছয়টি বুলেট সিম্পসনের শরীর ভেদ করে

৬ দিন আগে

মেঘনা পাড়ে মৃত্যুফাঁদ— রাও ফরমান আলীর পালানোর আকুতি

তবে এ দিনের সবচেয়ে বড় ‘নাটক’ মঞ্চস্থ হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে নয়, বরং ঢাকার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে এবং নিউইয়র্কের জাতিসংঘের সদর দপ্তরে। খোদ পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী রাওয়ালপিন্ডির অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, ‘খেলা শেষ’।

৬ দিন আগে