ডিসেম্বরের দিনলিপি: ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

‘পাকিস্তান আজ মৃত’— এক ভেটো ও আকাশজয়ের আখ্যান

নাজমুল ইসলাম হৃদয়

৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। এ দিন কেবল একটি শহর বা জনপদ মুক্ত হয়নি, বরং ভেঙে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তথাকথিত ‘দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যূহ’। ৫ ডিসেম্বরের সূর্য যখন অস্ত যায়, তখন রণাঙ্গনের মানচিত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক নতুন বাস্তবতা। যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা পালানোর পথ খুঁজছে, আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভেস্তে যাচ্ছে পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ ষড়যন্ত্র।

কামালপুরের মতো ৫ ডিসেম্বরের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান অধ্যায় হলো ‘ব্যাটল অব আখাউড়া’ বা আখাউড়ার যুদ্ধ। ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে আখাউড়া ছিল ঢাকা বিজয়ের অন্যতম প্রবেশপথ। তিতাস বিধৌত জনপদটি দখল করা ছাড়া মিত্রবাহিনীর পক্ষে মেঘনা নদী অতিক্রম করে ঢাকার দিকে এগোনো ছিল অসম্ভব।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও জানত আখাউড়ার গুরুত্ব। তাই তারা তাদের দুর্ধর্ষ ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২৭ ব্রিগেডের একটি বড় অংশ এখানে মোতায়েন করে রেখেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো মূল্যে আখাউড়াকে ‘আয়রন ফোর্ট’ বা লৌহ দুর্গে পরিণত করা।

৩ ডিসেম্বর থেকেই এখানে এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কে এম শফিউল্লাহর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মিত্রবাহিনীর ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন যৌথভাবে আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর ছিল এ যুদ্ধের চূড়ান্ত ফয়সালার দিন।

টানা তিন দিন ও তিন রাতের নির্ঘুম লড়াইয়ের পর ৫ ডিসেম্বর ভোরে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ তার ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’ বইয়ে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, আখাউড়ার যুদ্ধ ছিল এক ‘ক্ল্যাশ অব টাইটানস’। পাকিস্তানিরা রেলওয়ে বাঁধকে কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী বাংকার তৈরি করেছিল, যেখান থেকে তারা বৃষ্টির মতো মেশিনগানের গুলি ছুড়ছিল।

মুক্তিযোদ্ধারা তখন আর কেবল গেরিলা নন, তারা সম্মুখ সমরের দক্ষ সৈনিক। ৫ ডিসেম্বর সকালে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাহসী যোদ্ধারা পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর চূড়ান্ত চার্জ করে। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। বেয়নেট আর গ্রেনেডের লড়াইয়ে আখাউড়ার মাটি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়।

পাকিস্তানি ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল কামাল ও তার সৈন্যরা এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশনের দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।

এ যুদ্ধে সুবেদার আশরাফ আলী খান (বীর প্রতীক) ও সিপাহী আমির হোসেনসহ (বীর প্রতীক) বহু মুক্তিযোদ্ধা অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। লেফট্যানেন্ট বদিউজ্জামান (বীর প্রতীক) সহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ লড়াইয়ে শহিদ হন।

আখাউড়ার পতন পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। কারণ তারা ধারণা করেছিল, আখাউড়া রক্ষা করতে তারা অন্তত ১০-১২ দিন সময় পাবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসের কাছে মাত্র তিন দিনেই তাদের সেই অহংকার ধুলোয় মিশে যায়। এ বিজয়ের ফলে ঢাকা অভিমুখে অগ্রযাত্রার প্রধান সড়কটি উন্মুক্ত হয়ে যায়, যা ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।

এ দিন আরেকটি ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় কুমিল্লা অঞ্চলের চৌদ্দগ্রাম ও লাকসাম সেক্টরে। এখানে পাকিস্তানি ৩৯ ডিভিশন কার্যত একটি ‘ডেথ ট্র্যাপ’ বা মৃত্যুফাঁদে আটকা পড়ে। এই অঞ্চলের যুদ্ধের বিশেষত্ব ছিল, মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে পালানোর সুযোগ না দিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল বা ‘এনসার্কেল’ করেছিল।

মেজর রফিকুল ইসলামের (বীর উত্তম) বই ও সেক্টর কমান্ডারদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ৫ ডিসেম্বর লাকসাম ও মুদাফফরগঞ্জের মধ্যবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর মরণকামড় বসায়। এতদিন যারা কেবল রাতের আঁধারে অ্যামবুশ করত, এদিন তারা দিনের আলোতে পাকিস্তানি কনভয়গুলোর ওপর চড়াও হয়।

চৌদ্দগ্রামের যুদ্ধে প্রায় ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং বহু সৈন্য আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকিস্তানি গ্যারিসন। এই যুদ্ধের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহের লাইফলাইন চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

৫ ডিসেম্বরের অন্যতম বড় ঘটনা ছিল সিলেটের কানাইঘাট ও ছাতকের যুদ্ধ। ৪ ও ৫ ডিসেম্বর— এই দুই দিন ধরে কানাইঘাটে চলে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এখানে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। জেড ফোর্সের অধীন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাট দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর (বীর বিক্রম) লেখা থেকে জানা যায়, কানাইঘাটের যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত কঠিন। কারণ পাকিস্তানিরা এখানে উঁচুতে অবস্থান নিয়েছিল এবং নিচু জমিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালানো তাদের জন্য সহজ ছিল। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাদা ও জলাভূমি পার হয়ে পাকিস্তানি বাংকারের খুব কাছে পৌঁছে যায় এবং গ্রেনেড হামলা চালায়।

তুমুল যুদ্ধের পর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সুরমা নদী পার হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কানাইঘাট মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সিলেট শহর মুক্ত করার পথ প্রশস্ত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন।

৫ ডিসেম্বরের আরেকটি বড় তাৎপর্য, এ দিন থেকেই বাংলাদেশের আকাশ পুরোপুরি শত্রুবিমানমুক্ত হয়। আগের দুই দিনের মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির রানওয়েগুলো এতটাই বিধ্বস্ত হয়েছিল যে, পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর গর্বের প্রতীক ‘সেভার জেট’গুলো আর ওড়ার সক্ষমতা রাখেনি। রানওয়েগুলো বড় বড় গর্তে ভরে গিয়েছিল। পাকিস্তানি পাইলটরা কার্যত রানওয়েতে আটকা পড়ে যায়।

ফলে ৫ ডিসেম্বর থেকে রণাঙ্গনে পাকিস্তানি পদাতিক বাহিনী আর কোনো ‘এয়ার কভার’ বা বিমান সহায়তা পায়নি। মাথার ওপর নিজেদের বিমানের বদলে তারা কেবল মিত্রবাহিনীর বিমানের গর্জন শুনতে পাচ্ছিল। এটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য এক বিশাল মনস্তাত্ত্বিক পরাজয়। জেনারেল নিয়াজির ভাষায়, আকাশ তখন তাদের জন্য ‘নিরাপদ ছাদ’ নয়, বরং ‘খোলা কবর’-এ পরিণত হয়েছিল।

মাঠের যুদ্ধের মতোই ৫ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চলছিল এক ভিন্ন যুদ্ধ। পাকিস্তানকে নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাতে ও বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উঠেপড়ে লাগে। মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ (সিনিয়র) নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যেখানে অবিলম্বে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের কথা বলা হয়।

এ প্রস্তাব পাস হলে মুক্তিযোদ্ধারা চরম বিপদে পড়তেন এবং পাকিস্তানের দখলদারিত্ব টিকে থাকত। কিন্তু ঠিক সেই নাটকীয় মুহূর্তে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) তাদের ঐতিহাসিক ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিক সাফ জানিয়ে দেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য অধিকার এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া কোনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়ন মেনে নেবে না।’

এই একটি ‘না’ ভোট বা ভেটো সেদিন মার্কিন ও চীনা ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়েছিল। রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা যখন বুকের রক্ত ঢালছিলেন, তখন হাজার মাইল দূরে এই কূটনৈতিক বিজয় তাদের লড়াইকে আন্তর্জাতিক বৈধতা এবং সময় দুটোই এনে দেয়।

যুদ্ধ ও কূটনৈতিক টানাপোড়েনের এই উত্তাল দিনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার কণ্ঠে ছিল বিজয়ের দৃঢ় প্রত্যয়। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দখলদার বাহিনীর থাকার কোনো অধিকার নেই। ইয়াহিয়া খানের বর্বর সেনাবাহিনী এখন আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের সামনে ধসে পড়ছে।’

তাজউদ্দীন আহমদের এই ঘোষণা অবরুদ্ধ বাংলার সাত কোটি মানুষকে জানিয়ে দেয়, পরাধীনতার দীর্ঘ রাত শেষ হয়ে আসছে।

তথ্যসূত্র

  • মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ – মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীর উত্তম
  • এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য – মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম
  • লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে – মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (ত্রয়োদশ খণ্ড) – আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও জাতিসংঘের দলিল
  • মূলধারা ’৭১ – মঈদুল হাসান
  • একাত্তরের রণাঙ্গন – শামসুল হুদা চৌধুরী
  • উইটনেস টু সারেন্ডার (Witness to Surrender) – ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক
  • স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দলিলপত্র
ad
ad

সাত-পাঁচ থেকে আরও পড়ুন

জঁ— মুক্তিযুদ্ধে বিমান ছিনতাই করা এক ফরাসি যুবক

বিমানের ওয়্যারলেসটি কেড়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জঁ নির্দেশ দিলেন বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দিতে। এসব সামগ্রী নিয়ে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাহত ও শরণার্থীদের কাছে পৌঁছে দেবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমার এই দাবি নিয়ে কোনো আপস চলবে না।’

২ দিন আগে

মারা গেছেন অভিনেতা ধর্মেন্দ্র

কয়েকদিন ধরেই ধর্মেন্দ্রর মৃত্যু নিয়ে গভীর ধোঁয়াশা। গভীর সংকটে ধর্মেন্দ্র, নাকি সত্যিই মৃত্যু হয়েছে মেগাস্টারের? কিছুদিন আগেই খবর ছড়ায়- মৃত্যু হয়েছে অভিনেতার। তবে সেই খবর সত্যি নয় বলে দাবি করেছিলেন হেমা মালিনী ও এষা দেওল।

১১ দিন আগে

ভূমিকম্পে করণীয়-বর্জনীয়

এমন পরিস্থিতিতে ভূমিকম্পের সময় কী করা উচিত—কী করা উচিত না তা নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একগুচ্ছ পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত।

১৩ দিন আগে

আত্মসমর্পণ করলেন মেহজাবীন

ছোট পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ, হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এ ঘটনায় আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেছেন মডেল ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী এবং তার ভাই আলিসান চৌধুরী।

১৯ দিন আগে