সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম— অনির্বাণ আলো হয়ে জেগে থাকবে সমাজে-সাহিত্যে

রাশেদা কে চৌধূরী
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০০: ৫৫
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্য, শিক্ষা ও মানবিকতার জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতা রেখে চলে গেল সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সে ছিল এমন এক মানুষ, যে কথায়-কাজে-চিন্তায় ও জীবনদর্শনে জাতির বিবেক হয়ে উঠেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দীর্ঘদিনের শিক্ষক হিসেবে সৈয়দ মনজুর ছাত্রদের শুধু সাহিত্য নয়, মানুষ হওয়ার পাঠও শেখাতো। ক্লাসরুম থেকে কলাম, গল্প থেকে প্রবন্ধ— সবখানেই ফুটে উঠত তার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, মানবিক সংবেদনশীলতা আর ন্যায়বোধ।

অন্ধকার সময়েও সে ছিল আমাদের আলোকবর্তিকা, যে দেখিয়েছে— সাহিত্য কেবল নান্দনিকতার নয়, নৈতিক সাহসেরও একটি ক্ষেত্র। অন্যায় ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সে ছিল দৃঢ়, কিন্তু তার ভাষা ছিল সবসময় কোমল, গভীর ও আলোকিত।

শৈশব, পরিবার ও পড়ালেখার সূত্রে আমাদের সারা জীবনের পথ চলা। আমরা যারা সৈয়দ মনজুরের সহপাঠী, তাকে চিনতাম বন্ধুবৎসল, হাসিখুশি ও ‘উইটি’ মানুষ হিসেবে। তার সঙ্গে আমার শৈশবের সম্পর্ক। সে সিলেট শহরের পাইলট স্কুলে পড়ত। আর আমি অগ্রণী স্কুলে পড়তাম। সৈয়দ মনজুরের সঙ্গে সেই শৈশব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা দুজন ছিলাম ইংরেজি বিভাগের সহপাঠী।

যোগসূত্র পরিচয় বা ঘনিষ্ঠতা এখানেই শেষ নয়— আমার বাবা ছিলেন সৈয়দ মনজুরের শিক্ষক, আর মনজুরের মা ছিলেন আমার শিক্ষক। সহপাঠীই শুধু নয়, বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও দাবিতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি রয়েছে আমাদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বয়কট করেছিলাম একসঙ্গে।

আজ তার এক ইন্টেগ্রিটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে আমি ছিলাম সভাপতি প্রার্থী, আর নির্বাচন কমিশনার ছিল সৈয়দ মনজুর। কিন্তু আমি সভাপতি প্রার্থী হওয়ায় সে নির্বাচন পরিচালনা করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তার বদলে ফখরুল ইসলামকে কমিশনার করা হয়।

ইংরেজি বিভাগ তো বটেই, সৈয়দ মনজুর হয়ে উঠেছিল জাতির বাতিঘর। সৈয়দ মনজুরের সূত্রে আজ মনে পড়ে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কথা। এই সূত্রে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারকেও, যার মাপের কাউকে আর খুঁজে পাই না। তাদের কাছে পুঁথিগত বিদ্যা বা পাস করা ছিল না মুখ্য বিষয়।

বাবা কর্মসূত্রে চট্টগ্রামে থাকায় আমি ভর্তি হয়েছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই আমার বিয়ে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর সৈয়দ মনজুর স্বাগত জানায় এবং আমাকে ঘিরে কিছুটা ফিসফাস টের পেয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয়, আমি বিবাহিত। আমি যখন সন্তানসম্ভবা, তখন সহপাঠী হিসেবে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে তার সহায়তার কথা বেশ মনে পড়ে।

এক গোলটেবিল বৈঠকে পাশাপাশি চেয়ারে রাশেদা কে চৌধূরী (ডান থেকে তৃতীয়) ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (ডান থেকে দ্বিতীয়)। তারা দুজনে ছিলেন সহপাঠী, পারিবারিকভাবেও ঘনিষ্ঠ। ছবি: সংগৃহীত
এক গোলটেবিল বৈঠকে পাশাপাশি চেয়ারে রাশেদা কে চৌধূরী (ডান থেকে তৃতীয়) ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (ডান থেকে দ্বিতীয়)। তারা দুজনে ছিলেন সহপাঠী, পারিবারিকভাবেও ঘনিষ্ঠ। ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ মনজুর আড়ালে অনেক মানুষের উপকার করত। তার কাছে অগ্রাধিকার ছিল ছাত্র, সতীর্থ ও সিলেট। সিলেটের কেউ তার কাছে গেলে এবং তার সামর্থ্যের মধ্যে থাকলে কখনো খালি হাতে ফিরত না। ঢাকাকেন্দ্রিক জীবন হলেও শেকড়ের প্রতি তার কমিটমেন্ট ছিল গভীর। ঢাকা ছাড়াও তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিস্তৃতি ছিল দেশের বাইরেও।

সৈয়দ মনজুরের মৃত্যুর খবর পেয়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযানের কর্মীরা অনেকেই কেঁদেছে। গণস্বাক্ষরতা অভিযানে বিভিন্ন ইস্যুতে তাকে ডাকলেই পাওয়া যেত। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির দরদ ছিল শিক্ষার প্রতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও সৈয়দ মনজুর ভাবত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক— সব স্তরের শিক্ষার কথা, এমনকি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়েও। কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধেও সে ছিল সোচ্চার। আমাদের ওপর তার এতটাই আস্থা ছিল যে অনেক সময় শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের ইস্যুতে বিবৃতি তৈরি করার সময় সে পড়েও দেখত না।

কঠিন কথা সহজ করে বলার এক জাদুকর ছিল সৈয়দ মনজুর। সে বিশ্বাস করত, সাহিত্য এক নৈতিক চর্চা, যেখানে লেখককে নিজের সময়-সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। তার গল্পে যেমন উঠে এসেছে শহুরে জীবনের সংকট, তেমনি প্রান্তিক মানুষের বেদনাও।

কালপুরুষের দুঃখবিলাস, প্রেম ও প্রার্থনার গল্প, গল্পসমগ্র, প্রত্নগল্প, ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে, কিংবা সাম্প্রতিক আলাপচারিতা— প্রতিটি রচনায় সে দেখিয়েছে বাঙালির মনোজগতের বহুমাত্রিক রূপ। প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন।

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাতে নিজের লেখা গল্পের সংকলন তুলে দিচ্ছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তারা দুজনেই এখন প্রয়াত। ছবি: সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাতে নিজের লেখা গল্পের সংকলন তুলে দিচ্ছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তারা দুজনেই এখন প্রয়াত। ছবি: সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে

সৈয়দ মনজুরের লেখায় সমাজের ভেতরকার অন্ধকার, ভয় ও অন্যায়ের মুখোমুখি হওয়ার এক সাহসী আহ্বান থাকে। তবে সেই প্রতিবাদ কখনো কণ্ঠের উচ্চতায় নয়, ভাষার গভীরতায় প্রকাশ পায়। সে বিশ্বাস করত, সত্যিকারের সাহিত্য মানবিকতাকে জাগিয়ে তোলে— অন্যের দুঃখ অনুভবের ক্ষমতা শেখায়।

তরুণ প্রজন্মের প্রতি তার আস্থা ছিল অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কিংবা পত্রিকার কলামলেখক হিসেবে সে তরুণদের উৎসাহ দিত প্রশ্ন করতে, ভাবতে, সাহসী হতে।

সে ছিল আমাদের সময়ের এক নির্ভীক চিন্তাবিদ, যে কখনো আপস করেনি নিজের নৈতিক অবস্থানের সঙ্গে। অন্যায়, দমন, বিভাজন— যে রূপেই আসুক, সে তা ভদ্র অথচ দৃঢ় ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে। তার কলমে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল এক অনমনীয় বিবেক।

আজ যখন সমাজে সত্য বলা কঠিন, যখন নৈতিকতা প্রায়ই বাজারে হারিয়ে যায়, তখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের চলে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়— বিবেক হারালে জাতি দিশাহারা হয়। সে আমাদের শিখিয়ে গেছে, শব্দেরও একটি নৈতিক দায় আছে এবং সাহিত্য মানে কেবল রুচির নয়, মানবতার চর্চাও বটে।

ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বক্তব্য রাখছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি: সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে
ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বক্তব্য রাখছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ছবি: সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে

এভাবে সৈয়দ মনজুর হঠাৎ করে চলে যাবে, ভাবতেও পারিনি। বেশ আগে থেকেই হার্ট ও কিডনির সমস্যা ছিল। বিষয়টি সেভাবে কাউকে বলেনি। একটু চাপা স্বভাবের ছিল, বিশেষ করে নিজের বিষয়ে।

ক্যান্সার সারভাইভার জীবনসঙ্গীর জন্য সে অনেক করেছে। অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে না আসার কারণ হিসেবে সে জানাত, সনজিদার (সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের স্ত্রী) শরীর ভালো না, তাই আসতে পারবে না।

সৈয়দ মনজুর ছিল এক প্রজন্মের আলোকবর্তিকা, যে আমাদের মনের অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে গেছে। তার মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি, কিন্তু তার চিন্তা, সততা ও নৈতিক সাহস আমাদের সাহিত্য-সমাজে দীর্ঘদিন জেগে থাকবে— এক অনির্বাণ আলো হয়ে।

লেখক: গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ব্যাখ্যার দায় সরকারের

এখানে সরকারের ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব আছে। তার মন্তব্যের কারণ কী, সেটি সরকার জানতে চাইতে পারে এবং পরিষ্কার করতে পারে। কারণ এর বাইরে অন্য কোনো বিশেষ জটিলতা আছে বলে আমার মনে হয় না।

৭ দিন আগে

তারেক রহমানের দেশে না ফেরা হতে পারে হিসেবি রাজনৈতিক কৌশল

দীর্ঘ সময় ধরে তারেক রহমান দেশের বাইরে। এটি এখন বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। তৃণমূলের বহু নেতাকর্মী বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। সত্যি বলতে, তিনি দেশে ফিরলে দল অবশ্যই নতুন উদ্দীপনা পাবে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও দলের সাংগঠনিক কাজ থেমে নেই— এটাই গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।

৭ দিন আগে

তারেক রহমানের ফিরতে বাধা পুরনো শক্তির অমীমাংসিত হিসাব

ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেসব শক্তি তাকে গ্রেপ্তার করেছিল এবং নির্যাতন করেছিল, তাদের সঙ্গে সেই পুরনো বিরোধ এখনো পুরোপুরি মিটেনি। সেই সময়ের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা এতে জড়িত ছিলেন, তাদের একটি অংশ আজও ‘সম্মতি’ দিচ্ছেন না— এমন ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের হয়তো নিজেদের কিছু স্বার্থ বা অবস্থান রয়ে

৭ দিন আগে

দেশে ফিরতে অসুবিধা থাকলে খোলাখুলি জনগণকে জানান

যদি তিনি সত্যিই বিএনপিকে ধরে রাখতে চান, তাকে দেশে ফিরে এসে নেতৃত্ব দিতে হবে। তা না হলে খালেদা জিয়ার দুঃখজনক অনুপস্থিতিতে দল গভীর সংকটে পড়বে। আমি আশা করি তিনি ফিরবেন। আর যদি কোনো অসুবিধা থাকে, সেটা খোলাখুলিভাবে জনগণকে জানানো উচিত— ‘এই আমার অসুবিধা’।

৭ দিন আগে