চাকরিজীবীদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতেই হবে

বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিতে হলে সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতাসীনদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি।

আমাদের সংবিধানের ২য় অনুচ্ছেদের ধারা ২১(২) স্পষ্টভাবে বলে, ‘জনসেবার সকল পর্যায়ে সেবাগ্রহীতার প্রতি নিরপেক্ষতা, জবাবদিহিতা ও আনুগত্য রক্ষা করতে হবে।’

তবে বাস্তবে দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচার, দলীয় সভা বা প্রভাবশালী নেতার স্বার্থ রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হন। বেসরকারি খাতে রাজনৈতিক প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম থাকলেও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত নয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন। তাদের মূল কাজ হওয়া উচিত জনগণের সেবা নিশ্চিত করা। অথচ রাজনৈতিক চাপ ও পক্ষপাতের কারণে প্রকৃত জনসেবা ব্যাহত হয়। এতে একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্বল হয়, অন্যদিকে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশে বেসরকারি খাতে প্রায় চার কোটি মানুষ কর্মরত। অনেক প্রতিষ্ঠানেই বস, মালিকপক্ষ বা সুপারভাইজারের রাজনৈতিক মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হয় বা চাকরি হারানোর ভয় দেখানো হয়। এ ধরনের চাপ শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এবং যোগ্য কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, নিরাপদ কর্মপরিবেশ মানে শুধু শারীরিক নিরাপত্তা নয়, বরং রাজনৈতিক ও মানসিক চাপমুক্ত একটি পেশাগত পরিবেশও নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বেসরকারি খাতেও দক্ষ জনবল টিকে থাকতে পারে না, উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়ে।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিশেষভাবে বিবেচ্য—

  • জনগণ সরকারি অফিসে গেলে তারা দলীয় আনুগত্য নয়, বরং দ্রুত-স্বচ্ছ ও নিয়মতান্ত্রিক সেবা প্রত্যাশা করে।
  • রাজনৈতিক চাপে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন, ফলে তাদের আগ্রহ ও কর্মোদ্যম নষ্ট হয়, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের সরকারি কর্ম কমিশনের (PSC) সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ কর্মকর্তাই মনে করেন রাজনৈতিক প্রভাব তাদের পেশাগত উন্নয়নে বড় বাধা।
  • রাজনৈতিক চাপ ও মানসিক হয়রানি কেবল শ্রম আইন ভঙ্গ নয়, বরং মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। সরকার বা মালিকানা পরিবর্তনের সময় কর্মীরা হঠাৎ সমস্যায় পড়েন, যা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

অতএব রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণে সরকারি আইন ২০১৮-কে আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে, যেন রাজনৈতিক আনুগত্য নয় বরং যোগ্যতা ও দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা হয়।

বেসরকারি খাতে শ্রম আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে কর্মীদের রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কর্মসূচিতে জোর করে অংশগ্রহণ বন্ধ করা জরুরি। একই সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে রাখতে হবে, তারা দেশের বা মানুষের সেবক— কোনো দল বা ব্যক্তির নয়।

বাংলাদেশে উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক চর্চা টিকিয়ে রাখতে হলে কর্মক্ষেত্রকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। তা না করতে পারলে দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব ও অব্যবস্থাপনা আরও গভীর হবে, যা জাতীয় অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। তাই সরকারি ও বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই একটি নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং স্বচ্ছ কর্মসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার এখনই সময়।

লেখক: উপপরিচালক (এইচআর ফ্যাকাল্টি), নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এবং সাবেক সহসভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা)

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

পুঁজিবাজারে মহামারি—শেয়ারমূল্য তলানিতে

অন্যদিকে অনুরুদ্ধ কুমারা দিশানায়েকে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেউলিয়া শ্রীলঙ্কার অর্থ–সামাজিক–রাজনৈতিক সূচককে সম্মানজনক উচ্চতায় তুলেছেন। দিশানায়েক নোবেলপ্রাপ্ত নন; আন্তর্জাতিক বাজারের ভাষ্যকারও নন। তবু তিনি নিজ দেশে দৃশ্যমান উন্নয়ন ঘটিয়েছেন।

১১ দিন আগে

পলিটিক্সের বাংলা অর্থ কি রাজনীতি?

অর্থাৎ, ‘পলিটিক্স’ শব্দের মূল শেকড় গ্রিক ‘Polis’ (নগর-রাষ্ট্র) থেকে এসেছে, আর ধাপে ধাপে ভাষাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে আজকের ব্যবহৃত রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে ‘রাজনীতি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে।

১৩ দিন আগে

অন্তর্বর্তীকালীন না, এই সরকার উপদেষ্টা সরকার

এখন আপনারা বারবার বলতেছেন গণভোট। গণভোট কে দেবে? এই সরকারের কি এখতিয়ার আছে গণভোট দেওয়ার? সে তো বলছে, আমি এই সংবিধান রক্ষা করব। কীসের গণভোট?

১৫ দিন আগে

কোডিং ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিখিত পরীক্ষার মূল্যায়ন: একটি বিশ্লেষণ

কোডিং পদ্ধতিতে কেবল লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এর বাইরে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শ্রেণি পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রেজেন্টেশন, মৌখিক পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষার কোনোটিতেই কোডিং বা ছদ্মবেশ নেওয়ার কোনো উপায় নেই!

১৬ দিন আগে