যখন স্বপ্ন পুড়ে ছাই, তখনই আত্মজাগরণের সময়

আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৫২

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের শিশুরা সেদিনও প্রতিদিনের মতোই ক্লাসে যাচ্ছিল। কেউ কবিতা মুখস্থ করছিল, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে হাসছিল, কেউ ঘুমজড়ানো চোখে বেঞ্চে বসে ছিল। কোনো মা-বাবা তখন কল্পনাও করেননি, সেদিন বাসা থেকে স্কুলের পতে যাত্রাই ছিল তাদের সন্তানের শেষ বিদায়।

আচমকা সেই স্বাভাবিক দুপুর পরিণত হলো ভয়াল এক মুহূর্তে। একটি প্রশিক্ষণ বিমান আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল স্কুলের ওপর। আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। শিশুদের কান্না, চিৎকার আর আগুনে পুড়ে যাওয়া শরীর— সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য। এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি জাতীয় ট্রাজেডি— যা আমাদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।

স্তব্ধ, বিমূঢ় একটি জাতি

আমরা অনেক দুর্যোগ, অনেক মৃত্যু দেখেছি। কিন্তু এবার মৃত্যু এসেছিল স্কুলে পাঠরত শিশুদের ঘরে। তাদের নিষ্পাপ মুখ, তাদের স্বপ্ন, তাদের খেলা— সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এই শোক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কোনো মা এখন পুড়ে যাওয়া সন্তানের পাশে বসে আছে। কীভাবে বলব, ‘আপনার সন্তান আর ফিরে আসবে না!’

এটি কি কেবল নিয়তি? নাকি এক গাফিলতির ইতিহাস?

প্রতিটি মৃত্যু যদি এড়ানো যেত, তবে আমরা কেন আগেই ব্যবস্থা নিইনি? প্রশিক্ষণ বিমান কেন জনবহুল স্কুলের এত কাছে উড়ছিল? কোথায় ছিল নিরাপত্তা প্রটোকল? স্কুলের আগুন প্রতিরোধব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত ছিল? প্রশাসনিক অনুমোদন ও পর্যবেক্ষণ কতটা কার্যকর? এসব প্রশ্ন রাজনীতি নয়, এগুলো নিরাপত্তার প্রশ্ন, দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন।

কিছু গল্প, যা আর বলা হবে না

৮ বছরের আয়েশা প্রতিদিন পাখির ছবি আঁকত। তার খাতা রঙিন স্বপ্নে ভরা। আজ সে ৮০ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

১০ বছরের সামি একটি সায়েন্স প্রেজেন্টেশনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। সে আর কোনোদিন মঞ্চে উঠবে না।

এ গল্পগুলো শুধুই কয়েকটি নাম নয়, এগুলো আমাদের সব শিশুর গল্প। তাদের প্রত্যেকের জন্য আমাদের দায় আছে।

এখন কী করণীয়— একটি জাতি হিসেবে?

আমরা যাদের হারিয়েছি, তাদের ফেরাতে পারব না। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে পারি।

জাতীয় শোক ঘোষণা: এ দুর্ঘটনা স্মরণ করে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতা, আলোচনা সভা ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক।

স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি: বেসামরিক ও সামরিক উভয় পক্ষের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ তদন্ত কমিটি গঠন করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক।

স্কুল ও হাসপাতালকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা: প্রশিক্ষণ বা নিম্ন উচ্চতার উড়ানকে জনবহুল ও সংবেদনশীল এলাকায় নিষিদ্ধ করতে হবে।

আহতদের পূর্ণ চিকিৎসা ও মানসিক সমর্থন: দেশে বা বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং মানসিক সাপোর্টের জন্য পৃথক তহবিল গঠন করা হোক।

ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের জন্য আজীবন স্কলারশিপ: বেঁচে যাওয়া শিশুদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে সম্পূর্ণ শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা হোক।

শিক্ষক ও কর্মীদের সম্মাননা ও সমর্থন: দুর্ঘটনার সময় যারা সাহসিকতার সঙ্গে রক্ষা করেছেন, তাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হোক।

একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ: নিহত শিশুদের নামসহ একটি স্মৃতি প্রাচীর গড়ে তোলা হোক, যা জাতিকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেবে— আমরা যেন ভুলে না যাই।

জাতীয় শিশু নিরাপত্তা টাস্কফোর্স: প্রতিটি স্কুলের জন্য ঝুঁকি মূল্যায়ন, অগ্নিনিরাপত্তা ও জরুরি প্রস্তুতির জন্য একটি স্থায়ী সরকারি কমিটি গঠন করা হোক।

বিশ্ব থেকে শিক্ষা

জাপানে শিশুদের জন্য সপ্তাহে একাধিক ভূমিকম্প মহড়া হয়। আমেরিকায় স্কুল নিরাপত্তা নিয়ে আইন হয়েছে বহুবার। আমরা কেন পারি না?

সমাজের করণীয়

সরকারের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, চিকিৎসক, শিক্ষক, সংগঠন— সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

কমিউনিটি কাউন্সেলিং, নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতা, জনমত গঠন, অনুদান সংগ্রহ— এ দুঃখ যেন শুধু কান্নায় শেষ না হয়। এ দুঃখ পরিবর্তনের বীজ হয়ে উঠুক।

‘বারবার কেন জাগি

কেবল মৃত্যুর পর?’

আমরা প্রতিক্রিয়া দিই, কিন্তু প্রস্তুত হই না। কেন? এই লেখা কারও বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি আত্মজিজ্ঞাসা। আমরা কি এবার সত্যিই পরিবর্তন চাই?

অন্তরের দোয়া

‘হে আল্লাহ, যেসব শিশু ও প্রাণ আমরা হারিয়েছি, তাদের জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আহতদের পূর্ণ সুস্থতা দিন। পরিবারগুলোকে ধৈর্য ও শক্তি দিন। জাতির অন্তরে সচেতনতা সৃষ্টি করুন যেন আর কোনো শিশু এমনভাবে মৃত্যুবরণ না করে।’

এই লেখা আমি লিখছি একজন পিতা, একজন সাধারণ মানুষ, একজন বিবেকবান নাগরিকের হৃদয় নিয়ে। এই গল্প যেন আমরা ভুলে না যাই। বরং এটিই হোক আমাদের পথ পরিবর্তনের ইতিহাস।

[লেখাটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত। কোনো প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা কর্মস্থলের প্রতিনিধিত্ব করে না।]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

অপারেশন মাউন্টেন ঈগল: মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতী গেরিলা

কর্ণফুলীর স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরের আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ। সেই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ যোগ দেয় একদল সশস্ত্র তিব্বতীয় গেরিলা। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আর কর্ণফুলীর স্রোত যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। আনন্দে উদ্বেলিত জনতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিব্বতীয়দের দিকে।

১২ দিন আগে

সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

১২ দিন আগে

সহিংসতার রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হ

১৩ দিন আগে

অস্তিত্ব সংকটে শিক্ষা ক্যাডার ও উচ্চশিক্ষা

আজ যদি ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির দাবি মেনে এই মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হয়, তবে খুব দ্রুতই জেলা পর্যায়েও একই দাবি উঠবে। টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি কিংবা রাজশাহী কলেজ, বিএম কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি আসবে।

২০ দিন আগে