ড. আবদুল লতিফ মাসুম
বছর জুড়ে অভ্যুত্থানের ঢেউ পেরিয়ে ৫ আগস্ট জাতি পেল দুটি বড় ঘোষণা— জুলাই ঘোষণাপত্র ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের পরিবর্তন-আকাঙ্ক্ষা এবার প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল। অর্ধ শতাব্দীর রাজনৈতিক অবহেলা ও বঞ্চনার পর এই ঘোষণাপত্রকে অনেকে দেখছেন গণতন্ত্রের নতুন সোপান হিসেবে, যদিও অসম্পূর্ণতার অভিযোগও তুলেছেন অনেকে।
গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী দাবি-দাওয়ার বেশুমার প্রদর্শন সেই জমে থাকা হতাশারই প্রমাণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা সচেতন মানুষ জানেন। তারপরও অসচেতনভাবে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ, সচিবালয়, এমনকি প্রধান উপদেষ্টার আবাসস্থল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে জনগণের আবেদন ও আন্দোলন। এককভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হিমালয়সম ক্ষোভ ও ক্রোধকে প্রশমিত করতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। তাই সঙ্গতভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধানত তিনটি প্রত্যয় নিয়ে সরকার তার যাত্রা শুরু করে। প্রথমত, বৈষম্যের নিরসন; দ্বিতীয়ত, সংস্কার প্রস্তাবনা; এবং তৃতীয়ত, গণহত্যাকারী পতিত সরকারের বিচার। এর মধ্যে বৈষম্যের নিরসন এমন একটি গণদাবি, যার সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার ইতিহাস।
অন্যদিকে সংস্কার প্রস্তাবনা এতই দীর্ঘ ও অগণিত যে হিসাব-নিকাশ একরকম অসম্ভব। সরকার এসব সংস্কার বা মেরামতের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। অবশেষে ছয়টি কমিশনের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হয়। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসম্ভব ধৈর্য ও কুশলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিভেদের, ঐক্যের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙন প্রক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেই এই দ্বন্দ্ব, কলহ, কোন্দল ইত্যাদির প্রমাণ মিলবে।
৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশ নেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ একমত হওয়া অসম্ভব কল্পনা। তবে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশির ভাগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করলেই কমিশনের সার্থকতা প্রমাণিত হবে। কিছু মৌলিক বিষয়ে অবশ্য একমত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে যা অর্জিত হয়েছে এই দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের দেশে, তাও কম নয়।
সংস্কারের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল— সংবিধান, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, নির্বাচনব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, গণপ্রতিনিধিদের সীমিত স্বাধীনতার গ্যারান্টি, আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, শাসন ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিযুক্তির ন্যায্যকরণ।
রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোনো দিক নেই যে সংস্কারের আবেদন উত্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয় হচ্ছে— সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করা, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিত করা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি।
এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য অর্জন সরকারের একটি বড় সাফল্য। এদিকে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দাবি ও ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে চলেছে। সে কারণে ৫ আগস্টের সুন্দর সময়ে সরকার একই সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায় ও দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে পারত অভ্যুত্থানের পরপরই, সেটি অবশেষে প্রকাশিত হলো। জুলাই বিপ্লবের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা রয়েছে। এখানে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৪ নম্বর দফায় গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।
ঘোষণাপত্রের শেষ কথাগুলো এ রকম— ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।’
এ ঘোষণার মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত একটি বিষয়ের মীমাংসা হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা বারবার এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারা নিজেরা ঘোষণাটি দেবেন— এ রকম তারিখও দুয়েকবার দিয়েছেন। সর্বশেষ এনসিপি বলেছিল, ৩ আগস্ট জনসমক্ষে ঘোষণাটি প্রকাশ করা হবে। ঘোষণাটি অনেককে তুষ্ট করেছে। আবার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন জুলাই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হননি।
৫ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল ঘোষণা করেন। আগামী বছর, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠানোর কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এরই মধ্যে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত চিঠি নির্বাচন কমিশন বরাবর পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কমিশন যেন রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার ও সংস্কারসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়— ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব ছিল। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারবার ওয়াদা করছিলেন বটে, তবে সঠিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো কথা বলেননি।
রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখী। যে দল যতটা প্রত্যয়ী তারা তত জোরেশোরে নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিল। এ অনিশ্চিত অবস্থাটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে বেশ দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি করে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন বৈঠকে। রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসে। তবে অন্য দলগুলো বিএনপির এই প্রাধান্যের বিরোধিতা করে।
যাই হোক, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনটি হবে— এ রকম আশ্বাসের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টের ঘোষণা এসেছে। এ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংশয় ও সন্দেহে ভুগছিল, তার অবসান ঘটল। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্বস্তির কথা বললেও কোনো দলই নির্বাচন নাকচ করা বা প্রতিরোধের কথা বলেনি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে গুজব ছিল, ঘোষিত সময়সীমার বিপক্ষে অবস্থান নেবে ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অসম্পূর্ণতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়নি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের দিন-ক্ষণ।
আগেই বলা হয়েছে, বিএনপি স্বস্তির মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা দুটির পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস দৃঢ়তর হবে— এটিই স্বাভাবিক। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি, এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে।
নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচনের দিন-ক্ষণকে স্বাগত জানানো হলেও জুলাই ঘোষণাকে তারা অসম্পূর্ণ ও একপেশে মনে করছে। দলের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা লক্ষ করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে।
এক সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির পীরসাহেব চরমোনাই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর ও নব্বইয়ের আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় ১৯৪৭ সাল এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড শাপলা হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও আলেম-উলামাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন মনে করে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমাদের একটি জোরালো অবস্থান ছিল। সেটি হলো— জুলাই সনদ সইয়ের পরই তা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ সেটি বাস্তবায়ন করবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
জুলাই সনদ ও নির্বাচন সম্পর্কে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বাম ধারার প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। তবে জুলাই সনদ ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা উপস্থিত ছিলেন না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্ক্ষার কিছু বিষয় ‘অনুপস্থিত’ থাকলেও, তা স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে দলের এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চলমান রাষ্ট্রসংস্কার উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান করার বিষয়টি সরকারকে ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কিছু অস্বস্তি লক্ষ করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আগের মতো এসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে মতামত জেনে নিত, তাহলে অদৃশ্যমান বিভেদটি দৃশ্যমান হতো না।
তবে নাগরিক সাধারণ জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কার, সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনটি উপায়ে নাগরিক সাধারণের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান করা যায়।
প্রথমত, সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের সইয়ে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃত সংশোধনীর প্রকাশ ঘটানো যায়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রপতি তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনি ঘোষণাপত্রের (Legal Frame Order) মাধ্যমে সংস্কারকার্যক্রম ও প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের ঘোষণা দেওয়া যায়।
বাংলাদেশের মতো বিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক ছাতার নিচে দলগুলোকে আনা সহজ নয়। তবু জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কিছু মৌলিক সংস্কারে একমত করিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এখন নাগরিকদের চোখ নির্বাচনের দিকে— যেখানে শুধু তারিখ নয়, দরকার নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন। সময় বলবে, ৫ আগস্টের এই ঘোষণাগুলো ইতিহাসের মোড় ঘোরাবে নাকি অন্ধকারে ঠেলে দেবে।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বছর জুড়ে অভ্যুত্থানের ঢেউ পেরিয়ে ৫ আগস্ট জাতি পেল দুটি বড় ঘোষণা— জুলাই ঘোষণাপত্র ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের পরিবর্তন-আকাঙ্ক্ষা এবার প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল। অর্ধ শতাব্দীর রাজনৈতিক অবহেলা ও বঞ্চনার পর এই ঘোষণাপত্রকে অনেকে দেখছেন গণতন্ত্রের নতুন সোপান হিসেবে, যদিও অসম্পূর্ণতার অভিযোগও তুলেছেন অনেকে।
গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী দাবি-দাওয়ার বেশুমার প্রদর্শন সেই জমে থাকা হতাশারই প্রমাণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সীমাবদ্ধতা সচেতন মানুষ জানেন। তারপরও অসচেতনভাবে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণ, সচিবালয়, এমনকি প্রধান উপদেষ্টার আবাসস্থল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে জনগণের আবেদন ও আন্দোলন। এককভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই হিমালয়সম ক্ষোভ ও ক্রোধকে প্রশমিত করতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। তাই সঙ্গতভাবেই জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত সরকারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
প্রধানত তিনটি প্রত্যয় নিয়ে সরকার তার যাত্রা শুরু করে। প্রথমত, বৈষম্যের নিরসন; দ্বিতীয়ত, সংস্কার প্রস্তাবনা; এবং তৃতীয়ত, গণহত্যাকারী পতিত সরকারের বিচার। এর মধ্যে বৈষম্যের নিরসন এমন একটি গণদাবি, যার সঙ্গে যুক্ত কোটি কোটি মানুষের দীর্ঘকাল ধরে বঞ্চনার ইতিহাস।
অন্যদিকে সংস্কার প্রস্তাবনা এতই দীর্ঘ ও অগণিত যে হিসাব-নিকাশ একরকম অসম্ভব। সরকার এসব সংস্কার বা মেরামতের সুপারিশ প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। অবশেষে ছয়টি কমিশনের মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হয়। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অসম্ভব ধৈর্য ও কুশলতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের জনচরিত্র বিভেদের, ঐক্যের নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙন প্রক্রিয়া গভীরভাবে অবলোকন করলেই এই দ্বন্দ্ব, কলহ, কোন্দল ইত্যাদির প্রমাণ মিলবে।
৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল এই সংলাপে অংশ নেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর শতভাগ একমত হওয়া অসম্ভব কল্পনা। তবে গরিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশির ভাগ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করলেই কমিশনের সার্থকতা প্রমাণিত হবে। কিছু মৌলিক বিষয়ে অবশ্য একমত হয়নি রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তবে যা অর্জিত হয়েছে এই দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের দেশে, তাও কম নয়।
সংস্কারের প্রধান প্রধান বিষয়গুলো ছিল— সংবিধান, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রণয়ন, নির্বাচনব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, গণপ্রতিনিধিদের সীমিত স্বাধীনতার গ্যারান্টি, আমলাতন্ত্রের জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নির্ধারণ, শাসন ও বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিযুক্তির ন্যায্যকরণ।
রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন কোনো দিক নেই যে সংস্কারের আবেদন উত্থাপিত হয়নি। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এসব বিষয় হচ্ছে— সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয় করা, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিত করা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি।
এসব বিষয়ে সাধারণ ঐকমত্য অর্জন সরকারের একটি বড় সাফল্য। এদিকে সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দাবি ও ব্যবস্থাপনাও এগিয়ে চলেছে। সে কারণে ৫ আগস্টের সুন্দর সময়ে সরকার একই সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায় ও দায়িত্ব পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশিত হতে পারত অভ্যুত্থানের পরপরই, সেটি অবশেষে প্রকাশিত হলো। জুলাই বিপ্লবের প্রতি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার রেখে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্রে ২৮টি দফা রয়েছে। এখানে ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের স্বীকৃতি রয়েছে। ঘোষণাপত্রের ২৪ নম্বর দফায় গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের জাতীয় বীর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে।
ঘোষণাপত্রের শেষ কথাগুলো এ রকম— ‘৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হলো।’
এ ঘোষণার মাধ্যমে বহুল প্রতীক্ষিত একটি বিষয়ের মীমাংসা হলো। জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা বারবার এ ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তারা নিজেরা ঘোষণাটি দেবেন— এ রকম তারিখও দুয়েকবার দিয়েছেন। সর্বশেষ এনসিপি বলেছিল, ৩ আগস্ট জনসমক্ষে ঘোষণাটি প্রকাশ করা হবে। ঘোষণাটি অনেককে তুষ্ট করেছে। আবার রাজনৈতিক দলের কয়েকজন জুলাই ঘোষণায় সন্তুষ্ট হননি।
৫ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় জীবনে গৌরবময় দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরপরই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কাল ঘোষণা করেন। আগামী বছর, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই নির্বাচন আয়োজন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠানোর কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এরই মধ্যে সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত চিঠি নির্বাচন কমিশন বরাবর পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কমিশন যেন রমজান মাস শুরুর আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যার বিচার ও সংস্কারসহ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তার ভাষায়— ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা, নির্বাচন অনুষ্ঠান। এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।’
নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন দূরত্ব ছিল। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন অনুষ্ঠানে বারবার ওয়াদা করছিলেন বটে, তবে সঠিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনি কোনো কথা বলেননি।
রাজনৈতিক দলগুলো স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনমুখী। যে দল যতটা প্রত্যয়ী তারা তত জোরেশোরে নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছিল। এ অনিশ্চিত অবস্থাটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে বেশ দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি করে।
এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডন বৈঠকে। রাজনৈতিক মহলে মোটামুটি স্বস্তি ফিরে আসে। তবে অন্য দলগুলো বিএনপির এই প্রাধান্যের বিরোধিতা করে।
যাই হোক, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনটি হবে— এ রকম আশ্বাসের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে। সেই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্টের ঘোষণা এসেছে। এ ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো যে সংশয় ও সন্দেহে ভুগছিল, তার অবসান ঘটল। এর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দল জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্বস্তির কথা বললেও কোনো দলই নির্বাচন নাকচ করা বা প্রতিরোধের কথা বলেনি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে গুজব ছিল, ঘোষিত সময়সীমার বিপক্ষে অবস্থান নেবে ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অসম্পূর্ণতা, অগ্রহণযোগ্যতা ও অসহযোগিতার কথা উচ্চারিত হলেও প্রত্যাখ্যাত হয়নি ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ও নির্বাচনের দিন-ক্ষণ।
আগেই বলা হয়েছে, বিএনপি স্বস্তির মধ্যে ছিল। এই ঘোষণা দুটির পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস দৃঢ়তর হবে— এটিই স্বাভাবিক। নির্বাচন ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি, এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে।
নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠকে এই সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচনের দিন-ক্ষণকে স্বাগত জানানো হলেও জুলাই ঘোষণাকে তারা অসম্পূর্ণ ও একপেশে মনে করছে। দলের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা লক্ষ করছি, নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এ জন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে।
এক সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির পীরসাহেব চরমোনাই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর ও নব্বইয়ের আন্দোলনসহ দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হলেও আমাদের স্বাধীনতার প্রথম অধ্যায় ১৯৪৭ সাল এবং পতিত ফ্যাসিস্ট আমলের সবচেয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড শাপলা হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও আলেম-উলামাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ না করে ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অংশ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন মনে করে, এতে ইতিহাসের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমাদের একটি জোরালো অবস্থান ছিল। সেটি হলো— জুলাই সনদ সইয়ের পরই তা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ সেটি বাস্তবায়ন করবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের জনআকাঙ্ক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
জুলাই সনদ ও নির্বাচন সম্পর্কে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বাম ধারার প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। তবে জুলাই সনদ ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা উপস্থিত ছিলেন না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্ক্ষার কিছু বিষয় ‘অনুপস্থিত’ থাকলেও, তা স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে দলের এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে চলমান রাষ্ট্রসংস্কার উদ্যোগগুলো দৃশ্যমান করার বিষয়টি সরকারকে ফের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
জুলাই ঘোষণা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কিছু অস্বস্তি লক্ষ করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি আগের মতো এসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে মতামত জেনে নিত, তাহলে অদৃশ্যমান বিভেদটি দৃশ্যমান হতো না।
তবে নাগরিক সাধারণ জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কার, সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বিগ্ন। তিনটি উপায়ে নাগরিক সাধারণের এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান করা যায়।
প্রথমত, সব রাজনৈতিক নেতৃত্বের সইয়ে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করা যায়। দ্বিতীয়ত, অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের স্বীকৃত সংশোধনীর প্রকাশ ঘটানো যায়। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রপতি তথা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আইনি ঘোষণাপত্রের (Legal Frame Order) মাধ্যমে সংস্কারকার্যক্রম ও প্রশাসনিক দায়-দায়িত্বের ঘোষণা দেওয়া যায়।
বাংলাদেশের মতো বিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক ছাতার নিচে দলগুলোকে আনা সহজ নয়। তবু জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কিছু মৌলিক সংস্কারে একমত করিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এখন নাগরিকদের চোখ নির্বাচনের দিকে— যেখানে শুধু তারিখ নয়, দরকার নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন। সময় বলবে, ৫ আগস্টের এই ঘোষণাগুলো ইতিহাসের মোড় ঘোরাবে নাকি অন্ধকারে ঠেলে দেবে।
লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিএনপি, যাদের এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল, তারা চাইছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হোক, যাতে তারা নিজেদের অবস্থান ফের শক্ত করতে পারে। তবে এনসিপি ও জামায়াত মনে করে, আগে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার—তারপরেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়া যেতে পার
৪ দিন আগেদিনটি এখন ইতিহাসে খোদাই হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— এটা কি কেবল রোমাঞ্চকর এক স্মৃতি, নাকি বদলে দিয়েছে দেশের ভবিষ্যৎগতি? যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেদিন, তা কি এখনও দীপ্ত? নাকি ঢেকে যাচ্ছে নতুন হতাশার ছায়ায়?
৬ দিন আগেতবে বহু বছর পর ব্যাংক ও বীমা খাত একসঙ্গে ধনাত্মক ধারায় প্রবেশ করেছে। এর কৃতিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দাবি করতেই পারেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন এবং আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন।
৮ দিন আগেআমরা যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই দেখা যায় যে, যুক্তরাজ্যই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জায়নবাদী নেতা ব্যারণ রথচাইল্ডকে এক পত্রে বৃটিশ সরকার কর্তৃক ইহুদী জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাসভূমি গড়ে
৯ দিন আগে