গণভোট কী, এতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে কি?

বিশেষ প্রতিনিধি, রাজনীতি ডটকম
গণভোট। প্রতীকী ছবি

সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে আলোচনায় উঠে এসেছে গণভোট। রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটের মাধ্যমেই এই সনদ বাস্তবায়নের জনরায় পেতে সম্মতির কথা জানিয়েছে।

নতুন করে আলোচনায় উঠে আসা এই গণভোট প্রকৃতপক্ষে কী? এই গণভোটের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন কতটুকু ঘটে? বাংলাদেশে এর আগে যে কয়েকটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে কী ঘটেছিল?

গণভোট কী

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গণভোট রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল একটি ধারণা। এটি প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। দেশের ইতিহাসে এমন ভোট এর আগে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার জুলাই সনদ ঘিরে চতুর্থ গণভোটের আলোচনাও এগিয়েছে অনেক দূর।

গণভোটের মূল ভাবনা হলো— জনগণের হাতে সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তুলে দেওয়া। কোনো নীতি, সংবিধান সংশোধনী বা শাসনব্যবস্থা নিয়ে জনগণ কী ভাবছে, সে বিষয়ে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করাই হলো গণভোট।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বাইরে গিয়ে এমন সরাসরি অংশগ্রহণ রাজনৈতিক বৈধতা ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটি উপায় হিসেবে কাজ করতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বের অনেক দেশেই স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিভিন্ন ইস্যুতে এমন গণভোটের মাধ্যমে জনরায় বাস্তবায়নের নজির রয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণভোট প্রায় সবসময়ই শাসকগোষ্ঠীর সমর্থন যাচাইয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাস বলছে, গণভোটের এই প্রক্রিয়া জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা প্রকাশের স্বাধীন প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার হয়নি দেশে।

কী ঘটেছিল আগের গণভোটগুলোতে

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট তিনটি জাতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে সবশেষ গণভোটটিও হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে, ১৯৯১ সালে। এর আগে ১৯৭৭ সাল ও ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশের ইতিহাসের প্রথম ও দ্বিতীয় গণভোট।

১৯৭৭ সালের প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে। ওই বছরের ৩০ মে আয়োজিত গণভোটের প্রশ্ন ছিল— জিয়াউর রহমানের নীতি ও কর্মকাণ্ডের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না?

সরকার দাবি করেছিল, প্রায় ৯৮ শতাংশ ভোটার ‘হ্যাঁ’ বলেছে সেই গণভোটে। তবে ওই সময়কার প্রশাসনিক প্রভাব, সেনাশাসনের প্রেক্ষাপট ও বিরোধী কণ্ঠরোধের কারণে এ ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল শুরু থেকেই। অনেক গবেষক ও ইতিহাসবিদ মনে করেন, এটি ছিল সামরিক শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠার এক প্রকার রাজনৈতিক চেষ্টা।

দ্বিতীয় গণভোটটি হয় জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময়ে, ১৯৮৫ সালের ১ মার্চ। এ গণভোটের উদ্দেশ্যও ছিল মূলত একই— নিজের শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রতি জনগণের অনুমোদন পাওয়া।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দ্বিতীয় সেই গণভোটে ৯৪ শতাংশেরও বেশি ভোটার সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ভোটেও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক দমননীতি ও বিরোধী দলগুলোর বর্জনের কারণে ‘গণ’ বা ‘ভোট’— দুটোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য গণভোটটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী বিল অনুমোদনের জন্য। এবারের গণভোটে প্রশ্ন ছিল— বাংলাদেশ কি রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা পরিত্যাগ করে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠা করবে?

সরকারি হিসাব বলছে, প্রায় ৮৪ শতাংশ ভোটার ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছিলেন, তথা রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনর্প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। ফলে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে মূলত আনুষ্ঠানিক পদে সীমাবদ্ধ করে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় সে সময়।

এই গণভোটটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এক মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত। কারণ এর মাধ্যমেই সংসদীয় শাসনব্যবস্থার পুনর্প্রবর্তন নিশ্চিত হয়।

গণভোট নিয়ে সংবিধান কী বলছে

সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো মৌলিক সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হওয়ার পর চাইলে গণভোটে নেওয়া যেতে পারে। গণভোট আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধান করে এবং নির্বাচনি রোলে অন্তর্ভুক্ত নাগরিকরাই ভোট দিতে পারেন।

কিন্তু বাস্তবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৯১ সালের পর আর কোনো গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। গণভোট সংক্রান্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি একরকম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ শাসকদল বা প্রশাসন কেউই আর এমন সরাসরি জনরায়ের ঝুঁকি নিতে চায়নি।

নতুন করে কেন আলোচনায় গণভোট

সাম্প্রতিক সময়ে সংবিধান সংস্কার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল বা ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের দাবি নতুন করে উঠেছে।

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিতে গণভোট করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। গত রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে নিজেদের মতামত স্পষ্ট করেছে।

এ ক্ষেত্রে গণভোটের আয়োজনের ব্যাপারে সব একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলই, তবে তা আয়োজনের সময় নিয়ে রয়েছে মতভিন্নতা। বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দল বলেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদের গণভোট অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে জনরায় নিশ্চিত হওয়ার পক্ষে অভিমত জানিয়েছে।

অন্যদিকে যেসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত আছে সেগুলোর কী হবে, গণভোটের আগে জুলাই সনদ নিয়ে সংবিধান আদেশ জারি করা হবে কি না— রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে এসব বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের পর কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে। তবে বিএনপি ও এনসিপি বলছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই আলাদা ব্যালটে আয়োজন করতে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বলছে নির্বাচনের আগেই গণভোট হলে ভালো।’

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, বুধবার দুপুরে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। কমিশন আশা করছে, সেদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।

গণভোট কতটা গণতান্ত্রিক

বাংলাদেশে গণভোটের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এটি জনগণের ইচ্ছা প্রকাশের চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের প্রতীকী আয়োজন হিসেবে। যে তিনটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতিটিই তখনকার ক্ষমতাসীন সামরিক বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবস্থান শক্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা মনে করেন, এসবের পরিপ্রেক্ষিতে গণভোটের ভাবনাটি যতটা গণতান্ত্রিক আদর্শের অংশ, ততটাই এটি ক্ষমতার রাজনীতির একটি হাতিয়ার। ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে আবার কোনো গণভোট হয়, তার প্রকৃত তাৎপর্য নির্ভর করবে এটি কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয় তার ওপর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারপরও গণভোটের ধারণাটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং গণতন্ত্রের চূড়ান্ত পরীক্ষার এক রূপ। যদি প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক ঐকমত্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে গণভোট হতে পারে জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ এবং রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের একটি গ্রহণযোগ্য পথ। তা না হলে এটি থেকে যাবে কেবল রাজনৈতিক নাটকের অংশ হিসেবে— যেমনটি ছিল বাংলাদেশের অতীতের তিনটি গণভোটে।

জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক রাজনীতি ডটকমকে বলেন, এক ডজন কমিশন ও তার ওপর ঐকমত্য কমিশন হয়েছে। এসবের ফলে রাজনীতিটা বিরাজনীতিকরণ হয়েছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে, সেটা নিয়ে তারা জনগণের কাছে যায়। আর তারা এসি রুমে বসে মাসের পর মাস মিটিং করছেন। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হলে সময় বেশ কম । কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা ঐকমত‍্য কমিশনকেন্দ্রিক। আমি মনে করি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছে সরকার।

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটকে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি মনে করেন না এই সংবিধান বিশেষজ্ঞ। বলেন, জুলাই সনদ যদি পাঁচ পাতার হয় এবং সেটাতে অনেকগুলো ধারা থাকে, সেক্ষেত্রে এটা পড়ে সাধারণ মানুষ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন? আসলে ডকুমেন্টের ওপর গণভোট হয় না।

একটা বাঁশের মই দিয়ে চাঁদে যাওয়ার বিষয়ে আপনি ছয় মাস আলোচনা করতে পারবেন। কিন্তু চাঁদে যেতে পারবেন কি?— প্রশ্ন রাখেন শাহদীন মালিক।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

ফ্যাসিবাদের শেষ শিকড় উৎখাত করে জনতার বাংলাদেশ গড়ে তুলব : ছাত্র অধিকার পরিষদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি থেকে ফ্যাসিবাদের শেষ শিকড় উৎখাত করে ‘জনতার বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ। ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক শহীদ আবরার ফাহাদের ষষ্ঠ শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি পায়রা চত্বর

৮ ঘণ্টা আগে

আ.লীগের অপরাধ তদন্ত শুরু হয়েছে: চিফ প্রসিকিউটর

প্রসিকিউটর বলেন, এই মুহূর্তে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের ব্যাপারেই তদন্ত শুরু হয়েছে। যদি প্রয়োজন মনে হয় যে আরও কোনো দলও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত সেক্ষেত্রে তাদের ব্যাপারেও আমাদের তদন্ত সংস্থা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

৯ ঘণ্টা আগে

দেশে এখনও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি : পরিকল্পনা উপদেষ্টা

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এখনো আমরা এমন একটি স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে পারিনি, যা জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। ফলে বর্তমান বাস্তবতায় কিছু মৌলিক ও সীমিত লক্ষ্য অর্জনই এখন প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১০ ঘণ্টা আগে

এবারের নির্বাচনকে জীবনের শেষ সুযোগ হিসেবে নিয়েছি: সিইসি

১১ ঘণ্টা আগে