ইতিহাস

জিনিসপত্র কতটা সস্তা ছিল শায়েস্তা খাঁর আমলে

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

মুঘল-বাংলার ইতিহাসে শায়েস্তা খাঁ এমন এক নাম, যাঁর শাসনকালকে বাঙালিরা এখনো স্মরণ করে সুশাসন আর সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সুবাহ বাংলা তথা বাংলার সুবেদার ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়কালে তিনি শুধু রাজনৈতিক স্থিতি বজায় রাখেননি, বরং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জনকল্যাণে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর আমলে বাংলার বাজারে জিনিসপত্র এতটাই সস্তা হয়েছিল যে, তা আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। শায়েস্তা খাঁর শাসনামল নিয়ে বহু বিদেশি পর্যটক ও গবেষক তাঁদের ভ্রমণকথা ও ঐতিহাসিক রেকর্ডে উল্লেখ রেখেছেন, যেগুলো থেকে আমরা সেই সময়কার মূল্যমান ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাই।

শায়েস্তা খাঁ ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের মামা এবং এক দক্ষ প্রশাসক। তিনি ক্ষমতায় আসার পরই অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং বাংলার বাণিজ্য ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানাবিধ উদ্যোগ নেন। নদীপথের দস্যু দমন, স্থানীয় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশি ব্যবসায়ীদের সাথে সুচিন্তিত বাণিজ্য চুক্তি—এসবই তাঁর শাসনকে স্থিতিশীল করেছিল। এর ফলে বাংলার গ্রামাঞ্চল নিরাপদ হয়, কৃষকেরা নিশ্চিন্তে চাষাবাদ করতে পারে, এবং বাজারে শস্য ও অন্যান্য পণ্যের যোগান ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।

ঐতিহাসিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, শায়েস্তা খাঁর সময়ে চাল, ডাল, চিনি, কাপড়—সবকিছুই ছিল হাতের নাগালে। উদাহরণস্বরূপ, সমসাময়িক দলিলপত্রে উল্লেখ আছে যে আট মন চালের দাম ছিল মাত্র ১ টাকা! আজকের দিনে যা কল্পনার বাইরে। শুধু চাল নয়, গরুর মাংস, মাছ, সবজি, এমনকি উৎকৃষ্ট মানের মসলাও ছিল খুবই সস্তা। দাম এত কম হওয়ার পেছনে ছিল কয়েকটি কারণ—প্রথমত, কৃষি উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। দ্বিতীয়ত, নদীপথ ও স্থলপথে নিরাপত্তা থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে পণ্য সহজে আনা যেত। তৃতীয়ত, মুঘল সাম্রাজ্যের বৃহৎ বাজারের সাথে বাংলার সংযোগ থাকায় পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ তৈরি হতো, যা দাম কমিয়ে দিত।

ফরাসি ভ্রমণকারী ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে তাঁর ভ্রমণকথায় বাংলার প্রাচুর্যের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন—বাংলায় এত সস্তায় শস্য ও কাপড় মেলে যে ইউরোপের কোনো দেশ তা কল্পনাও করতে পারে না। তিনি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, “এখানে গরিব মানুষও সুতি কাপড় পরে এবং পেট ভরে খায়।” বার্নিয়ের মন্তব্যের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—বাংলা এমন এক দেশ যেখানে খাদ্য ও বস্ত্রের প্রাচুর্য এত বেশি যে, দরিদ্রতম মানুষও দৈনন্দিন জীবনে আরাম ভোগ করে।

ডাচ ব্যবসায়ী ইয়োহান ভান ডের হিউস্ট ১৭শ শতকে বাংলায় এসে লিখেছিলেন, শায়েস্তা খাঁর সুবিচার আর সুশাসনের কারণে এখানে বাজারে কোনো কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি হয় না। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল—বাংলার কৃষকরা শুধু নিজেদের জন্যই নয়, রপ্তানির জন্যও প্রচুর উৎপাদন করে। বাংলার সুতির কাপড়, বিশেষ করে ঢাকার মসলিন, তখন গোটা ইউরোপে বিলাসপণ্যের মর্যাদা পেয়েছিল, অথচ স্থানীয় মানুষের কাছে তা সুলভ ছিল।

ইংরেজ ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি লেন-পুল তাঁর "দ্য মুঘল এম্পায়ার" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শায়েস্তা খাঁর আমলে বাংলার অর্থনীতি এমনভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল যে, স্থানীয় জনগণ দরিদ্রতাকে চেনে না বললেই চলে। তাঁর ভাষায়—বাংলা ছিল "পৃথিবীর বাগান"। বাংলার শস্য, ফলমূল, মসলার প্রাচুর্য এবং সস্তা দাম সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার তৈরি করেছিল। লেন-পুলের এই পর্যবেক্ষণ আমাদের জানিয়ে দেয়, সেই সময় বাংলার জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত ছিল।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শায়েস্তা খাঁর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাজারে সরকারি নজরদারি চালু করেছিলেন, যাতে কোনো ব্যবসায়ী অতিরিক্ত দাম নিতে না পারে। স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নিয়মিত হাটবাজার বসত, যেখানে গ্রামের মানুষ সরাসরি নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করত। এর ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কমে যায়, আর সাধারণ মানুষ ন্যায্যমূল্যে পণ্য পেত।

শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, নির্মাণ সামগ্রী যেমন কাঠ, বাঁশ, চুন, ইট, এমনকি ধাতব সামগ্রীও সস্তায় পাওয়া যেত। এর কারণে সাধারণ মানুষ ঘরবাড়ি মেরামত বা নতুন করে নির্মাণ করতে পারত সহজে। পণ্যের সুলভ মূল্য গ্রামীণ জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছিল এবং সামাজিকভাবে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এনেছিল।

তবে শায়েস্তা খাঁর এই সোনালি যুগ খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাঁর অবসরের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির ক্রমবর্ধমান প্রভাব বাংলার অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। দাম বেড়ে যায়, শস্যের ঘাটতি দেখা দেয়, এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানও দ্রুত অবনতি ঘটে।

তবুও ইতিহাসের পাতায় শায়েস্তা খাঁর শাসনকাল এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে। সেই সময়ের সস্তা বাজার, প্রাচুর্য, এবং সামাজিক সমৃদ্ধি আজও ইতিহাসপ্রেমী ও গবেষকদের বিস্মিত করে। ফরাসি, ডাচ, ইংরেজসহ নানা দেশের পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের লেখায় পাওয়া যায় বাংলার এই সমৃদ্ধির জীবন্ত চিত্র। শায়েস্তা খাঁ শুধু একজন সুবেদার নন, তিনি বাংলার অর্থনৈতিক স্বর্ণযুগের স্থপতি হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ad
ad

অর্থের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ব্যাংকের টাকা লোপাটকারী কেউ ছাড় পাবে না: আনিসুজ্জামান

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জানান, আর্থিক খাতের অনিয়মের মামলা করতে অনেক ডকুমেন্ট দরকার হয়। হুট করে করা যায় না। তাই টাকা পাচার বা টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের এখন অন্য মামলায় আটক করা হলেও অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে যাচাই করা তথ্যের ভিত্তিতে টাকা আত্মসাতের মামলা করা হবে।

৬ দিন আগে

সেপ্টেম্বরের ২৭ দিনে রেমিট্যান্স এলো ২৮ হাজার কোটি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো প্রবাসী আয় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি ফিরিয়েছে। হুন্ডি প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, প্রণোদনা ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নতির কারণেই রেমিট্যান্সে এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে।

৬ দিন আগে

এনবিআরের নিয়োগ পরীক্ষা এক সপ্তাহ পেছাল

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তিন পদের নিয়োগ পরীক্ষা এক সপ্তাহ পেছানো হয়েছে। উচ্চমান সহকারী, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের এ পরীক্ষা ৩ অক্টোবর নেওয়ার কথা ছিল। তা পিছিয়ে ১১ অক্টোবর পরীক্ষার নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

৬ দিন আগে

৫ ব্যাংক একীভূত হলে বিনিয়োগকারীদের কী হবে?

বিনিয়োগকারীদের এ বিপুল বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার রাস্তা কী? জবাব কে দেবে? জবাব হলো— সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও ডিবিএর দায়িত্ব হবে বিএসইসিকে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার কাজ সম্পন্ন

৭ দিন আগে