ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে ৩৬ দিনের এক প্রবল আন্দোলনে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনের। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু, পাঁচ সপ্তাহের মাথায় তা সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলে।
ওই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে থাকা নহিদ ইসলাম বলছেন, সরকারি বাহিনীসহ সরকারি দলের অনুসারীদের নির্বিচারে আক্রমণ-হামলাই এই আন্দোলনকে বেগবান করে। বিশেষ করে ১৬ জুলাই গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেয়।
শেষ পর্যন্ত ‘৩৪ জুলাই’ বা ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলছেন, এরপর আর পিছু ফিরে তাকানোর সুযোগ ছিল না। বরং তারা ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মুখে পড়েন।
জুলাই আন্দোলনের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন নাহিদ ইসলাম। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জুলাই গণআন্দোলন, সেখানে অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। কঠোর নজরদারি এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও বৈষম্যমুক্তির আন্দোলনে ছিলেন অবিচল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনের শুরুর কথা জানিয়ে নাহিদ বলেন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হলেও সরকার কোটা বাতিল করে। পরে গত বছরের ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ে আবার কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাস্থা, ক্ষোভ, হতাশা ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করে।
ওই দিনই সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয়। তিন দিন আন্দোলনের পর শুরু হয় ঈদের ছুটি। এর আগেই ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রাখার আলটিমেটাম দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়। আর ছুটির মধ্যে আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিজেদের সংগঠিত করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
নাহিদ বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ও কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করি। অনলাইনে মিটিং করি, ফেসবুকে ক্যাম্পেইন করি। সরকার ৩০ জুনের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নিলে ১ জুলাই আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রথমবারের মতো কর্মসূচি পালন করি।
এরপর দ্রুতই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। একপর্যায়ে সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। নাহিদ বলেন, আমরা ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেই। এ দিন শেখ হাসিনা চীন সফর থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করেন। সবার একটা প্রত্যাশা ছিল, এতদিন টানা আন্দোলন চলেছে, তিনি হয়তো দেশে ফিরে সমাধান দিতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল, তিনি কেবল এই আন্দোলনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলেন না, বরং একে ‘রাজাকারদের আন্দোলন’ আখ্যা দিলেন।
‘ন্যায্য, ন্যায়ভিত্তিক ও যৌক্তিক আন্দোলন হলেও শেখ হাসিনা এভাবে কথা বলায় সবার আত্মমর্যাদায় লাগে। শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। পুরোটাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগায় সবাই এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে। হলে হলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে শুরু করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখে আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, ক্যাম্পাসে গিয়েছি। সবাই খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে রাতে রাস্তায় নেমে আসে,’— বলেন নাহিদ ইসলাম।
আন্দোলনে হামলার বিষয়ে নাাহিদ বলেন, আমরা জানতাম যে আন্দোলনে কোনো একটা পর্যায়ে ছাত্রলীগ বা পুলিশ হামলা করবে। ফলে আন্দোলনে হামলা আসবে বা গ্রেপ্তার হতে পারি— এ রকম মানসিক প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। কিন্তু সেদিন (১৫ জুলাই) শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যে ভয়াবহ হামলা চালায়, তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। বিশেষ করে নারীদের ওপর এভাবে হামলা করবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি। আমরা জানতাম ছাত্রলীগ হামলা করবে, কিন্তু এতটা বর্বর হবে, এতটা দমনমূলক হবে, এতটা হিংস্র হবে— এটা আমাদের ধারণাতেও ছিল না।
ওই হামলার প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই ব্যাপক বিক্ষোভ হয় সারা দেশে। সে দিন প্রাণ হারান রংপুরের আবু সাঈদসহ মোট ছয়জন। নাহিদ বলেন, তার মৃত্যুর খবর আমি শহিদ মিনারে প্রথম ঘোষণা দিয়ে বলি, আমাদের এক ভাই শহিদ হয়েছে। আগের দিন আবু সাঈদের সঙ্গে বাকেরের কথা হয়। বাকেরের কাছে আবু সাঈদ জানতে চায় পরদিনের পরিকল্পনা কী? বাকের জানায়, আমরা মাঠে থাকবো যে কোনো মূল্যে। আবু সাঈদ জীবন দিয়ে তার অটল সংকল্প প্রমাণ করছে। সে মাঠ ছাড়েনি, দাঁড়িয়ে ছিল বুলেটের সামনে। ওই ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত করে।
ছয়জন নিহতের খবরে ১৬ জুলাই রাতেই নাহিদরা বুঝতে পারেন, আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে হবে বলেই তখন ভাবছিলেন তারা। কিন্তু ১৭ জুলাই আশুরার ছুটি আর এরপর ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আন্দোলনকারীরা বিপাকে পড়েন। নাহিদের ভাষায়, তাদের প্রস্তুতির ঘাটতির সুযোগ নেয় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাস এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবসহ এমন কোনো বাহিনী ছিল না যাদের সেদিন মোতায়েন করেনি।
নাহিদ বলেন, কফিন মিছিল শুরু হলে তারা টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে আমরা হলে ফিরে যাই, হল পাড়ায় অবস্থান নিই। সেখানেও ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখি আমাদের লোকবল খুবই কমে গেছে। বুঝতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ওপর সরাসরি আক্রমণ চলছে। তখন অনুরোধ জানাই, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একটা সময় শিক্ষার্থীরা শোকার্ত হয়ে বের হয়ে যায়। তখন ভাবি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা মনে হয় আন্দোলনটা আর চালিয়ে যেতে পারব না। আন্দোলন হয়তো এখানেই শেষ।
আন্দোলন নিয়ে হতাশা থাকলেও রাতে কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরদিন ১৮ জুলাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে। নাহিদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনটা একেবারে জনগণের কাতারে চলে আসে।
এ সময়ে সরকার কারফিউ জারি করে। ছাত্ররাও কমপ্লিট শাটডেউন অব্যাহত রাখে। এ সময়েই আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় নহিদকে। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি আগেই জেনেছিলাম, আমাকে গ্রেপ্তারের শঙ্কা রয়েছে। মোবাইল ফোনে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। সেই রাতেই রাত ২টা বা আড়াইটার দিকে কিছু লোক ডিবি পরিচয়ে আমার বন্ধুর বাসায় আসে। তারা আমার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে এবং আমাকে গাড়িতে তুলে নেয়। হ্যান্ডকাফ পরায়, চোখ বেঁধে দেয়। এরপর গাড়িতে তারা আমাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে আমার ওপর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
২১ জুলাই ভোরে পূর্বাচল এলাকায় ফেলে দেওয়া হয় নাহিদকে। সেখান থেকে তিনি হাসপাতালে যান, পরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান। নাহিদ বলেন, পুরো হাসপাতালকে নজরদারির আওতায় নিয়ে নেওয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ আমাদের কাউকে যোগাযোগ করতে দিচ্ছিল না। আসিফ ও বাকেরও একপর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকেই আমরা আবার আন্দোলন বিষয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও দিকনির্দেশনা দিতে শুরু করি।
এ পর্যায়ে হাসপাতাল থেকে নাহিদকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি অফিসে। আরও পাঁচ সমন্বয়ককেও ডিবিতে নেওয়া হয়। তাদের ওপর নানা রকম চাপ প্রয়োগ করা হয় আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। রাজি না হলে পরিবারের সদস্য ও মেয়েদের গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়।
নাহিদ বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও নানা ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হয়। হুমকি ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তারা আমাদের আন্দোলনটা স্থগিত করতে বলে। আমরা বলি, আন্দোলন শেষ করার ঘোষণা দেবো, তবে তা বাইরে গিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানাব। তবে তারা সেটা মানেনি। তারা আমাদের দিয়ে জোর করে ভিডিও স্টেটমেন্ট নেয়, যেখানে আন্দোলনের সমাপ্তির কথা বলতে বাধ্য করা হয়। বলা হয়, এই ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানো হবে।
ওই ভিডিও প্রচার করে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। খাওয়ার সময় জোর করে খাইয়ে তার ছবি প্রচার করা হয়। আন্দোলন শেষ হয়েছে— এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু বাইরে যারা ছিল, তারা এসব বিশ্বাস করেনি। বরং তারা আন্দোলনকে আরও শক্তভাবে চালিয়ে যায়।
নাহিদ বলেন, ভেতরে থেকে একবার আমাদের মনে হয়েছিল যে আন্দোলনটা হয়তো শেষ হয়ে গেছে। একসময় আমরা বুঝতে পেরেছি, আমরা স্টেটমেন্ট দেওয়ার পর লোকজন বিশ্বাস করেনি এবং আরও ব্যাপকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তখন ডিবি অফিসের ভেতরে আমরা নীরব আন্দোলন শুরু করি। আমরা তাদের কোনো ধরনের ডিরেকশন মানছিলাম না। অনশন শুরু করি। তারা একটা সময় চেষ্টা করছিল আমাদের সেখান থেকে শেখ হাসিনার অফিসে নিয়ে যাওয়ার। একপর্যায়ে অনশনের কারণে তারা আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
১ আগস্ট ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পান নাহিদসহ অন্য সমন্বয়করা। নাহিদ বলেন, ২ আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম আন্দোলনটা যে মাত্রায় চলে গেছে, তাতে এখন স্পষ্ট করে আমাদের অবস্থান জানাতে হবে। এতদিন কৌশলগতভাবে ৯ দফার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টা ছিল এ সরকারকে আমরা মানি না। যখন আন্দোলনটা এ পর্যায়ে চলে গেছে, আমরাও বুঝতে পারছিলাম আমাদের শেষ পরিণতির ঘোষণা দিতে হবে। তখন আমরা আবারও যোগাযোগ তৈরি করি যারা বাইরে আন্দোলনটা পরিচালনা করছিল তাদের সঙ্গে। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ৩ আগস্ট আমরা এক দফা ঘোষণা দেবো। শহিদ মিনারে ঐতিহাসিক সেই এক দফার ঘোষণাটা দিই।
নাহিদ বলেন, সেদিন আমাদের আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। এটা আমরা জেনেশুনেই চূড়ান্ত অবস্থায় গেছি। ফলে ৪ আগস্ট বা আরও পরে ব্যাপক ভয়াবহতা আসবে, তা আমরা জানতাম। আশঙ্কা হচ্ছিল, হয় আমরা বেঁচে থাকব, না হয় মরে যাব। বেঁচে থাকলে আমরা এই সরকারকে উৎখাত করব, আর নইলে আমাদের মৃত্যু হবে। আমরা এই ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।
একদফার ঘোষক নাহিদ বলেন, ৪ তারিখেই আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম যে প্রয়োজনে অস্ত্রও তুলে নিতে পারি। সে দিনই সারা দেশে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আমরা ৬ তারিখে লংমার্চের ঘোষণা দিলেও ৪ তারিখের ভয়াবহতা দেখে বুঝে যাই, সরকার ইন্টারনেট আবার বন্ধ করে দেবে এবং আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে আমরা লংমার্চ একদিন আগে নিয়ে আসি, যেন সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে কোনো ধরনের পরিকল্পনা করার সুযোগ না পায়।
এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের রূপরেখা নিয়েও আলাপ শুরু হয়। নাহিদ বলেন, আমরা ৪ তারিখ রাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করছিলাম। ঢাকার কতগুলো পয়েন্ট থেকে আন্দোলনকারীরা আসবে, গণভবন কীভাবে ঘেরাও হবে, বা এই সরকারের পতনের পর আমরা কী করব— এসব আলোচনা করেছি। ৩ আগস্টের পর থেকেই এ আলোচনাগুলো শুরু হয়ে যায়।
নাহিদ বলেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে আলোচনা হয় যে সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে। কে হতে পারে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, অন্য উপদেষ্টারা কারা হবেন— এসব বিষয় নিয়ে আমরা পুরো ব্যস্ত ছিলাম। কবে হবে, কীভাবে হবে তা হয়তো নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু ৩ আগস্ট থেকে আমাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল যে সরকারের পতন হবে।
৫ আগস্টের কথা তুলে ধরে নাহিদ বলেন, আমরা দেখলাম, সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সৈনিকরা, তরুণ অফিসাররা জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমরা যখন শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে মার্চ করতে শুরু করি আর ওই দিকে উত্তরার দিক থেকে মানুষ আসতে শুরু করে, তখন আমরা শুনতে পাই শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। আমরা এটা দুপুর ১টা-২টার দিকে শুনতে পাই সাংবাদিকদের মাধ্যমে।
শেষ পর্যন্ত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিকামী মানুষের অপ্রতিরোধ্য স্রোত। আন্দোলনের সাফল্য উদযাপনে বিজয় মিছিলে মেতে ওঠে সারা দেশ।
জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে ৩৬ দিনের এক প্রবল আন্দোলনে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনের। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু, পাঁচ সপ্তাহের মাথায় তা সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলে।
ওই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে থাকা নহিদ ইসলাম বলছেন, সরকারি বাহিনীসহ সরকারি দলের অনুসারীদের নির্বিচারে আক্রমণ-হামলাই এই আন্দোলনকে বেগবান করে। বিশেষ করে ১৬ জুলাই গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দেয়।
শেষ পর্যন্ত ‘৩৪ জুলাই’ বা ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলছেন, এরপর আর পিছু ফিরে তাকানোর সুযোগ ছিল না। বরং তারা ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মুখে পড়েন।
জুলাই আন্দোলনের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে বাসসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন নাহিদ ইসলাম। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জুলাই গণআন্দোলন, সেখানে অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। কঠোর নজরদারি এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েও বৈষম্যমুক্তির আন্দোলনে ছিলেন অবিচল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করেন। এই আন্দোলনের শুরুর কথা জানিয়ে নাহিদ বলেন, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন হলেও সরকার কোটা বাতিল করে। পরে গত বছরের ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ে আবার কোটাব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। সেটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাস্থা, ক্ষোভ, হতাশা ও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করে।
ওই দিনই সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয়। তিন দিন আন্দোলনের পর শুরু হয় ঈদের ছুটি। এর আগেই ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রাখার আলটিমেটাম দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়। আর ছুটির মধ্যে আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও নিজেদের সংগঠিত করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
নাহিদ বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ও কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করি। অনলাইনে মিটিং করি, ফেসবুকে ক্যাম্পেইন করি। সরকার ৩০ জুনের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা না নিলে ১ জুলাই আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রথমবারের মতো কর্মসূচি পালন করি।
এরপর দ্রুতই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। একপর্যায়ে সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। নাহিদ বলেন, আমরা ১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেই। এ দিন শেখ হাসিনা চীন সফর থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করেন। সবার একটা প্রত্যাশা ছিল, এতদিন টানা আন্দোলন চলেছে, তিনি হয়তো দেশে ফিরে সমাধান দিতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল, তিনি কেবল এই আন্দোলনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিলেন না, বরং একে ‘রাজাকারদের আন্দোলন’ আখ্যা দিলেন।
‘ন্যায্য, ন্যায়ভিত্তিক ও যৌক্তিক আন্দোলন হলেও শেখ হাসিনা এভাবে কথা বলায় সবার আত্মমর্যাদায় লাগে। শিক্ষার্থীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। পুরোটাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের বহির্প্রকাশ। আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগায় সবাই এর বিরুদ্ধে কথা বলেছে। হলে হলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে শুরু করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখে আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, ক্যাম্পাসে গিয়েছি। সবাই খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে রাতে রাস্তায় নেমে আসে,’— বলেন নাহিদ ইসলাম।
আন্দোলনে হামলার বিষয়ে নাাহিদ বলেন, আমরা জানতাম যে আন্দোলনে কোনো একটা পর্যায়ে ছাত্রলীগ বা পুলিশ হামলা করবে। ফলে আন্দোলনে হামলা আসবে বা গ্রেপ্তার হতে পারি— এ রকম মানসিক প্রস্তুতিও আমাদের ছিল। কিন্তু সেদিন (১৫ জুলাই) শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যে ভয়াবহ হামলা চালায়, তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। বিশেষ করে নারীদের ওপর এভাবে হামলা করবে, তা আমরা ভাবতেও পারিনি। আমরা জানতাম ছাত্রলীগ হামলা করবে, কিন্তু এতটা বর্বর হবে, এতটা দমনমূলক হবে, এতটা হিংস্র হবে— এটা আমাদের ধারণাতেও ছিল না।
ওই হামলার প্রতিবাদে পরদিন ১৬ জুলাই ব্যাপক বিক্ষোভ হয় সারা দেশে। সে দিন প্রাণ হারান রংপুরের আবু সাঈদসহ মোট ছয়জন। নাহিদ বলেন, তার মৃত্যুর খবর আমি শহিদ মিনারে প্রথম ঘোষণা দিয়ে বলি, আমাদের এক ভাই শহিদ হয়েছে। আগের দিন আবু সাঈদের সঙ্গে বাকেরের কথা হয়। বাকেরের কাছে আবু সাঈদ জানতে চায় পরদিনের পরিকল্পনা কী? বাকের জানায়, আমরা মাঠে থাকবো যে কোনো মূল্যে। আবু সাঈদ জীবন দিয়ে তার অটল সংকল্প প্রমাণ করছে। সে মাঠ ছাড়েনি, দাঁড়িয়ে ছিল বুলেটের সামনে। ওই ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে, আলোড়িত করে।
ছয়জন নিহতের খবরে ১৬ জুলাই রাতেই নাহিদরা বুঝতে পারেন, আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে সীমাবদ্ধ থাকবে না। সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে হবে বলেই তখন ভাবছিলেন তারা। কিন্তু ১৭ জুলাই আশুরার ছুটি আর এরপর ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আন্দোলনকারীরা বিপাকে পড়েন। নাহিদের ভাষায়, তাদের প্রস্তুতির ঘাটতির সুযোগ নেয় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাস এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবসহ এমন কোনো বাহিনী ছিল না যাদের সেদিন মোতায়েন করেনি।
নাহিদ বলেন, কফিন মিছিল শুরু হলে তারা টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড মারতে শুরু করে। একপর্যায়ে আমরা হলে ফিরে যাই, হল পাড়ায় অবস্থান নিই। সেখানেও ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দেখি আমাদের লোকবল খুবই কমে গেছে। বুঝতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ওপর সরাসরি আক্রমণ চলছে। তখন অনুরোধ জানাই, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একটা সময় শিক্ষার্থীরা শোকার্ত হয়ে বের হয়ে যায়। তখন ভাবি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা মনে হয় আন্দোলনটা আর চালিয়ে যেতে পারব না। আন্দোলন হয়তো এখানেই শেষ।
আন্দোলন নিয়ে হতাশা থাকলেও রাতে কমপ্লিট শাটডাউনের ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরদিন ১৮ জুলাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে। নাহিদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনটা একেবারে জনগণের কাতারে চলে আসে।
এ সময়ে সরকার কারফিউ জারি করে। ছাত্ররাও কমপ্লিট শাটডেউন অব্যাহত রাখে। এ সময়েই আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় নহিদকে। তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমি আগেই জেনেছিলাম, আমাকে গ্রেপ্তারের শঙ্কা রয়েছে। মোবাইল ফোনে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। সেই রাতেই রাত ২টা বা আড়াইটার দিকে কিছু লোক ডিবি পরিচয়ে আমার বন্ধুর বাসায় আসে। তারা আমার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে এবং আমাকে গাড়িতে তুলে নেয়। হ্যান্ডকাফ পরায়, চোখ বেঁধে দেয়। এরপর গাড়িতে তারা আমাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে আমার ওপর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।
২১ জুলাই ভোরে পূর্বাচল এলাকায় ফেলে দেওয়া হয় নাহিদকে। সেখান থেকে তিনি হাসপাতালে যান, পরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যান। নাহিদ বলেন, পুরো হাসপাতালকে নজরদারির আওতায় নিয়ে নেওয়া হয়। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ আমাদের কাউকে যোগাযোগ করতে দিচ্ছিল না। আসিফ ও বাকেরও একপর্যায়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন থেকেই আমরা আবার আন্দোলন বিষয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও দিকনির্দেশনা দিতে শুরু করি।
এ পর্যায়ে হাসপাতাল থেকে নাহিদকে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি অফিসে। আরও পাঁচ সমন্বয়ককেও ডিবিতে নেওয়া হয়। তাদের ওপর নানা রকম চাপ প্রয়োগ করা হয় আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। রাজি না হলে পরিবারের সদস্য ও মেয়েদের গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়।
নাহিদ বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও নানা ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হয়। হুমকি ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তারা আমাদের আন্দোলনটা স্থগিত করতে বলে। আমরা বলি, আন্দোলন শেষ করার ঘোষণা দেবো, তবে তা বাইরে গিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে জানাব। তবে তারা সেটা মানেনি। তারা আমাদের দিয়ে জোর করে ভিডিও স্টেটমেন্ট নেয়, যেখানে আন্দোলনের সমাপ্তির কথা বলতে বাধ্য করা হয়। বলা হয়, এই ভিডিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখানো হবে।
ওই ভিডিও প্রচার করে দেওয়া হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। খাওয়ার সময় জোর করে খাইয়ে তার ছবি প্রচার করা হয়। আন্দোলন শেষ হয়েছে— এমন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু বাইরে যারা ছিল, তারা এসব বিশ্বাস করেনি। বরং তারা আন্দোলনকে আরও শক্তভাবে চালিয়ে যায়।
নাহিদ বলেন, ভেতরে থেকে একবার আমাদের মনে হয়েছিল যে আন্দোলনটা হয়তো শেষ হয়ে গেছে। একসময় আমরা বুঝতে পেরেছি, আমরা স্টেটমেন্ট দেওয়ার পর লোকজন বিশ্বাস করেনি এবং আরও ব্যাপকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তখন ডিবি অফিসের ভেতরে আমরা নীরব আন্দোলন শুরু করি। আমরা তাদের কোনো ধরনের ডিরেকশন মানছিলাম না। অনশন শুরু করি। তারা একটা সময় চেষ্টা করছিল আমাদের সেখান থেকে শেখ হাসিনার অফিসে নিয়ে যাওয়ার। একপর্যায়ে অনশনের কারণে তারা আমাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
১ আগস্ট ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পান নাহিদসহ অন্য সমন্বয়করা। নাহিদ বলেন, ২ আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম আন্দোলনটা যে মাত্রায় চলে গেছে, তাতে এখন স্পষ্ট করে আমাদের অবস্থান জানাতে হবে। এতদিন কৌশলগতভাবে ৯ দফার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টা ছিল এ সরকারকে আমরা মানি না। যখন আন্দোলনটা এ পর্যায়ে চলে গেছে, আমরাও বুঝতে পারছিলাম আমাদের শেষ পরিণতির ঘোষণা দিতে হবে। তখন আমরা আবারও যোগাযোগ তৈরি করি যারা বাইরে আন্দোলনটা পরিচালনা করছিল তাদের সঙ্গে। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ৩ আগস্ট আমরা এক দফা ঘোষণা দেবো। শহিদ মিনারে ঐতিহাসিক সেই এক দফার ঘোষণাটা দিই।
নাহিদ বলেন, সেদিন আমাদের আর পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। এটা আমরা জেনেশুনেই চূড়ান্ত অবস্থায় গেছি। ফলে ৪ আগস্ট বা আরও পরে ব্যাপক ভয়াবহতা আসবে, তা আমরা জানতাম। আশঙ্কা হচ্ছিল, হয় আমরা বেঁচে থাকব, না হয় মরে যাব। বেঁচে থাকলে আমরা এই সরকারকে উৎখাত করব, আর নইলে আমাদের মৃত্যু হবে। আমরা এই ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতির মধ্যে চলে গিয়েছিলাম।
একদফার ঘোষক নাহিদ বলেন, ৪ তারিখেই আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম যে প্রয়োজনে অস্ত্রও তুলে নিতে পারি। সে দিনই সারা দেশে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আমরা ৬ তারিখে লংমার্চের ঘোষণা দিলেও ৪ তারিখের ভয়াবহতা দেখে বুঝে যাই, সরকার ইন্টারনেট আবার বন্ধ করে দেবে এবং আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে আমরা লংমার্চ একদিন আগে নিয়ে আসি, যেন সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে কোনো ধরনের পরিকল্পনা করার সুযোগ না পায়।
এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের রূপরেখা নিয়েও আলাপ শুরু হয়। নাহিদ বলেন, আমরা ৪ তারিখ রাতে বিভিন্ন পরিকল্পনা করছিলাম। ঢাকার কতগুলো পয়েন্ট থেকে আন্দোলনকারীরা আসবে, গণভবন কীভাবে ঘেরাও হবে, বা এই সরকারের পতনের পর আমরা কী করব— এসব আলোচনা করেছি। ৩ আগস্টের পর থেকেই এ আলোচনাগুলো শুরু হয়ে যায়।
নাহিদ বলেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে আলোচনা হয় যে সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে। কে হতে পারে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, অন্য উপদেষ্টারা কারা হবেন— এসব বিষয় নিয়ে আমরা পুরো ব্যস্ত ছিলাম। কবে হবে, কীভাবে হবে তা হয়তো নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু ৩ আগস্ট থেকে আমাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস চলে এসেছিল যে সরকারের পতন হবে।
৫ আগস্টের কথা তুলে ধরে নাহিদ বলেন, আমরা দেখলাম, সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সৈনিকরা, তরুণ অফিসাররা জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমরা যখন শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে মার্চ করতে শুরু করি আর ওই দিকে উত্তরার দিক থেকে মানুষ আসতে শুরু করে, তখন আমরা শুনতে পাই শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। আমরা এটা দুপুর ১টা-২টার দিকে শুনতে পাই সাংবাদিকদের মাধ্যমে।
শেষ পর্যন্ত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে। রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিকামী মানুষের অপ্রতিরোধ্য স্রোত। আন্দোলনের সাফল্য উদযাপনে বিজয় মিছিলে মেতে ওঠে সারা দেশ।
ছাত্র-জনতাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার সহস্রাধিক মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ মাস। বর্ষপঞ্জির পাতায় সেটি ৫ আগস্ট লেখা থাকলেও যে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট শাসনের, সেই ছাত্র-জনতার হৃদয়ে দিনটি ৩৬ জুলাই হিসেবেই জেগে রয়েছে।
১৩ ঘণ্টা আগেএই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো—এতে অনেক সময় জোট সরকার গঠনে দীর্ঘ সময় লাগে।
১৫ ঘণ্টা আগেইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আগামীকাল বাদ জোহর দুপুর ১:৩০ টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।
১৬ ঘণ্টা আগেনতুন নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চীন মুখিয়ে আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।আজ সোমবার বিকালে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান তিনি।
১ দিন আগে