জাপার চেয়ারম্যান-মহাসচিবের সমালোচনা করায় অব্যাহতি!

বিশেষ প্রতিনিধি, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১০: ২০
(বাঁদিক থেকে) কাজী ফিরোজ রশীদ, সুনীল শুভ রায় ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং ইয়াহিয়া চৌধুরী। ছবি: কোলাজ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে পাওয়া আসন নিয়ে জাতীয় পার্টিতে বিরোধ এখন তুঙ্গে। আসন না পেয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সভা ডেকে ক্ষোভ ঝাড়ছেন সাবেক সংসদ সদস্যরা। প্রকাশ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের সমালোচনা করায় একের পর এক দলের পদ-পদবি থেকে নেতাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সব পদ থেকে অন্তত চার নেতাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তারা হলেন- দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়। দুজনই জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং সাবেক এমপি, পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া চৌধুরীকেও দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এদিকে পদত্যাগ করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের একজন উপদেষ্টা, যদিও তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে ১১টি আসনে জয়ী হন দলটির প্রার্থীরা। বাকি আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হন তারা। পরাজিত প্রার্থীদের ৯০ শতাংশই জামানত হারিয়েছেন। সমঝোতার বাইরে প্রায় আড়াই শ আসনের একটিতেও জিততে পারেননি জাপা প্রার্থীরা।

১৪ জানুয়ারি ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইউস্টিটিউশন মিলনায়তনে নির্বাচনে অংশ নেয়া জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীদের এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, ‌‘নির্বাচন উপলক্ষে সরকার জাতীয় পার্টিকে ভরপুর দিয়েছে। সরকার কোনো কার্পণ্য করেনি। টাকা-পয়সা দিয়েছে। আসনও বেশি ছাড় দিতে রাজি ছিলো সরকার। কিন্তু আপনি চেয়ারম্যান ও মহাসচিব তা আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। মহাসচিবের ব্যর্থতার কারণে আজকে জাতীয় পার্টির এই অবস্থা।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রার্থীরা যখন আমার কাছে এসে ক্ষোভ জানালো তখন আমি মহাসচিবকে ফোন করি। তিনি আমাকে বলেন, “অল্প কিছু টাকা পেয়েছেন। সেখান থেকে একটা অংশ তিনি শেরিফা কাদেরের (জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য) কাছে রেখে নিজের নির্বাচন করতে চলে গেছেন।” কিন্তু সেখান থেকেও প্রার্থীরা কোনও সহযোগিতা পাননি।’

ওই সভায় দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে প্রতারক বলে দাবি করেন নোয়াখালী-৩ আসন থেকে নির্বাচন করা জাতীয় পার্টির প্রার্থী ফজলে এলাহী সোহাগ। তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনের সময় মহাসচিবকে শতাধিকবার ফোন দিয়েছি, কিন্তু তিনি ফোন ধরেন নাই। তিনি একজন প্রতারক ও বাটপার। তিনি সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে আমাদের প্রার্থীদের না দিয়ে নিজের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।’

দলের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, ‘চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আমরা জাতীয় পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করতে চাই। কিন্তু কিছু লোক চেয়ারম্যানকে কুক্ষিগত রেখে নিজেদের অবস্থান শক্ত রাখতে পার্টির মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে।’

আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার একটি ঢাকা-১৮ আসন দলের চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরিফা কাদের কোন যোগ্যতায় মনোনয়ন পেয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচন করা ইয়াহিয়া চৌধুরী।

সরকারি দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি ইস্যুতে জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের কড়া সমালোচনা। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসন পাওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনে ১১টি আসনে জয়ী হন জাপার প্রার্থীরা। সমঝোতার বাইরে প্রায় আড়াইশ আসনের একটিতেও জিততে পারেননি দলটির প্রার্থীরা।

সমালোচনা করে বহিষ্কার

চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সমালোচনার পর ওইদিন রাতেই দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহিত পান দুই নেতা; সেন্টু ও ইয়াহিয়া। দলটির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর সুপারিশক্রমে দলের চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে দলের সব পদ থেকে এই দুইজনকে অব্যাহতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তরের জাতীয় পার্টির কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

ওই দিন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা এবং গাজীপুর মহানগরের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন এমএম নিয়াজউদ্দিন।

‘কোথায় আমার ভোট আছে, কোথায় আমার সমর্থন আছে-এইটা তো আমার জানার কথা। ঢাকা-৪ এবং ঢাকা-৬ আসনে আমরা জিতেছি, সংসদ সদস্য আছে। সেখানে আমাদের কিছু কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী আছে। ঢাকা-১৮ আসনে আমার কী আছে এইটাও জানার কথা। এখানে আওয়ামী লীগ নেই, কিন্তু স্বতন্ত্র আছে। এইখানে যদি আমি প্রার্থী দেই তাহলে যে আমার ভরাডুবি হবে এইটুকু দূরদর্শীতা যদি নেতৃত্বের না থাকে সেই নেতৃত্বকে যদি ব্যর্থ বলি তাহলে আমার অপরাধ হবে? আমি এটা বলার কারণে আমাকে অব্যাহতি দিয়েছে,’ এই প্রতিবেদককে জানান অব্যাহতি পাওয়া দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে যে ভরাডুবি হয়েছে এবং দলের অনিয়ম হয়েছে এটার মূল্যায়ন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছি। যদি নেতৃত্বের ব্যর্থতা থাকে তাহলে নতুনভাবে নেতৃত্ব সাজাতে হবে। তারা যদি বোঝাতে সক্ষম হয় তারা যা করেছে ঠিক করেছে এবং দলের লোকজন মেনে নেয় তাহলে সব ঠিক আছে।’

গত বুধবার রাজধানীর বনানীতে দলটির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন দলের নেতা–কর্মীরা। এ সময় তারা কার্যালয়ে ঢুকতে গেলে বাধা দেয় পুলিশ। পরে কার্যালয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন দলের নেতারা।

পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে বনানীর কার্যালয়ের সামনে নেতা–কর্মীদের একটি অংশ বিক্ষোভ করেন। এতে ঢাকা ও আশপাশ এলাকার কয়েকজন প্রার্থীও ছিলেন। সেখানে চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হকের পদত্যাগ দাবি করা হয়। এরপর অব্যাহতি দেয়া হয় দলটির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়কে।

টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কাযালয় থেকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের কোনও লোক যদি বলতে পারে আমি বা চেয়ারম্যান কারও কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। প্রমাণ করতে পারলে আমি পদত্যাগ করব। শত কোটি টাকা পেলে বিদেশ চলে যেতাম।’

জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, ‘অনেকেই মনে করেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেহেতু আমাদের কথাবার্তা হয়েছে, ২৬টা সিট দিয়েছে। তাদের ধারণা আমাদের অনেক টাকা দিয়েছে, শত শত কোটি টাকা দিয়েছে। প্রার্থীদের কেন আমরা টাকা দিলাম না? এটা তাদের মনের আসল ব্যথা। দু-একজন ছাড়া পরাজিত প্রার্থীদের আসল ব্যথা, আমরা শত কোটি টাকা পেয়েছি তাদের কেন দেইনি।’

সুবিধাবাদীদের ভাঙন পরিণতি স্বাভাবিক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘জাতীয় পার্টির নেতারা যারা আছেন প্রচণ্ড সুবিধাবাদী এবং ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ক্ষমতা থেকে সব ধরনের সুবিধা তারা নিতে চান। তাদের আদর্শবাদের কোনো জায়গায়ই নেই।’

‘নিজেদের আখের গোছানো ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। তাদের দলের ভাঙন হবে, বিপর্যয় হবে। একসময় ধীরে ধীরে পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবে দলটি,’ বলছিলেন তিনি।

সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘যে দল কতগুলো সুবিধাবাদী নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয় সেই দলের পরিণতি এমন হওয়া খুব স্বাভাবিক। এ যাবৎকাল সরকারের তোষণ ছাড়া তাদের কোনো ভূমিকা নেই।’

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

১৫ আগস্ট শোক জানিয়েছে অনুভূতিহীন কবি-শিল্পীরা: রিজভী

তথাকথিত কবি, সাহিত্যিক ও অভিনয় শিল্পীরা অনুভূতিহীন হয়ে ১৫ আগস্টে শোক প্রকাশ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বস্তুগত প্রাপ্তির লোভেই তারা ফ্যাসিবাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলেন তিনি।

১৬ ঘণ্টা আগে

জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে দ্বিমত বিএনপির

জুলাই জাতীয় সনদকে সংবিধানের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী নয় বিএনপি। সনদ সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না– এ অঙ্গীকারেও একমত নয় দলটি। বিএনপি চায়, যেসব সাংবিধানিক সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নির্বাচনের আগে নয়; আগামী সংসদে বাস্তবায়ন করা হবে।

১৯ ঘণ্টা আগে

জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে বিএনপির আপত্তি, জমা দিয়েছে মতামত

১ দিন আগে

৯ প্যানেলে জমজমাট ডাকসু— কোন প্যানেলে প্রার্থী কারা

ছয় বছরের বিরতিতে হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচন ঘিরে বহুমুখী লড়াইয়ের আভাস ছিল আগে থেকেই। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনে একে একে প্যানেলগুলো ঘোষণা হতে থাকলে সে আভাসের সত্যতা মিলেছে। দিন শেষে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ মোট প্যানেলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯টিতে। প্যানেলগুলো আলাদা আলাদা নামও পেয়েছে।

১ দিন আগে