নাজমুল ইসলাম হৃদয়
শুরুটা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কথার সূত্র ধরে। এরপর থেকেই ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হয়েছে ‘সেফ এক্সিট’ শব্দযুগল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা কথা বলেছেন এটি নিয়ে। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও, যারা ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন বলে আলোচনা উসকে দিয়েছিলেন নাহিদ।
এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে উপদেষ্টাদের সবার বক্তব্যের মূল সুরটা এক— তারা কেউ ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে আদৌ কিছু ভাবছেন না। দেশ ছেড়েও কেউ কোথাও যেতেও চান না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে যে কথাবার্তাগুলো চলছে, সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা। আদৌ বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টির বাস্তবতা রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা।
‘সেফ এক্সিট’ শব্দবন্ধের আক্ষরিক অর্থ নিরাপদ প্রস্থান। প্রায়োগিক অর্থেও এর মাধ্যমে প্রস্থান বোঝানো হলেও এর আলাদা তাৎপর্য রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। বিশেষ করে ক্ষমতার পালাবদলের সময় ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
‘সেফ এক্সিট’ বলতে মূলত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিরাপদে দেশত্যাগকে বোঝানো হয়ে থাকে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ওই সময় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দেশের বাইরে চলে যাবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না— ‘সেফ এক্সিট’ বলতে মূলত এটিকেই বোঝানো হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আলোচনায় এসেছে ২০০৬-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গও। ওই সময়কার প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল সেনাসমর্থিত। তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নিয়েও সে সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর।
ওই সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতেই সে সময় ফখরুদ্দীন আহমদ ছাড়াও তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমান। তাদের এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্য কোনো উপদেষ্টাদের নিয়ে সরকার টুঁ শব্দটিও করেনি।
তবে এবার জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিটে’র প্রয়োজনীয়তার কতটা প্রাসঙ্গিক— সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, নির্বাচিত সরকার এলে আদৌ এই ‘সেফ এক্সিটে’র প্রয়োজন হবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা এখনো যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুসংহত বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ওঠেনি। ফলে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।
সাম্প্রতিক আলোচনায় উঠে আসা ‘সেফ এক্সিট’ শব্দযুগলের সূত্রপাত এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ হোসেনের বক্তব্যে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সমালোচনা করেন তিনি।
নাহিদ বলেন, আমাদের উচিত ছিল ছাত্র-নেতৃত্বকেই শক্তিশালী করা, সরকারে গেলে সম্মিলিতভাবে যাওয়া। নাগরিক সমাজ বা রাজনৈতিক দলকে আমরা যে বিশ্বাসটা করেছিলাম, যে আস্থা রেখেছিলাম, সেই জায়গায় আসলে আমরা প্রতারিত হয়েছি। অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে অথবা গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে বিট্রে (প্রতারণা) করেছে।
সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে। তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবতেছে। তারা যদি এটা বিশ্বাস করত যে তাদের নিয়োগকর্তা ছিল গণঅভ্যুত্থানের শক্তি, রাজপথে নেমে জীবন দেওয়া ও আহত সাধারণ মানুষজন এবং তারা যদি তাদের ওপর ভরসা করত, তাহলে উপদেষ্টাদের এই বিচ্যুতি হতো না।
নাহিদ ইসলামের ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গটি আলোচনায় এলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে তারই সহযোদ্ধা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গত বুধবার (৮ অক্টোবর) নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে দেওয়া পোস্টে জানান, দেশ ছেড়ে যাবেন না কখনো।
আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, ‘যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট-নাগরিকত্ব নেওয়া, তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে। যারা ৫ আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এ দেশে, মৃত্যুও এ দেশের মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহিদি মৃত্যুই কামনা করি।’
একই দিন সচিবালয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে নিজ মন্ত্রনালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সেখানেও সাংবাদিকদের কথায় উঠে আসে ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ।
জবাবে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, নাহিদ ইসলামের বক্তব্য তাকেই প্রমাণ করতে হবে। আমি একদম কোনো এক্সিট খুঁজছি না। দেশেই ছিলাম, বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটাব। সব রাজনৈতিক দলের মতো নবগঠিত রাজনৈতিক দলের (এনসিপি) সঙ্গেও সরকারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এখন সেই দলের প্রধান নাহিদ ইসলাম কী কারণে, কোন অভিমান থেকে উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’ বা এ সংক্রান্ত মন্তব্য করেছেন, সেটি তাদের দলের মন্তব্য। তাদের কোনো বক্তব্য নিয়ে সরকারের পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
পরদিন বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ফাওজুল কবির খান ফেসবুক পোস্টে নিজেই তুলে ধরেন ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ। প্রতিদিন কতটা পরিশ্রম করছেন, সে কথা তুলে ধরে ‘সেফ এক্সিটে’ ভাবনা নিয়ে আফসোস-আক্ষেপের কথা তুলে ধরেন তিনি।
ফাওজুল কবির পোস্টে লিখেছেন, সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষকতার সূত্রে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নিশ্চিত সুযোগ গ্রহণ করিনি। তাই আজ ৭২ প্লাস বছর বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়!
নতুন সপ্তাহে এসেও উপদেষ্টাদের পিছু ছাড়েনি ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ। শনিবার (১১ অক্টোবর) ‘খসড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, এখন ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। বরং জাতি হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন রয়েছে। বিগত ১৬ বছর দুঃশাসন, গুম-খুন ও লুটপাট দেখলাম। অসুস্থ, ভয়াবহ, আত্মধ্বংসী কাঠামো থেকে আমাদের অবশ্যই সেফ এক্সিটের দরকার রয়েছে।
এ দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম ওলামা পরিষদ আয়োজিত ‘সম্প্রীতি সমাবেশে’ যোগ দিতে রাঙ্গামাটি গিয়েছিলেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গে জানতে চান তার কাছে।
জবাবে উপদেষ্টা খালিদ হোসেন বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন যথাসময়ে ও সুষ্ঠুভাবে হবে। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমরা চলে যাব। সেফ এক্সিট বলতে আমি কিছু বুঝি না। আমার কোনো সেকেন্ড হোম নেই, এমনকি ঢাকাতেও নিজের বাড়ি নেই। বর্তমানে আমি সরকারি বাড়িতে আর চট্টগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকি। আমি এই দেশের মানুষ। এই দেশ আমার, এখানেই আমি থাকব।
রোববার (১২ অক্টোবর) একই কথা বলেন আরও দুই উপদেষ্টা। সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, কে কী চান সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। আমার ছেলে-মেয়ে সবাই দেশে। আমি দেশের বাইরে যাব কেন? আমি একা সেফ এক্সিট নিয়ে কী করব? বিদেশে কার কাছে যাব?
এ দিন বরিশালে টাইফয়েড টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। সেখানে তিনি বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, আমি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সুতরাং ‘সেফ এক্সিট’ আমার জন্য নয়। আমি এ দেশেই থাকব।
‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে চলমান আলোচনায় খুব বেশি সারবত্তা রয়েছে বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল হতে পারে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা রাজনীতি ডটকমকে বলেন, এটি মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কথার লড়াই, যেখানে কিছুটা ‘চোখ রাঙানোর’ ভঙ্গিমা থাকলেও এর গভীরে রয়েছে দায়িত্বশীলদের আরও সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ করার একটি বার্তা। ‘সেফ এক্সিট’ বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে এর পেছনে থাকা রাজনৈতিক ইঙ্গিতটা বোঝা জরুরি।
ড. মামুনের অভিমত, উভয় পক্ষই এর তাৎপর্য সম্পর্কে জানে। ফলে এর আক্ষরিক অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলে বরং ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। একে হুমকি হিসেবে না দেখে বরং রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হিসেবেই দেখা উচিত।
আলোচনায় থাকলেও ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি বলেও মনে করেন ঢাবি অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, উপদেষ্টারা ‘সেফ এক্সিট’ চান— এমন অভিযোগ উঠলেও নির্দিষ্ট কারও নাম কিংবা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ সামনে আসেনি। ফলে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।
শুরুটা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের কথার সূত্র ধরে। এরপর থেকেই ‘টক অব দ্য টাউনে’ পরিণত হয়েছে ‘সেফ এক্সিট’ শব্দযুগল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা কথা বলেছেন এটি নিয়ে। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও, যারা ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন বলে আলোচনা উসকে দিয়েছিলেন নাহিদ।
এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে উপদেষ্টাদের সবার বক্তব্যের মূল সুরটা এক— তারা কেউ ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে আদৌ কিছু ভাবছেন না। দেশ ছেড়েও কেউ কোথাও যেতেও চান না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে যে কথাবার্তাগুলো চলছে, সেটি রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা। আদৌ বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টির বাস্তবতা রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা।
‘সেফ এক্সিট’ শব্দবন্ধের আক্ষরিক অর্থ নিরাপদ প্রস্থান। প্রায়োগিক অর্থেও এর মাধ্যমে প্রস্থান বোঝানো হলেও এর আলাদা তাৎপর্য রয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। বিশেষ করে ক্ষমতার পালাবদলের সময় ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টি গুরুত্ব পেয়ে থাকে।
‘সেফ এক্সিট’ বলতে মূলত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিরাপদে দেশত্যাগকে বোঝানো হয়ে থাকে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হলে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। রাজনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ওই সময় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দেশের বাইরে চলে যাবেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না— ‘সেফ এক্সিট’ বলতে মূলত এটিকেই বোঝানো হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আলোচনায় এসেছে ২০০৬-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গও। ওই সময়কার প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল সেনাসমর্থিত। তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নিয়েও সে সরকার ক্ষমতায় ছিল দুই বছর।
ওই সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। বলা হয়ে থাকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতেই সে সময় ফখরুদ্দীন আহমদ ছাড়াও তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে দেশের বাইরে পাড়ি জমান। তাদের এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্য কোনো উপদেষ্টাদের নিয়ে সরকার টুঁ শব্দটিও করেনি।
তবে এবার জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিটে’র প্রয়োজনীয়তার কতটা প্রাসঙ্গিক— সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিভিন্ন মহলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, নির্বাচিত সরকার এলে আদৌ এই ‘সেফ এক্সিটে’র প্রয়োজন হবে কি না, সেই প্রশ্ন তোলা এখনো যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুসংহত বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ওঠেনি। ফলে এ ধরনের কোনো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি।
সাম্প্রতিক আলোচনায় উঠে আসা ‘সেফ এক্সিট’ শব্দযুগলের সূত্রপাত এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ হোসেনের বক্তব্যে। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সমালোচনা করেন তিনি।
নাহিদ বলেন, আমাদের উচিত ছিল ছাত্র-নেতৃত্বকেই শক্তিশালী করা, সরকারে গেলে সম্মিলিতভাবে যাওয়া। নাগরিক সমাজ বা রাজনৈতিক দলকে আমরা যে বিশ্বাসটা করেছিলাম, যে আস্থা রেখেছিলাম, সেই জায়গায় আসলে আমরা প্রতারিত হয়েছি। অনেক উপদেষ্টা নিজেদের আখের গুছিয়েছে অথবা গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে বিট্রে (প্রতারণা) করেছে।
সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে। তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবতেছে। তারা যদি এটা বিশ্বাস করত যে তাদের নিয়োগকর্তা ছিল গণঅভ্যুত্থানের শক্তি, রাজপথে নেমে জীবন দেওয়া ও আহত সাধারণ মানুষজন এবং তারা যদি তাদের ওপর ভরসা করত, তাহলে উপদেষ্টাদের এই বিচ্যুতি হতো না।
নাহিদ ইসলামের ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গটি আলোচনায় এলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে তারই সহযোদ্ধা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গত বুধবার (৮ অক্টোবর) নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে দেওয়া পোস্টে জানান, দেশ ছেড়ে যাবেন না কখনো।
আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, ‘যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট-নাগরিকত্ব নেওয়া, তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে। যারা ৫ আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এ দেশে, মৃত্যুও এ দেশের মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহিদি মৃত্যুই কামনা করি।’
একই দিন সচিবালয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে নিজ মন্ত্রনালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সেখানেও সাংবাদিকদের কথায় উঠে আসে ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ।
জবাবে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, নাহিদ ইসলামের বক্তব্য তাকেই প্রমাণ করতে হবে। আমি একদম কোনো এক্সিট খুঁজছি না। দেশেই ছিলাম, বাকিটা জীবনও বাংলাদেশেই কাটাব। সব রাজনৈতিক দলের মতো নবগঠিত রাজনৈতিক দলের (এনসিপি) সঙ্গেও সরকারের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এখন সেই দলের প্রধান নাহিদ ইসলাম কী কারণে, কোন অভিমান থেকে উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’ বা এ সংক্রান্ত মন্তব্য করেছেন, সেটি তাদের দলের মন্তব্য। তাদের কোনো বক্তব্য নিয়ে সরকারের পক্ষে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
পরদিন বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ফাওজুল কবির খান ফেসবুক পোস্টে নিজেই তুলে ধরেন ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ। প্রতিদিন কতটা পরিশ্রম করছেন, সে কথা তুলে ধরে ‘সেফ এক্সিটে’ ভাবনা নিয়ে আফসোস-আক্ষেপের কথা তুলে ধরেন তিনি।
ফাওজুল কবির পোস্টে লিখেছেন, সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষকতার সূত্রে এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নিশ্চিত সুযোগ গ্রহণ করিনি। তাই আজ ৭২ প্লাস বছর বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়!
নতুন সপ্তাহে এসেও উপদেষ্টাদের পিছু ছাড়েনি ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ। শনিবার (১১ অক্টোবর) ‘খসড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ শীর্ষক জাতীয় পরামর্শ সভায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, এখন ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে কথা হচ্ছে। আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। বরং জাতি হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন রয়েছে। বিগত ১৬ বছর দুঃশাসন, গুম-খুন ও লুটপাট দেখলাম। অসুস্থ, ভয়াবহ, আত্মধ্বংসী কাঠামো থেকে আমাদের অবশ্যই সেফ এক্সিটের দরকার রয়েছে।
এ দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম ওলামা পরিষদ আয়োজিত ‘সম্প্রীতি সমাবেশে’ যোগ দিতে রাঙ্গামাটি গিয়েছিলেন ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গে জানতে চান তার কাছে।
জবাবে উপদেষ্টা খালিদ হোসেন বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন যথাসময়ে ও সুষ্ঠুভাবে হবে। নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি নিয়েছে। নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে আমরা চলে যাব। সেফ এক্সিট বলতে আমি কিছু বুঝি না। আমার কোনো সেকেন্ড হোম নেই, এমনকি ঢাকাতেও নিজের বাড়ি নেই। বর্তমানে আমি সরকারি বাড়িতে আর চট্টগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকি। আমি এই দেশের মানুষ। এই দেশ আমার, এখানেই আমি থাকব।
রোববার (১২ অক্টোবর) একই কথা বলেন আরও দুই উপদেষ্টা। সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, কে কী চান সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। আমার ছেলে-মেয়ে সবাই দেশে। আমি দেশের বাইরে যাব কেন? আমি একা সেফ এক্সিট নিয়ে কী করব? বিদেশে কার কাছে যাব?
এ দিন বরিশালে টাইফয়েড টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। সেখানে তিনি বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, আমি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সুতরাং ‘সেফ এক্সিট’ আমার জন্য নয়। আমি এ দেশেই থাকব।
‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে চলমান আলোচনায় খুব বেশি সারবত্তা রয়েছে বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল হতে পারে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুন আল মোস্তফা রাজনীতি ডটকমকে বলেন, এটি মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কথার লড়াই, যেখানে কিছুটা ‘চোখ রাঙানোর’ ভঙ্গিমা থাকলেও এর গভীরে রয়েছে দায়িত্বশীলদের আরও সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ করার একটি বার্তা। ‘সেফ এক্সিট’ বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে না নিয়ে এর পেছনে থাকা রাজনৈতিক ইঙ্গিতটা বোঝা জরুরি।
ড. মামুনের অভিমত, উভয় পক্ষই এর তাৎপর্য সম্পর্কে জানে। ফলে এর আক্ষরিক অর্থ খোঁজার চেষ্টা করলে বরং ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। একে হুমকি হিসেবে না দেখে বরং রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হিসেবেই দেখা উচিত।
আলোচনায় থাকলেও ‘সেফ এক্সিট’ প্রসঙ্গ খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি বলেও মনে করেন ঢাবি অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি বলেন, উপদেষ্টারা ‘সেফ এক্সিট’ চান— এমন অভিযোগ উঠলেও নির্দিষ্ট কারও নাম কিংবা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ সামনে আসেনি। ফলে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।
সারজিস আলম বলেন, এক দিন হইত, দুই দিন হইত কিচ্ছু বলতাম না। তিন দিনের তিন দিনই এটা হইছে। যারা এটা করছে, তারা হচ্ছে রাজনৈতিক... (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ)। এই রাজনৈতিক দেউলিয়াদের আমরা দেখে নেব তাদের কলিজা কত বড় হইছে। কলিজা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখব।
১ দিন আগেনতুন ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) মানববন্ধন হবে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে। পরদিন বুধবার (১৫ অক্টোবর) একই কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব জেলা সদরে।
১ দিন আগে