ইতিহাস

ব্যাটল অব থার্মোপিলাই: সাহস ও আত্মত্যাগের অমর ইতিহাস

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১৩
চ্যাটজিপিটির চোখে ব্যাটল অব থার্মোপিলাই

খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সালের গ্রীষ্ম। ইউরোপ তখন সাম্রাজ্য বিস্তারের উত্তাল সময়ে। পারস্য সাম্রাট জারক্সিস তার বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালিয়েছেন স্বাধীন গ্রিক শহর-রাষ্ট্রগুলোর ওপর। ঠিক এই সময়েই ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় এক অনন্য অধ্যায়—থার্মোপিলাইয়ের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না, ছিল ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। একদিকে পারস্যের অসংখ্য সৈন্য, অন্যদিকে মাত্র তিনশো স্পার্টান যোদ্ধা এবং কয়েক হাজার গ্রিক সেনার মিলিত প্রতিরোধ। আজও এই যুদ্ধ ইতিহাসে বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে আছে।

এই যুদ্ধের পটভূমি বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তার আগের দশকগুলোতে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের আশপাশে পারস্য সাম্রাজ্য তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। বর্তমান ইরান, ইরাক, তুরস্ক, আফগানিস্তান, মিশরসহ এক বিশাল এলাকা জুড়ে পারস্যের শাসন বিস্তৃত ছিল। কিন্তু ইউরোপের পশ্চিম দিকে ছোট ছোট স্বাধীন শহর-রাষ্ট্র যেমন এথেন্স, স্পার্টা, করিন্থ—এগুলো পারস্যের কাছে মাথা নত করতে রাজি ছিল না।

খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালে পারস্যের আগের সম্রাট দারিউস গ্রীসে আক্রমণ চালিয়েছিলেন এবং এথেন্সের পাশে ম্যারাথন নামের জায়গায় গ্রীকরা তাকে পরাজিত করেছিল। সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই দারিউসের পুত্র জারক্সিস আবারও গ্রীসে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আগমন করেন। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস লিখেছেন, এই সেনাবাহিনীতে ২০ লক্ষের বেশি সৈন্য ছিল, যদিও আধুনিক গবেষকরা মনে করেন এই সংখ্যা অনেক কম, সম্ভবত দুই থেকে তিন লাখের মধ্যে।

গ্রীক শহর-রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ করত, কিন্তু এবার তারা বুঝেছিল, যদি একত্রিত না হয়, তবে সবাই হারিয়ে যাবে। তাই তারা একজোট হয়ে পারস্যকে প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করে। যুদ্ধের জন্য যে স্থানটি তারা বেছে নেয়, তা ছিল ‘থার্মোপিলাই’—একটি সরু উপত্যকা, যেখানে একসাথে বেশি সৈন্য প্রবেশ করতে পারে না। এটি ছিল এক কৌশলগত সিদ্ধান্ত। যদি সীমিত সংখ্যক সৈন্য দিয়ে অনেকগুলো শত্রু সৈন্যকে আটকে রাখা যায়, তবে সময় কেনা যাবে এবং অন্য শহরগুলো প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারবে।

স্পার্টার রাজা লিওনিদাস (Leonidas) এই প্রতিরোধ বাহিনীর নেতৃত্ব নেন। তার সঙ্গে ছিল ৩০০ জন স্পার্টান যোদ্ধা, যাদের প্রশিক্ষণ ছিল কড়াকড়িভাবে কঠোর এবং মৃত্যুকে অবহেলা করার মতো সাহসী। এদের সঙ্গে ছিল আরও কিছু হাজার গ্রীক সৈন্য, যেমন থেস্পিয়ান, থিবিয়ান এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত সেনা।

তিন দিন ধরে থার্মোপিলাইয়ের সরু পথ ধরে পারস্য বাহিনী আক্রমণ চালিয়েও গ্রীকদের প্রতিরোধ ভাঙতে পারেনি। গ্রীকরা আশ্চর্য সাহসিকতা এবং কৌশলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের বিশাল বাহিনীকে রুখে দিয়েছিল। কিন্তু চতুর্থ দিনে এক বিশ্বাসঘাতক, এফিয়ালতিস (Ephialtes), পারস্যদের জানিয়ে দেয় পাহাড়ি একটি গোপন পথ, যা দিয়ে তারা পেছন থেকে গ্রীকদের ঘিরে ফেলতে পারে। এই খবর পেয়ে লিওনিদাস অন্য গ্রীক সৈন্যদের সরে যেতে বলেন এবং নিজে মাত্র তিনশো স্পার্টান নিয়ে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে জীবন দেন।

এই আত্মত্যাগ শুধু গ্রীকদের নয়, সারা বিশ্বের ইতিহাসকে নাড়া দিয়েছিল। বহু গবেষক মনে করেন, থার্মোপিলাইয়ে গ্রীকদের এই প্রতিরোধ না হলে ইউরোপের ইতিহাস আজ ভিন্ন হতো।

ব্রিটিশ সামরিক ইতিহাসবিদ স্যার জন কিগান তাঁরআ হিস্ট্রি অব ওয়ারফেয়ার বইয়ে লিখেছেন—
“থার্মোপিলাইয়ের যুদ্ধে লিওনিদাস ও তার যোদ্ধারা কেবল যুদ্ধ করেননি, তারা ভবিষ্যতের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য এক প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।”

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক একাডেমির অধ্যাপক এবং ইতিহাসবিদ ভিক্টর ডেভিস হ্যানসন লিখেছেন—
“থার্মোপিলাই ছিল না শুধু অস্ত্রের যুদ্ধ, বরং মনোবলের যুদ্ধ।”

হ্যানসনের মতে, পারস্য বাহিনীর কাছে জয়ের সব উপকরণ থাকলেও গ্রীকরা তাদের সাংস্কৃতিক ঐক্য, সাহস আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে সেই বৈষম্য কাটিয়ে তুলনায় অনেকটা সময় পারস্য বাহিনীকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়।

এই যুদ্ধের তাৎপর্য বুঝতে গেলে আরও কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন, পারস্য যদি জয়ী হতো, তাহলে এথেন্সের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তো। গ্রীক নাট্য, দার্শনিক চর্চা, গণতান্ত্রিক চিন্তা—সবই হয়তো ইতিহাসে বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু লিওনিদাস ও তাঁর সেনাদের আত্মত্যাগ ইউরোপকে রক্ষা করেছিল এক সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা থেকে।

আরেক গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্ক লিখেছেন, “স্পার্টানদের জন্য পরাজয় কোনো লজ্জা নয়, পালিয়ে যাওয়া লজ্জা।” এই নীতিরই বাস্তব প্রয়োগ হয়েছিল থার্মোপিলাইয়ে।

বর্তমানে থার্মোপিলাইয়ে একটি স্মারক তৈরি করা হয়েছে যেখানে লিওনিদাসের ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানে খোদাই করা আছে একটি বিখ্যাত লাইন: “হে পথিক, স্পার্টাবাসীদের জানাও, আমরা এখানেই শুয়ে আছি, তাদের আদেশ মেনে।” এই লাইনটি স্পার্টান যোদ্ধাদের কর্তব্যনিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগের চূড়ান্ত রূপক।

এই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বহু কবিতা, উপন্যাস, সিনেমা ও শিল্পকর্মে চিত্রিত হয়েছে। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘300’ (Three Hundred) নামে একটি হলিউড চলচ্চিত্র থার্মোপিলাইয়ের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নির্মিত, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

ইতিহাসবিদ পিটার গ্রিন বলেন— “যদি থার্মোপিলাই না হতো, তবে গ্রীক সভ্যতার আলো হয়তো নিভেই যেত।”

থার্মোপিলাইয়ের যুদ্ধ তাই কেবল এক সামরিক সংঘর্ষ নয়, এটি এক দর্শন—যেখানে আত্মত্যাগ, নৈতিকতা ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই মানুষকে চিরকাল অনুপ্রাণিত করে। বর্তমান পৃথিবীতেও যখন ছোট ছোট রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী বড় শক্তির আগ্রাসনের মুখে পড়ে, তখন থার্মোপিলাইয়ের এই অধ্যায় মনে করিয়ে দেয়—সবসময় জয় পরিমাণে নয়, মানসিক শক্তিতে হয়। আর এই শিক্ষা মানবসভ্যতার এক অমূল্য ঐতিহ্য।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

চেয়েছিলাম ডেমোক্রেসি, হয়ে যাচ্ছে মবক্রেসি: সালাহউদ্দিন

সরকারের উদ্দেশে তিনি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন বিলম্বিত করতে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তা যেন প্রশ্রয় না পায়। জনগণের মনে যাতে এ প্রশ্ন না জাগে যে সরকার কোনো একটি বিশেষ দলকে সুবিধা দিতে চাইছে।’

৯ ঘণ্টা আগে

ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিবাদের মোকাবেলা করতে হবে: দুলু

আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘মহল্লায়-মহল্লায় আমাদের পাহারা দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যেন ফ্যাসিবাদ ঘুরে দাঁড়াতে না পারে। তাই নিজেদের মধ্য বিভেদ সৃষ্টি না করে দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

১০ ঘণ্টা আগে

গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ

গোপালগঞ্জে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করে বৈঠক আশা করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত সর্তকতার সঙ্গে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করবে, অন্যথায় গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিকে সুযোগ করে দেওয়া হবে।

১১ ঘণ্টা আগে

'সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে আরেকটা ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে'

গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করার জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, রাজনৈতিক ময়দানে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করার প্রয়োজনে যে মাঠের সমতা প্রয়োজন সেই সমতা নেই। সেজন্য আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণের দাবি এই সমাবেশ থেকে জানাব। ’

১২ ঘণ্টা আগে