যুদ্ধ

ব্যাটল অব অ্যাক্টিয়াম : নৌযুদ্ধে নিভে যায় রোমান সূর্য

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৪৩
চ্যাটজিপিটির চোখে ব্যাটল অব অ্যাক্টিয়াম

মানব ইতিহাসে বহু যুদ্ধ হয়েছে, যার মধ্যে কিছু যুদ্ধ শুধু সামরিক বিজয়ের গল্প নয়, বরং গোটা এক সভ্যতা, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই রকমই একটি যুদ্ধ হলো ব্যাটল অব অ্যাক্টিয়াম বা অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধ। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ সালে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ভূমধ্যসাগরের উপকূলে, গ্রিসের পশ্চিমে অ্যাক্টিয়াম নামের জায়গায়। এটি ছিল রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো ঘটনা, যা শেষ করে দেয় রোমান প্রজাতন্ত্রের যুগ এবং সূচনা করে রোমান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র শাসনের।

এই যুদ্ধে মুখোমুখি হয়েছিলেন গাইয়াস অক্টাভিয়াস—পরবর্তীতে যিনি ‘অগাস্টাস’ নামে পরিচিত হন—তার বাহিনী এবং মিশরের রানি ক্লিওপেট্রা ও রোমের অন্যতম শক্তিশালী সেনানায়ক মার্ক অ্যান্টনির যৌথ বাহিনী। যুদ্ধটি মূলত সামুদ্রিক যুদ্ধ হলেও এর প্রভাব রাজনীতি, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা ও সাম্রাজ্যের ক্ষমতার বণ্টন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

অক্টাভিয়াস ছিলেন জুলিয়াস সিজারের দত্তকপুত্র। সিজারের মৃত্যুর পর রোমে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অক্টাভিয়াস, মার্ক অ্যান্টনি ও লেপিডাস। এক পর্যায়ে অক্টাভিয়াস ও অ্যান্টনির মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়, বিশেষ করে অ্যান্টনি যখন মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার প্রেমে পড়ে যান এবং তাঁর সঙ্গে জোট গঠন করেন। এই সম্পর্ক রোমে ভালো চোখে দেখা হয়নি। অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা একসঙ্গে নিজেদের সন্তানদের উত্তরাধিকার ঘোষণা করলে তা রোমানদের আরও ক্ষেপিয়ে তোলে।

ব্যাটল অব অ্যাক্টিয়াম সংঘটিত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩১ সালের ২ সেপ্টেম্বর। রোমান সেনাপতি আগ্রিপা অক্টাভিয়াসের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন, যিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ নৌসেনানায়ক। অন্যদিকে, ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনি একসঙ্গে বেশ বড় বাহিনী নিয়ে এলেও তাঁদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে অ্যান্টনির অনেক নাবিক অক্টাভিয়াসের পক্ষ বেছে নেয়, এবং ক্লিওপেট্রার নৌবহর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটে যায়। ইতিহাসবিদ প্লুটার্ক লিখেছেন, “ক্লিওপেট্রা হঠাৎ করে যুদ্ধস্থল থেকে পালিয়ে যান, যা অ্যান্টনিকে বিভ্রান্ত করে এবং তিনিও তাঁর পিছু নেন।”

পরবর্তীতে, এই পরাজয়ের পর অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা দুজনেই আত্মহত্যা করেন। ক্লিওপেট্রার মৃত্যু নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে—কারও মতে তিনি বিষধর সাপের কামড়ে আত্মহনন করেন, আবার কেউ বলেন বিষ পান করেছিলেন। যেভাবেই হোক না কেন, তাঁদের মৃত্যু রোমান প্রজাতন্ত্রের শেষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেয় এবং অক্টাভিয়াস হয়ে ওঠেন রোমের একচ্ছত্র শাসক।

এই যুদ্ধ নিয়ে বহু বিদেশি ইতিহাসবিদ আলোচনা করেছেন। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক অ্যাড্রিয়ান গোল্ডসওয়ার্থ তাঁর বই অগাস্টাস: ফার্স্ট এম্পেরর অব রোম -এ লেখেন, “অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধ ছিল শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, এটি ছিল রোমের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী এক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব—রোম বনাম প্রাচ্যের প্রলোভন।” তাঁর মতে, এই যুদ্ধ অগাস্টাসকে একজন মহান প্রশাসক ও সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে গড়ে তোলে।

অন্যদিকে, মার্কিন ইতিহাসবিদ বারবারা স্ট্রাস বলেন, “ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির সম্পর্ককে রোমান প্রচারণা এমনভাবে চিত্রিত করেছিল যেন তা একটি জাতীয় বিপদ। অথচ বাস্তবে এটি ছিল একটি জটিল রাজনৈতিক জোট, যা অক্টাভিয়াস দক্ষতার সঙ্গে ধ্বংস করে দেন।” তাঁর মতে, যুদ্ধটি ছিল কৌশলের লড়াই, যেখানে অক্টাভিয়াস ছিলেন ধৈর্যশীল এবং প্রতিপক্ষ ছিল বিভ্রান্ত।

গ্রিক গবেষক ডিমিত্রিস ভাসিলিয়াদিস উল্লেখ করেন, “যুদ্ধের অবস্থান—অ্যাক্টিয়াম—গ্রীসের ইতিহাসে এক স্মরণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। আজও সেই জায়গায় রোমান বিজয়ের স্মারক হিসেবে এক বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।” তিনি মনে করেন, যুদ্ধটি প্রাচীন গ্রীস, মিশর এবং রোমের সাংস্কৃতিক ছোঁয়া বহন করে।

এই যুদ্ধের ফলে শুধু রাজনীতিই নয়, সংস্কৃতিও প্রভাবিত হয়। রোমান কবি ভার্জিল তাঁর মহাকাব্য ‘এনেইয়েড’-এ অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে অগাস্টাসকে দেবতুল্য করে দেখানো হয়েছে। এই কাব্য রোমান সাম্রাজ্যের গৌরবময় ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি পরবর্তী রোমান সম্রাটরা নিজেদের legitimize করার জন্য অ্যাক্টিয়ামের স্মৃতি ব্যবহার করেছেন।

আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধ একদিকে যেমন একটি সাম্রাজ্যিক সংগ্রাম, অন্যদিকে তা এক প্রেমের ট্র্যাজেডিও। ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির সম্পর্ক নিয়ে বহু চিত্র, নাটক ও সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, যার মধ্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আধুনিক কালের ইতিহাসবিদ এমা ডেনবারি উল্লেখ করেন, “এই যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—ক্ষমতার রাজনীতিতে আবেগের জায়গা খুব সীমিত। অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা আবেগকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, আর অক্টাভিয়াস যুক্তিকে।” তিনি বলেন, এই যুদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও গবেষণার বিষয়, কারণ এতে দেখা যায় কীভাবে কৌশল, প্রচারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতা একটি সাম্রাজ্যের জন্ম দিতে পারে।

সব মিলিয়ে ব্যাটল অব অ্যাক্টিয়াম শুধু একটি সামরিক সংঘর্ষ নয়, এটি ছিল প্রাচীন বিশ্বের এক মোড় ঘোরানো রাজনৈতিক নাটক। এর পরিণতি ছিল দীর্ঘস্থায়ী—রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসান এবং একটি সাম্রাজ্যের উদয়। ইতিহাসের পাতায় এই যুদ্ধ শুধুই এক দিনের ঘটনা নয়, বরং একটি যুগের অবসান ও নতুন যুগের সূচনা। ক্লিওপেট্রা ও অ্যান্টনির প্রেম যেমন ট্র্যাজেডি হয়ে রয়ে গেছে, তেমনি অগাস্টাসের রাজনীতি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। এই যুদ্ধ প্রমাণ করে, প্রেম, বিশ্বাস, ক্ষমতা ও কৌশলের জটিল মেলবন্ধনই গড়ে দেয় ইতিহাসের গতিপথ।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

৭২-এর মুজিববাদী সংবিধান রেখে নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ১৯৭২ সালের মুজিববাদী সংবিধান রেখে কখনোই নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন।

১০ ঘণ্টা আগে

মঞ্চে পড়ে গেলেন জামায়াত আমির, বসে শেষ করলেন বক্তব্য

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশে বক্তৃতা করতে করতেই মঞ্চে ঢলে পড়েছেন জামআয়াতে ইসালামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরে একাধিকবার দাঁড়িয়ে বকতৃতা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বসেই বক্তৃতা শেষ করেন তিনি।

১১ ঘণ্টা আগে

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই : আমীর খসরু

আমীর খসরু বলেন, জনগণের ভোটে, জনগণের মালিকানায় নির্বাচিত সংসদ-সরকার; এর বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন এজন্য ভোটের প্রতীক্ষায় রয়েছে। যারা নির্বাচন চান না, তাদের দল করার কোনো প্র‍য়োজনীয়তা আছে কিনা, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

১১ ঘণ্টা আগে

জামায়াতের সমাবেশে আমন্ত্রণ পায়নি বিএনপি: সালাহউদ্দিন আহমদ

জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

১১ ঘণ্টা আগে