
বিবিসি বাংলা

খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন তার স্বামী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হামলায় নিহত হন। জিয়ার মৃত্যুর পর একদিকে যেমন দিশেহারা তার পরিবার, অন্যদিকে বিপর্যস্ত হয় তারই গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি।
১৯৮১ সালের সেই সময় খালেদা জিয়া ছিলেন একজন গৃহবধু। দুই সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন।
কে ধরবে বিএনপির হাল এমন প্রশ্নে খোদ দলের মধ্যে দুইটি ভাগ তৈরি হয়। সেই সময় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যোগ দেন নেতাকর্মীদের আগ্রহে।
১৯৮২ সালের দলের প্রাথমিক সদস্য হওয়ার পর এক বছরের মাথায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন খালেদা জিয়া। ১৯৮৪ সালের নির্বাচিত হন দলীয় চেয়ারপারসন।
সেই থেকে চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এর মধ্যেই সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন। ফলে দলের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকেই মূলত প্রতিকূল এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তখন থেকেই তাকে টানা আন্দোলনের মধ্যে থাকতে হয়েছে।
আন্দোলন সংগ্রামে নেমে বহুবার, জেল বা নির্যাতনেরও স্বীকার হয়েছেন। সত্তরোর্ধ একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বয়সে জেলেও জীবন কাটাতে হয়েছে।
রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নানা প্রশ্নে খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থান তাকে বাংলাদেশের আপোসহীন নেত্রীর খ্যাতি দিয়েছে।
গৃহকোণ থেকে রাজনীতির কঠিন পথ
১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ ছিলেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়াকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং তার সাদামাটা জীবনের গল্পও তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক ও এক সময়ের তার উপ-প্রেস সচিব সৈয়দ আবদাল আহমেদ। তিনি সে সব গল্প তার 'নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া' বইয়েও তুলে ধরেছেন।
সৈয়দ আবদাল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "উনি যখন গৃহবধু ছিলেন, নিজেকে ঢেকে রেখেছিল স্বামী জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিত্বের আড়ালে। কখনো কোন সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখেননি। কোন বিবৃতি দেন নি, রাজনীতি থেকে ছিলেন বহু পথ দূরে"।
তাহলে কিভাবে তিনি সেখান থেকে রাজনীতিতে এলেন এবং সফলতার শিখরে পৌছালেন সে সব গল্প উঠে এসেছে ইতিহাসের পাতায়।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
এক পর্যায়ে মি. সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে বিএনপির অনেক নেতার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান - এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা।
দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার পরামর্শ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া।
বিএনপি নিয়ে গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, সেই সময় থেকেই খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এমন অবস্থার মধ্যেই বিএনপির ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন।
তখন দলের একটি অংশ চেয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের কাঠামো ঠিক করা হোক। কিন্তু অপর আরেকটি অংশ, যারা রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারে ছিলেন, তারা এর বিরোধিতা করেন।
দলের প্রবীণ ও তরুণ অংশটি খালেদা জিয়াকে সমর্থন করেন। দুইজনের নমিনেশন পেপারই নির্বাচন কমিশনারের নিকট দাখিল করা হয়।
পরে দলের বিভক্তি রোধের প্রয়োজনে আব্দুস সাত্তারের অনুরোধে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন খালেদা জিয়া।
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন। কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
অনড় থেকে আপসহীন
সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে একযোগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ একটি নির্বাচন আয়োজন করেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা নির্বাচন বর্জন করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এরশাদের আয়োজিত ৮৬'র নির্বাচনে অংশ নেয়।
সৈয়দ আবদাল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সবাই এক সাথে ওয়াদা করেছিল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। যারা যাবে তারা জাতীয় বেঈমান হবে। কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিলো"।
তিনি বলছিলেন, তখন অন্যরা নির্বাচন করে ক্ষমতায় গেলেও ভোট বয়কট করে আন্দোলন চালিয়ে যান খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। তখন বিএনপি এই আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অননমীয় মনোভাবের কারণে খালেদা জিয়া আপোসহীন নেত্রীর তকমা পান।
এই আন্দোলনের মুখে এক পর্যায় সংসদ থেকে বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীও।
একটা পর্যায়ে আন্দোলন জোরালো হয়। পতন হয় এরশাদ সরকারের।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, "তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন আমরা দেখলাম একেবারে সাফল্যের সঙ্গে বিএনপিকে ধরে রাখলেন এবং নিজেও একজন রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলেন"।
"এবং শুধু তাই না, ধারাবাহিকভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তিনি একটা আপোসহীন ভাবমূর্তি গড়ে তুললেন। যা তাকে আলাদা একটা পরিচিতি দিলো এবং এটা তার রাজনৈতিক ক্যারিশমা। মানুষ তাকে ভাবে তিনি আন্তরিক, নীতিবান এবং আপোসহীন"।
নির্বাচনেও ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী
গণআন্দোলনের মূখে ১৯৯০ সালের ছয়ই ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তখন মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে এটা অনেকটা ধারণা করা হচ্ছিল যে নির্বাচনে অনায়াসে ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ।
কিন্তু ভোটের ফলাফলে বিএনপির ১৪০টি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের আসন ছিল ৮৮টি। তখন জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির প্রথম ভোট ছিল সেটি। সেই থেকে গত তিন দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সবগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
যে সব নির্বাচনের কোনটিতে পাঁচটি আসনে কোনবার তিনটি আসনে ভোটে অংশ নেন এবং সবগুলো নির্বাচনেই জয়লাভ করেন তিনি।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে জোট গঠন করে বিএনপি। যদিও সেই জোট নির্বাচনে তাদের বিপুল জয় এনে দিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে।
সেই সরকারের সময় 'হাওয়া ভবন' নিয়েও সমালোচনার তৈরি হয়।
তবে বিএনপি সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো নিয়ে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসাবে নিজেদের পছন্দের লোককে নিয়োগ দিতেই তারা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ নিয়ে ব্যাপক অস্থিরতার মধ্যে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পরে সেনা সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের ঘটনা ঘটে।
সেই সময় রাজনৈতিক দল হিসাবে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল বিএনপিকে। আওয়ামী লীগের মতো দলটির অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হয়।
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান গ্রেফতারের পর ব্যাপক নির্যাতনের মুখোমুখি হন। একপর্যায়ে তিনি বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হন, যার পরে তিনি আর বাংলাদেশে আসেননি। শেখ হাসিনার পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়।
সেই সময় খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়, ৩০০ টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩৩টি আসন জয়লাভ করে বিএনপি।
সেই সময়েও বগুড়া-৬, বগুড়া-৭ এবং ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন খালেদা জিয়া।
রাজনীতির গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাদের বহুদলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে এতগুলো আসনে ভোটে অংশ নিয়ে না হারার বিষয়টি এটা একটা রেকর্ড।
সমসাময়িক অন্য যারা আছেন, বা ওই সময়ের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন, শেখ হাসিনা, হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, তারা সবাই তো কোন না কোনবার হেরেছেন।
কিন্তু খালেদা জিয়া কখনো হারেনি"।
মি. আহমদের মতে, খালেদা জিয়ার নির্দিষ্ট কোন ভোট ব্যাংক ছিল না। তিনি যে জায়গা থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হতেন সেখানেই তিনি বিপুল ভোটে জয় পেতেন। এটা খালেদা জিয়াকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
টানাপোড়েন ও সংকটে খালেদা জিয়া
১৯৯১ সালের সালের নির্বাচনের পর ১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলার একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সংকট তৈরি হয়।
মাগুরার সেই বিতর্কিত উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠের রাজনীতি আন্দোলন দানা বাধে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে।
তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সে উপ-নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবি করে।
কিন্তু বিএনপি শুরু থেকে সে দাবি নাকচ করে আসছিল। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তাদের আন্দোলন জোরদার করে। আওয়ামী লীগের এই দাবিকে সমর্থন করে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।
১৯৯৫ সালে বছর-জুড়ে বিভিন্ন সময় হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয় আওয়ামী লীগ।
একদিকে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচী জোরালো হচ্ছিল অন্যদিকে বিএনপি সরকারও একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
বিএনপি যুক্তি দিয়েছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতেই হবে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য নানা কূটনীতিকের আলোচনা ও মধ্যস্থতার চেষ্টা বিফলে যায়।
বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলন ও বয়কটের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পরে অবশ্য সেই সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচন দেয় খালেদা জিয়া। সেই নির্বাচনে অবশ্য জয় পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট গঠন করে বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল।
নির্বাচনের পর জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই সরকার গঠন করে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে , যেগুলো খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে অনেকের ধারণা।
এছাড়া ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া গ্রেফতার হন। সে সময় শেখ হাসিনাও গ্রেফতার হয়েছিলেন।
খালেদা জিয়ার এক সময়ের উপ প্রেস সচিব সৈয়দ আবদাল আহমেদ জানান, ওয়ান ইলেভেন সরকার খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন ওয়ান ইলেভেনের সরকার।
"তারা খালেদা জিয়াকে সৌদি আরব পাঠাতে চেয়েছিল। সেটি খালেদা জিয়া জানতে পেরে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে জানান তিনি দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। তখন সৌদি রাষ্ট্রদূত ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তখন খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারেনি তৎকালীন ওয়ান ইলেভেন সরকার", বলছিলেন মি. আহমেদ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল।
ক্ষমতায় এসে উচ্চ আদালতের আদেশের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেকগুলো দল।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জনের পর সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। অন্যদিকে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তাঁর বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা।
সেই সময় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকে গুম বা খুনের শিকার হয়েছে। তা সত্ত্বেও সক্রিয়ভাবে বিএনপির হাল ধরে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া। বেশ কয়েক দফায় চেষ্টা হলেও বিএনপিকে ভাঙা যায়নি।
খালেদা জিয়া যখন রাজনৈতিকভাবে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছিলেন, ওই একই সময়ে তাঁর পারিবারিক ট্র্যাজেডিও ঘটে ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
কিন্তু সেই সময়েও দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন খালেদা জিয়া। যদিও তখন লন্ডন থেকে তারেক রহমান দলের মূল নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দিতেন।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলো আদালত, যা পরে বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়। তারপর থেকে প্রথমে কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় ও পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। দুর্নীতির আরেকটি মামলাতেও তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই নির্বাহী আদেশে বিশেষ শর্তে মুক্তির পর তিনি গুলশানের বাসায় উঠেন। শারীরিক নানা অসুস্থতাও তাকে কাবু করে ফেলছিল। দলের চেয়ারপার্সন হিসাবে থাকলেও সেই সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দলের মূল নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন লন্ডন থেকে তার বড় ছেলে তারেক রহমান।
২০২৪ সালে অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৬ই অগাস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাকে সব দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয়।

খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন তার স্বামী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের হামলায় নিহত হন। জিয়ার মৃত্যুর পর একদিকে যেমন দিশেহারা তার পরিবার, অন্যদিকে বিপর্যস্ত হয় তারই গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি।
১৯৮১ সালের সেই সময় খালেদা জিয়া ছিলেন একজন গৃহবধু। দুই সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন।
কে ধরবে বিএনপির হাল এমন প্রশ্নে খোদ দলের মধ্যে দুইটি ভাগ তৈরি হয়। সেই সময় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যোগ দেন নেতাকর্মীদের আগ্রহে।
১৯৮২ সালের দলের প্রাথমিক সদস্য হওয়ার পর এক বছরের মাথায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন খালেদা জিয়া। ১৯৮৪ সালের নির্বাচিত হন দলীয় চেয়ারপারসন।
সেই থেকে চার দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বিএনপিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
এর মধ্যেই সেনাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছেন। ফলে দলের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকেই মূলত প্রতিকূল এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তখন থেকেই তাকে টানা আন্দোলনের মধ্যে থাকতে হয়েছে।
আন্দোলন সংগ্রামে নেমে বহুবার, জেল বা নির্যাতনেরও স্বীকার হয়েছেন। সত্তরোর্ধ একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বয়সে জেলেও জীবন কাটাতে হয়েছে।
রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নানা প্রশ্নে খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থান তাকে বাংলাদেশের আপোসহীন নেত্রীর খ্যাতি দিয়েছে।
গৃহকোণ থেকে রাজনীতির কঠিন পথ
১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যখন নিহত হন তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ ছিলেন খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়াকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং তার সাদামাটা জীবনের গল্পও তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক ও এক সময়ের তার উপ-প্রেস সচিব সৈয়দ আবদাল আহমেদ। তিনি সে সব গল্প তার 'নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া' বইয়েও তুলে ধরেছেন।
সৈয়দ আবদাল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "উনি যখন গৃহবধু ছিলেন, নিজেকে ঢেকে রেখেছিল স্বামী জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিত্বের আড়ালে। কখনো কোন সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখেননি। কোন বিবৃতি দেন নি, রাজনীতি থেকে ছিলেন বহু পথ দূরে"।
তাহলে কিভাবে তিনি সেখান থেকে রাজনীতিতে এলেন এবং সফলতার শিখরে পৌছালেন সে সব গল্প উঠে এসেছে ইতিহাসের পাতায়।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
এক পর্যায়ে মি. সাত্তারকে অপসারণ করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
একদিকে দলীয় কোন্দল, অন্যদিকে বিএনপির অনেক নেতার এরশাদের মন্ত্রিসভায় যোগদান - এই দুই পরিস্থিতিতে বিএনপি তখন অনেকটা ছত্রভঙ্গ, বিপর্যস্ত এবং দিশেহারা।
দল টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে তৎকালীন বিএনপির সিনিয়র কিছু নেতার পরামর্শ এবং অনুরোধে ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনীতিতে আসেন খালেদা জিয়া।
বিএনপি নিয়ে গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর মতে, সেই সময় থেকেই খালেদা জিয়া হয়ে উঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এমন অবস্থার মধ্যেই বিএনপির ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন।
তখন দলের একটি অংশ চেয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের কাঠামো ঠিক করা হোক। কিন্তু অপর আরেকটি অংশ, যারা রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারে ছিলেন, তারা এর বিরোধিতা করেন।
দলের প্রবীণ ও তরুণ অংশটি খালেদা জিয়াকে সমর্থন করেন। দুইজনের নমিনেশন পেপারই নির্বাচন কমিশনারের নিকট দাখিল করা হয়।
পরে দলের বিভক্তি রোধের প্রয়োজনে আব্দুস সাত্তারের অনুরোধে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন খালেদা জিয়া।
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন। কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
অনড় থেকে আপসহীন
সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে একযোগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে নামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ একটি নির্বাচন আয়োজন করেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা নির্বাচন বর্জন করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এরশাদের আয়োজিত ৮৬'র নির্বাচনে অংশ নেয়।
সৈয়দ আবদাল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "সবাই এক সাথে ওয়াদা করেছিল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। যারা যাবে তারা জাতীয় বেঈমান হবে। কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিলো"।
তিনি বলছিলেন, তখন অন্যরা নির্বাচন করে ক্ষমতায় গেলেও ভোট বয়কট করে আন্দোলন চালিয়ে যান খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি। তখন বিএনপি এই আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অননমীয় মনোভাবের কারণে খালেদা জিয়া আপোসহীন নেত্রীর তকমা পান।
এই আন্দোলনের মুখে এক পর্যায় সংসদ থেকে বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীও।
একটা পর্যায়ে আন্দোলন জোরালো হয়। পতন হয় এরশাদ সরকারের।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, "তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন আমরা দেখলাম একেবারে সাফল্যের সঙ্গে বিএনপিকে ধরে রাখলেন এবং নিজেও একজন রাজনীতিবিদ হয়ে উঠলেন"।
"এবং শুধু তাই না, ধারাবাহিকভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তিনি একটা আপোসহীন ভাবমূর্তি গড়ে তুললেন। যা তাকে আলাদা একটা পরিচিতি দিলো এবং এটা তার রাজনৈতিক ক্যারিশমা। মানুষ তাকে ভাবে তিনি আন্তরিক, নীতিবান এবং আপোসহীন"।
নির্বাচনেও ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী
গণআন্দোলনের মূখে ১৯৯০ সালের ছয়ই ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তখন মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে এটা অনেকটা ধারণা করা হচ্ছিল যে নির্বাচনে অনায়াসে ক্ষমতায় আসবে আওয়ামী লীগ।
কিন্তু ভোটের ফলাফলে বিএনপির ১৪০টি আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগের আসন ছিল ৮৮টি। তখন জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির প্রথম ভোট ছিল সেটি। সেই থেকে গত তিন দশকেরও বেশি সময় বাংলাদেশের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সবগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
যে সব নির্বাচনের কোনটিতে পাঁচটি আসনে কোনবার তিনটি আসনে ভোটে অংশ নেন এবং সবগুলো নির্বাচনেই জয়লাভ করেন তিনি।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাথে জোট গঠন করে বিএনপি। যদিও সেই জোট নির্বাচনে তাদের বিপুল জয় এনে দিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে।
সেই সরকারের সময় 'হাওয়া ভবন' নিয়েও সমালোচনার তৈরি হয়।
তবে বিএনপি সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে বিচারপতিদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো নিয়ে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসাবে নিজেদের পছন্দের লোককে নিয়োগ দিতেই তারা ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ নিয়ে ব্যাপক অস্থিরতার মধ্যে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পরে সেনা সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের ঘটনা ঘটে।
সেই সময় রাজনৈতিক দল হিসাবে বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিল বিএনপিকে। আওয়ামী লীগের মতো দলটির অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হয়।
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান গ্রেফতারের পর ব্যাপক নির্যাতনের মুখোমুখি হন। একপর্যায়ে তিনি বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হন, যার পরে তিনি আর বাংলাদেশে আসেননি। শেখ হাসিনার পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়।
সেই সময় খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়, ৩০০ টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩৩টি আসন জয়লাভ করে বিএনপি।
সেই সময়েও বগুড়া-৬, বগুড়া-৭ এবং ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন খালেদা জিয়া।
রাজনীতির গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমাদের বহুদলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে এতগুলো আসনে ভোটে অংশ নিয়ে না হারার বিষয়টি এটা একটা রেকর্ড।
সমসাময়িক অন্য যারা আছেন, বা ওই সময়ের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন, শেখ হাসিনা, হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, তারা সবাই তো কোন না কোনবার হেরেছেন।
কিন্তু খালেদা জিয়া কখনো হারেনি"।
মি. আহমদের মতে, খালেদা জিয়ার নির্দিষ্ট কোন ভোট ব্যাংক ছিল না। তিনি যে জায়গা থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হতেন সেখানেই তিনি বিপুল ভোটে জয় পেতেন। এটা খালেদা জিয়াকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
টানাপোড়েন ও সংকটে খালেদা জিয়া
১৯৯১ সালের সালের নির্বাচনের পর ১৯৯৪ সালে মাগুরা জেলার একটি উপ-নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সংকট তৈরি হয়।
মাগুরার সেই বিতর্কিত উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠের রাজনীতি আন্দোলন দানা বাধে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে।
তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সে উপ-নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন দাবি করে।
কিন্তু বিএনপি শুরু থেকে সে দাবি নাকচ করে আসছিল। কিন্তু দাবি আদায়ের জন্য আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তাদের আন্দোলন জোরদার করে। আওয়ামী লীগের এই দাবিকে সমর্থন করে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।
১৯৯৫ সালে বছর-জুড়ে বিভিন্ন সময় হরতাল এবং অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক কর্মসূচী দেয় আওয়ামী লীগ।
একদিকে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচী জোরালো হচ্ছিল অন্যদিকে বিএনপি সরকারও একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
বিএনপি যুক্তি দিয়েছিল, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতেই হবে।
দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য নানা কূটনীতিকের আলোচনা ও মধ্যস্থতার চেষ্টা বিফলে যায়।
বিরোধী দলগুলোর তীব্র আন্দোলন ও বয়কটের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পরে অবশ্য সেই সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচন দেয় খালেদা জিয়া। সেই নির্বাচনে অবশ্য জয় পায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট গঠন করে বিএনপি দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল।
নির্বাচনের পর জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই সরকার গঠন করে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে , যেগুলো খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে অনেকের ধারণা।
এছাড়া ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া গ্রেফতার হন। সে সময় শেখ হাসিনাও গ্রেফতার হয়েছিলেন।
খালেদা জিয়ার এক সময়ের উপ প্রেস সচিব সৈয়দ আবদাল আহমেদ জানান, ওয়ান ইলেভেন সরকার খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন ওয়ান ইলেভেনের সরকার।
"তারা খালেদা জিয়াকে সৌদি আরব পাঠাতে চেয়েছিল। সেটি খালেদা জিয়া জানতে পেরে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে জানান তিনি দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। তখন সৌদি রাষ্ট্রদূত ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তখন খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারেনি তৎকালীন ওয়ান ইলেভেন সরকার", বলছিলেন মি. আহমেদ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল।
ক্ষমতায় এসে উচ্চ আদালতের আদেশের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেকগুলো দল।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জনের পর সংসদে বিএনপির কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। অন্যদিকে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তাঁর বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা।
সেই সময় বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকে গুম বা খুনের শিকার হয়েছে। তা সত্ত্বেও সক্রিয়ভাবে বিএনপির হাল ধরে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া। বেশ কয়েক দফায় চেষ্টা হলেও বিএনপিকে ভাঙা যায়নি।
খালেদা জিয়া যখন রাজনৈতিকভাবে নানান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছিলেন, ওই একই সময়ে তাঁর পারিবারিক ট্র্যাজেডিও ঘটে ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
কিন্তু সেই সময়েও দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন খালেদা জিয়া। যদিও তখন লন্ডন থেকে তারেক রহমান দলের মূল নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত দিতেন।
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলো আদালত, যা পরে বাড়িয়ে ১০ বছর করা হয়। তারপর থেকে প্রথমে কারাগারে বিশেষ ব্যবস্থায় ও পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। দুর্নীতির আরেকটি মামলাতেও তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরে হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই নির্বাহী আদেশে বিশেষ শর্তে মুক্তির পর তিনি গুলশানের বাসায় উঠেন। শারীরিক নানা অসুস্থতাও তাকে কাবু করে ফেলছিল। দলের চেয়ারপার্সন হিসাবে থাকলেও সেই সময় থেকেই তিনি রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। দলের মূল নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন লন্ডন থেকে তার বড় ছেলে তারেক রহমান।
২০২৪ সালে অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৬ই অগাস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাকে সব দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া বহুবার কারাবরণ করেছেন এবং চড়াই-উৎরাই পার করেছেন। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক আদর্শ ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অবিচল। দেশ ও জাতির সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন।
১৪ ঘণ্টা আগে
মঙ্গলবার এক শোকবার্তায় বলা হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া এক রাজনৈতিক অস্থির সময়ে তাঁর দলের হাল ধরেছিলেন। এদেশে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে অনড় ভূমিকা রেখে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে সফল হয়েছিলেন।
১৫ ঘণ্টা আগে
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় দেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, মানবাধিকারের জন্য, ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করে গেছেন। জেল খেটেছেন, নির্যাতিত হ
১৬ ঘণ্টা আগে