
সজীব রহমান

রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার টেবিলে বসতে না পারায় শেষ পর্যন্ত সরকারই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করে আদেশ জারি করেছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েও সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
‘জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ শিরোনামের এ আদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি শুরু থেকেই সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের বিষয়ে অনড় অবস্থান ধরে রেখেছে, যার বিপরীত অবস্থান ছিল জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ তারিখ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অবস্থান নেয়নি।
এ গণভোটের প্রশ্নের মধ্যেই আবার উল্লেখ করা হয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু এবং উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোট (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা। এটি জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অন্যতম দাবি। এনসিপিও উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে। বিএনপি আবার উচ্চকক্ষে নিমরাজি হলেও পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোর বিরোধী।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠনের কথা বলা হয়েছে আদেশে। এই পরিষদই জুলাই সনদের প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবি ছিল গণপরিষদ গঠন করে তাকে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া। গণপরিষদ নামে না হলেও সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে এনসিপির সে দাবি পূরণ হয়েছে। বিএনপি আবার গণপরিষদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। গণপরিষদ দাবি না করলেও তাতে মৌন সমর্থন ছিল জামায়াতের।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া তিনটি রাজনৈতিক দলের দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়েই প্রতিটি দলের কোনো না কোনো দাবি মেনে নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে সরকার।
কিন্তু তাতে কি শেষ রক্ষা হলো? প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তি কি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ হাসি মুখে গ্রহণ করতে পারল? জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তাই বা কাটল কতটুকু?
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকালে উপদেষ্টা পরিষদ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদন করে। এর পরপরই প্রধান উপদেষ্টা এর সারসংক্ষেপে সই করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ আদেশে সই করলে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই আদেশ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন দলগুলোর নেতারা। পরে এনসিপি বাদে বিএনপি-জামায়াতের আনুষ্ঠানিক অবস্থানও প্রকাশ্যে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পরপরই বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল জুলাই সনদ প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির নেতৃত্ব দেওয়া সালাহউদ্দিন আহমদকে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজে যে জুলাই সনদে সই করেছেন, জুলাই আদেশের মাধ্যমে তিনি নিজেই তা লঙ্ঘন করেছেন।
এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা অবশ্য দেননি সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে তিনিসহ বিএনপির আগের অবস্থান, গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদের ঠিক যে ভাষ্যে সই করেছে সেভাবেই তারা জুলাই সনদের গণভোট ও বাস্তবায়নের পক্ষপাতী। পরে বিএনপির আনুষ্ঠানিক বক্তব্যেও উঠে এসেছে সে কথা।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকে বসে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি কেবল দলের স্থায়ী কমিটির লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন।
বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ও একই দিনে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোটকে স্বাগত জানানো হয়েছে। এর জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদও জানিয়েছে দলটি। তবে ১৭ অক্টোবর ঐক্যমতের ভিত্তিতে সই হওয়া জুলাই জাতীয় সনদের ওপরই জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি।
জুলাই সনদের সেই সই হওয়া ভাষ্যের অর্থ— তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনসহ আরও বেশ কিছু ইস্যুতেই বিএনপি এমন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল। সই হওয়া জুলাই সনদের কোথাও সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় এটিরও বিরুদ্ধে বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নির্বাচনের দিনকে গণভোটের তারিখ ঘোষণার জন্য ধন্যবাদ জানালেও তাই সই হওয়া জুলাই সনদের ভাষ্যের ওপর গণভোট উল্লেখ করায় সনদ বাস্তবায়নের আদেশের বিরুদ্ধে বিএনপি অবস্থান নিচ্ছে কি না— সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্রিফিংয়েও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতি পাঠের পর সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন না নিয়েই বিদায় নেওয়ায় সে প্রশ্নের কোনো উত্তর এখন পর্যন্ত মিলছে না।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট আয়োজনের পূর্ব অবস্থানে তারা এখনো অনড়।
বিকেলেই দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জনগণের দাবি ও অভিপ্রায় উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে নির্বাচন ও গণভোটের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। একই দিন নির্বাচন ও গণভোট হলে সংকট তৈরি হবে।
পরে সন্ধ্যায় সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের সভাপতিত্বে বৈঠক করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ। সেখানেও উঠে আসে নায়েবে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের ভাষ্যেরই প্রতিফলন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ পর্যালোচনা করে বলা হয়, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং গণদাবি মানা হয়নি।
সরকার জামায়াতের সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর দাবি মেনে নিলেও গণভোটের তারিখ নিয়ে দলটির বিরোধিতা অব্যাহত থাকবে বলেই জানিয়েছেন মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণায় সংকটমুক্ত স্বচ্ছ নির্বাচনের সংকটটা রয়েই গেল। নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে তাদের আট দলের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
সংবিধান সংশোধনে গণপরিষদ ছাড়াও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টার সইয়ে জারি হওয়ার দাবি ছিল দলটির। সে দাবি পূরণ না হওয়ায় অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত মিলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের বক্তব্যে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় কৃষক শক্তির এক আলোচনা সভায় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখাতে পারেনি। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিজে বাস্তবায়নের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ।
একই সুর ছিল দলের মুখ্য সংগঠন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, জুলাই সনদের আদেশ জারি রাষ্ট্রপতি দিলেও জায়েজ হবে, কিন্তু নৈতিক হবে না। প্রধান উপদেষ্টাকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে।
সন্ধ্যায় ‘জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন জুলাই আদেশের মাধ্যমে সরকারের দায় এড়ানোর প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ আদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের উচিত, জনগণের স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করা। সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।’
পরে অবশ্য দলের জরুরি বৈঠকে বসেছে এনসিপি। নেতারা জানান, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও দলটির সে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সেই ভাষণ ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও। সেখানেও উঠে এসেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কোনো কোনো দল একে স্বাগত জানালেও অন্যরা মনে করছে প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মওলানা মামুনুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে।
খেলাফত মজলিস
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক এবং জনঅভিপ্রায়ের বহির্প্রকাশ। এটি জনগণের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি। তবে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্তে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি।
ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি
ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একইদিনে গণভোট বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। আমরা মনে করি, একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসেবে আসন নির্ধারণ অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান। সার্বিক বিচারে এ ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।
বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ
বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সংকট থেকে উত্তরণে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এটি গত ২৮ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া পক্ষপাতমূলক প্রস্তাবনার পুনরাবৃত্তি মাত্র। গণভোটের প্রস্তাব ও উচ্চকক্ষের প্রস্তাবনা অপ্রয়োজনীয়। এর মধ্য দিয়ে শুধু আর্থিক ব্যয় বাড়বে না, সরকার পরিচালনায় সংকট তৈরির ঝুঁকিও রয়েছে। আর সংবিধান সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার সার্বভৌম সংসদের।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, আমাদের সংবিধানে আদেশ জারি বা গণভোটের কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি শুধু অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। তাকে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে সংবিধান পরিপন্থি কাজ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গণভোট ও আদেশ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তাতে দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ নেই। অথচ প্রধান উপদেষ্টা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে সনদে সই করেছিলেন তাতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ ছিল।
বজলুর রশীদ আরও বলেন, ১৮০ দিন জাতীয় সংসদ দ্বৈত সত্তা নিয়ে চলবে। এটিও সংবিধান পরিপন্থি এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য হয়নি। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে গণভোট সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা খুবই খারাপ। তাই আমরা মনে করি উচ্চকক্ষ, গণভোট ইত্যাদি শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, দেশের অর্থের অপচয়ের একটা পদক্ষেপ মাত্র।
বাংলাদেশ জাসদ
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান এক যুক্ত বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক অবস্থান তুলে ধরেন। তারা বলেন, আমরা যথাসময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনকে স্বাগত জানাই। কিন্তু গোঁজামিলে পূর্ণ গণভোটকে গ্রহণ করতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন আর দেরি না করে জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করবেন, জাতি সেটাই আশা করে।
১২ দলীয় জোট
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), এলডিপি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ন্যাশনাল লেবার পার্টির, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ইউনাইটেড লিবারেল পার্টি, নয়া গণতান্ত্রিক পার্টি ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল (পিএনপি) মিলে গঠিত ১২ দলীয় জোট।
এক বিবৃতিকে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে এই জোটের নেতারা বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছিল তা কেটে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিন গণভোট করার সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যে গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে, সে গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে প্রশ্ন। গণভোটের জন্য চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর দেওয়ার বিষয়টি জটিলতা তৈরি করবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
জুলাই আদেশ অনুযায়ী, গণভোটের জন্য যে প্রশ্নটি তৈরি করা হয়েছে সেটি হলো— ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
এ অংশে রাখা হয়েছে চারটি বিষয় বা প্রস্তাব। এগুলো হলো—
নেটিজেনদের অনেকেই বলছে, এমন চারটি বিষয় বুঝে নিয়ে গণভোটে অংশগ্রহণ করা ভোটারদের জন্য কঠিন। আবার একটিই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকায় চারটি বিষয়ের প্রতিটিতেই একমত বা ভিন্নমত পোষণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ভোটারদের সামনে।
কেউ কেউ বলছেন, এই চারটি প্রস্তাবের মধ্যে আবার জুলাই সনদে উল্লিখিত সর্বসম্মত ৩০ প্রস্তাবের উল্লেখ রয়েছে। ফলে এই চারটি প্রস্তাবকে বুঝতে গেলেও জুলাই সনদের পুরোটা পাঠ করার প্রয়োজন হবে। সামগ্রিকভাবে গণভোটের প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন নেটিজেনরা।
রাজনীতিবিদদের কেউ কেউও গণভোটের প্রশ্নের এই অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, গণভোটে যে চারটি প্রশ্ন নির্ধারণ করা হলো, মানে এই চার প্রশ্নের ওপর ভোট দিতে হবে। দেখা গেল চারটির মধ্যে তিনটি প্রশ্নে কেউ একমত, একটিতে ভিন্নমত। এই ভিন্নমতটা সে কীভাবে রাখবে? তাকে হয় ভিন্নমতের বিষয়েও ‘হ্যাঁ’ দিতে হবে অথবা একমতের বিষয়েও ‘না’ দিতে হবে। এটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ জাসদও। দলটি এক বিবৃতিতে বলেছে, গণভোটের জন্য যেভাবে চারটি প্রশ্নের প্রস্তাব করা হয়েছে তা গণভোটকে হাসি-ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার টেবিলে বসতে না পারায় শেষ পর্যন্ত সরকারই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করে আদেশ জারি করেছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েও সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা তুলে ধরেছেন।
‘জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ শিরোনামের এ আদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি শুরু থেকেই সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের বিষয়ে অনড় অবস্থান ধরে রেখেছে, যার বিপরীত অবস্থান ছিল জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ তারিখ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অবস্থান নেয়নি।
এ গণভোটের প্রশ্নের মধ্যেই আবার উল্লেখ করা হয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু এবং উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোট (পিআর) পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা। এটি জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অন্যতম দাবি। এনসিপিও উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে। বিএনপি আবার উচ্চকক্ষে নিমরাজি হলেও পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোর বিরোধী।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়েই ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠনের কথা বলা হয়েছে আদেশে। এই পরিষদই জুলাই সনদের প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবি ছিল গণপরিষদ গঠন করে তাকে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়া। গণপরিষদ নামে না হলেও সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে এনসিপির সে দাবি পূরণ হয়েছে। বিএনপি আবার গণপরিষদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। গণপরিষদ দাবি না করলেও তাতে মৌন সমর্থন ছিল জামায়াতের।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া তিনটি রাজনৈতিক দলের দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়েই প্রতিটি দলের কোনো না কোনো দাবি মেনে নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে সরকার।
কিন্তু তাতে কি শেষ রক্ষা হলো? প্রধান তিন রাজনৈতিক শক্তি কি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ হাসি মুখে গ্রহণ করতে পারল? জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তাই বা কাটল কতটুকু?
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকালে উপদেষ্টা পরিষদ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ অনুমোদন করে। এর পরপরই প্রধান উপদেষ্টা এর সারসংক্ষেপে সই করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এ আদেশে সই করলে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই আদেশ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন দলগুলোর নেতারা। পরে এনসিপি বাদে বিএনপি-জামায়াতের আনুষ্ঠানিক অবস্থানও প্রকাশ্যে এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পরপরই বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল জুলাই সনদ প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপির নেতৃত্ব দেওয়া সালাহউদ্দিন আহমদকে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নিজে যে জুলাই সনদে সই করেছেন, জুলাই আদেশের মাধ্যমে তিনি নিজেই তা লঙ্ঘন করেছেন।
এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা অবশ্য দেননি সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে তিনিসহ বিএনপির আগের অবস্থান, গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদের ঠিক যে ভাষ্যে সই করেছে সেভাবেই তারা জুলাই সনদের গণভোট ও বাস্তবায়নের পক্ষপাতী। পরে বিএনপির আনুষ্ঠানিক বক্তব্যেও উঠে এসেছে সে কথা।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকে বসে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সে বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি কেবল দলের স্থায়ী কমিটির লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন।
বিবৃতিতে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ও একই দিনে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোটকে স্বাগত জানানো হয়েছে। এর জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদও জানিয়েছে দলটি। তবে ১৭ অক্টোবর ঐক্যমতের ভিত্তিতে সই হওয়া জুলাই জাতীয় সনদের ওপরই জনগণের সম্মতি গ্রহণের জন্য গণভোট আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি।
জুলাই সনদের সেই সই হওয়া ভাষ্যের অর্থ— তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি প্রবর্তনসহ আরও বেশ কিছু ইস্যুতেই বিএনপি এমন ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল। সই হওয়া জুলাই সনদের কোথাও সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকায় এটিরও বিরুদ্ধে বিএনপি।
প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নির্বাচনের দিনকে গণভোটের তারিখ ঘোষণার জন্য ধন্যবাদ জানালেও তাই সই হওয়া জুলাই সনদের ভাষ্যের ওপর গণভোট উল্লেখ করায় সনদ বাস্তবায়নের আদেশের বিরুদ্ধে বিএনপি অবস্থান নিচ্ছে কি না— সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্রিফিংয়েও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতি পাঠের পর সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন না নিয়েই বিদায় নেওয়ায় সে প্রশ্নের কোনো উত্তর এখন পর্যন্ত মিলছে না।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের গণভোট আয়োজনের পূর্ব অবস্থানে তারা এখনো অনড়।
বিকেলেই দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জনগণের দাবি ও অভিপ্রায় উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে নির্বাচন ও গণভোটের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। একই দিন নির্বাচন ও গণভোট হলে সংকট তৈরি হবে।
পরে সন্ধ্যায় সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের সভাপতিত্বে বৈঠক করে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ। সেখানেও উঠে আসে নায়েবে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলের ভাষ্যেরই প্রতিফলন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ পর্যালোচনা করে বলা হয়, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং গণদাবি মানা হয়নি।
সরকার জামায়াতের সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর দাবি মেনে নিলেও গণভোটের তারিখ নিয়ে দলটির বিরোধিতা অব্যাহত থাকবে বলেই জানিয়েছেন মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণায় সংকটমুক্ত স্বচ্ছ নির্বাচনের সংকটটা রয়েই গেল। নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা দাবিতে তাদের আট দলের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
সংবিধান সংশোধনে গণপরিষদ ছাড়াও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধান উপদেষ্টার সইয়ে জারি হওয়ার দাবি ছিল দলটির। সে দাবি পূরণ না হওয়ায় অসন্তুষ্টির ইঙ্গিত মিলেছে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের বক্তব্যে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় কৃষক শক্তির এক আলোচনা সভায় এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখাতে পারেনি। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিজে বাস্তবায়নের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সাংবিধানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ পদক্ষেপ।
একই সুর ছিল দলের মুখ্য সংগঠন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর কণ্ঠেও। তিনি বলেন, জুলাই সনদের আদেশ জারি রাষ্ট্রপতি দিলেও জায়েজ হবে, কিন্তু নৈতিক হবে না। প্রধান উপদেষ্টাকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে।
সন্ধ্যায় ‘জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন জুলাই আদেশের মাধ্যমে সরকারের দায় এড়ানোর প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ আদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের উচিত, জনগণের স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করা। সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।’
পরে অবশ্য দলের জরুরি বৈঠকে বসেছে এনসিপি। নেতারা জানান, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও দলটির সে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সেই ভাষণ ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও। সেখানেও উঠে এসেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কোনো কোনো দল একে স্বাগত জানালেও অন্যরা মনে করছে প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মওলানা মামুনুল হক বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করার ঘোষণা দিয়ে এবং একই প্রশ্নের মধ্যে আলাদা আলাদা চারটি অংশ রেখে গণভোটকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর মাধ্যমে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতিও ঝুঁকিতে পড়েছে।
খেলাফত মজলিস
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির সিদ্ধান্ত ইতিবাচক এবং জনঅভিপ্রায়ের বহির্প্রকাশ। এটি জনগণের কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি। তবে একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচনের সিদ্ধান্তে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন হয়নি।
ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি
ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টির চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একইদিনে গণভোট বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। আমরা মনে করি, একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক ভোটের হিসেবে আসন নির্ধারণ অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য সমাধান। সার্বিক বিচারে এ ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।
বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ
বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে সংকট থেকে উত্তরণে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এটি গত ২৮ অক্টোবর ঐকমত্য কমিশনে দেওয়া পক্ষপাতমূলক প্রস্তাবনার পুনরাবৃত্তি মাত্র। গণভোটের প্রস্তাব ও উচ্চকক্ষের প্রস্তাবনা অপ্রয়োজনীয়। এর মধ্য দিয়ে শুধু আর্থিক ব্যয় বাড়বে না, সরকার পরিচালনায় সংকট তৈরির ঝুঁকিও রয়েছে। আর সংবিধান সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকার সার্বভৌম সংসদের।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, আমাদের সংবিধানে আদেশ জারি বা গণভোটের কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি শুধু অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। তাকে দিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করে সংবিধান পরিপন্থি কাজ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গণভোট ও আদেশ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তাতে দলগুলোর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ নেই। অথচ প্রধান উপদেষ্টা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে সনদে সই করেছিলেন তাতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ উল্লেখ ছিল।
বজলুর রশীদ আরও বলেন, ১৮০ দিন জাতীয় সংসদ দ্বৈত সত্তা নিয়ে চলবে। এটিও সংবিধান পরিপন্থি এবং এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য হয়নি। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে গণভোট সম্পর্কে দেশবাসীর ধারণা খুবই খারাপ। তাই আমরা মনে করি উচ্চকক্ষ, গণভোট ইত্যাদি শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, দেশের অর্থের অপচয়ের একটা পদক্ষেপ মাত্র।
বাংলাদেশ জাসদ
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান এক যুক্ত বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক অবস্থান তুলে ধরেন। তারা বলেন, আমরা যথাসময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজনকে স্বাগত জানাই। কিন্তু গোঁজামিলে পূর্ণ গণভোটকে গ্রহণ করতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন আর দেরি না করে জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করবেন, জাতি সেটাই আশা করে।
১২ দলীয় জোট
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), এলডিপি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ন্যাশনাল লেবার পার্টির, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি, ইউনাইটেড লিবারেল পার্টি, নয়া গণতান্ত্রিক পার্টি ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল (পিএনপি) মিলে গঠিত ১২ দলীয় জোট।
এক বিবৃতিকে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে এই জোটের নেতারা বলেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছিল তা কেটে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি একই দিন গণভোট করার সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যে গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে, সে গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে প্রশ্ন। গণভোটের জন্য চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তর দেওয়ার বিষয়টি জটিলতা তৈরি করবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
জুলাই আদেশ অনুযায়ী, গণভোটের জন্য যে প্রশ্নটি তৈরি করা হয়েছে সেটি হলো— ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?’
এ অংশে রাখা হয়েছে চারটি বিষয় বা প্রস্তাব। এগুলো হলো—
নেটিজেনদের অনেকেই বলছে, এমন চারটি বিষয় বুঝে নিয়ে গণভোটে অংশগ্রহণ করা ভোটারদের জন্য কঠিন। আবার একটিই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকায় চারটি বিষয়ের প্রতিটিতেই একমত বা ভিন্নমত পোষণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ভোটারদের সামনে।
কেউ কেউ বলছেন, এই চারটি প্রস্তাবের মধ্যে আবার জুলাই সনদে উল্লিখিত সর্বসম্মত ৩০ প্রস্তাবের উল্লেখ রয়েছে। ফলে এই চারটি প্রস্তাবকে বুঝতে গেলেও জুলাই সনদের পুরোটা পাঠ করার প্রয়োজন হবে। সামগ্রিকভাবে গণভোটের প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন নেটিজেনরা।
রাজনীতিবিদদের কেউ কেউও গণভোটের প্রশ্নের এই অংশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, গণভোটে যে চারটি প্রশ্ন নির্ধারণ করা হলো, মানে এই চার প্রশ্নের ওপর ভোট দিতে হবে। দেখা গেল চারটির মধ্যে তিনটি প্রশ্নে কেউ একমত, একটিতে ভিন্নমত। এই ভিন্নমতটা সে কীভাবে রাখবে? তাকে হয় ভিন্নমতের বিষয়েও ‘হ্যাঁ’ দিতে হবে অথবা একমতের বিষয়েও ‘না’ দিতে হবে। এটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশ জাসদও। দলটি এক বিবৃতিতে বলেছে, গণভোটের জন্য যেভাবে চারটি প্রশ্নের প্রস্তাব করা হয়েছে তা গণভোটকে হাসি-ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে।

বৈঠকে দলের মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সব সময়ই নির্বাচনমুখী দল। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের সুযোগ নেই। তাই আমাদের সব সময় নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে সেই নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক। কোনো কারণে নির্বাচন যদি অ
১৭ ঘণ্টা আগে
ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ অনেকে সংস্কারের কথা বলেন, পরিবর্তনের কথা বলেন। কিন্তু আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- দেশে রাষ্ট্র মেরামতের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রথম দিয়েছে বিএনপি।’
১৭ ঘণ্টা আগে
গোলাম পরওয়ার বলেন, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের ঘোষণায় সংকটমুক্ত স্বচ্ছ নির্বাচনের সংকটটা রয়েই গেল। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি এবং আদেশের ওপর নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দফা গণদাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চলমান ও ঘোষিত আট দলীয় কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
১৭ ঘণ্টা আগে
শেখ হাসিনার ট্রাইব্যুনালের রায়ের তারিখ ঘোষণাকে আপনারা আসলে কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে আমীর খসরু বলেন, ‘এসবের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। নির্বাচনের সময়সীমার সঙ্গে কিন্তু কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিটি ঘটনা ভিন্নভাবে সরকার সমাধ
১৯ ঘণ্টা আগে