
সজীব রহমান

৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে প্রায় আট মাসের চেষ্টায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চূড়ান্ত সনদেও প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আকারে স্থান পেয়েছিল দলগুলোর ভিন্নমত। সে অবস্থায় সনদ সইয়ের দুই সপ্তাহ পার না হতেই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ, বিশেষ করে সনদে গণরায় নিতে গণভোটের প্রশ্ন ও বাস্তবায়নের জন্য ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠন নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে বিভক্তি।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, জুলাই সনদে কিছুটা ঐক্য এলেও সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে তার প্রতিফলন নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে সরাসরি একে ‘অনৈক্য’ তৈরির প্রয়াস বলেই অভিহিত করা হয়েছে। বিশ্লেষকরাও বলছেন, সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ খুব বাস্তবসম্মত হয়নি।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে উপদেষ্টা পরিষদের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দেয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের সদস্যদের উপস্থিতিতে এসব সুপারিশের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারপ্রধান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করবেন। এরপর জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে যে ৩৬টি সরকারের নির্বাহী আদেশ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিস আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো সরাসরি নির্বাহী বা অফিস আদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করবে সরকার।
জুলাই সনদের বাকি ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এর জন্য দুটি বিকল্প পদ্ধতির সুপারিশ রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের। দুটি পদ্ধতির জন্যই আয়োজন করতে হবে গণভোট।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রথম বিকল্প হিসেবে সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয়ে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি, তারা যেন একটি ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সংবিধান সংস্কার বিষয়ক আদেশ’ জারি করে। এ আদেশের অধীনে সরকার একটি গণভোটের আয়োজন করবে। সেখানে জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখা হবে— ‘আদেশ ও এর তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ৪৮টি সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের সম্মতি আছে কি না।’
গণভোটে সম্মতি পাওয়া গেলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে। সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন। এ সময়ের মধ্যে পরিষদ জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করবে।
এর একটি বিকল্প প্রস্তাবও করেছে ঐকমত্য কমিশন। এ প্রস্তাব অনুযায়ীও আগের প্রশ্নেই আয়োজন করা হবে গণভোট। তবে এবারে জুলাই সনদের সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবকে এই গণভোটের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে বিল আকারে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে।
এবারে গণভোটে জনগণের অনুমোদন মিললে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে দায়িত্ব সম্পন্ন তথা জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলেও গণভোটে অনুমোদিত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলো প্রতিস্থাপন করবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের মাধ্যমে জনরায় নেওয়ার বিষয়ে আগেই ঐকমত্য হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তবে গণভোট আয়োজনের তারিখ নিয়ে সুস্পষ্ট মতপার্থক্য ছিল। ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে সেই বিভক্তি কাটেনি।
কমিশন সুপারিশ করেছে, সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনসহ এর আগের যেকোনো দিন গণভোট আয়োজন করতে পারে। ব্যালটের মাধ্যমে হবে এই গণভোট এবং নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ব্যালটে ভোটাররা গোপনে ভোট দেবেন।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, গণভোটের জন্য প্রশ্ন থাকবে— ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের পর জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়েই সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের সুপারিশ থাকবে, আগামী সংসদে সংসদ সদস্যরা সংসদ হিসেবে এবং পৃথকভাবে সংবিধান পরিষদের সদস্য হিসেবেও শপথ নেবেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার হবেন এই পরিষদের সভাপতি। স্পিকারের অবর্তমানে ডেপুটি স্পিকার সভাপতিত্ব করবেন। তিনিও না থাকলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিজেদের মধ্য থেকে যে সভাপতিমণ্ডলী তৈরি করবে, তার থেকে একজন সভাপতিত্ব করবেন। সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে গঠনের দিন থেকে ২৭০ দিন।
সুপারিশ অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গাঠনিক ক্ষমতা বা কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার প্রয়োগ করতে পারবে। সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে এই পরিষদ জুলাই সনদের সংবিধান সংশোধনবিষয়ক প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে। ২৭০ দিনের মধ্যে তারা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করবে।
ঐকমত্য কমিশনের জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগেই হওয়া উচিত বলে মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিকল্প নেই। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে।’
তবে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া এসেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ রীতিমতো ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে কটাক্ষই করেছেন ‘অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার হিসেবে অভিহিত করে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এমন প্রতিক্রিয়া জানান তিনি।
সালাহউদ্দিন আহমদ দুইবার ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। কেন ধন্যবাদ দিচ্ছি? অবশেষে তারা তাদের প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম সমাপ্ত করতে পেরেছে। তাদের দ্বিতীয়বার তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি— তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে ‘জাতীয় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন।
বিএনপির এই নেতা সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ তুলেছেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সই করেছে, সেই সনদের বাইরের অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ এই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। আবার জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলো প্রতিটি দল নির্বাচনি ইশতেহারে সংযুক্ত করে ভোটে জিতলে বাস্তবায়ন করবে বলে ঐকমত্য হয়েছিল। কিন্তু জুলাই সনদ আদেশের খসড়ায় এসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও উল্লেখ করা হয়নি।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে নতুন একটি আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে, যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনো টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। কোনো আলোচনা না হওয়ার পরও কমিশন এভাবে একটি সিদ্ধান্ত আরোপ করতে পারে না। সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে পারেনি বলে জানান তিনি।
গণভোটের পর সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে ব্যর্থ হলে জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধানের বিভিন্ন ধারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে— এমন সুপারিশের তীব্র সমালোচনা করে সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধান সংশোধনের সুনির্দিষ্ট একটি কর্মপদ্ধতি রয়েছে। এখানে যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি হাস্যকর ব্যাপার। সংবিধান সংশোধন হোক বা অন্য আইন, পরীক্ষায় অটোপাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল আমি জানি না।
জুলাই সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত থেকেও এখনো সনদে সই করেনি সিপিবি। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যেসব প্রস্তাবে সব দল একমত হবে কেবল সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ হওয়ার কথা ছিল। তারপর আবার ভিন্নমতগুলোকে রাখা হলো জুলাই সনদে। এখন দেখি ঐকমত্যের নামে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব বিষয়ে ঐক্যমত্যই হয়নি। ফলে এগুলোকে ঐক্যমত বলে নতুন সংকট তৈরি করা হলো।
গণভোট ও সংবিধান সংস্কার পরিষদকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ আখ্যা দিয়ে সিপিবির এই নেতা বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদের কথা কেন বলা হলো, তা বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে তো ঐক্যমত্য কমিশনে আলোচনা বা কোনো ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদকেও প্রয়োজন মনে করছি না।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে তাদের কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার দেওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ বলেছিলাম। তবে তারা ২৭০ দিনে কার্যকর করতে না পারলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হয়ে যাবে, এমন প্রস্তাব পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই। আবার বেশির ভাগ দল জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোটের পক্ষে থাকলেও কমিশন তার আগেও গণভোট হতে পারে বলে যে প্রস্তাব দিয়েছে, এটি ঠিক করেনি।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না থাকার কারণেই সনদে সই করেনি এনসিপি। এবার কমিশন সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের সুপারিশকে স্বাগত জানালেও পুরো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো নিশ্চিন্ত হতে পারেনি দলটি।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, গণভোটের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এটি নির্বাচনের আগে হলে দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে। এ ছাড়া সুপারিশে সরকার উল্লেখ থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকেই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। তবে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে বেশ কিছু ভাষাগত অস্পষ্টতা রয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনার পর তারপর এতে সইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বিশেষজ্ঞরাও প্রশ্ন তুলেছেন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে। সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সুপারিশে বড় সমস্যা দেখছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘এটা কীভাবে গণভোট, তা আমার বোধগম্য নয়। কারণ জুলাই সনদে এতগুলো ধারা যে সেখানে কীসের ভিত্তিতে মানুষ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলবে? এসব ধারা বাস্তবসম্মত নয়। এগুলো কেউ পড়বে না। না পড়ে, না বুঝে কীভাবে মানুষ জবাব দেবে— এটা আমি বুঝতে পারছি না।’
শাহদীন মালিক আরও বলেন, কোনো জটিল ও দুর্বোধ্য প্রস্তাবের ওপর গণভোট জনগণের প্রতি অবিচার করার শামিল। আমরা দেখেছি, জটিল বিষয়ে মতামত জরিপে প্রকৃত ফলাফল আসে না। আমার মতে, এই গণভোট সঠিক হবে না। কারণ প্রশ্নটি পড়ে বা বুঝে মতামত দেওয়া মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশ আছে বলে মনে হয় না।
লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজের অভিমত, ঐকমত্য কমিশনের এই সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন একটি জটিলতা তৈরি হবে। এর পেছনেও তিনি কমিশনকেই দায়ী করছেন। কারণ কমিশনের সুপারিশগুলো মূল জুলাই সনদ থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে আলতাফ পারভেজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের যে খসড়া আমরা দেখলাম, তার মধ্যেই জটিলতা রয়েছে। ৪৮টি প্রস্তাবের জন্য গণভোট হলেও প্রশ্ন রাখা হয়েছে একটিই, উত্তর দিতে হবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে। কোনো ভোটার ২৪টি বিষয়ে রাজি ও ২৪টি বিষয়ে ভিন্নমত হলে তার সেই মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে সবগুলো প্রস্তাবে সম্মত ধরতে হবে, ‘না’ ভোট দিলে সবগুলোতেই অসম্মত ধরতে হবে। তার অর্থ, জনগণকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
‘নোট অব ডিসেন্ট’ না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলোর উল্লেখ জুলাই সনদের আদেশে নেই। তার মানে কি রাজনৈতিক দলগুলো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়াই জুলাই সনদে রাজি হয়েছে? আমরা কিন্তু জানি, এসব প্রস্তাবে তাদের আপত্তি ছিল বলেই তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল। সেগুলো না থাকা একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করবে।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ ব্যর্থ হলে ২৭০ দিন পর সনদের প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও আপত্তি তোলেন আলতাফ পারভেজ। বলেন, এভাবে সংবিধান পরিবর্তনের বিধান নেই। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য ১৪২ নম্বর যে অনুচ্ছেদ, সেখানেও বলা হয়েছে যে সংবিধানে পাস হয়ে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংশোধন হতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এসব সুপারিশ অনেক জটিলতা তৈরি করবে এবং আগামীকাল থেকেই আমরা নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনায় প্রবেশ করব— এমনটিই মনে করেন লেখক-গবেষক আলতাফ পারভেজ।

৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে প্রায় আট মাসের চেষ্টায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চূড়ান্ত সনদেও প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আকারে স্থান পেয়েছিল দলগুলোর ভিন্নমত। সে অবস্থায় সনদ সইয়ের দুই সপ্তাহ পার না হতেই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ, বিশেষ করে সনদে গণরায় নিতে গণভোটের প্রশ্ন ও বাস্তবায়নের জন্য ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ গঠন নিয়ে নতুন করে দেখা দিয়েছে বিভক্তি।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, জুলাই সনদে কিছুটা ঐক্য এলেও সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে তার প্রতিফলন নেই। বিএনপির পক্ষ থেকে সরাসরি একে ‘অনৈক্য’ তৈরির প্রয়াস বলেই অভিহিত করা হয়েছে। বিশ্লেষকরাও বলছেন, সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ খুব বাস্তবসম্মত হয়নি।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে উপদেষ্টা পরিষদের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দেয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের সদস্যদের উপস্থিতিতে এসব সুপারিশের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারপ্রধান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করবেন। এরপর জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে যে ৩৬টি সরকারের নির্বাহী আদেশ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিস আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো সরাসরি নির্বাহী বা অফিস আদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করবে সরকার।
জুলাই সনদের বাকি ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এর জন্য দুটি বিকল্প পদ্ধতির সুপারিশ রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের। দুটি পদ্ধতির জন্যই আয়োজন করতে হবে গণভোট।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রথম বিকল্প হিসেবে সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয়ে আমরা সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি, তারা যেন একটি ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সংবিধান সংস্কার বিষয়ক আদেশ’ জারি করে। এ আদেশের অধীনে সরকার একটি গণভোটের আয়োজন করবে। সেখানে জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখা হবে— ‘আদেশ ও এর তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ৪৮টি সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের সম্মতি আছে কি না।’
গণভোটে সম্মতি পাওয়া গেলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে। সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন। এ সময়ের মধ্যে পরিষদ জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করবে।
এর একটি বিকল্প প্রস্তাবও করেছে ঐকমত্য কমিশন। এ প্রস্তাব অনুযায়ীও আগের প্রশ্নেই আয়োজন করা হবে গণভোট। তবে এবারে জুলাই সনদের সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবকে এই গণভোটের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে বিল আকারে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে।
এবারে গণভোটে জনগণের অনুমোদন মিললে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে দায়িত্ব সম্পন্ন তথা জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলেও গণভোটে অনুমোদিত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলো প্রতিস্থাপন করবে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের মাধ্যমে জনরায় নেওয়ার বিষয়ে আগেই ঐকমত্য হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। তবে গণভোট আয়োজনের তারিখ নিয়ে সুস্পষ্ট মতপার্থক্য ছিল। ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে সেই বিভক্তি কাটেনি।
কমিশন সুপারিশ করেছে, সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনসহ এর আগের যেকোনো দিন গণভোট আয়োজন করতে পারে। ব্যালটের মাধ্যমে হবে এই গণভোট এবং নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ব্যালটে ভোটাররা গোপনে ভোট দেবেন।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, গণভোটের জন্য প্রশ্ন থাকবে— ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের পর জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের নিয়েই সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের সুপারিশ থাকবে, আগামী সংসদে সংসদ সদস্যরা সংসদ হিসেবে এবং পৃথকভাবে সংবিধান পরিষদের সদস্য হিসেবেও শপথ নেবেন।
জাতীয় সংসদের স্পিকার হবেন এই পরিষদের সভাপতি। স্পিকারের অবর্তমানে ডেপুটি স্পিকার সভাপতিত্ব করবেন। তিনিও না থাকলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ নিজেদের মধ্য থেকে যে সভাপতিমণ্ডলী তৈরি করবে, তার থেকে একজন সভাপতিত্ব করবেন। সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে গঠনের দিন থেকে ২৭০ দিন।
সুপারিশ অনুযায়ী, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গাঠনিক ক্ষমতা বা কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার প্রয়োগ করতে পারবে। সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে এই পরিষদ জুলাই সনদের সংবিধান সংশোধনবিষয়ক প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে। ২৭০ দিনের মধ্যে তারা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করবে।
ঐকমত্য কমিশনের জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগেই হওয়া উচিত বলে মনে করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিকল্প নেই। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে।’
তবে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়া এসেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ রীতিমতো ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে কটাক্ষই করেছেন ‘অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার হিসেবে অভিহিত করে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এমন প্রতিক্রিয়া জানান তিনি।
সালাহউদ্দিন আহমদ দুইবার ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই। কেন ধন্যবাদ দিচ্ছি? অবশেষে তারা তাদের প্রক্রিয়া বা কার্যক্রম সমাপ্ত করতে পেরেছে। তাদের দ্বিতীয়বার তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি— তারা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে ‘জাতীয় অনৈক্য’ প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন।
বিএনপির এই নেতা সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ তুলেছেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সই করেছে, সেই সনদের বাইরের অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ এই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। আবার জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব প্রস্তাবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলো প্রতিটি দল নির্বাচনি ইশতেহারে সংযুক্ত করে ভোটে জিতলে বাস্তবায়ন করবে বলে ঐকমত্য হয়েছিল। কিন্তু জুলাই সনদ আদেশের খসড়ায় এসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও উল্লেখ করা হয়নি।
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে নতুন একটি আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে, যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনো টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। কোনো আলোচনা না হওয়ার পরও কমিশন এভাবে একটি সিদ্ধান্ত আরোপ করতে পারে না। সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে পারেনি বলে জানান তিনি।
গণভোটের পর সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে ব্যর্থ হলে জুলাই সনদ অনুযায়ী সংবিধানের বিভিন্ন ধারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে— এমন সুপারিশের তীব্র সমালোচনা করে সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধান সংশোধনের সুনির্দিষ্ট একটি কর্মপদ্ধতি রয়েছে। এখানে যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি হাস্যকর ব্যাপার। সংবিধান সংশোধন হোক বা অন্য আইন, পরীক্ষায় অটোপাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল আমি জানি না।
জুলাই সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত থেকেও এখনো সনদে সই করেনি সিপিবি। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যেসব প্রস্তাবে সব দল একমত হবে কেবল সেগুলো নিয়েই জুলাই সনদ হওয়ার কথা ছিল। তারপর আবার ভিন্নমতগুলোকে রাখা হলো জুলাই সনদে। এখন দেখি ঐকমত্যের নামে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব বিষয়ে ঐক্যমত্যই হয়নি। ফলে এগুলোকে ঐক্যমত বলে নতুন সংকট তৈরি করা হলো।
গণভোট ও সংবিধান সংস্কার পরিষদকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ আখ্যা দিয়ে সিপিবির এই নেতা বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদের কথা কেন বলা হলো, তা বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে তো ঐক্যমত্য কমিশনে আলোচনা বা কোনো ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদকেও প্রয়োজন মনে করছি না।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে তাদের কনস্টিটিউয়েন্ট পাওয়ার দেওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ বলেছিলাম। তবে তারা ২৭০ দিনে কার্যকর করতে না পারলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হয়ে যাবে, এমন প্রস্তাব পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কি না জানা নেই। আবার বেশির ভাগ দল জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোটের পক্ষে থাকলেও কমিশন তার আগেও গণভোট হতে পারে বলে যে প্রস্তাব দিয়েছে, এটি ঠিক করেনি।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও এর আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না থাকার কারণেই সনদে সই করেনি এনসিপি। এবার কমিশন সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের সুপারিশকে স্বাগত জানালেও পুরো বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো নিশ্চিন্ত হতে পারেনি দলটি।
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম রাজশাহীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, গণভোটের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। এটি নির্বাচনের আগে হলে দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকবে। এ ছাড়া সুপারিশে সরকার উল্লেখ থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকেই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। তবে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে বেশ কিছু ভাষাগত অস্পষ্টতা রয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনার পর তারপর এতে সইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বিশেষজ্ঞরাও প্রশ্ন তুলেছেন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে। সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সুপারিশে বড় সমস্যা দেখছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘এটা কীভাবে গণভোট, তা আমার বোধগম্য নয়। কারণ জুলাই সনদে এতগুলো ধারা যে সেখানে কীসের ভিত্তিতে মানুষ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলবে? এসব ধারা বাস্তবসম্মত নয়। এগুলো কেউ পড়বে না। না পড়ে, না বুঝে কীভাবে মানুষ জবাব দেবে— এটা আমি বুঝতে পারছি না।’
শাহদীন মালিক আরও বলেন, কোনো জটিল ও দুর্বোধ্য প্রস্তাবের ওপর গণভোট জনগণের প্রতি অবিচার করার শামিল। আমরা দেখেছি, জটিল বিষয়ে মতামত জরিপে প্রকৃত ফলাফল আসে না। আমার মতে, এই গণভোট সঠিক হবে না। কারণ প্রশ্নটি পড়ে বা বুঝে মতামত দেওয়া মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশ আছে বলে মনে হয় না।
লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজের অভিমত, ঐকমত্য কমিশনের এই সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন একটি জটিলতা তৈরি হবে। এর পেছনেও তিনি কমিশনকেই দায়ী করছেন। কারণ কমিশনের সুপারিশগুলো মূল জুলাই সনদ থেকে কিছুটা হলেও বিচ্যুত হয়েছে।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে আলতাফ পারভেজ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের যে খসড়া আমরা দেখলাম, তার মধ্যেই জটিলতা রয়েছে। ৪৮টি প্রস্তাবের জন্য গণভোট হলেও প্রশ্ন রাখা হয়েছে একটিই, উত্তর দিতে হবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোটে। কোনো ভোটার ২৪টি বিষয়ে রাজি ও ২৪টি বিষয়ে ভিন্নমত হলে তার সেই মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে সবগুলো প্রস্তাবে সম্মত ধরতে হবে, ‘না’ ভোট দিলে সবগুলোতেই অসম্মত ধরতে হবে। তার অর্থ, জনগণকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
‘নোট অব ডিসেন্ট’ না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেসব ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে, সেগুলোর উল্লেখ জুলাই সনদের আদেশে নেই। তার মানে কি রাজনৈতিক দলগুলো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ ছাড়াই জুলাই সনদে রাজি হয়েছে? আমরা কিন্তু জানি, এসব প্রস্তাবে তাদের আপত্তি ছিল বলেই তারা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল। সেগুলো না থাকা একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করবে।
সংবিধান সংস্কার পরিষদ ব্যর্থ হলে ২৭০ দিন পর সনদের প্রস্তাব অনুযায়ী সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধন হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও আপত্তি তোলেন আলতাফ পারভেজ। বলেন, এভাবে সংবিধান পরিবর্তনের বিধান নেই। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য ১৪২ নম্বর যে অনুচ্ছেদ, সেখানেও বলা হয়েছে যে সংবিধানে পাস হয়ে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংশোধন হতে হবে।
ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এসব সুপারিশ অনেক জটিলতা তৈরি করবে এবং আগামীকাল থেকেই আমরা নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনায় প্রবেশ করব— এমনটিই মনে করেন লেখক-গবেষক আলতাফ পারভেজ।

‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেসব সুপারিশ দিয়েছে তা নতুন সংকট করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজনের ধারণাকেও অপ্রয়োজনীয় বলে অভিহিত করেছেন তিনি।
১৫ ঘণ্টা আগে
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তার উপদেষ্টাদের নিয়ে শহীদ মিনারে গিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তার দাবি, ঘোষণা অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহতদেরও রাখতে হবে। ওই দিন এনসিপি সনদে সই করবে বলেও জান
১৬ ঘণ্টা আগে
তিনি বলেন, আমরা যদি আবার বিভিন্ন বর্গে, সূত্রে ভাগ হয়ে যাই, তখন আমাদের জন্য কঠিন হবে। এছাড়া আওয়ামী লীগ বিভিন্ন নামে ফিরে আসতে পারে। এটা তাদের ধর্ম। কারণ তাদের একটা কেবলা আছে। একটা ধর্মে যা যা থাকে তার সব আসে। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
১৭ ঘণ্টা আগে
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার তাণ্ডবে সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের উদ্যোগে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) বিকেলে বিক্ষোভ মিছিল-পূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
১৮ ঘণ্টা আগে