স্বাস্থ্য

পুদিনা পাতা কেন খাবেন

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৫, ১৩: ৫৩
পুদিনা পাতা হজমে সহায়ক। ছবি: এআই ব্যবহার করে তৈরি

পুদিনা পাতা—একটা ছোট্ট নাম, কিন্তু এর গুণাগুণের জগৎ অনেক বড়। আমরা অনেকেই পুদিনা পাতা শুধু শসার রায়তা, চাটনি বা শরবতে ব্যবহার করি একটু সুগন্ধ বা স্বাদ বাড়ানোর জন্য। কিন্তু জানলে অবাক হবেন, এই ছোট্ট পাতাটিই শরীরের ভেতরের নানা জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই পাতা শুধু রান্নার উপকরণ নয়, বরং নানা রোগের প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আধুনিক বিজ্ঞানও আজ পুদিনার সেই প্রাচীন কীর্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পুদিনা পাতার বৈজ্ঞানিক নাম Mentha এবং এটি মূলত ল্যামিয়াসি (Lamiaceae) পরিবারভুক্ত একটি উদ্ভিদ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এর কোনো না কোনো জাত পাওয়া যায়। তবে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ, ঠাণ্ডা স্বাদ, এবং শীতল অনুভূতির জন্য এটি খাবারে অতুলনীয়। কিন্তু পুদিনার স্বাস্থ্যগুণ সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁরা এটিকে শুধুই একটি রান্নার উপাদান বলে থামেন না।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. লিন্ডা ম্যাথার বলেন, “পুদিনা পাতা হচ্ছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের এক চমৎকার উৎস। এটা শুধু হজমেই সাহায্য করে না, বরং দেহের কোষকে সজীব রাখে ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।” (বাংলা অনুবাদ)

পুদিনা পাতা হজমে সহায়ক। প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় পুদিনা পাতাকে পেট ঠাণ্ডা রাখা, গ্যাস-অম্বল কমানো এবং হজমশক্তি বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে পুদিনার মধ্যে থাকা menthol নামের একটি প্রাকৃতিক যৌগে। এই মেনথল পাচনতন্ত্রের পেশিকে শান্ত করে এবং অন্ত্রের অস্বস্তি কমায়। ব্রিটেনের King's College London এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পুদিনা পাতা বা পুদিনার তেল ব্যবহার করেন, তাঁদের মধ্যে ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS) রোগে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

শুধু হজমের ক্ষেত্রেই নয়, মুখের স্বাস্থ্য রক্ষাতেও পুদিনার অবদান অসাধারণ। এই পাতা প্রাকৃতিকভাবে ব্যাকটেরিয়া নাশক। ফলে এটি মুখের দুর্গন্ধ দূর করে, দাঁতের গোড়া শক্ত করে এবং মুখগহ্বরের সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে। অনেক টুথপেস্ট এবং মাউথওয়াশে পুদিনার নির্যাস ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি মুখে দীর্ঘক্ষণ সতেজ অনুভূতি বজায় রাখতে পারে।

পুদিনার আরেকটি চমৎকার গুণ হলো এটি মাথাব্যথা কমাতে সাহায্য করে। ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের নিউরোসায়েন্স গবেষক ড. জেসন উইলসন বলেন, “পুদিনা পাতার নির্যাস থেকে তৈরি তেল সরাসরি কপালে মাখলে মেনথল মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, পেশি শিথিল করে এবং মাথাব্যথা কমায়। অনেক ক্ষেত্রে এটি মাইল্ড মাইগ্রেনেও কার্যকর।” (বাংলা অনুবাদ)

পুদিনার এই শীতল গুণ শুধু মাথাব্যথাই না, ত্বকের যত্নেও কার্যকর। গরমে ঘামাচি, ফুসকুড়ি বা চুলকানিতে এটি আরাম দেয়। অনেক আয়ুর্বেদিক স্কিন ক্রিম ও অ্যান্টিসেপটিক লোশনে পুদিনার নির্যাস ব্যবহৃত হয়। মেনথল ত্বকে প্রাকৃতিক ঠাণ্ডাভাব এনে চুলকানি ও জ্বালাভাব দূর করতে পারে। সেই সঙ্গে এটি চামড়ার ব্যাকটেরিয়া দূর করতেও সক্ষম।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পুদিনা পাতার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, পুদিনা পাতা ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, এবং বিটা ক্যারোটিনে ভরপুর। এই উপাদানগুলো শরীরের কোষকে অক্সিডেটিভ চাপ থেকে রক্ষা করে এবং বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে। এছাড়া এতে রয়েছে পলিফেনল নামের একটি অণু, যা শরীরের ফ্রি র‍্যাডিক্যাল নিঃসরণ কমিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH)-এর নিউট্রিশন বিভাগের গবেষক ড. সারাহ ও’কনেল বলেন, “পুদিনার মধ্যে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড এবং অ্যাসিডিক উপাদানগুলো কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় বলেই বহু দেশ এটি স্বাস্থ্যকর ডায়েটের অংশ করে নিয়েছে।” (বাংলা অনুবাদ)

এছাড়া ঠান্ডা-কাশিতে পুদিনা পাতা অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। বিশেষত গলার ব্যথা বা শ্বাসকষ্টে পুদিনা চা, ইনহেলেশন বা বাষ্প গ্রহণ অত্যন্ত উপকারী। মেনথল শ্বাসনালীকে প্রসারিত করে, কফ পাতলা করে এবং গলার ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। শিশুর ঠান্ডায় গায়ে পুদিনা তেল মালিশ করাও অনেক পরিবারে একটি পরিচিত উপায়।

কিন্তু শুধু রোগ প্রতিরোধ বা আরোগ্যের ক্ষেত্রেই নয়, পুদিনা পাতার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও আছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পুদিনার গন্ধ মানুষের মেজাজ ভালো রাখতে, দুশ্চিন্তা কমাতে এবং মনঃসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এর সুগন্ধ মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ বাড়ায়, যা স্বস্তি এবং প্রশান্তি এনে দেয়। তাই অফিস, পড়ার ঘর বা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে অনেকেই পুদিনার এসেনশিয়াল অয়েল বা গাছ রেখে দেন।

পুদিনা পাতার ব্যবহার যেমন খাদ্যতালিকায়, তেমনি চিকিৎসা ও ঘরোয়া পরিচর্যায় এর ব্যবহার বহু রকম। পুদিনা চা গরমকালে যেমন ঠান্ডা দেয়, তেমনি শীতকালে ঠান্ডা-কাশির প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। কেউ কেউ সকালে এক চা চামচ পুদিনা পাতার রস খেয়ে থাকেন হজমের জন্য। কেউ কেউ আবার পুদিনা পাতা বেটে ত্বকে মাখেন ব্রণ বা র‌্যাশ কমানোর জন্য। এটি গরমে শরীর ঠান্ডা রাখতে ও পানিশূন্যতা প্রতিরোধে চমৎকার কাজ করে।

তবে অতিরিক্ত পুদিনা খেলে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে। যেমন, গ্যাস্ট্রিকের রোগীদের ক্ষেত্রে মেনথল কখনও কখনও পাকস্থলীতে অ্যাসিডের নিঃসরণ বাড়াতে পারে। আবার কারও কারও ত্বকে পুদিনা তেল ব্যবহারে অ্যালার্জিও হতে পারে। তাই যাঁদের অতিসंবেদনশীল ত্বক আছে বা অ্যাসিডিটির সমস্যা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ব্যবহার করাই ভালো।

ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হেলসিঙ্কির ফার্মাকোলজি বিভাগের গবেষক ড. হেনরীক মাকেলি বলেন, “পুদিনা হল একধরনের ভার্সেটাইল হার্ব। কিন্তু যেকোনো ওষুধ বা হার্বের মতো, এটি ব্যবহারেও পরিমিতি ও সচেতনতা জরুরি।” (বাংলা অনুবাদ)

সার্বিকভাবে পুদিনা পাতা হচ্ছে প্রকৃতির এক আশ্চর্য উপহার। ছোট এক টুকরো পাতা, কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে বহু উপকারিতা। শরীর, মন এবং রুচি—তিনটি জায়গাতেই এর প্রভাব সুস্পষ্ট। তাই রান্নায় কিংবা পানীয়তে, চিকিৎসায় কিংবা প্রসাধনীতে—পুদিনার ব্যবহার যত বাড়বে, ততই আপনি উপকৃত হবেন। শুধু মনে রাখবেন, কোনো ওষুধ বা ভেষজই এককভাবে অলৌকিক নয়; কিন্তু সঠিকভাবে ও নিয়মিত ব্যবহারে এই ছোট্ট পাতা হতে পারে আপনার জীবনের এক বড় রক্ষাকবচ।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি কেন, কীভাবে বাঁচবেন?

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত 'এডিস ইজিপ্টাই' নামের মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই মশাটি খুবই বিশেষভাবে অভিযোজিত—এটি দিনের বেলা কামড়ায়, সাধারণত সকাল ও বিকেলের দিকে।

১ দিন আগে

ভিন্ন ধরনের উপস্থাপনায় তোরসা

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাধ্যমে উপস্থাপনা করলেও প্রথমবারের মতো নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ বিজয়ী মডেল-অভিনেত্রী রাফাহ নানজিবা তোরসা। নারীর সাহস, সত্য আর স্বর তুলে ধরার এক নতুন যাত্রায় দেখা যাবে তাকে। তোরসার উপস্থাপনায় ব্যতিক্রমী ঘরানার পডকাস্ট ‘শি’ আসছে অচিরেই।

১ দিন আগে

গল্প শোনালেন, কাঁদলেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী আনোয়ারা

বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মমতাময়ী মা’ খ্যাত কিংবদন্তি অভিনেত্রী আনোয়ারা বেগম সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’-এ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সম্মাননা স্মারক গ্রহণের পর কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। নিজের দীর্ঘ অভিনয়জীবনের নানা স্মৃ

১ দিন আগে

ডিভোর্স কামনা করায় ঠান্ডা মাথায় মেহজাবীনের উত্তর

নিজের ফেসবুক পেজে কানাডার মনট্রিয়েল শহরে তোলা কিছু ছবি শেয়ার করেন মেহজাবীন। ছবিগুলোতে বেশ হাসিখুশি, প্রাণবন্ত দেখা গেছে তাকে। পর্দার ‘মালতী’ চরিত্রে দর্শকদের মন জয় করা এই অভিনেত্রীর ছবিতে মন্তব্য জানাতে থাকেন তার ভক্ত-অনুরাগীরা। এর মাঝেই একজন নেটিজেন চরম রকমের কটাক্ষ করে বসেন। মন্তব্যে লেখেন, ‘২ বছ

২ দিন আগে