ডিজিটাল সেবা

নাগরিক সেবা রূপান্তরের গল্প

শানজীদা শারমিন

প্রশাসন শব্দটির উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে কতগুলো দৃশ্য—লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, পুরনো কাঠের আলমারিতে ধুলো ধরা নথিপত্র, হাতে লেখা আবেদনের স্তূপ আর দীর্ঘসূত্রতার ক্লান্তি। এমন চিত্র বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার অংশ ছিল। কিন্তু গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রশাসনিক পরিসরে একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা দিয়েছে—প্রযুক্তিনির্ভরতা। এই রূপান্তর শুধু সেবাদান ব্যবস্থাকে সহজতর করেছে তা নয়, বরং গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের চিন্তা, কাঠামো ও নাগরিক সম্পর্কের রূপান্তর ঘটিয়েছে।

এই দশককে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশাসনিক সংস্কারের দশক বলা চলে। যেখান থেকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা সূচিত হচ্ছে প্রযুক্তির হাত ধরেই। বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ইতিহাসে এই পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। কেননা, বিগত সময়ে যে সমস্ত কাঠামো নাগরিকের কাছে নাগালের বাইরে ছিল, তা এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়ে উঠেছে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক।

এই রূপান্তরকে বুঝতে হলে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কাঠামোর দিকে একবার চোখ ফেরাতে হবে। ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের প্রশাসন ছিল কেন্দ্রনির্ভর, আমলাতান্ত্রিক এবং কাগজনির্ভর। তথ্য ও সেবার প্রবাহ ছিল একমুখী—সরকার থেকে জনগণের দিকে। নাগরিক এখানে ছিল সেবাপ্রার্থী, কর্তৃত্বপূর্ণ কাঠামোর নিচে অবস্থানকারী। কিন্তু প্রযুক্তি এই সম্পর্ককে দ্বিমুখী করেছে। এখন নাগরিক কেবল সেবা গ্রহণকারী নয়, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী—তথ্যদাতা, প্রতিক্রিয়াকারী এবং কখনো কখনো সহ-উদ্ভাবকও বটে।

উদাহরণস্বরূপ, আজ একটি অভিযোগ জানাতে নাগরিককে আর সরকারি কার্যালয়ে ছুটে যেতে হয় না। নাগরিকেরা এখন অনলাইনেই অভিযোগ জানাতে এবং অভিযোগের বিষয়ে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। সন্তুষ্ট না হলে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও সহজতর হয়েছে। এটি কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং এটি নাগরিক-মুখী প্রশাসনের প্রতিচ্ছবি।

একইভাবে সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। 'ই-জিপি' বা ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতির মাধ্যমে এখন সরকারি দরপত্র আহ্বান, মূল্যায়ন ও চূড়ান্তকরণ সবই এখন ডিজিটাল। এর ফলে সময় ও খরচ সাশ্রয় ও দুর্নীতি—তিনটি বড় সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে। এটি অর্থনৈতিক সুশাসনের ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

প্রশাসনের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর হাতিয়ার হলো ‘ই-ফাইলিং’ বা ডি-নথি ব্যবস্থা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এই পদ্ধতি চালু হওয়ায় প্রশাসনিক কাজের গতি বেড়েছে বহুগুণ। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ফাইল অনুমোদন ও সেবা দেওয়ার প্রক্রিয়া এখন সময়োপযোগী এবং দৃষ্টিগোচর। এই স্বচ্ছতা প্রশাসনের প্রতি নাগরিক আস্থা বাড়াতে সহায়তা করছে।

এছাড়া একটি সময় ছিল যখন তথ্য পাওয়ার অধিকার থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হতে পারতেন না। কিন্তু জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার (Open Data Portal) চালুর ফলে এখন বিভিন্ন দপ্তরের পরিকল্পনা, বাজেট, কার্যক্রম এমনকি সেবার মানদণ্ড সম্পর্কেও জানতে পারছেন যেকোনও ব্যক্তি। প্রযুক্তি এখানে গণতান্ত্রিক চর্চাকে আরও শক্তিশালী করেছে।

তবে এই রূপান্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো—মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি। বিগত এক দশকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ বিভিন্ন নিয়োগ প্রক্রিয়া ডিজিটাল হয়েছে। আবেদন, পরীক্ষা, ফলাফল—সবই হচ্ছে অনলাইনে। এতে প্রশাসনের মধ্যে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিরা স্থান পাচ্ছেন, এবং প্রক্রিয়ার উপর জনআস্থা বাড়ছে।

এই দশকে জন্ম নিয়েছে ‘গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিট’, যেটি নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে একধরনের সেতুবন্ধন তৈরি করছে। তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘এটুআই’ কর্মসূচি শুধু সেবা ডিজিটালাইজেশন নয়, বরং সম্পূর্ণ প্রশাসনিক সংস্কারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি যেমন ব্লকচেইন, বিগ ডাটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এখন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা রাখছে।

প্রশাসনের আরেকটি বড় দিক হলো প্রশিক্ষণ। আগে যেখানে কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ সীমিত ছিল, এখন ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ বা অনলাইন-অফলাইন মিশ্রিত পাঠক্রমের মাধ্যমে কর্মকর্তারা নিজ নিজ কাজে দক্ষ হয়ে উঠছেন। দেশের নানা প্রান্তে প্রশাসনিক বিদ্যালয়গুলোতেও ই-লার্নিং চালু হয়েছে, যা স্থানের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই জ্ঞান সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখছে।

অবশ্য এই রূপান্তরের পথচলা কেবল প্রশংসার দাবিদার নয়, এর কিছু সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রযুক্তিগত পরিকাঠামোর অভাব, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতি, এবং ডিজিটাল বিভাজনের কারণে নাগরিকের সমান অংশগ্রহণ এখনো নিশ্চিত হয়নি। তাছাড়া, ডেটা নিরাপত্তা ও সাইবার ঝুঁকির মতো বিষয়গুলোও প্রশাসনিক ব্যবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, প্রশাসনিক সংস্কারের এই দশক আমাদের ভবিষ্যতের রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি গড়ে দিচ্ছে। যে রাষ্ট্র নাগরিকের কাছে জবাবদিহিতামূলক, স্বচ্ছ এবং প্রযুক্তিনির্ভর—সেই রাষ্ট্রই আগামী শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হবে। এক সময় রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম কেবলই কেন্দ্রীয় অফিস ও দপ্তরে সীমাবদ্ধ থাকত, এখন সেই রাষ্ট্র চলছে নাগরিকের হাতে থাকা স্মার্টফোনে, ক্লিকের দূরত্বে।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

রাতে ঘুমানোর আগে এলাচ খেলে মিলবে যে উপকার

এলাচ যে কেবল খাবারে সুগন্ধ যোগ করে সেটা নয়। নিয়মিত এলাচ খাওয়ার রয়েছে অনেক উপকার। কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ডায়েটারি ফাইবার, নিয়াসিন, পাইরিডক্সিন, রিবোফ্লোভিন, থিয়ামাইন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, কপার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ও জিঙ্কের চমৎকার উৎস এই মসলা। প

৯ দিন আগে

ডাক্তার না হয়ে যেভাবে গীতিকার হয়ে ওঠেন 'গাজী মাজহারুল'

পাঁচবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে তিনটি গানের রচয়িতা গুণী এই গীতিকবি। গানগুলো হচ্ছে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’ ও ‘একবার যেতে দে না’।

৯ দিন আগে

'এআই চ্যাটবট' ছদ্মবেশে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে অনুপযুক্ত আলাপ করছে

টিমোথি শালামে, চ্যাপেল রোন ও প্যাট্রিক মাহোমসের নামে তৈরি এআইভিত্তিক চ্যাটবট শিশু-কিশোরদের সঙ্গে যৌন, মাদক ও আত্মহত্যাসংক্রান্ত অনুপযুক্ত আলাপ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই চ্যাটবটগুলো টেক্সটের মাধ্যমে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি কণ্ঠ ব্যবহার করে, যেগুলো তারকাদের মতো শোনানোর জন্য প্রশিক্ষিত ছিল

১০ দিন আগে

উত্তম কুমার— বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়নকের জন্মদিন

চলচ্চিত্র ছেড়ে দেবো করতে করতেই পাহাড়ি সান্যালের হাত ধরে অভিনয় করেন ‘বসু পরিবার’ ছবিতে। ১৯৫২ সালের সে ছবিটি বেশ নজর কাড়ে অনেকের। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পায় ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। সুচিত্রা সেনের বিপরীতে উত্তমের এই ছবিটি বক্স অফিসে ব্লকবাস্টার! উত্তম কুমারের চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠারও সূচনা তার সঙ্গে।

১১ দিন আগে