স্বাস্থ্য

লিভার সিরোসিসের লক্ষণগুলো কী কী

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৫২

লিভার সিরোসিস এক ভয়াবহ ও নীরব রোগ, যা শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভারকে ধীরে ধীরে অকেজো করে দেয়। এই রোগের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে এর লক্ষণগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে অনেকেই বুঝতে পারেন না যে তাঁর লিভারে এত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। যখন লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়, তখন অনেক সময়ই চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। তাই লিভার সিরোসিস সম্পর্কে জানার পাশাপাশি এর লক্ষণ চেনা অত্যন্ত জরুরি।

লিভার আমাদের শরীরের এক শক্তিশালী অঙ্গ, যা রক্ত পরিষ্কার করা, পুষ্টি সংরক্ষণ, হজমে সহায়তা, এবং টক্সিন দূর করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। যখন কোনো কারণে লিভারে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতি হতে থাকে—যেমন অতিরিক্ত মদ্যপান, হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাস সংক্রমণ, চর্বিযুক্ত লিভারের জটিলতা বা কিছু ওষুধের অপব্যবহার—তখন লিভার আস্তে আস্তে শক্ত ফাইব্রাস টিস্যুতে পরিণত হয়, যাকে বলে সিরোসিস। এই ফাইব্রাস টিস্যু লিভারের স্বাভাবিক কোষের জায়গা দখল করে নেয় এবং অঙ্গটির কার্যকারিতা ব্যাহত করে।

প্রাথমিক পর্যায়ে সিরোসিসের লক্ষণ খুব সাধারণ হতে পারে। অনেক সময় রোগীরা শুধু ক্লান্তি, অরুচি বা সামান্য ওজন কমার মতো উপসর্গ অনুভব করেন। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকের হেপাটোলজিস্ট ড. ক্রিস্টিনা লিন বলেন, “সিরোসিসের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, এটি নিঃশব্দে এগোয়। বেশির ভাগ মানুষ যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, তখন লিভার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে।” তাঁর মতে, তাই উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের নিয়মিত লিভার ফাংশন টেস্ট করানো উচিত।

যখন সিরোসিস কিছুটা অগ্রসর পর্যায়ে যায়, তখন লক্ষণগুলো একটু বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—শরীর দুর্বল লাগা, সহজে ক্লান্ত হয়ে পড়া, হাত-পায়ে পানি জমে যাওয়া (edema), পেটের ভেতর পানি জমা (ascites), চুলকানি, চোখ ও চামড়ায় হলুদাভ রঙ (জন্ডিস), পেট ফুলে যাওয়া এবং সহজে রক্তপাত বা রক্ত জমাট না বাঁধা। অনেক সময় পুরুষদের ক্ষেত্রে স্তনবৃদ্ধি (gynecomastia) ও টেস্টিকুলার সংকোচন দেখা দিতে পারে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো ‘হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি’, যা হচ্ছে লিভারের অকার্যকারিতার কারণে মস্তিষ্কে বিষাক্ত পদার্থ জমে গিয়ে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হওয়া। এতে মনোযোগ কমে যাওয়া, ভুলভাল বলা, ঘুমে সমস্যা, এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ড. মাইকেল র‌্যামসে, যিনি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকোতে লিভার রোগ নিয়ে গবেষণা করেন, বলেন, “সিরোসিস যখন হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন তা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং তৎক্ষণাৎ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শরীরে রক্ত জমাট বাধার ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে সিরোসিস রোগীদের মধ্যে চামড়ায় হালকা চাপেই দাগ পড়ে যায়, এমনকি নাক ও মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে পারে। এর বাইরে চামড়ায় ‘স্পাইডার অ্যাঞ্জিওমা’ নামে লালচে ছোপ ছোপ দাগ দেখা দিতে পারে, যা দেখতে মাকড়সার জালের মতো। নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্র অনিয়মিত হয়ে যায় এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে যৌন শক্তি কমে যেতে পারে।

একসময় রোগীর শরীরে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি ও প্লাটিলেট কমে যায়, যার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসে। আবার যেহেতু লিভার ভিটামিন ও খনিজ শোষণ করে, সেহেতু অপুষ্টির লক্ষণও দেখা দিতে পারে—যেমন দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হওয়া, হাড় ক্ষয় হওয়া এবং অস্থিসন্ধিতে ব্যথা।

এমনকি সিরোসিস দীর্ঘমেয়াদি হলে এটি লিভার ক্যানসারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও বাড়ায়। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও আলফা-ফেটোপ্রোটিন (AFP) টেস্ট করার পরামর্শ দেয়, যাতে লিভার ক্যানসার আগেভাগেই শনাক্ত করা যায়।

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই যেখানে বেশি কার্যকর, সেখানে এই রোগের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের উচিত জীবনধারায় পরিবর্তন আনা। অতিরিক্ত মদ্যপান, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ, অপরিষ্কার সুচ বা রক্তের মাধ্যমে সংক্রমণ, অনিরাপদ যৌনাচার—এসব থেকে দূরে থাকলে হেপাটাইটিস ও সিরোসিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। বিশ্বখ্যাত লিভার বিশেষজ্ঞ ড. জেমস কাসপার বলেন, “যতক্ষণ না পর্যন্ত সিরোসিস সম্পূর্ণভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনধারার পরিবর্তন এবং ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে লিভারের কার্যক্ষমতা রক্ষা করা সম্ভব।”

যদিও একবার সিরোসিস হয়ে গেলে পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব নয়, তবে আগেভাগে লক্ষণ শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে রোগের অগ্রগতি ধীর করা যায়। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে এখনো অনেক মানুষ সিরোসিস সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে তারা অসুস্থ বোধ করলেও গুরুত্ব দেন না এবং যখন বুঝতে পারেন, তখন খুব দেরি হয়ে যায়। তাই জনসচেতনতা বাড়ানো, বিনামূল্যে হেপাটাইটিস বি টিকা প্রদান, মদ্যপানের কুফল নিয়ে প্রচারণা এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই হতে পারে লিভার সিরোসিস রোধে মূল উপায়।

সবশেষে বলা যায়, লিভার সিরোসিস কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া রোগ নয়। এটি বছরের পর বছর ধরে শরীরে গড়ে ওঠে নীরবে। কিন্তু আমরা যদি এর লক্ষণগুলো চিনে রাখতে পারি, জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনতে পারি, এবং সময়মতো চিকিৎসকের পরামর্শ নেই, তবে এই রোগ থেকে জীবন রক্ষা করা সম্ভব। কারণ, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান, এবং একটি সুস্থ লিভার মানেই একটি শক্তিশালী শরীর ও উন্নত জীবনমান।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

কালোজিরার তেলের স্বাস্থ্যগত উপকারিতা

কালোজিরার তেল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

১৮ ঘণ্টা আগে

যেভাবে শুরু হয়েছিল ঢাকার তাজিয়া মিছিল

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঢাকার তাজিয়া মিছিলের সূচনা ঘটে মুঘল আমলে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে। সেই সময় ঢাকায় শাসন করতেন সুবাদারদের প্রতিনিধি হিসেবে আগত মুঘল আমলারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এমন অনেকেই, যারা শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন।

১৮ ঘণ্টা আগে

কোন ভিটামিনের অভাবে স্কার্ভি হয়?

স্কার্ভি আসলে চর্ম রোগ নয়—এটি একটি পুষ্টিগত রোগ, তবে এর লক্ষণ বেশির ভাগ সময় ত্বক

২ দিন আগে

কিম জং উন কীভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নির্বাচনের পেছনে কিম জং ইলের ব্যক্তিগত পছন্দ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিম জং উনের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তা।

২ দিন আগে