বর্ষাকালে কাঁচামরিচের দাম এত বাড়ে কেন

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১৬: ০৬

আজ ঢাকার বাজারে কাঁচামরিচের দাম ৩০০ ছাড়িয়েছে। টানা বর্ষাই দাম বৃদ্ধির মূল কারণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বর্ষা কালে কাঁচামরিচের দাম এত বাড়ে কেন?

বাংলাদেশে বাজারে হাঁটলেই দেখা যায়, সবজির দাম ওঠানামা করে প্রকৃতির ছন্দে। শীতকালে যখন মাঠভরা শাকসবজি, তখন দাম একটু কমে আসে। আর বর্ষা নামলেই যেন বাজারে আগুন লাগে। বিশেষ করে কাঁচামরিচ— যেটি বাঙালির রান্নাঘরের অবিচ্ছেদ্য অংশ—বর্ষাকালে তার দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয়। পত্রিকার শিরোনামে প্রায়শই দেখা যায়, “কাঁচামরিচের কেজি তিনশ টাকা”, “চোখের জলে মরিচ কিনছেন ক্রেতা”, “মরিচ কিনতে মরিচ খাচ্ছেন মানুষ!” সাধারণ মানুষ হাস্যরসের মাঝে রীতিমতো কষ্টে পড়ে যান এই মরিচের দাম নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন প্রতিবছরই বর্ষাকালে কাঁচামরিচের দাম এত বেড়ে যায়? এর পেছনে কি শুধুই প্রাকৃতিক কারণ, না কি এর সঙ্গে জড়িত আছে কৃষি উৎপাদনের গঠনগত কিছু অসুবিধা, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা কিংবা কিছু মানুষের কৃত্রিম সংকট তৈরির অপচেষ্টা?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের প্রথমে দেখতে হবে, কাঁচামরিচের উৎপাদন ও সরবরাহের চক্রটি কীভাবে চলে। বাংলাদেশে কাঁচামরিচ একটি মৌসুমি ফসল হলেও, সারা বছরই এর চাহিদা থাকে। মরিচ মূলত চাষ হয় রবি মৌসুমে, অর্থাৎ শীতের শেষে বসন্ত থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের আগ পর্যন্ত। এই সময়ে আবহাওয়া তুলনামূলক শুষ্ক ও উষ্ণ থাকে, যা মরিচ গাছের জন্য আদর্শ পরিবেশ। তবে বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও রোদ-বৃষ্টির অনিয়মিত পালাবদলের ফলে মরিচের গাছ সহজেই রোগে আক্রান্ত হয়, গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, এমনকি ক্ষেত প্লাবিত হলে গাছ মারা যায়। ফলে এই সময় নতুন মরিচ উৎপাদন কমে আসে।

বর্ষাকাল মূলত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সময়টাতে দেশের অধিকাংশ এলাকায় প্রবল বর্ষণের ফলে অনেক মাঠ-ঘাট ডুবে যায়। কৃষকদের তখন চাষাবাদের উপযুক্ত পরিবেশ থাকে না। ফলে যেসব কৃষক গ্রীষ্মকালের শেষদিকে শেষবারের মতো মরিচ তোলেন, বর্ষার শুরুতে বাজারে সেই মজুতই চলতে থাকে। নতুন উৎপাদন না থাকায় সরবরাহ ধীরে ধীরে কমে আসে। চাহিদা যখন একই থাকে বা বাড়ে, আর সরবরাহ যখন কমে যায়—তখনই বাজারে তৈরি হয় মরিচের সংকট। আর তখনই শুরু হয় মরিচের দামের হঠাৎ উল্লম্ফন।

অপরদিকে, বর্ষাকালে দেশের অনেক এলাকা থেকে রাজধানীসহ বড় শহরে কাঁচামরিচ পরিবহন করাও কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় রাস্তা ঘাট কাদা মাখা, কিংবা জলাবদ্ধতার কারণে পচে যাওয়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা কম মরিচ আনেন। আবার যারা আনেন, তারাও উচ্চ পরিবহন খরচ ও ঝুঁকির কারণে দাম বাড়িয়ে দেন। ফলত, বাজারে সরবরাহ হঠাৎ করে কমে যায়। ক্রেতা বেশি, মাল কম—এই অবস্থায় প্রাকৃতিক নিয়মেই দাম চড়তে থাকে।

এদিকে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীও এই অবস্থাকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে শুরু করেন। হঠাৎ দাম বাড়তে দেখলেই অনেক পাইকার কিংবা মধ্যস্বত্বভোগী মজুত করে রাখেন মরিচ। ভাবেন, আরও কিছুদিন পর আরও বেশি দামে বিক্রি করা যাবে। এর ফলে বাজারে মরিচের সরবরাহ আরও কমে যায় এবং দাম আরও বেড়ে যায়। সাধারণ ক্রেতার পক্ষে তখন এক কেজি মরিচ কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় তাদের আধা কেজির বদলে ৫০ গ্রাম বা ১০০ গ্রাম কিনেই বাড়ি ফিরতে হয়।

এ বিষয়ে দেশের কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতামতও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ মতিন বলেন, “বর্ষাকালে মরিচের উৎপাদন কমে যাওয়া এক ধরনের প্রাকৃতিক চক্র। কিন্তু এর সঙ্গে যে ভয়াবহ দাম বৃদ্ধি ঘটে, তা পুরোপুরি প্রাকৃতিক নয়। এর পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও কিছু ব্যবসায়ীর অসাধু তৎপরতা জড়িত।” তাঁর মতে, সরকারের উচিত এই সময়টায় মরিচসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সবজির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ নজরদারি চালানো।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেখা যায়, ভারত, থাইল্যান্ড ও চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ মরিচ রপ্তানি করে থাকে। বাংলাদেশে যখন কাঁচামরিচের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যায়, তখন ভারত থেকে কিছু পরিমাণ মরিচ আমদানি করা হয় পরিস্থিতি সামাল দিতে। কিন্তু ভারতের অনেক রাজ্যেই বর্ষাকালে নিজেরাই উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ে, ফলে তখন রপ্তানির সুযোগ কমে যায়। আর ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেই বাংলাদেশের বাজারে মরিচের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ২০২৩ সালে এর একটি নজির পাওয়া যায়, যখন ভারতের পক্ষ থেকে একমাসের জন্য মরিচ রপ্তানি বন্ধ রাখা হয়, তখন বাংলাদেশে প্রতি কেজি মরিচের দাম এক সপ্তাহেই ২২০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবও এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে। এখনো আমাদের কৃষি নীতিতে মরিচসহ মৌসুমি সবজির সংরক্ষণের ব্যবস্থা দুর্বল। ফল ও আলুর জন্য কিছু হিমাগার থাকলেও মরিচের মতো দ্রব্যের জন্য হিমাগার বা শুকিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে বেশি দামে বিক্রির আশায় কৃষকরাও দ্রুত মরিচ বাজারজাত করে ফেলেন। দীর্ঘমেয়াদি মজুত করতে না পারায় বর্ষাকালে সরবরাহ হঠাৎ করে কমে যায়।

সমাধান কী হতে পারে? কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁচামরিচের উৎপাদনে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে হবে। এমন এলাকা চিহ্নিত করতে হবে যেখানে বর্ষাকালেও সেচ ও উঁচু জমির সুবিধায় মরিচ চাষ সম্ভব। এইসব এলাকাকে মরিচ উৎপাদনের বিশেষ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে বর্ষাকালেও সরবরাহ বজায় রাখা সম্ভব হবে। এছাড়া, মরিচ সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তিভিত্তিক হিমাগার, সোলার ড্রায়ার ও আধুনিক শুকানো পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে।

তবে শুধু উৎপাদন বা সংরক্ষণ নয়, বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনাও জরুরি। বিশেষ করে পাইকারি ও খুচরা বাজারে নজরদারি বাড়ানো, কৃত্রিম সংকটকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, এবং প্রয়োজনে সরকারি টিসিবি বা অন্যান্য মাধ্যমে বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত করা যেতে পারে। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ তৈরিরও সময় এসেছে। একটি অ্যাপ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কোথায় কী দামে মরিচ বিক্রি হচ্ছে তা জানানো গেলে বাজারে স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সমাজে ভোক্তা সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন। বর্ষাকালে কাঁচামরিচের দাম বাড়ে—এই সত্য মেনে নিয়ে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা নমনীয়তা আনা দরকার। মরিচের ব্যবহার কিছুটা কমিয়ে অন্য সুস্বাদু উপাদান ব্যবহার করেও রান্না সম্ভব। এক ধরনের গঠনমূলক বাজারচর্চা গড়ে তুললে ব্যবসায়ীরাও বুঝবেন, ভোক্তা ঠকানো যায় না।

সুতরাং বলা যায়, বর্ষাকালে কাঁচামরিচের দাম বাড়ার পেছনে একদিকে যেমন প্রকৃতির নিয়ামক কাজ করে, অন্যদিকে আছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা, সংরক্ষণের দুর্বলতা এবং বাজার ব্যবস্থার নানা অসংগতি। এই সমস্যা সমাধানে দরকার একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেখানে কৃষক, ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও প্রশাসন একযোগে কাজ করবে। তাহলেই বর্ষার মরিচ আর চোখের জলের কারণ হবে না—বরং থাকবে স্বাদ আর সুস্থতার মেলবন্ধনে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হার্টের রোগীদের যেসব খাবার এড়িয়ে চলা উচিত

হার্টের রোগীদের জন্য আরেকটি বিপজ্জনক খাবার হলো প্রসেসড মাংস। হট ডগ, সসেজ, প্যাকেটজাত সালামি কিংবা বেকন জাতীয় খাবারগুলোতে থাকে অতিরিক্ত সোডিয়াম নাইট্রেট ও প্রিজারভেটিভ, যেগুলো রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও এসব খাবারে হেম আয়রন নামের একটি উপাদান থাকে, এট হৃদপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর।

২ দিন আগে

দেশে এসএসসি পরীক্ষার সূচনা হয় কবে?

বাংলাদেশ যখন ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল, সেই সময় থেকেই এই ম্যাট্রিক পরীক্ষা চালু হয়েছিল। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই অঞ্চলে প্রথম ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রবর্তন হয় ১৮৫৭ সালে, যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

২ দিন আগে

কোন ভিটামিনের অভাবে বেরিবেরি রোগ হয়?

বেরিবেরি রোগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়— ‘ওয়েট বেরিবেরি’ ও ‘ড্রাই বেরিবেরি’। ওয়েট বেরিবেরিতে মূলত হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়। আর ড্রাই বেরিবেরিতে প্রভাব পড়ে স্নায়ুতন্ত্রে। ড্রাই বেরিবেরিতে আক্রান্ত ব্যক্তির -পায়ে ঝিনঝিন অনুভব হয়, হাঁটতে কষ্ট হয়, পায়ের পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে।

২ দিন আগে

ভূমিধসের আশঙ্কায় সতর্কবার্তা জারি আবহাওয়া অধিদপ্তরের

অতি ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ভারী বৃষ্টির ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা মহানগরের কিছু এলাকায় অস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে।

৩ দিন আগে