
বিবিসি বাংলা

সপ্তাহদুয়েক আগে আমেরিকার বৃহত্তম ব্যাংক জেপি মর্গানের প্রধান জেমি ডিমনের একটি সাক্ষাৎকার নেন বিবিসির বিজনেস এডিটর সাইমন জ্যাক। ওই সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পর কথায় কথায় তিনি একটি ছোটখাটো ‘বোমা’ ফাটান।
ডিমন জানান, মার্কিন প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন, বিস্তর জটিলতার পর ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ট্যারিফ নিয়ে অবশেষে একটি ‘ব্রেকথ্রু’ হয়ে গেছে। আশা করা যেতে পারে, দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়া এখন নেহাত সময়ের অপেক্ষা।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রর মধ্যে এই সমঝোতা হয়ে গেলে সেটি যে ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ হবে, তা নিয়ে জেমি ডিমনের অন্তত কোনো সংশয় ছিল না।
সাইমন জ্যাককে জেপি মর্গানের চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য শেয়ার করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো ‘অফ দ্য রেকর্ড’ ছিল বলে এখানে লেখা সম্ভব নয়।
এ ঘটনার কদিন পরই মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) হোয়াইট হাউজে দিওয়ালি উদযাপনের অনুষ্ঠানে ভারতীয়-আমেরিকানদের জমায়েতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির সদ্যই টেলিফোনে কথা হয়েছে।
আর সেই আলাপের মূল বিষয়বস্তু যে ছিল ‘ট্রেড’ বা বাণিজ্য এবং রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল বা ক্রুড কেনার পরিমাণ কমানো, সেটাও তিনি খোলাখুলি জানিয়ে দেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন এ কথা বলছেন, তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আমেরিকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বিনয় মোহন কোয়াটরা।
এর একটু পরেই প্রধানমন্ত্রী মোদিও টুইট করে জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ফোন করে দিওয়ালির শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং তিনি আশা করবেন, বিশ্বের দুই মহান গণতন্ত্র সারা বিশ্বকে আশায় আলোকিত করে চলবে। সরাসরি বাণিজ্যের প্রসঙ্গ না উল্লেখ করলেও মোদির বক্তব্যেও সহযোগিতার সুর ছিল স্পষ্ট।
এরই মধ্যে বুধবার (২২ অক্টোবর) ভারতের প্রথম সারির অর্থনৈতিক সংবাদপত্র ‘দ্য মিন্ট’ তাদের এক প্রতিবেদনে দাবি করে, সংশ্লিষ্ট অন্তত তিনজন সূত্র, যারা গোটা পরিস্থিতির সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তারা তাদের জানিয়েছেন যে ভারতর ওপর আমেরিকার চাপানো ৫০ শতাংশ ট্যারিফ অচিরেই ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে– এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তারা আরও জানায়, সব ঠিকঠাক থাকলে এ মাসের শেষ দিকে মালয়েশিয়াতে যে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন হবে, সেখানেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী মোদির উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির কথাও ঘোষণা করা হতে পারে।
তবে আসিয়ানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত হলেও নরেন্দ্র মোদি আদৌ সশরীরে সেখানে যাবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে গেলে হয়তো তাকে মালয়েশিয়াতে যেতেও দেখা যাবে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা হোয়াইট হাউজ ‘দ্য মিন্টে’র এ প্রতিবেদন নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ট্যারিফ হ্রাস আর চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা ভারতের শেয়ার বাজারে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৃহস্পতিবার সকালেও ভারতের মুম্বাই শেয়ারবাজারের সূচক প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে সর্বকালীন রেকর্ডের দিকে এগোচ্ছে।
কিন্তু আমেরিকা যদি সত্যিই ভারতের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হয় এবং দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেটা ঠিক কোন শর্তে হতে পারে? এই প্রতিবেদন উত্তর খুঁজেছে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই!
ভারতের রপ্তানি পণ্যের পর ট্রাম্প প্রশাসন যে ৫০ শতাংশ চড়া হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তার অর্ধেকটাই রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রুড কেনার জন্য ‘পেনাল্টি’ বা জরিমানা হিসেবে। অন্তত ঘোষিত কারণ এটাই।
এই ৫০ শতাংশের মধ্যে বাকি ২৫ শতাংশ হলো রেসিপ্রোকাল বা পালটা ট্যারিফ, যা মার্কিন পণ্যের ওপর ভারতের বসানো শুল্কর পালটা পদক্ষেপ।
এখন সত্যিই যদি এই ৫০ শতাংশ ট্যারিফতে ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে তেল কেনার কারণে আরোপিত ২৫ শতাংশ ‘পেনাল্টি’র পুরোটাই প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি রেসিপ্রোকাল ট্যারিফও অনেকটাই কমাতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে বা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিয়েই কেবল ভারত এ সুবিধা আদায় করতে পারে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের সূত্রগুলোও বিবিসিকে আভাস দিয়েছেন, রাশিয়ান ক্রুডের ‘প্রবাহের দিক পালটে’ (রিডাইরেক্টিং ফ্লো) এ সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে। সোজা কথায়, যার অর্থ হলো রাশিয়ার থেকে কম তেল কিনে আমেরিকা থেকে ক্রমশ ভারতের বেশি তেল কেনা!
দিওয়ালির অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা থেকেও আভাস মিলেছে, তিনি এই মুহূর্তে ভারতকে কিছুটা ছাড় হয়তো দিতে রাজি; তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কমিয়ে আনলেও সেটা হয়তো একটা রফার পথ প্রশস্ত করবে।
ওই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, এইমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মোদির সঙ্গে কথা হলো— আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক। উনি রাশিয়া থেকে আর খুব একটা বেশি তেল কিনবেন না! আসলে আমার মতো মোদিও চান (রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে) যুদ্ধ বন্ধ হোক... তাই ওরা ঠিক করেছেন রাশিয়া থেকে খুব বেশি তেল আর কিনবেন না!
যে ট্রাম্প আগে জেদ ধরে ছিলেন যে ভারতকে রাশিয়ার ক্রুড কেনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে (তার ভাষায় ‘আ বিগ স্টপ’), তার এই নতুন অবস্থানকে পর্যবেক্ষকরা কিছুটা সুর নরম করার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন।
রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হলো— দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের বাজার থেকে যেখানে সুলভে ও সহজে তেল পাওয়া যাবে সেখান থেকেই ভারত তেল কিনবে। এ যুক্তি আঁকড়ে থাকলেও ভারতের পক্ষে এখন একটা ‘সুবিধাজনক’ ঘটনাও ঘটেছে— রাশিয়ার ক্রুড কয়েক মান আগেও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় যতটা সস্তা ছিল, এখন আর ততটা নেই।
গত ৮ অক্টোবর ব্লুমবার্গ তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০২৩ সালেও রাশিয়ান ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের সঙ্গে বেঞ্চমার্ক ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দামের ফারাক ছিল ২৩ ডলার, যা এখন নেমে এসেছে মাত্র ২ বা ২.৫ ডলারে। এর অর্থ, মধ্যপ্রাচ্য বা আমেরিকার তেল এখন অনেকটাই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে।
ভারত এখন তাদের মোট তেল আমদানির ৩৪ শতাংশের মতো রাশিয়া থেকে করে থাকে। কিন্তু এতে চলতি অর্থ বছরে ভারতের অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের পরিমাণ আগের অর্থ বছরের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে, কারণ রাশিয়ার তেল তুলনামূলকভাবে আর অতটা সস্তা নেই।
দ্য মিন্ট জানাচ্ছে, এই পটভূমিতেই শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তারা সম্প্রতি মস্কো সফরে গিয়ে রাশিয়াকে জানিয়ে এসেছেন, সেখান থেকে তেল কেনার পরিমাণ তারা কমাতে বাধ্য হবেন। তবে এই ঘাটতি মেটাতে আমেরিকা থেকে তেল কেনা বাড়াতে হবে, কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার মতো দামে কোনো ছাড় দিতে রাজি হয়নি।
ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে বিগত বহু মাস ধরে। কিন্তু সেই আলোচনার জট এখনো খোলেনি। এর মধ্যে চুক্তি ঘোষণার ‘ডেডলাইন’ পর্যন্ত একাধিকবার পেছোনো হয়েছে।
এ চুক্তির পথে প্রধান বাধা ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের কৃষিজাত, ডেয়ারি ও জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) প্রোডাক্টের জন্য আমেরিকার অধিকতর প্রবেশাধিকার (অ্যাকসেস) দাবি।
ভারত মনে করে, এই প্রবেশাধিকার দিলে তাদের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই এই দাবি মানা হচ্ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মোদিও একাধিকবার বলেছেন, দেশের কৃষকদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করে কোনো বাণিজ্য চুক্তি হবে না।
এরপর রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনাকে কেন্দ্র করে বিরোধ এবং চড়া হারে ভারতের ওপর ট্যারিফ বসানো সেই আলোচনাকে আরও জটিল করেছে এবং প্রস্তাবিত চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।
তবে এখন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ভারত তাদের বাজারে আমেরিকার নন-জিএম কর্ন (ভুট্টা) ও সয়মিল (সয়াবিনজাত পণ্য) অনেক বেশি পরিমাণে ঢুকতে দিতে রাজি। এই মুহূর্তে আমেরিকা থেকে নন-জিএম ভুট্টা আমদানির বার্ষিক কোটা মাত্র ৫ লাখ টন, ভারত সেটা অনেকটাই বাড়াতে পারে।
এ সিদ্ধান্তের পেছনে চীনেরও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। কারণ তারা আমেরিকা থেকে ভুট্টা কেনার পরিমাণ হালে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। ২০২২ সালেও চীন যেখানে ৫২০ কোটি ডলার মূল্যের আমেরিকান কর্ন আমদানি করেছিল, ২০২৪ সালেই সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৩৩ কোটি ডলারে। ফলে আমেরিকাও এখন তাদের কর্নের জন্য নতুন বাজার ধরতে মরিয়া, আর ভারত তাদের সেই সুযোগটা দিতে পারে।
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পোলট্রি ফিড (মুরগি ইত্যাদির খাবার), ডেয়ারি ইনপুট (গবাদি পশুর খাদ্য) ও ইথানলের মতো বিকল্প জ্বালানির চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। সেটাকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেও ভারত আমেরিকান কর্নের জন্য দরজা অনেকটা অবারিত করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দ্য মিন্টকে জানিয়েছেন, আমেরিকা থেকে মানুষ ও গবাদি পশু উভয়ের খাবার উপযোগী নন-জিএম সয়মিল আমদানির অনুমদি দিতেও ভারত প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আমেরিকার আলোচনাকারীদের আর একটি প্রধান দাবি– খুব উঁচু মানের চিজসহ মার্কিন ডেয়ারি প্রোডাক্টে ভারতের শুল্ক কমানো, সেটা নিয়ে ভারত শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দিল্লি ও ওয়াশিংটন ডিসি– দুই রাজধানী থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তির একটি মোটামুটি রূপরেখা (ব্রড আউটলাইন) প্রায় তৈরি। কিন্তু জ্বালানি ও কৃষিখাতের বেশ কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে দুপক্ষ থেকে রাজনৈতিক ছাড়পত্র মিললে তবেই চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সম্ভব হবে।
দিল্লির গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ অজয় কুমার শ্রীবাস্তব বলেন, চীন তাদের রেয়ার আর্থ রপ্তানির ওপর যেভাবে রাশ টেনে ধরছে এবং আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ যেভাবে দিন দিন খারাপ মোড় নিচ্ছে, তাতে আমেরিকা এখন তাদের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে এবং বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে নতুন নতুন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী খুঁজছে। চুক্তি সম্পাদনের জন্য এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য অনুকূল হতে পারে।
এই পটভূমিতেই তার ধারণা– যাবতীয় দরকষাকষির শেষে আমেরিকা হয়তো ভারতকে ১৬-১৮ শতাংশ ট্যারিফের ব্র্যাকেটে ফেলতে চাইবে, যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপানের ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি, কিন্তু ভিয়েতনামের ২০ শতাংশের চেয়ে কম!

সপ্তাহদুয়েক আগে আমেরিকার বৃহত্তম ব্যাংক জেপি মর্গানের প্রধান জেমি ডিমনের একটি সাক্ষাৎকার নেন বিবিসির বিজনেস এডিটর সাইমন জ্যাক। ওই সাক্ষাৎকার শেষ হওয়ার পর কথায় কথায় তিনি একটি ছোটখাটো ‘বোমা’ ফাটান।
ডিমন জানান, মার্কিন প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছেন, বিস্তর জটিলতার পর ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ট্যারিফ নিয়ে অবশেষে একটি ‘ব্রেকথ্রু’ হয়ে গেছে। আশা করা যেতে পারে, দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হওয়া এখন নেহাত সময়ের অপেক্ষা।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ আর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রর মধ্যে এই সমঝোতা হয়ে গেলে সেটি যে ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ হবে, তা নিয়ে জেমি ডিমনের অন্তত কোনো সংশয় ছিল না।
সাইমন জ্যাককে জেপি মর্গানের চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য শেয়ার করেছিলেন, কিন্তু সেগুলো ‘অফ দ্য রেকর্ড’ ছিল বলে এখানে লেখা সম্ভব নয়।
এ ঘটনার কদিন পরই মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) হোয়াইট হাউজে দিওয়ালি উদযাপনের অনুষ্ঠানে ভারতীয়-আমেরিকানদের জমায়েতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির সদ্যই টেলিফোনে কথা হয়েছে।
আর সেই আলাপের মূল বিষয়বস্তু যে ছিল ‘ট্রেড’ বা বাণিজ্য এবং রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল বা ক্রুড কেনার পরিমাণ কমানো, সেটাও তিনি খোলাখুলি জানিয়ে দেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন এ কথা বলছেন, তখন তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আমেরিকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বিনয় মোহন কোয়াটরা।
এর একটু পরেই প্রধানমন্ত্রী মোদিও টুইট করে জানান, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ফোন করে দিওয়ালির শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং তিনি আশা করবেন, বিশ্বের দুই মহান গণতন্ত্র সারা বিশ্বকে আশায় আলোকিত করে চলবে। সরাসরি বাণিজ্যের প্রসঙ্গ না উল্লেখ করলেও মোদির বক্তব্যেও সহযোগিতার সুর ছিল স্পষ্ট।
এরই মধ্যে বুধবার (২২ অক্টোবর) ভারতের প্রথম সারির অর্থনৈতিক সংবাদপত্র ‘দ্য মিন্ট’ তাদের এক প্রতিবেদনে দাবি করে, সংশ্লিষ্ট অন্তত তিনজন সূত্র, যারা গোটা পরিস্থিতির সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তারা তাদের জানিয়েছেন যে ভারতর ওপর আমেরিকার চাপানো ৫০ শতাংশ ট্যারিফ অচিরেই ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে– এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
তারা আরও জানায়, সব ঠিকঠাক থাকলে এ মাসের শেষ দিকে মালয়েশিয়াতে যে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন হবে, সেখানেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও প্রধানমন্ত্রী মোদির উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির কথাও ঘোষণা করা হতে পারে।
তবে আসিয়ানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত হলেও নরেন্দ্র মোদি আদৌ সশরীরে সেখানে যাবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে গেলে হয়তো তাকে মালয়েশিয়াতে যেতেও দেখা যাবে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা হোয়াইট হাউজ ‘দ্য মিন্টে’র এ প্রতিবেদন নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ট্যারিফ হ্রাস আর চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা ভারতের শেয়ার বাজারে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৃহস্পতিবার সকালেও ভারতের মুম্বাই শেয়ারবাজারের সূচক প্রায় ৮০০ পয়েন্ট বেড়ে সর্বকালীন রেকর্ডের দিকে এগোচ্ছে।
কিন্তু আমেরিকা যদি সত্যিই ভারতের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হয় এবং দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেটা ঠিক কোন শর্তে হতে পারে? এই প্রতিবেদন উত্তর খুঁজেছে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরই!
ভারতের রপ্তানি পণ্যের পর ট্রাম্প প্রশাসন যে ৫০ শতাংশ চড়া হারে শুল্ক আরোপ করেছে, তার অর্ধেকটাই রাশিয়ার কাছ থেকে ক্রুড কেনার জন্য ‘পেনাল্টি’ বা জরিমানা হিসেবে। অন্তত ঘোষিত কারণ এটাই।
এই ৫০ শতাংশের মধ্যে বাকি ২৫ শতাংশ হলো রেসিপ্রোকাল বা পালটা ট্যারিফ, যা মার্কিন পণ্যের ওপর ভারতের বসানো শুল্কর পালটা পদক্ষেপ।
এখন সত্যিই যদি এই ৫০ শতাংশ ট্যারিফতে ১৫ বা ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে হয়, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে তেল কেনার কারণে আরোপিত ২৫ শতাংশ ‘পেনাল্টি’র পুরোটাই প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি রেসিপ্রোকাল ট্যারিফও অনেকটাই কমাতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে বা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিয়েই কেবল ভারত এ সুবিধা আদায় করতে পারে।
ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রশাসনের সূত্রগুলোও বিবিসিকে আভাস দিয়েছেন, রাশিয়ান ক্রুডের ‘প্রবাহের দিক পালটে’ (রিডাইরেক্টিং ফ্লো) এ সংকটের সমাধান খোঁজার চেষ্টা চলছে। সোজা কথায়, যার অর্থ হলো রাশিয়ার থেকে কম তেল কিনে আমেরিকা থেকে ক্রমশ ভারতের বেশি তেল কেনা!
দিওয়ালির অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা থেকেও আভাস মিলেছে, তিনি এই মুহূর্তে ভারতকে কিছুটা ছাড় হয়তো দিতে রাজি; তেল কেনা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও কমিয়ে আনলেও সেটা হয়তো একটা রফার পথ প্রশস্ত করবে।
ওই অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, এইমাত্র প্রধানমন্ত্রীর মোদির সঙ্গে কথা হলো— আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক। উনি রাশিয়া থেকে আর খুব একটা বেশি তেল কিনবেন না! আসলে আমার মতো মোদিও চান (রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে) যুদ্ধ বন্ধ হোক... তাই ওরা ঠিক করেছেন রাশিয়া থেকে খুব বেশি তেল আর কিনবেন না!
যে ট্রাম্প আগে জেদ ধরে ছিলেন যে ভারতকে রাশিয়ার ক্রুড কেনা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে (তার ভাষায় ‘আ বিগ স্টপ’), তার এই নতুন অবস্থানকে পর্যবেক্ষকরা কিছুটা সুর নরম করার ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন।
রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হলো— দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশ্বের বাজার থেকে যেখানে সুলভে ও সহজে তেল পাওয়া যাবে সেখান থেকেই ভারত তেল কিনবে। এ যুক্তি আঁকড়ে থাকলেও ভারতের পক্ষে এখন একটা ‘সুবিধাজনক’ ঘটনাও ঘটেছে— রাশিয়ার ক্রুড কয়েক মান আগেও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় যতটা সস্তা ছিল, এখন আর ততটা নেই।
গত ৮ অক্টোবর ব্লুমবার্গ তাদের এক রিপোর্টে জানিয়েছে, ২০২৩ সালেও রাশিয়ান ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের সঙ্গে বেঞ্চমার্ক ক্রুডের প্রতি ব্যারেলের দামের ফারাক ছিল ২৩ ডলার, যা এখন নেমে এসেছে মাত্র ২ বা ২.৫ ডলারে। এর অর্থ, মধ্যপ্রাচ্য বা আমেরিকার তেল এখন অনেকটাই প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে।
ভারত এখন তাদের মোট তেল আমদানির ৩৪ শতাংশের মতো রাশিয়া থেকে করে থাকে। কিন্তু এতে চলতি অর্থ বছরে ভারতের অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের পরিমাণ আগের অর্থ বছরের চেয়ে অনেকটাই কমে গেছে, কারণ রাশিয়ার তেল তুলনামূলকভাবে আর অতটা সস্তা নেই।
দ্য মিন্ট জানাচ্ছে, এই পটভূমিতেই শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তারা সম্প্রতি মস্কো সফরে গিয়ে রাশিয়াকে জানিয়ে এসেছেন, সেখান থেকে তেল কেনার পরিমাণ তারা কমাতে বাধ্য হবেন। তবে এই ঘাটতি মেটাতে আমেরিকা থেকে তেল কেনা বাড়াতে হবে, কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার মতো দামে কোনো ছাড় দিতে রাজি হয়নি।
ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে বিগত বহু মাস ধরে। কিন্তু সেই আলোচনার জট এখনো খোলেনি। এর মধ্যে চুক্তি ঘোষণার ‘ডেডলাইন’ পর্যন্ত একাধিকবার পেছোনো হয়েছে।
এ চুক্তির পথে প্রধান বাধা ছিল ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের কৃষিজাত, ডেয়ারি ও জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) প্রোডাক্টের জন্য আমেরিকার অধিকতর প্রবেশাধিকার (অ্যাকসেস) দাবি।
ভারত মনে করে, এই প্রবেশাধিকার দিলে তাদের অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই এই দাবি মানা হচ্ছিল না। প্রধানমন্ত্রী মোদিও একাধিকবার বলেছেন, দেশের কৃষকদের স্বার্থের সঙ্গে আপস করে কোনো বাণিজ্য চুক্তি হবে না।
এরপর রাশিয়া থেকে ভারতের তেল কেনাকে কেন্দ্র করে বিরোধ এবং চড়া হারে ভারতের ওপর ট্যারিফ বসানো সেই আলোচনাকে আরও জটিল করেছে এবং প্রস্তাবিত চুক্তিটির ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।
তবে এখন আভাস পাওয়া যাচ্ছে, ভারত তাদের বাজারে আমেরিকার নন-জিএম কর্ন (ভুট্টা) ও সয়মিল (সয়াবিনজাত পণ্য) অনেক বেশি পরিমাণে ঢুকতে দিতে রাজি। এই মুহূর্তে আমেরিকা থেকে নন-জিএম ভুট্টা আমদানির বার্ষিক কোটা মাত্র ৫ লাখ টন, ভারত সেটা অনেকটাই বাড়াতে পারে।
এ সিদ্ধান্তের পেছনে চীনেরও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। কারণ তারা আমেরিকা থেকে ভুট্টা কেনার পরিমাণ হালে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। ২০২২ সালেও চীন যেখানে ৫২০ কোটি ডলার মূল্যের আমেরিকান কর্ন আমদানি করেছিল, ২০২৪ সালেই সেটা নেমে এসেছে মাত্র ৩৩ কোটি ডলারে। ফলে আমেরিকাও এখন তাদের কর্নের জন্য নতুন বাজার ধরতে মরিয়া, আর ভারত তাদের সেই সুযোগটা দিতে পারে।
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেও পোলট্রি ফিড (মুরগি ইত্যাদির খাবার), ডেয়ারি ইনপুট (গবাদি পশুর খাদ্য) ও ইথানলের মতো বিকল্প জ্বালানির চাহিদা হু হু করে বাড়ছে। সেটাকে যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেও ভারত আমেরিকান কর্নের জন্য দরজা অনেকটা অবারিত করতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দ্য মিন্টকে জানিয়েছেন, আমেরিকা থেকে মানুষ ও গবাদি পশু উভয়ের খাবার উপযোগী নন-জিএম সয়মিল আমদানির অনুমদি দিতেও ভারত প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু আমেরিকার আলোচনাকারীদের আর একটি প্রধান দাবি– খুব উঁচু মানের চিজসহ মার্কিন ডেয়ারি প্রোডাক্টে ভারতের শুল্ক কমানো, সেটা নিয়ে ভারত শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
দিল্লি ও ওয়াশিংটন ডিসি– দুই রাজধানী থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, বাণিজ্য চুক্তির একটি মোটামুটি রূপরেখা (ব্রড আউটলাইন) প্রায় তৈরি। কিন্তু জ্বালানি ও কৃষিখাতের বেশ কিছু স্পর্শকাতর ইস্যুতে দুপক্ষ থেকে রাজনৈতিক ছাড়পত্র মিললে তবেই চুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা সম্ভব হবে।
দিল্লির গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞ অজয় কুমার শ্রীবাস্তব বলেন, চীন তাদের রেয়ার আর্থ রপ্তানির ওপর যেভাবে রাশ টেনে ধরছে এবং আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ যেভাবে দিন দিন খারাপ মোড় নিচ্ছে, তাতে আমেরিকা এখন তাদের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে এবং বিকল্প সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে নতুন নতুন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী খুঁজছে। চুক্তি সম্পাদনের জন্য এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য অনুকূল হতে পারে।
এই পটভূমিতেই তার ধারণা– যাবতীয় দরকষাকষির শেষে আমেরিকা হয়তো ভারতকে ১৬-১৮ শতাংশ ট্যারিফের ব্র্যাকেটে ফেলতে চাইবে, যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাপানের ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি, কিন্তু ভিয়েতনামের ২০ শতাংশের চেয়ে কম!

গাজায় ত্রাণ প্রবেশে ইসরায়েল বাধা দিতে পারবে না এবং ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে বলে আদেশ দিয়েছেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
২ দিন আগে
গাজা উপত্যকায় সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন, বেআইনি হত্যাকাণ্ড ও সন্দেহজনক মৃত্যুর ভয়াবহ প্রতিবেদন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সামরিক বন্দিশালা সেডিতিমান থেকে যে ১৯৫ ফিলিস্তিনি বন্দির লাশ হস্তান্তর
২ দিন আগে
যুদ্ধ ও দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টায় থাকা অভিবাসীদের জন্য তিউনিসিয়া এখন একটি প্রধান ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে।
২ দিন আগে
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্টে পরিকল্পিত বৈঠকটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের বিষয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার একদিন পর এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
২ দিন আগে