'সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া' জাতিসংঘ গাজার জন্য কী করেছে?

বিবিসি বাংলা

ইউনাইটেড নেশনস্ চার্টার বা জাতিসংঘ সনদ কার্যকর হওয়ার ৮০তম বার্ষিকী আজ। ১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবর থেকে এটি কার্যকর হয়। এই দিনটি জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

অবশ্য, সনদটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ওই বছরের ২৬শে জুন।

জাতিসংঘ সনদকে বলা হয় সংস্থাটির সংবিধান। এই সনদের ওপর ভিত্তি করেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এই সনদে শান্তি, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

সনদের উদ্দেশ্য ও নীতির বর্ণনায় শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, "আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং সেই লক্ষ্যে, শান্তির প্রতি হুমকি প্রতিরোধ ও অপসারণের জন্য কার্যকর সম্মিলিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা…"

এছাড়া, "অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অথবা মানবিক সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার" কথাও বলা হয়েছে এতে।

কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে, প্রতিষ্ঠার আট দশক পার করে নিজ উদ্দেশ্য ও নীতির পথে কতটা হাঁটতে পারছে জাতিসংঘ।

সাম্প্রতিকতম এবং ব্যাপকতার দিক থেকে গুরুতর ইসরায়েল-গাজা সংঘাত দিয়ে বিবেচনা করলে জাতিসংঘের ভূমিকা কেমন ছিল?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের কারো কারো মতে, গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের 'আগ্রাসন' ঠেকাতে ব্যর্থতার পর জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়েই নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

আবার, কেউ কেউ মনে করেন, মানবিক সহায়তার প্রশ্নে সংস্থাটির সক্রিয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই এবং বৈশ্বিক কূটনীতিতে এখনো এর কোনো বিকল্প নেই।

গাজা ইস্যুতে সাধারণ পরিষদের পদক্ষেপ

ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র নয়। ২০১২ সাল থেকে অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছে।

গত নয়ই মে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যপদ দেয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহবান জানিয়ে সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। কারণ, সদস্য পদের বিষয়টি শুধুমাত্র নির্ধারণ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।

নিরাপত্তা পরিষদ বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে অচল হয়ে পড়ায়, সাধারণ পরিষদকে আরো একাধিক জরুরি অধিবেশন আয়োজন ও প্রস্তাব গ্রহণ করতে দেখা গেছে।

গত জুনে সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যা গাজায় তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়।

এর আগে, ২০২৪ এর ডিসেম্বর, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর এবং অক্টোবরেও, সাধারণ পরিষদ "যুদ্ধবিরতির" আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পাশ করে।

তবে, সাধারণ পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকায়, কূটনৈতিক গুরুত্ব থাকলেও কার্যকারিতার দিক থেকে সেগুলো যথেষ্ট ছিল না।

আইসিসির পরোয়ানা

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলি সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।

২০২৪ সালের ২১শে নভেম্বর এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এটিই পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে তৈরি কোনো দেশের নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির প্রথম ঘটনা।

আইসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, "ক্ষুধাকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য এই দুইজনকে দায়ী করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।"

ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের তৎকালীন নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল সেই সময়। পরবর্তীতে জানা যায়, মি. দেইফ জুলাইয়ে ইসরায়েলের হামলায় মারা গেছেন।

আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই। ফলে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য তারা তাদের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর উপর নির্ভর করে।

এটি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) থেকে আলাদা।

আইসিসিকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং ইসরায়েল।

ইসরায়েল আইসিসির সদস্য দেশ না হওয়ায় এর ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই বলে দাবি করে দেশটি।

ফলে, পরোয়ানা জারির প্রায় এক বছর হতে চললেও ইসরায়েলি নেতৃত্বকে কোনো আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়নি।

এর মধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি নেতাদের জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান আটকে দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

এখন, নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ট আইসিসির কোনো সদস্য রাষ্ট্রে ভ্রমণ করা এবং গ্রেফতার হওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনা না ঘটলে এই আদালতে তাদের বিচারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

'দুর্ভিক্ষ' ও ত্রাণকর্মীদের মৃত্যু

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় মানবিক বিপর্যয় এবং 'দুর্ভিক্ষ'র কথা আগে থেকেই বলে আসছিল বিভিন্ন পক্ষ।

তবে, গত অগাস্টে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের একটি সংস্থা জানায়, গাজার মানুষ দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত।

গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ 'ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর' মুখোমুখি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।

খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নজরদারির দায়িত্ব পালন করা জাতিসংঘের সংস্থা দ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেইজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি জানায়, গাজার 'দুর্ভিক্ষ' সম্পূর্ণরূপে মানুষের তৈরি এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

কিন্তু, যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকায় খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করাও চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

গত দুই বছরে গাজায় ত্রাণসহায়তায় গিয়ে কয়েকশো মানবাধিকার কর্মী নিহত হন।

গত তেসরা অক্টোবর জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানান, মোট ৫৬২ ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ৩৭৬ জন জাতিসংঘের কর্মী।

'জাতিসংঘের দুইটি চেহারা'

গত শতাব্দীতে বছর বিশেকের ব্যবধানে দুইটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল জাতিসংঘের।

ফলে, ভবিষ্যতের যুদ্ধ এড়াতে আন্তর্জাতিক বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্র হওয়ার লক্ষ্য উল্লেখ করা হয়েছিল জাতিসংঘ সনদে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্থাটির 'মনোযোগে' বিবর্তন দেখা গেছে বলে মনে করেন সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিক এম হুমায়ূন কবির।

"প্রথম দুই দশক জাতিসংঘের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল বিভিন্ন স্থানে সংঘাত বা যুদ্ধ বন্ধ করার প্রয়াসে," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিন।

"তৃতীয় দশকে দেখা গেল অর্থনৈতিক বিষয়, নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি,"এমনটা উল্লেখ করে করে মি. কবির বলেন, জাতিসংঘকে এ সময় আংকটাডের মতো বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়।

আংকটাড হলো ইউনাইটেড নেশনস্ কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন।

"চতুর্থ দশকে ইউএনের মনোযোগ অর্থনীতি থেকে সরে মানবাধিকার গুরুত্ব পেল," বলছিলেন সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির।

তার মতে, এসব বিবর্তনের ফলে সংস্থাটি একটি মিশ্র বৈশিষ্ট্য পায়।

"এক পর্যায়ে, জাতিসংঘ দুইটি চেহারায় আবির্ভূত হয়," যোগ করেন মি. কবির।

এক দিকে, 'নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতিসংঘ' অন্যদিকে, 'মহাসচিবের নেতৃত্বাধীন সহায়তা ও মানবিক কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর জাতিসংঘ'।

নিরাপত্তার পরিষদের স্থায়ী সদস্য পাঁচটি দেশ। তাদের ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে তোলা যেকোনো প্রস্তাব আটকে দিতে পারে যেকোনো একটি সদস্য দেশের ভেটো।

"রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মতৈক্যের অভাবে, নিরাপত্তা পরিষদ অনেক সময় কঠোর ভূমিকা নিতে পারে না," বলেন এম হুমায়ূন কবির।

তিনি বলেন, এর ফলে গাজায় ইসরায়েলের তৎপরতা থামাতে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি জাতিসংঘকে। বরং, তারা মানবিক সহায়তা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে।

অবশ্য সেই চেষ্টার মধ্যে 'হিপোক্রেসি' দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশীদ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "ইউএন যা করতে পারতো বা করা উচিত ছিল, তেমন কিছুই ইউএন করেনি।"

"জাতিসংঘের প্রথম দায়িত্ব ছিল অ্যাগ্রেসন বন্ধের জন্য কাজ করা। তা বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলের বিপক্ষে যা করা উচিত ছিল, তার কিছুই করা হয়নি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। এই জায়গাটায় সে ফেল করেছে," যোগ করেন অধ্যাপক রোজানা রশীদ।

তার মতে, "কনফ্লিক্ট বন্ধ করতে না পেরে ত্রাণ সহায়তার মাঝামাঝি সেটেলমেন্টে আসা এক ধরনের হিপোক্রেসি।"

"এমনকি নিজেদের কর্মীদের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। এই জায়গায় সংস্থাটিকে অসহায় মনে হয়েছে কখনো কখনো," বলেন মিজ রোজানা রশীদ।

এসব কারণে জাতিসংঘের অস্তিত্বের আদৌ দরকার আছে কি না এমন প্রশ্নও তোলেন তিনি। বলেন, নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় এই সংস্থাকে নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

লাশে নির্যাতনের চিহ্ন, চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস গার্ডিয়ানের

গাজা উপত্যকায় সাময়িক যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন, বেআইনি হত্যাকাণ্ড ও সন্দেহজনক মৃত্যুর ভয়াবহ প্রতিবেদন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইসরায়েলি সামরিক বন্দিশালা সেডিতিমান থেকে যে ১৯৫ ফিলিস্তিনি বন্দির লাশ হস্তান্তর

১ দিন আগে

তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকা ডুবে ৪০ অভিবাসী নিহত

যুদ্ধ ও দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টায় থাকা অভিবাসীদের জন্য তিউনিসিয়া এখন একটি প্রধান ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে।

১ দিন আগে

পুতিনের সঙ্গে আলোচনা নিয়ে ট্রাম্পের ক্ষোভ, রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বুদাপেস্টে পরিকল্পিত বৈঠকটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের বিষয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার একদিন পর এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

১ দিন আগে

ইসরায়েলের সংসদে পশ্চিম তীর দখলের বিতর্কিত বিলের প্রাথমিক অনুমোদন

তবে এই পদক্ষেপ দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথকে কার্যত বন্ধ করে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এই বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হামাস, কাতার, সৌদি আরব ও জর্ডান।

১ দিন আগে