দুর্নীতি ও ‘নেপো বেবি’দের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে ফিলিপাইনেও

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
বন্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় জলমগ্ন ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা। ছবি: সংগৃহীত

অস্বাভাবিক রকমের তীব্র মৌসুমি বৃষ্টিতে নজিরবিহীন বিপর্যয় নেমে এসেছে ফিলিপাইনের জনজীবনে। তীব্র বৃষ্টির পর রাস্তাগুলো যেন নদীতে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ চলাচল নিয়ে সংকটে পড়েছেন। ছড়িয়ে পড়েছে লিভারের রোগ লেপ্টোসপাইরোসিস, যা সাধারণত ছড়ায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করা ইঁদুরের মল থেকে।

অভিযোগ উঠেছে, ফিলিপাইনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে, যা দেশ জুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করেছে। নানা খাতের দুর্নীতিতে জড়িত মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন দেশটির বাসিন্দারা, বিশেষ করে তরুণরা। পাশাপাশি নেপালের মতো ফিলিপাইনেও ‘নেপো কিড’ তথা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে তৈরি হয়েছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।

৩৬ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষক ক্রিসা তলেন্তিনো বিবিসিকে জানান, প্রতিদিন বাড়ি থেকে প্যাডেলবোটে করে জলমগ্ন রাস্তা পাড়ি দিয়ে কর্মস্থল আপালিত শহরে যেতে হয় তাকে। যাতায়াতের আর কোনো বিকল্প নেই তার কাছে। আপালিতে তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসাও নেন।

তলেন্তিনো বলেন, অনেক আগেই বন্যাকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছি। কারণ বছরে মাত্র দুই মাসের মতো সময় সড়ক শুকনো থাকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি বেশি খারাপ। আমি কঠোর পরিশ্রম করি, অপচয় করি না। প্রতি মাসে আমার বেতন থেকে কর কেটে নেওয়া হয়। তারপর শুনি, আমাদের কোটি কোটি টাকার কর দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা ভোগ করছেন। আমি প্রতারিত বোধ করছি।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, কেবল তলেন্তিনো নয়, এ অভিযোগ এখন পুরো ফিলিপাইনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মানুষ প্রশ্ন তুলছে— সরকার সড়ক, সেতু ও বাঁধ নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো ব্যয় করলেও কেন বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না?

টিকটক, ফেসবুক ও এক্সের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ভূতুড়ে’ প্রকল্পের জন্য চুক্তি হয়, যেগুলো বাস্তবে কখনোই আলোর মুখ দেখে না— এমন অভিযোগ তুলে সংসদ সদস্য ও নির্মাণ খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে এসব মাধ্যমে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়র নিজেও এ সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। একটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পরিদর্শনে গিয়ে তিনি দেখেন, সেটি আদৌ নির্মিতই হয়নি। পরে এক বক্তব্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে বরাদ্দ করা সরকারি অর্থের ৭০ শতাংশই দুর্নীতির কারণে আত্মসাৎ হয়।

Philippines Flood And Protest 19-09-2025 (1)

দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে ফিলিপাইনে বিক্ষোভ করছেন তরুণরা। ছবি: সংগৃহীত

এ ঘটনায় সংসদের স্পিকার পদত্যাগ করেন, যদিও তিনি কোনো দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। অন্যদিকে সিনেট নেতাকে পদচ্যুত করা হয়েছে। কারণ তার ২০২২ সালের নির্বাচনি প্রচারে অনুদান দিয়েছিলেন একটি সরকারি প্রকল্পের দরপত্রের কাজ পাওয়া একজন ঠিকাদার, যা আইনত নিষিদ্ধ।

এ পরিস্থিতিতে আগামী রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) একটি দুর্নীতিবিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। ১৯৭২ সালের এই দিনে তৎকালীন নেতা ফার্দিনান্দ মার্কোস দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন।

ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট তারই ছেলে ফার্দিনান্দ ‘বংবং’ মার্কোস জুনিয়র। ১৯৮৬ সালে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনই তার বাবাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, যা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বিলিয়ন বিলিয়ন পেসো আত্মসাতের অভিযোগ ছিল মার্কোসের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে আইনে সংস্কারের পথে হেঁটেছে ইন্দোনেশিয়া। গত সপ্তাহেই একই ধরনের আন্দোলন নেপালে সরকার পতনের কারণ হয়েছে।

এ অবস্থায় সোমবার যখন ফিলিপিনোরা জবাব চাইছিল, প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়র তখন একটি তদন্ত শুরুর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, প্রতারকদের মুখোশ খুলে দেওয়া হবে। তারা কত টাকা চুরি করেছে তা বের করা হবে। আমি যদি প্রেসিডেন্ট না হতাম, তাহলে হয়তো আমিও তাদের সঙ্গে রাস্তায় থাকতাম।

ফিলিপিনো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখন সরকারি অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগ আছে— এমন রাজনীতিবিদ ও ঠিকাদারদের সন্তানদের দিকেও ক্ষোভের তীর ছুঁড়ছেন। তাদেরকে ‘নেপো বেবি’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, ‘ডিজাইনার পোশাক’ পরা ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করার চিত্র যারা তুলে ধরছেন তাদের নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করা হচ্ছে। তাদের অনেকে তরুণী।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তাদের (নেপো বেবি) উচিত করদাতাদের ধন্যবাদ জানানো, কেননা তাদের কেনাকাটা ও ভ্রমণের খরচ সেই কর থেকেই এসেছে।

সম্প্রতি নেপালে ‘জেন-জি’ আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের নেপথ্যেও ‘নেপো কিড’দের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ভূমিকা রেখেছে। সেখানে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে একটি ‘নেপো কিড’ প্রচারণা সামাজিক যোগামাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেশের আরও নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন হয়।

ফিলিপাইনে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়েকে একবার পোশাকের জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তিনি ফেন্ডি ও ডিওর মিলিয়ে পরেছিলেন এবং বহুল কাঙ্ক্ষিত ও দামি হারমেসের বারকিন ব্যাগ বহন করছিলেন। এ ধরনের তীর্যক মন্তব্যের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা অনেকেই তাদের অ্যাকাউন্টে মন্তব্যের সুযোগ বন্ধ বা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন।

অন্যদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয় কিছু অ্যাকাউন্টের পেছনের মানুষদের একত্রিত করেছে। ক্রিয়েটরস এগেইনস্ট করাপশন নামের একটি গ্রুপ বলেছে, ‘আমরা থামব না। বরং আরও সোচ্চার হব। আমরা ক্ষমতার সামনে আয়না ধরব এবং ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত সরে দাঁড়াব না।

ফিলিপাইন জুড়ে এ ক্ষোভ শুধু অনলাইনে নয়, অফলাইনেও ছড়িয়ে পড়েছে। গণপূর্ত বিভাগের প্রকৌশলীদের জনসমক্ষে অপমান, অপদস্ত হওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে, এই বিভাগের প্রকৌশলীদের ইউনিফর্ম না পরার কথা বলা হয়েছে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

দুই দিক থেকে গাজা শহরে ইসরায়েলি হামলা

ইসরায়েলি সেনারা শহরের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছেন। এর ফলে সাধারণ মানুষ মধ্যবর্তী এলাকায় আটকা পড়ে পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছেন, যেখানে আল-রশিদ উপকূলীয় সড়ক অবস্থিত, যা দক্ষিণের দিকে চলে গেছে।

১১ ঘণ্টা আগে

গাজা ইস্যুতে জাতিসংঘে ভোট আজ, চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র

ভোটের জন্য প্রস্তুত খসড়াটি পর্যালোচনা করেছে বার্তা সংস্থা- এএফপি। এতে সাহায্যের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি সব পক্ষ ‘গাজায় অবিলম্বে, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও জিম্মিদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির’ দাবি জানিয়েছে। এ নিয়ে নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান কার্যালয়ে এই ভ

১ দিন আগে

গাজার প্রধান আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়েছে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক

যুদ্ধের আগে এই শেখ রাদওয়ান জেলায় কয়েক হাজার মানুষের বসবাস ছিলো। এটি সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচিত।

১ দিন আগে

এয়ার ইন্ডিয়া দুর্ঘটনা: ৩ মাস পর বোয়িং ও হানিওয়েলের বিরুদ্ধে মামলা

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ ফুয়েল সুইচের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঝুঁকি সম্পর্কে জানার পরও কোম্পানিগুলো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

১ দিন আগে