ইতিহাস

আরাকান আর্মির আবির্ভাবের কাহিনি

অরুণাভ বিশ্বাস

বিচ্ছিন্ন আর পাহাড়ি রাখাইন রাজ্য এক সময় ছিল স্বাধীন আরাকান সাম্রাজ্যের অংশ। সে সাম্রাজ্য ছিল সংস্কৃতিতে ধনী, আরব-পারস্য ও বৌদ্ধ সভ্যতার মেলবন্ধন। কিন্তু ঔপনিবেশিক যুগের পর নানা ইতিহাসে গাঁথা এই অঞ্চল আজ মিয়ানমারের একটি সংঘাতপূর্ণ রাজ্য। এই রাখাইন থেকেই উঠে এসেছে এক বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী—আরাকান আর্মি। তাদের দাবি, রাখাইনবাসীর অধিকার ফিরিয়ে আনা, রাখাইনকে মিয়ানমারের নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এই পথ ছিল সহিংসতায় ভরা, এবং এই পথে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শক্তিশালী জান্তা সরকার।

আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালে। তখন রাখাইন রাজ্যের কিছু তরুণ শিক্ষিত যুবক নিজেদের জনগণের প্রতি অবিচার আর অবহেলার বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলেন। তাঁরা বুঝতে পারলেন, মিয়ানমারের মূল ধারার রাজনীতি তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে মূল্য দিচ্ছে না। রাখাইনের তরুণদের নেতৃত্বে এই যুবকরা গেলেন উত্তর মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যে। সেখানে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি বা কেআইএর কাছ থেকে তারা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিলেন। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল একটি নতুন বাহিনী—আরাকান আর্মি।

এই বাহিনীকে শুরুতে কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে তারা শুধু ছোটখাটো গ্রাম পাহারা দেওয়ার বাহিনী থেকে বড় আকারের সংগঠনে পরিণত হলো। ২০১৫ সালের দিকে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর (তৎকালীন তাতমাদাও) সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে নামে। তখন থেকেই দেশের সামরিক জান্তা আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে ঘোষণা করে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই মানেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। তারা দেশটির একমাত্র শক্তিশালী বাহিনী, অস্ত্রে, প্রশিক্ষণে এবং সম্পদে অনেক এগিয়ে। কিন্তু আরাকান আর্মি পাহাড়ি এলাকা, গেরিলা কৌশল আর স্থানীয় জনতার সমর্থন কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে থাকে। বিশেষ করে ২০১৯ সালে রাখাইন অঞ্চলে বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। এতে বহু সেনা নিহত হয়, বহু মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। আরাকান আর্মি ঘোষণা দেয়, তাদের লক্ষ্য শুধু স্বাধীনতা নয়, বরং "ন্যায্য স্বায়ত্তশাসন" প্রতিষ্ঠা করা।

তবে ২০২১ সালে মিয়ানমারে ঘটে যায় আরও বড় ঘটনা—সামরিক অভ্যুত্থান। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে আবারও সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর পর থেকেই দেশজুড়ে নতুন করে সশস্ত্র বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। রাখাইনেও এর রেশ পড়ে, কিন্তু প্রথমদিকে আরাকান আর্মি একটু চুপচাপ থাকে। কারণ, তারা জান্তার সঙ্গে সাময়িকভাবে এক ধরনের মৌন সমঝোতা করেছিল, যাতে রাখাইনে সাময়িক যুদ্ধবিরতি থাকে। কিন্তু সেই চুক্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০২2 সালের শেষের দিকে আবার সংঘর্ষ শুরু হয়।

আরাকান আর্মির নেতৃত্বে আছেন তুন মিয়াত নাং নামের এক তরুণ নেতা। তিনি একজন বৌদ্ধ রাখাইন এবং বিশ্বাস করেন, শুধু রাজনীতি নয়, সশস্ত্র সংগ্রামই রাখাইন জাতির অধিকার আদায়ের একমাত্র পথ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "আমরা জানি, শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের কোনো অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। যদি স্বাধীনতা না পাই, অন্তত যেন আমাদের জাতিসত্তা টিকে থাকে, সেই চেষ্টা করছি।"

বিদেশি গবেষকরাও আরাকান আর্মিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. শেইন স্নোডেন বলেন, ‘আরাকান আর্মি একটি এলোমেলো বাহিনী থেকে মিয়ানমারের অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত বিদ্রোহী সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছে। তাদের রয়েছে কৌশলগত বোঝাপড়া, স্থানীয় জনসমর্থন এবং দিনে দিনে বেড়ে চলা সামরিক সাফল্য।’

আরেকজন গবেষক, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ড. নাতালি ব্রান্সকোম, যিনি দীর্ঘদিন মিয়ানমারের জাতীয় রাজনীতি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁর মতে, ‘অনেক জাতিগত বাহিনী যেখানে জনসমর্থন হারাচ্ছে, সেখানে আরাকান আর্মি উল্টো জনসমর্থন ও বৈধতা দুই-ই অর্জন করছে। তারা শুধু রাখাইন নয়, অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছেও প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।’

তবে এই প্রতিরোধ আন্দোলন সহজ নয়। জান্তা সরকার শুধু সামরিক শক্তিতে নয়, তথ্য ও অর্থনীতিতেও প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করছে। রাখাইনে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়, খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত করা হয়, এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা আটকে দেওয়া হয়। এসবের মধ্যেও আরাকান আর্মি টিকে আছে, কারণ তাদের মূল শক্তি জনগণের ওপর নির্ভরতা।

আন্তর্জাতিক মহলও আরাকান আর্মির ভূমিকা নিয়ে দ্বিধায়। একদিকে তারা স্বীকার করে যে, এই বাহিনী সামরিক শৃঙ্খলা ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে অনেক এগিয়ে গেছে। অন্যদিকে এ-ও দেখা গেছে, কখনও কখনও তারা রোহিঙ্গা বা অন্য সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনায় যেতে চায় বলে জানিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের এই সঙ্কট সহজে মিটবে না। বিশেষ করে যখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়, এবং প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলছে, তখন এই সংঘাত দীর্ঘমেয়াদি হবে। আরাকান আর্মিও সেই বড় লড়াইয়ের অংশ। তারা শুধু অস্ত্রধারী বিদ্রোহী নয়, তারা হয়ে উঠেছে রাখাইন জাতীয়তাবাদের প্রতীক।

আজ যারা রাখাইনের ছোট শহর বা গ্রামে বাস করেন, তাঁরা প্রায়ই বলেন, ‘সরকার আমাদের কিছু দেয় না, কিন্তু আরাকান আর্মি অন্তত আমাদের কথা শুনে।’ এই বিশ্বাসই তাদের টিকিয়ে রেখেছে।

সেই লড়াইয়ের গল্প, অবিচারের প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নেওয়া এক সংগঠনের কাহিনি, আরাকান আর্মি—যারা আজও লড়ছে, অস্ত্র হাতে নয় শুধু, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

'মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ বন্ধ করলেই যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবে ইরান'

ইসরায়েলকে ছাড়লেই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবে ইরান মন্তব্য করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ বন্ধ না করে এবং ইসরায়েলকে দেওয়া সমর্থন ত্যাগ না করে, তবে তেহরান তাদের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করবে না।

২ দিন আগে

যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি হামলা

এদিকে যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজায় প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের এক সূত্র আল জাজিরাকে জানায়, সোমবার দক্ষিণ গাজার রাফাহর উত্তরে ইসরায়েলি হামলায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

২ দিন আগে

পৃথিবীকে ১৫০ বার উড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতার কথা জানালেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পর্যাপ্ত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে যা দিয়ে পৃথিবীকে ১৫০ বার উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেছেন, চীন ও রাশিয়ার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা মোকাবিলা করতে পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চালানো জরুরি।

৩ দিন আগে

আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্প, ৭ জনের মৃত্যু

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল মাজার-ই-শরিফ থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে, সামাঙ্গান প্রদেশের খোলম শহরের নিকটে। খোলমে প্রায় ৬৫ হাজার এবং মাজার-ই-শরিফে প্রায় ৫ লাখ ২৩ হাজার মানুষ বসবাস করেন।

৩ দিন আগে