ইতিহাস

রেজা পাহলভির শাসনকাল: আধুনিকতার আড়ালে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৫, ২৩: ২০

ইরানের ইতিহাসে এক অদ্ভুত দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের সময় ছিল শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনকাল। এই সময়কে অনেকে আধুনিক ইরানের ভিত্তি রচনার যুগ বলে মনে করেন, আবার অনেকে বলেন—এই সময়েই জন্ম নিয়েছিল সেই ক্ষোভ, সেই অসমতা, সেই দমনপীড়নের চোরাস্রোত, যা পরে ইসলামী বিপ্লবের রূপ নেয়। শাহের শাসনকাল শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সালে এবং তা শেষ হয় ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে। এই দীর্ঘ শাসনামলে ইরান যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে, তা ইতিহাসে একদিকে যেমন বিতর্কিত, তেমনি শিক্ষণীয়ও।

শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ছিলেন পাহলভি রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক। তার পিতা রেজা শাহ ১৯৪১ সালে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপে abdicate করলে মোহাম্মদ রেজা সিংহাসনে বসেন। প্রথমদিকে তার শাসন ছিল অনেকটাই আনুষ্ঠানিক, কারণ বাস্তব ক্ষমতা ছিল পশ্চিমা মিত্রদের হাতে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন একজন শক্তিশালী ও এককেন্দ্রিক শাসকে।

শাহ আধুনিকতা ও উন্নয়নের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি চান ইরান যেন একটি পশ্চিমা ধাঁচের উন্নত ও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এ উদ্দেশ্যে তিনি চালু করেন "হোয়াইট রেভল্যুশন" নামে এক সিরিজ সংস্কার কর্মসূচি। এতে ছিল জমি সংস্কার, শিক্ষার প্রসার, নারীদের ভোটাধিকার, কারখানা শ্রমিকদের অংশীদারিত্ব, এমনকি ধর্মীয় সম্পত্তির জাতীয়করণ। কিন্তু এই সংস্কার কর্মসূচি ইরানের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সমাজ ও ধর্মীয় নেতৃত্বের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দেয়। বিশেষত আয়াতুল্লাহ খোমেইনি প্রকাশ্যে শাহের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন।

তবে এসব সংস্কারের বাইরেও শাহের শাসনের প্রকৃত চেহারা ছিল ভিন্ন। তার প্রশাসন ছিল কার্যত একনায়কতান্ত্রিক। যদিও ইরানে একটি সংসদ ছিল, কিন্তু সেটি ছিল প্রায় অকার্যকর। কোনো বিরোধী দল টিকতে পারত না। ১৯৭৫ সালে তিনি ঘোষণা দেন যে এখন থেকে ইরানে কেবল একটাই রাজনৈতিক দল থাকবে—রাস্তাখিজ পার্টি। এতে সমগ্র রাজনৈতিক পরিসরই বন্ধ হয়ে যায়।

শাহের শাসনের আরেকটি ভয়ংকর দিক ছিল তার গোপন পুলিশ সংস্থা—সাভাক (SAVAK)। এটি গড়ে তোলা হয় মার্কিন সিআইএ ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহযোগিতায়। সাভাকের কাজ ছিল বিরোধীদের নজরদারি, গুম, আটক, এমনকি ভয়ংকর নির্যাতন। বহু মানুষ বিনা বিচারে আটক হতো, নির্যাতিত হতো, অনেকেরই আর খোঁজ পাওয়া যেত না।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হগ (Eric Hobsbawm) একবার মন্তব্য করেছিলেন—"শাহের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি যতই জাঁকজমকপূর্ণ হোক না কেন, তা বাস্তবিক অর্থে ছিল এক ‘আধুনিক ফ্যাসিবাদের’ রূপ।” এই কথার পেছনে যুক্তিও ছিল। শহরে কিছু উন্নয়ন হলেও গ্রামে, বিশেষত দরিদ্র কৃষিজীবীদের ভাগ্য বিশেষ বদলায়নি। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়েছিল আশঙ্কাজনক হারে। শাহ ও তার পরিবার বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। ২৫০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্সেপোলিসে দেওয়া এক রাজকীয় ভোজ, যেখানে বিশ্বনেতাদের ডেকে ১৬ দিনব্যাপী আতিথেয়তা দেওয়া হয়েছিল, তা জনসাধারণের চোখে ছিল এক ‘পাপের উৎসব’।

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গবেষক স্টিফেন কিনজার (Stephen Kinzer), যিনি বই লিখেছেন "All the Shah’s Men", সেখানে তিনি লিখেছেন—“শাহ ছিলেন একদিক দিয়ে আধুনিকতা ও উন্নয়নের প্রতীক, অন্যদিকে ছিলেন একটি আতঙ্কের রাষ্ট্রের নির্মাতা।” তাঁর মতে, এই দুই সত্তার দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত শাহের পতন ডেকে আনে।

আরেকজন মার্কিন অধ্যাপক, এরিক ডেভিস (Eric Davis), যিনি মিডল ইস্ট পলিটিক্স নিয়ে কাজ করেন, বলেন—"শাহের শাসন ছিল পলিটিক্যাল স্পেসের এক চরম সংকোচন। জনগণ যখন কথা বলতে পারে না, তখন তাদের ক্ষোভ ধর্মীয় নেতাদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়।” ডেভিস মনে করেন, শাহ একদিকে ধর্মকে অবজ্ঞা করে আধুনিকতা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধিতাও দমন করেছিলেন। ফলে জনগণের সামনে বিকল্প কিছুই ছিল না—তারা আশ্রয় নেয় মসজিদে, মিম্বারে, মোল্লার ভাষণে।

শাহের আরেকটি বড় ভুল ছিল তার পাশ্চাত্যপ্রীতি। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। ইরানের তেল সম্পদের এক বড় অংশ তিনি পশ্চিমাদের হাতে তুলে দেন। এ কারণে অনেকেই তাকে "আমেরিকার পুতুল" বলে সম্বোধন করত। ইসলামপন্থী নেতারা বারবার বলতেন, ইরানের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি পশ্চিমাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

সব মিলিয়ে শাহের শাসন একদিকে যতই উন্নয়ন ও আধুনিকতার গল্প বলুক না কেন, বাস্তবতা ছিল—তা ছিল দমনমূলক, অসম, আত্মকেন্দ্রিক ও জনবিচ্ছিন্ন। তার প্রশাসনে সাধারণ মানুষ ছিলেন অবিশ্বাসে, ভয় আর হতাশায় পূর্ণ। যুবসমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, হয়ে ওঠে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ এক শ্রেণি। আর এই ছাত্র, ধর্মীয় নেতা, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির সম্মিলিত অসন্তোষ থেকেই জন্ম নেয় ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব।

সে বছর শাহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তার পতনের পর ইরানে গঠিত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র, আয়াতুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে। নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মীয় নীতির ওপর, যা এক ভিন্নধর্মী একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়—কিন্তু সেটি শাহের শাসনের প্রতিক্রিয়াতেই তৈরি।

এই ইতিহাস আমাদের শেখায়, আধুনিকতা যদি মানবিকতা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে না গড়ে ওঠে, তা হলে তা হয়ে ওঠে এক নিষ্ঠুর মোহ। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসন তাই একটি দ্বন্দ্বময় অধ্যায়—যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, উন্নয়ন ছিল, কিন্তু জনগণের কণ্ঠ ছিল রুদ্ধ, সংস্কার ছিল চাপিয়ে দেওয়া, আর শাসনের গভীরে ছিল ভয়, অবিশ্বাস ও নিঃসঙ্গতা। ইতিহাস এই অধ্যায়কে মনে রাখবে এক ‘উজ্জ্বল মুখোশে ঢাকা ছায়ার সময়’ হিসেবে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইসরাইলি হামলায় ২৪ ঘণ্টায় নিহত ১০০ ফিলিস্তিনি

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলি হামলায় একদিনে আরও ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।এসময়ে আহত হয়েছেন আরও ৪০০ জন। নিহতদের মধ্যে শিশু ও ক্ষুধার্ত ত্রাণপ্রার্থীরাও রয়েছেন। বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা আনাদোলু।

১৮ ঘণ্টা আগে

আয়াতুল্লাহ খামেনি যেভাবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে উঠলেন

বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় ইরানের শাসন পদ্ধতি বেশ আলাদা। সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বা সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হলেও দেশের মূল ক্ষমতা রয়েছে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার হাতে। তিন দশকেরও বেশী সময় ধরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হিসেবে রয়েছেন।

১৯ ঘণ্টা আগে

কিউবিয়ান বিপ্লব, ফিদেল কাস্ত্রো ও যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়

কিউবিয়ান বিপ্লব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিনের সামাজিক অবিচার, বৈষম্য ও বিদেশি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত ক্ষোভের ফল।

১ দিন আগে

যত যুদ্ধে হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে অসংখ্য যুদ্ধে জড়িয়েছে। কখনও তারা সরাসরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, আবার কখনও তৃতীয় কোন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে

১ দিন আগে