ইতিহাস

কেন হয়েছিল আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ?

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫, ১৯: ১২

বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ একটি গভীর, দীর্ঘ ও রক্তাক্ত দ্বন্দ্বের নাম, যার শিকড় শুধুমাত্র ধর্ম, ভূখণ্ড বা আধিপত্যে নয়—বরং মানুষের পরিচয়, শরণার্থী সমস্যা, ঔপনিবেশিক বিভাজন, এবং বৈশ্বিক শক্তির দ্বিমুখী ভূমিকার মধ্যেও লুকিয়ে আছে। এই যুদ্ধ শুধু দুটি পক্ষের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ নয়; এটি ছিল আরব জাতি ও ইহুদি জাতির শতাব্দী পুরনো জমি-দখলের প্রশ্নে বিরোধের বিস্ফোরণ। এই প্রবন্ধে আমরা সহজ ভাষায় জানার চেষ্টা করব—এই যুদ্ধগুলো কেন হয়েছিল, ইতিহাস কীভাবে এগিয়ে এসেছে, এবং বিশ্বের গবেষকরা কীভাবে এই সংকটকে দেখেন।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস শুরু হয় ১৯১৭ সালের বালফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে, যেখানে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ইহুদি জাতিকে প্যালেস্টাইন অঞ্চলে একটি “জাতিগত আবাসভূমি” গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন প্যালেস্টাইন ছিল ওসমানি সাম্রাজ্যের অংশ, যেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি মিলেমিশে বাস করত, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম আরবরা। ব্রিটিশরা ১৯১৮ সালে ওসমানিদের কাছ থেকে এলাকা দখল করে নেয় এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি শাসন করে।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়—একটা ইহুদিদের জন্য, অন্যটা আরবদের জন্য। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেও আরব নেতারা একে অবিচার মনে করে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রে তখনও বহু আরব মুসলিম বাস করছিলেন, এবং তাঁরা নিজেদের জন্মভূমি হারানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিলেন। ইসরায়েল যখন ১৪ মে ১৯৪৮ সালে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, পরদিনই মিশর, জর্দান, সিরিয়া, লেবানন ও ইরাক—এই পাঁচ আরব দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরু হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ।

এই যুদ্ধের ফলে ইসরায়েল কেবল জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুযায়ী প্রাপ্ত এলাকা নয়, বরং অতিরিক্ত ভূখণ্ডও দখল করে নেয়। প্রায় ৭ লাখ প্যালেস্টাইনি মুসলমান শরণার্থী হয়ে পড়ে—এই ঘটনাকে আরব বিশ্বে বলা হয় “আল নাকবা” বা “বিপর্যয়”। অনেকের মতে, এই শরণার্থী সমস্যাই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মূল আগুন। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ইউজিন রোজেনটাল বলেন, “ইসরায়েলের জন্ম যদি ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর ঘটনা হয়, তবে প্যালেস্টিনীয় শরণার্থী সমস্যাই সে ইতিহাসকে রক্তাক্ত করেছে।”

এরপর ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৮২ সালে একের পর এক আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। সবচেয়ে নাটকীয় যুদ্ধ ছিল ১৯৬৭ সালের “ছয় দিনের যুদ্ধ”। এই যুদ্ধে ইসরায়েল একসঙ্গে মিশর, সিরিয়া ও জর্দানের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং মাত্র ছয় দিনেই পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম, সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। এই যুদ্ধের পর ইসরায়েল আরব বিশ্বের চোখে একটি দখলদার শক্তিতে পরিণত হয়। ব্রিটেনের মিডল ইস্ট পলিসি স্পেশালিস্ট ড. প্যাট্রিক সিল লেখেন, “ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল শুধু যুদ্ধ জেতেনি, বরং আরবদের আত্মবিশ্বাসও চূর্ণ করে দিয়েছে।”

এই পরাজয়ের জবাবে আরব দেশগুলো ১৯৭৩ সালে “ইম কিপুর যুদ্ধ” বা “রমজান যুদ্ধ” শুরু করে। মিশর ও সিরিয়া একযোগে ইসরায়েলের ওপর হামলা চালায়। প্রাথমিকভাবে তারা কিছু সাফল্য পেলেও পরে ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণে যুদ্ধের পালা ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে শক্ত অবস্থানে নিয়ে আসে, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন আরব দেশগুলোকে সহায়তা করে। এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধাক্কা দেয় এবং তেল রপ্তানিকারক আরব দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

এই নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলে। তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়, এবং আরব দেশগুলো একসময় নিজেদের শক্তি বুঝে নেয়। কিন্তু প্যালেস্টাইনের সাধারণ মানুষের ভাগ্য তাতে বদলায়নি। মার্কিন গবেষক এবং প্যালেস্টাইন বিষয়ক বিশ্লেষক ড. রশেল কারম্যান তাঁর বই Palestine and Power Politics–এ লিখেছেন, “যুদ্ধ হয়েছে বহুবার, কিন্তু যাঁদের জন্য যুদ্ধ, সেই প্যালেস্টিনীয়রা রয়ে গেছে উদ্বাস্তু ও অধিকারহীন।”

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো জেরুজালেম শহর এবং পশ্চিম তীর। ইসরায়েল এই অঞ্চলগুলোতে বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে, যাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ অবৈধ মনে করে। জাতিসংঘের বহু প্রস্তাবে এসব দখলদারিকে অবৈধ বলা হলেও ইসরায়েল তা মানেনি। ফ্রান্সের রাজনৈতিক বিশ্লেষক লরাঁ বৌশার বলেন, “ইসরায়েলের দখলদারি নীতিই প্রতিনিয়ত সংঘাতের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।”

বর্তমানে আরব দেশগুলোর অবস্থান আগের মতো একতাবদ্ধ নয়। মিশর ১৯৭৯ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে, পরে জর্দানও তেমন চুক্তি করে। ২০২০ সালে আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় “আব্রাহাম চুক্তি”র মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা একে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করে। লেবাননের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. গ্যাব্রিয়েল খালাফ বলেন, “আরব বিশ্ব এখন আর আগের মতো ফিলিস্তিনের জন্য ঐক্যবদ্ধ নয়। এই বিভাজনই ইসরায়েলের শক্তিকে আরও নিরঙ্কুশ করে তুলেছে।”

তবে পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে। গাজা অঞ্চলে হামাসের উত্থান, ইসরায়েলি বিমান হামলা, হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু—এসব মিলিয়ে এই দ্বন্দ্ব আর শুধু ভূখণ্ডের নয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার গবেষক নোয়াম চমস্কি বলেন, “ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ এখন এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে, যেখানে অস্ত্র নয়—নৈতিকতাই বড় প্রশ্ন।”

সব মিলিয়ে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পেছনে আছে ইতিহাসের গভীর ক্ষত, ঔপনিবেশিক যুগের অসম নীতি, আধুনিক রাজনীতির চাতুর্য, এবং পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থনির্ভর ভূমিকা। এই দ্বন্দ্বে হারছে সাধারণ মানুষ—আর জয়ী হচ্ছে শুধু অস্ত্র ব্যবসা ও রাজনীতির খেলোয়াড়রা। শান্তির সম্ভাবনা এখনো দেখা যায়, তবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে প্যালেস্টাইনের মানুষ তাঁদের জন্মভূমিতে অধিকার ফিরে পাবেন, আর ইহুদিদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত থাকবে।

বিশ্ব ইতিহাসে বহু যুদ্ধের পর সমাধান এসেছে, শান্তিচুক্তি হয়েছে। কিন্তু আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ এক বিরল উদাহরণ—যেখানে যুদ্ধের চেয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠাই বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য শুধু রাষ্ট্র নয়—মানুষের বিবেকের জাগরণও জরুরি। আর সেই বিবেক জাগলেই হয়তো একদিন সূর্য উঠবে জেরুজালেমের আকাশে, যেখানে আর রক্ত নয়—আসবে শান্তির আলো।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইসরাইলের সংবাদমাধ্যম কার্যালয়ে হামলা চালাল ইরান

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) অধিকৃত হাইফা শহরে অবস্থিত ইসরাইলি চ্যানেল ১৪-এর লাইভ সম্প্রচারের সদরদপ্তরকে মিসাইল হামলার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু করেছে। শনিবার আল-জাজিরার খবরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

১৫ ঘণ্টা আগে

৬০ ঘণ্টা ধরে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ইরান

বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট অ্যাক্সেস থেকে ৬০ ঘণ্টা ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে ইরান। ইন্টারনেট সংযোগ পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান নেটব্লকস এ তথ্য জানিয়েছে। নেটব্লকস মনিটর অনুসারে, ইরান দীর্ঘ গত ৬০ ঘণ্টা ধরে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট অ্যাক্সেস থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। খবর আল-জাজিরার।

১৫ ঘণ্টা আগে

ইরাক-ইরান যুদ্ধ: কেন হয়েছিল এই ভয়াবহ সংঘাত?

সাদ্দাম হোসেন তখন চাচ্ছিলেন নিজেকে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি ভাবেন, সদ্য বিপ্লব-পরবর্তী অস্থির ইরান দুর্বল অবস্থায় আছে, এই সুযোগে আক্রমণ করলে হয়তো ইরানের কিছু এলাকা দখল করে নেওয়া যাবে এবং খোমেনি সরকারের পতন ঘটানো যাবে।

১ দিন আগে

সাজিল ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে কাজ করে?

ই ক্ষেপণাস্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর কঠিন জ্বালানিচালিত ইঞ্জিন। কঠিন জ্বালানি ব্যবহারে একাধিক সুবিধা রয়েছে। তরল জ্বালানির মতো আলাদা ট্যাঙ্ক বা ফিলিংয়ের ঝামেলা নেই।

১ দিন আগে