ইতিহাস

যেভাবে গঠিত হয় আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১৫: ০৩

আজকের বিশ্বের অন্যতম বিতর্কিত রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম হয়েছিল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে রয়েছে ইহুদি জাতির সহস্র বছরের বেদনার কাহিনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি, এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতির জটিলতা। তবে এই ইতিহাস শুধু একটি জাতির রাষ্ট্রপ্রাপ্তির গল্প নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনি জনগণের বাস্তুচ্যুতি, আরব বিশ্বের প্রতিবাদ এবং বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘোরানো বহু ঘটনা।

ইহুদিদের সঙ্গে পবিত্র ভূমির সম্পর্ক বহু পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব একাদশ শতকে তারা প্রাচীন ইসরাইল ও যিহুদা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইজান্টাইন, ইসলামিক খেলাফত, ক্রুসেডার, ওসমানি এবং অবশেষে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে যায় এই ভূখণ্ড। দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের মধ্যে একটি বিশ্বাস ছিল, একদিন তারা আবার ‘পবিত্র ভূমি’তে ফিরবে। এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নেয় এক রাজনৈতিক আন্দোলন—জায়নবাদ (Zionism)।

জায়নবাদের প্রবক্তা ছিলেন অস্ট্রিয়ান ইহুদি সাংবাদিক থিওডর হার্জল। ১৮৯৬ সালে তিনি লেখেন ‘দ্য জিউইশ স্টেট’ (ইহুদি রাষ্ট্র), যেখানে তিনি যুক্তি দেন, “ইহুদিদের জন্য নিরপেক্ষ ও স্থায়ী নিরাপত্তা তখনই সম্ভব, যদি তাদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্র থাকে।” ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে প্রথম জায়নিস্ট কংগ্রেস বসে, যেখানে সিদ্ধান্ত হয় একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে ঐতিহাসিক ইসরাইল-ভূমিতে, অর্থাৎ ফিলিস্তিনে।

ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে ‘ব্যালফোর ঘোষণা’ দেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর এক খোলা চিঠিতে বলেন, “সরকার ইহুদি জনগণের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে।” তবে এ চিঠিতে ফিলিস্তিনি আরবদের অধিকার সংরক্ষণের কথাও বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে বসবাস শুরু করে। এতে স্থানীয় আরব জনগণের মধ্যে ক্রমেই ক্ষোভ বাড়তে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হিটলারের নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। নাৎসি জার্মানির হাতে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি নিহত হয়, যাকে বলা হয় ‘হলোকাস্ট’। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসভূমির দাবি জোরালো হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো সায়নবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে।

ইতিহাসবিদ বেনি মরিস, যিনি আধুনিক ইসরাইলের জন্ম নিয়ে বহু গবেষণা করেছেন, লিখেছেন, “হলোকাস্ট ইহুদি জনগণের মনে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে দিয়েছিল, আর সায়নবাদীদের চোখে ইসরাইল রাষ্ট্র তখন শুধু আদর্শ নয়, জীবনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।” তিনি আরো বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ, এই পরিস্থিতিতে ইহুদিদের রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি খুঁজে পায়।”

১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করে, যাতে ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়—একটি ইহুদি রাষ্ট্র, আরেকটি আরব রাষ্ট্র হিসেবে। জেরুজালেম রাখা হয় আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে। ইহুদি নেতারা এই প্রস্তাব মেনে নেয়, কিন্তু আরব দেশগুলো ও ফিলিস্তিনি নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বক্তব্য ছিল, একটি জাতির আবাসভূমি অন্য একটি জাতির জমি দখল করে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে না।

এর পরের ঘটনাপ্রবাহ ছিল নাটকীয়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার একদিন আগে, ইহুদি নেতারা ডেভিড বেন গুরিওনের নেতৃত্বে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা করেন। পরদিনই মিসর, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক ও লেবানন মিলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। একে বলা হয় প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। ইসরাইল এই যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং জাতিসংঘ প্রস্তাবে নির্ধারিত এলাকা ছাড়াও অতিরিক্ত ভূখণ্ড দখল করে নেয়।

ইসরাইলের এই বিজয়ের পেছনে ছিল সামরিক প্রস্তুতি ও কৌশল, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল একটি বড় বাস্তবতা—প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি আরব উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। এ ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা বলেন ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়। তারা তাদের ঘরবাড়ি, জমি, গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। অনেকে বলছেন, ইসরাইল পরিকল্পিতভাবেই আরবদের বিতাড়িত করেছিল, আবার কেউ কেউ বলেন যুদ্ধের চাপে এ ঘটনা ঘটে।

ইসরাইলি ঐতিহাসিক ইলান পাপে, যিনি ‘নিউ হিস্টোরিয়ানস’ ধারার একজন, ২০০6 সালে প্রকাশিত ‘The Ethnic Cleansing of Palestine’ গ্রন্থে বলেন, “ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রাচীন ভূমিকে ‘পরিষ্কার’ করা প্রয়োজন ছিল, আর সে কারণেই আরবদের বিতাড়ন পরিকল্পিত ছিল।” তিনি এ ঘটনাকে জাতিগত নিধন বলেও আখ্যায়িত করেন।

এরপর থেকে ইসরাইল রাষ্ট্র ক্রমে আরও শক্তিশালী হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে ব্যাপক সহায়তা দিতে থাকে। আরব দেশগুলোর সঙ্গে পরপর কয়েকটি যুদ্ধ হয়—১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধ, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধ, ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপুর যুদ্ধ। প্রতিবারই ইসরাইল সামরিক বিজয় অর্জন করে এবং অধিকাংশ যুদ্ধেই ফিলিস্তিনি জনগণ মার খায়।

তবে ইসরাইলের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার বৈধতা ও নৈতিকতার প্রশ্ন আজও তীব্র বিতর্কের জন্ম দেয়। ব্রিটিশ গবেষক অ্যাভি শ্লাইম বলেন, “ইসরাইল তার প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই একটি ‘বেসামরিক ও সেনাশক্তির’ দ্বৈত চরিত্র ধারণ করে। এটি যেমন একটি ইহুদি স্বপ্নের বাস্তবায়ন, তেমনি আরেকটি জাতির দুঃস্বপ্নের শুরু।” তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের জন্ম তখনই টেকসই হয়, যখন তা সব সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করে, যা ইসরাইল করতে পারেনি।

অন্যদিকে মার্কিন ইতিহাসবিদ মাইকেল ওরেন, যিনি একসময় ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন, তাঁর ‘Six Days of War’ বইতে লিখেছেন, “ইসরাইল কোনো সাম্রাজ্যিক ষড়যন্ত্রে গঠিত হয়নি, বরং এটি ছিল ইহুদি জাতির হাজার বছরের স্বপ্নের বাস্তব রূপ। একে অস্বীকার করা মানে সেই ইতিহাসকেই অস্বীকার করা।”

বর্তমানে ইসরাইল একটি শক্তিশালী আধুনিক রাষ্ট্র। এটি মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। প্রযুক্তি, কৃষি ও সামরিক ক্ষেত্রে বিশ্বে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। তবে এর জন্মের ইতিহাস এবং ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশা আজও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত ইস্যু।

আধুনিক ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পেছনে যেমন রয়েছে ইহুদি জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম ও বেদনা, তেমনি রয়েছে আরব জনগণের বাস্তুচ্যুতি ও ক্ষোভ। এই ইতিহাস নিছক কোনো ভূখণ্ডের দখল নয়—এ এক জটিল মানবিক ট্র্যাজেডি, যেখানে এক জাতির স্বাধীনতা আরেক জাতির বেদনায় রূপ নিয়েছে। আর তাই, ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম শুধু ইতিহাস নয়, আজও জ্বলন্ত বাস্তবতা।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

সোমবার জরুরি বৈঠকে বসবেন আইএইএ

রবিবার ভোরে ইরানের ফরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান—তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে এ হামলা চালানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পরে ইরানও তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার বিষয় নিশ্চিত করে। সূত্র: আ

৬ ঘণ্টা আগে

ইরান-আমেরিকা দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলো যেভাবে

এই ঘটনা ইরানিদের মনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দীর্ঘস্থায়ী অবিশ্বাসের বীজ বপন করে। অনেক ইরানিই বিশ্বাস করতেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করেছে শুধুমাত্র তেলের নিয়ন্ত্রণের জন্য।

৬ ঘণ্টা আগে

ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

শনিবার রাতে চালানো মার্কিন হামলার জবাবে রোববার সকালে ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।ইরানের সর্বশেষ এ হামলার পর ইসরাইলে কমপক্ষে ১১ জন আহত হয়েছে এবং তাদের চিকিৎসা চলছে বলে জানিয়েছে ইসরাইল।

৮ ঘণ্টা আগে

ইরানে মার্কিন হামলায় জাতিসংঘের উদ্বেগ

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা বিশ্ব রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। সংঘাতের বিস্তার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এই হামলার সংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সও। একদিকে যখন হোয়াইট হাউস এ হামলাকে ‌‌‘সামরি

৯ ঘণ্টা আগে