ইতিহাস
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: ভারতবর্ষের উত্তাল সময়ের গল্প: পর্ব ১

ভারতের ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত আছে, যেগুলো পুরো উপমহাদেশের রাজনৈতিক চেহারা বদলে দিয়েছে। ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বরের পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ ঠিক তেমনই এক মোড়—যেখানে মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ ঝুলে ছিল এক তরুণ ছেলের ভাগ্যের উপর, আর প্রতিপক্ষ ছিল এক সাধারণ বণিক পরিবারের সন্তান, যিনি নিজের পরিশ্রমে হয়ে উঠেছিলেন এক পরাক্রান্ত সেনাপতি। এ যুদ্ধ শুধু দুই সেনার সংঘর্ষ নয়, এটি এক ঐতিহাসিক উত্তরণ—গুরত্বপূর্ণ এক সময় যখন হিন্দু-মুসলমান, মুঘল-সূরিদের রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার ভারসাম্য এক নতুন রূপ নিতে চলেছিল।
এই যুদ্ধে একদিকে ছিলেন আকবর—মাত্র তেরো বছর বয়সী এক কিশোর, যার রাজ্যাভিষেক হয়েছে অস্থির পাঞ্জাবের কালানৌরে। আর অন্যদিকে ছিলেন হেমচন্দ্র, যিনি ইতিহাসে হেমু নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন সূরি সাম্রাজ্যের সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রী, যিনি তাঁর ক্ষমতা ও সাহসিকতায় একের পর এক জয় ছিনিয়ে এনে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন।
হেমুর জীবনগাথা যেন এক অলৌকিক উত্থান। তাঁর জন্ম হয়েছিল বিহারের এক সাধারণ হিন্দু বৈশ্য পরিবারে। প্রথম জীবনে তিনি চাল, ঘি, লবণ ইত্যাদি বিক্রি করতেন, পরে দিল্লিতে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর সামরিক প্রতিভা প্রথম চিহ্নিত হয় শের শাহ সূরির মৃত্যুর পরে সূরি সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সময়। দ্রুত একের পর এক বিদ্রোহ দমন করে তিনি আদিল শাহ সূরির প্রধান সেনাপতি এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠেন। ইতিহাসবিদ আব্রাহাম আর. এর্লি লেখেন— ‘হেমচন্দ্র সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় এই অবস্থানে উঠেছিলেন, জন্মসূত্র কিংবা কোনোরকম সুবিধাজনক পরিবারিক পরিচয় তাঁর ছিল না।’
হেমু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ২২টি যুদ্ধ জয় করেন, যার মধ্যে গৌড়, আগ্রা, কনৌজ, ও দিল্লির মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর রয়েছে। এই বিজয়সমূহ তাঁর জনপ্রিয়তা ও আত্মবিশ্বাস এতটাই বাড়িয়ে তোলে যে ১৫৫৬ সালে দিল্লি জয় করার পর তিনি নিজেকে "বিক্রমাদিত্য" উপাধিতে সজ্জিত করে রাজ্যাভিষিক্ত হন। এই ঘোষণার তাৎপর্য ছিল গভীর—তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল একটি স্বাধীন হিন্দু রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা।
অন্যদিকে, আকবর তখন কেবলমাত্র সিংহাসনে বসেছেন তাঁর পিতা হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর পর। হুমায়ুন দীর্ঘ নির্বাসনের পর যখন কাবুল থেকে ফিরে দিল্লি জয় করেন, তাঁর রাজত্ব খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আকবর তখনও অভিজ্ঞ নন, সেনা পরিচালনায় দূরদর্শিতা তাঁর নেই, কিন্তু তাঁর পাশে ছিলেন অভিভাবক ও তৎকালীন মুঘল সেনার সর্বাধিনায়ক বায়রাম খাঁ—একজন প্রবীণ ও নিষ্ঠাবান তুর্কি সেনাপতি।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ স্যার জ্যাডুনাথ সরকার বলেন, ‘বায়রাম খাঁ ছিলেন তরুণ সম্রাটের সিংহাসনের এক অদৃশ্য ঢাল, যিনি তাঁকে রক্ষা করেছিলেন চারদিক থেকে আসা বিপদের মুখে।’
হেমুর দিল্লি জয় আকবরের রাজত্বকে এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। হেমুর পরবর্তী লক্ষ্য ছিল পাঞ্জাব—অর্থাৎ আকবর যেখানে অবস্থান করছিলেন। বায়রাম খাঁ বুঝতে পারেন, এই মুহূর্তে একটিই পথ খোলা—সামরিক সংঘর্ষ। তিনি দ্রুত সেনাবাহিনী জড়ো করতে শুরু করেন, কাবুল থেকে পাঠানো সৈন্যদল ও তুর্কি-উজবেক ঘোড়সওয়ারদের যুক্ত করেন সেনাদলে।
এই প্রেক্ষাপটে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্মিথ বলেন—‘এই যুদ্ধ কেবল সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ ছিল না, এটি ছিল ভাগ্যের এক নিখুঁত পরখ।’
এই যুদ্ধের প্রাক্কালে উভয় পক্ষের প্রস্তুতি, কৌশল, এবং ক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে পরবর্তী অংশে। সেখানে থাকবে যুদ্ধদিনের ঘটনা, হেমুর পতনের নাটকীয় মুহূর্ত এবং যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি।
আকবর তখন সদ্যসম্রাট—বয়স মাত্র তেরো। মুঘলদের ভিত তখনও কাঁচা, মুঘল সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তি গড়তে তখন বহু যুদ্ধ বাকি। তার পিতা হুমায়ুন অল্প কিছুদিন আগেই দিল্লির সিংহাসন ফিরে পেয়েছেন, কিন্তু তার আকস্মিক মৃত্যু মুঘল দরবারকে নাড়িয়ে দেয়। সেই অস্থির সময়ে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত অভিভাবক বায়রাম খাঁর হাতে, যিনি ছিলেন এক সুদক্ষ তুর্কি-মুসলিম সেনাপতি ও হুমায়ুনের বিশ্বস্ত অনুগামী। তাঁর নেতৃত্বেই আকবরকে রাজ্যাভিষেক দেওয়া হয় পাঞ্জাবের কালানৌরে।
অন্যদিকে, হেমচন্দ্র বা হেমু তখন আফগান শাসক আদিল শাহ সূরির প্রধান সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রী। মূলত একটি সাধারণ বৈশ্য পরিবারে জন্ম হেমুর, তাঁর জীবনের শুরু ঘরোয়া পণ্যের দোকানে। কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও সংগঠনী দক্ষতার জোরে তিনি সেনাপতি হিসেবে অচিরেই পরিচিত হন। শের শাহ সূরির মৃত্যুর পরে সূরি সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, এই সুযোগে হেমু একের পর এক রাজ্য জয় করতে থাকেন এবং সর্বশেষ দিল্লি দখল করেন। সেখানেই তিনি নিজেকে ঘোষণা করেন ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধিতে সজ্জিত একজন স্বাধীন হিন্দু সম্রাট হিসেবে—অনেকের চোখে ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনাপ্রবাহ।
চলবে...