ইতিহাস

সুয়েজ যুদ্ধ কেন হয়েছিল?

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১৫: ৫৫

১৯৫৬ সালের শেষভাগে মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে গেল এক ভয়ংকর সংঘাত, যার ঢেউ কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। এই যুদ্ধ শুধু মিশর, ব্রিটেন, ফ্রান্স আর ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক লড়াই ছিল না, ছিল তা এক নতুন যুগের সূচনার সংকেত—যেখানে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষসূত্র রচনা হচ্ছিল, আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ক্রমে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছিল নিজেদের অধিকার আদায়ে। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এই লড়াইটি পরিচিত ‘সুয়েজ যুদ্ধ’ বা ‘সুয়েজ সংকট’ নামে।

এই যুদ্ধের মূল কেন্দ্রে ছিল একটি জলপথ—সুয়েজ খাল। ভূমধ্যসাগর আর লোহিত সাগরকে যুক্তকারী এই খালটি একসময় ব্রিটিশ-ফরাসি কোম্পানির মালিকানায় ছিল। কিন্তু ১৯৫৬ সালের ২৬ জুলাই, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের ঘোষণা দিলেন, সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণার পেছনে ছিল দুইটি বড় উদ্দেশ্য। প্রথমত, ব্রিটেন-ফ্রান্সের পুরনো ঔপনিবেশিক আধিপত্যের অবসান ঘটানো, এবং দ্বিতীয়ত, এই খাল থেকে আয় করা অর্থ ব্যবহার করে নাসের তাঁর স্বপ্নের ‘আসওয়ান বাঁধ’ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।

এই ঘোষণার পর পশ্চিমা বিশ্বে যেন আগুন ধরে গেল। ব্রিটেন ও ফ্রান্স মনে করল, তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে আঘাত এসেছে। আর ইসরায়েল, যে তখন মিশরের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিল, এই সুযোগকে ব্যবহার করতে চাইল মিশরকে দুর্বল করে দিতে। এই তিন দেশ গোপনে এক পরিকল্পনা নেয়, যাকে ইতিহাসে বলা হয় ‘সেভ্র চুক্তি’। এই গোপন চুক্তির আওতায় ইসরায়েল প্রথমে সিনাই উপদ্বীপে হামলা চালাবে, পরে ব্রিটেন-ফ্রান্স ‘শান্তি রক্ষার’ অজুহাতে মিশরের খাল এলাকায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবে।

১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবর ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপে অভিযান চালায়। মিশর প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী বিমান ও নৌ-আক্রমণ শুরু করে। সুয়েজ খাল দখল নিতে শুরু করে তারা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই আক্রমণের সময় মিশরীয় সেনারা যেমন সাহসিকতা দেখায়, তেমনি বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষও নাসেরের পক্ষে রাস্তায় নেমে আসে।

এই সময় বিশ্বপরিস্থিতিও অদ্ভুত এক বাঁকে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্র, যাকে সাধারণত ব্রিটেন-ফ্রান্সের মিত্র ভাবা হয়, তারাই এই আগ্রাসনের বিরোধিতা করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার স্পষ্টভাবে বলেন, “ঔপনিবেশিক যুগ শেষ হয়ে গেছে। এখন স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর সম্মান রক্ষা করতে হবে।” সোভিয়েত ইউনিয়নও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানায়, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকিও দেয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইসরায়েলের অবস্থান নৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে।

ইতিহাসবিদ আভা গ্রীনস্টেইন, যিনি ‘ইম্পিরিয়াল রিট্রিট: দ্য সুয়েজ ক্রাইসিস’ বইয়ের লেখক, লিখেছেন, “এই যুদ্ধ ছিল এক ধরনের ‘শেষের শুরু’। ব্রিটেন ও ফ্রান্স বুঝতে পারল, তারা আর আগের মতো বিশ্বরাজনীতির চালক নয়। তাদের জায়গা নিচ্ছে নতুন শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।” গ্রীনস্টেইনের মতে, এই যুদ্ধ পশ্চিমা আধিপত্যের শেষ নিঃশ্বাসগুলোর অন্যতম ছিল।

অন্যদিকে, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রজার ওয়াটসন বলেন, “নাসেরের মতো একজন তৃতীয় বিশ্বের নেতা যদি এত বড় তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করতে পারেন, তা শুধু সামরিক নয়—রাজনৈতিকভাবেও ঐতিহাসিক উদাহরণ হয়ে থাকবে।” তিনি আরও বলেন, “সুয়েজ যুদ্ধ ছিল আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। এটি আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।”

যুদ্ধ শেষে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয়। শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী খাল এলাকার দখল নেয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করতে হয়, এবং ইসরায়েলও সিনাই থেকে সরে আসে। মিশর খালটির নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়, যা নাসেরকে পুরো আরব দুনিয়ায় এক মহানায়কে পরিণত করে। তিনি হয়ে ওঠেন আরব জাতীয়তাবাদের মুখ।

এই যুদ্ধে যদিও সামরিকভাবে ব্রিটেন-ফ্রান্স-ইসরায়েল এগিয়ে ছিল, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয় তাদের জন্য ছিল বড় ধাক্কা। অনেক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক যেমন এন্ড্রু রবার্টস বা ম্যাথিউ হিউজ বলেন, এই যুদ্ধ ব্রিটেনের জন্য ‘সুপারপাওয়ার’ মর্যাদার অবসান টেনে আনে। হিউজ লেখেন, “এটি ছিল সেই মুহূর্ত, যখন ব্রিটেন তার প্রাক্তন ঔপনিবেশিক দাপটের ছায়া থেকে বের হয়ে এল—চোখে চোখে দেখতে লাগল বাস্তবতা।”

ফ্রান্সের ক্ষেত্রেও একই সত্য প্রযোজ্য। তাদের ঔপনিবেশিক স্বপ্ন বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায়, এই যুদ্ধে বড় ধাক্কা খায়। যুদ্ধের ঠিক পরপরই আলজেরিয়ায় স্বাধীনতা যুদ্ধ তীব্র হয়। মিশরের বিজয় সারা আরববিশ্বে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেয়।

ইসরায়েল সাময়িকভাবে লাভবান হলেও যুদ্ধের পর নতুন করে তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। কারণ আন্তর্জাতিক মহলে তার একতরফা আক্রমণের সমালোচনা হয়। এ ছাড়া আরব দুনিয়ায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জনমত আরও তীব্র হয়।

সবশেষে বলা যায়, সুয়েজ যুদ্ধ ছিল একটি বাঁকবদলের অধ্যায়। এটি একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক শক্তির পতনের প্রতীক, অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের আত্মবিশ্বাসের উত্থানের সংকেত। এ যুদ্ধ বুঝিয়ে দেয়, শক্তিশালী বলে কাউকে সবসময় ঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। কখনও কখনও ইতিহাস গড়ে উঠে দুর্বল বলে মনে হওয়া জাতির সাহসিকতায়, কূটনৈতিক প্রজ্ঞায় আর জনগণের ঐক্যে।

সুয়েজ যুদ্ধ তাই শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়—এটি এক আত্মপরিচয়ের যুদ্ধ, এক মর্যাদার দাবি, যার প্রতিধ্বনি এখনো শোনা যায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে, যেখানে জাতিরা তাদের ভূমি, সম্পদ আর স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হরমুজ প্রণালী ইরানের কৌশলগত অস্ত্র

ইরান এই প্রণালীর উত্তর তীরে অবস্থিত। এর দক্ষিণ তীরে রয়েছে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ মাত্র ২১ মাইল প্রশস্ত, যার মধ্যে দুটো পৃথক শিপিং লেন রয়েছে

৬ ঘণ্টা আগে

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কতটা ক্ষতি হয়েছে জানালেন ট্রাম্প

৬ ঘণ্টা আগে

হরমুজ প্রণালি খোলা রাখতে চীনের হস্তক্ষেপ চাইল যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, তাহলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পুরো বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় চীনের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৭ ঘণ্টা আগে

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো

মার্কিন হামলার পর থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল যে, তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় বাজারে তেলের দাম বাড়বে।এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হরমুজ প্রণালি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। তবে এই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত

৮ ঘণ্টা আগে