ইতিহাস

কাশ্মীর: ভারত, পাকিস্তান ও চীনের দখলের ইতিহাস​

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ২২: ২০
ভারত, পাকিস্তান ও চিন : তিন দখলদারে পিষ্ট ভূস্বর্গ কাশ্মির

কাশ্মীর উপত্যকা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জটিল ও বিতর্কিত অঞ্চলগুলোর একটি। ভারত, পাকিস্তান এবং চীন—এই তিনটি দেশই কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যা বহু দশক ধরে রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু।

কাশ্মীরের বিভাজনের সূচনা: ১৯৪৭ সালের দেশভাগ

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের সময়, জম্মু ও কাশ্মীর একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। রাজ্যটির হিন্দু মহারাজা হরি সিং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজাদের শাসন করতেন। পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতীয় বাহিনীর আক্রমণের মুখে, মহারাজা ভারতের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করেন। এর ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয় এবং কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যা আজ "আজাদ কাশ্মীর" ও "গিলগিট-বালতিস্তান" নামে পরিচিত।​

চীনের আগমন: আকসাই চিন ও ১৯৬২ সালের যুদ্ধ

কাশ্মীরের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত আকসাই চিন অঞ্চলটি ঐতিহাসিকভাবে ভারতের লাদাখ অঞ্চলের অংশ হিসেবে বিবেচিত। তবে চীন এই অঞ্চলকে তাদের শিনজিয়াং প্রদেশের অংশ দাবি করে। ১৯৫৭ সালে চীন আকসাই চিনে একটি রাস্তা নির্মাণ করে, যা ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যায়। এই ঘটনার পর ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। তখনে চীন আকসাই চিনসহ বেশ কিছু এলাকা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধের ফলে চীন বর্তমানে আকসাই চিন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু সেই অংশটি ভারতের মানচিত্রে এখনো অন্তর্ভুক্ত আছে।​

১৯৬৩ সালের চীন-পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি

১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ও চীন একটি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর মাধ্যমে পাকিস্তান গিলগিট-বালতিস্তানের একটি অংশ চীনের কাছে হস্তান্তর করে। এই অঞ্চলটি "শাকসগাম ভ্যালি" নামে পরিচিত। ভারত এই চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করে, কারণ এটি ভারতের দাবি করা ভূখণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে।​

১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান কাশ্মীরের ভারতীয় অংশে "অপারেশন জিব্রালটার" চালায়, যার ফলে দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের পর তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে উভয় দেশ কাশ্মীর সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়।​

২০১৯ সালের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ও বর্তমান পরিস্থিতি

২০১৯ সালে ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে, যা জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করত। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়: জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। এই পদক্ষেপ পাকিস্তান ও চীনের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। চীন এই পদক্ষেপকে তাদের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করে।​

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে কাশ্মীর সমস্যা

মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস (MP-IDSA)-এর সহযোগী ফেলো ড. প্রিয়াঙ্কা সিং চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক ও কাশ্মীর বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, চীন ও পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যুকে তাদের কৌশলগত স্বার্থে ব্যবহার করে, বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) প্রকল্পের মাধ্যমে। এই প্রকল্পটি পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যায়, যা ভারতের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।​

কাশ্মীরের বর্তমান বিভাজন ইতিহাস, ভূরাজনীতি ও কৌশলগত স্বার্থের জটিল সমন্বয়ের ফল। ভারত, পাকিস্তান ও চীন—তিনটি দেশের মধ্যে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র কূটনৈতিক সংলাপ, পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্ভব।​

সূত্র:

  1. "Kashmir: A disputed region in focus after deadly militant attack", Reuters, April 23, 2025.​ reuters.com
  2. "Sino-Pakistan Agreement", Wikipedia.​
  3. "Sino-Indian War", Wikipedia.
ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের বন্দরে নিহত ৭

কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী ইউক্রেনের ওডেসা বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে অভিযানরত রুশ বাহিনী। এতে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরও কমপক্ষে ১৫ জন।

১ দিন আগে

যুক্তরাষ্ট্রে বিমান দুর্ঘটনায় ক্রীড়া তারকাসহ নিহত ৭

আন্তর্জাতিক উড়োজাহাজ ট্র্যাাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটঅ্যাওয়ারের বরাতে জানা গেছে, বিমানটি ছিল একটি সেসনা ৫৫০ বিজনেস জেট উড়োজাহাজ। উড়োজাহাজটি গ্রেগ বিফেলের নামে নিবন্ধিত ছিল। অর্থাৎ বিফেল ছিলেন এটির মালিক। বৃহস্পতিবার সকালে দিকে নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহর নর্থ ক্যারোলাইনার বিমানবন্দর থেকে ফ্লোর

২ দিন আগে

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শহিদ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর

কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা তাদের শিরোনাম করেছে বাংলাদেশের ছাত্র বিক্ষোভের নেতার সিঙ্গাপুর হাসপাতালে মৃত্যু। প্রতিবেদনে বলা হয়, চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এতে আরো বলা হয়, তার মৃত্যুতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষুব্ধ সমর্থকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

২ দিন আগে

প্রবল বৃষ্টিতে দুর্ভোগ বেড়েছে গাজায়, ভবন ধসে ১১ প্রাণহানি

জাতিসংঘ ও সহযোগীরা অনুমান করছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজার পরিবার বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের আশ্রয় ও জিনিসপত্র নষ্ট বা ধ্বংস হয়েছে। সোম ও মঙ্গলবারের বৃষ্টির পর ৪০টিরও বেশি নির্ধারিত জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র মারাত্মকভাবে প্লাবিত হয়েছে, ফলে অনেক মানুষকে আবারও স্থানান্তরিত হতে হয়েছে।

৩ দিন আগে