স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৪, ০০: ১৫
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

একথা অনস্বীকার্য যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালিদের জন্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। সেদিন তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পরবর্তীতে তিনি সর্বজনের জন্যে কোনো ঘোষণা দিতে পারবেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তিনি পরবর্তীতে ২৬ শে মার্চ বিভিন্ন প্রহরে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর জন্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার এই ঘোষণার ভিত্তিতে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি করে। তার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং এই ঘোষণার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয়।

তারপরও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কিছু দিন পরপরই একান্তই রাজনৈতিক কারণে বিতর্কের সূচনা হয়ে তা এখনও অব্যাহত আছে। এমনি একটি বিতর্কের সূচনা করেছিলেন তাজউদ্দিনকন্যা শারমিন আহমেদ। আমার ধারণা তার বিতর্কে হিতে বিপরীত হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কন্যা, শারমিন আহমদ ‘তাজউদ্দিন আহমদ, নেতা ও পিতা’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। ঐতিহ্য ২০১৪ সালে বইটা প্রকাশ করার পর তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বইটির একাংশে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গ টেনে শুরুতেই উপসংহার টেনেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতার কোনো ঘোষণা দেননি। তবে ২৬ শে মার্চ যে ঘোষণাটি বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয়েছিল তা তাজউদ্দিন আহমদ প্রণীত এবং হয়তো তারই কোন ছাত্র, শুভাকাঙ্ক্ষী ও অনুসারী তা গণমাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে তুলে ধরেছেন (পৃ. ৫৯-৬০)।

বইটির ৭১ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন যে, ‘রেডিওর চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সর্বপ্রথম এই ঘোষণাটি পাঠ করেন। তারপর অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ট্রান্স-মিটারের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তিনিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষ থেকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’ তবে জিয়াউর রহমান কত নম্বর ঘোষক সে কথা অবশ্য বলেননি।

বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায় যে, তিনি ৫ম, ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম ঘোষক। এই সংখ্যা বিভ্রান্তির মূল কারণ হচ্ছে সবার আগে নাকি মাইকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা রিকশাযোগে প্রচার করেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অফিস সহকারী নূরুল হক (ড. হাসান মাহমুদ, গণমাধ্যম ৮ই মার্চ, ২০২১)। তার সাথে যদি আকাশ বাণীর কথা যুক্ত করি বা ৩রা মার্চ, ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির প্রস্তাব যোগ করি তাহলে জিয়ার ক্রম বদলে যাবে। এখন যদি আরও পেছনে যাই তাহলে জিয়ার ক্রম কি ঠিক রাখাই কঠিন হয়ে যাবে?

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি জাতীয় কথাগুলো শারমিন, মইদুল হাসানকে উদ্ধৃত করে বলেছেন ঠিকই কিন্তু নিজের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ভিন্ন উপসংহার টেনেছেন। শারমিনের এই বক্তব্য নিয়ে বেশ ক’জন সহমতও পোষণ করেছেন। আমার ধারণা তারা কেউই শারমিনের গ্রন্থটি পুরো না পড়েই মন্তব্য দিয়েছিলেন। কেউ কেউ অবশ্য পুরো বইটি পড়ে শারমিনকে বাহবা না দিলেও শারমিনকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি ‘পূর্বাপর’ সংগতি বিহীন। ওইসব কারণে কি না জানি না অন্তত এটুকু জানি যে এ ব্যাপারে খালেদা জিয়ার একটি মন্তব্যের পরই শারমিন তার বইয়ের প্রাসঙ্গিক অধ্যায় নিয়ে জনসম্মুখে হাজির হয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার জামালপুরের ভাষণের প্রসঙ্গে শারমিনের নিজস্ব বক্তব্য নিম্নরুপ:

‘বিএনপির সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামালপুরের জনসভায় (২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪) ‘তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইটি থেকে আমার লেখার উদ্বৃতি (৫৯-৬০ পৃষ্ঠা) দিয়ে বলেছেন যে তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে এনেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেননি। তিনি সচেষ্ট থাকেন এ কথা প্রমাণ করতে যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। বক্তব্যে তিনি অনুল্লেখিত রাখেন আমার বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোর উল্লেখিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাকি অংশগুলোর বর্ণনা। বঙ্গবন্ধু আমার বাবা বা দলকে জানিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও তিনি যে ভিন্ন মাধ্যমে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা তথ্য ও সাক্ষাৎকারসহ আমার বইয়ে স্পষ্ট উল্লেখিত।’ (তাজউদ্দিন আহমদ: নেতা ও পিতা ১৪৭-১৪৮, ২৭৪-২৯১, ৩০১-৩১০ পৃষ্ঠা)।

বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তার একমাত্র জীবিত সাক্ষী, বঙ্গবন্ধুর পারসোনাল এইড হাজি গোলাম মোরশেদ, যিনি ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩২ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার হন, তাঁর ও প্রকৌশলী শহীদ নূরুল হক, যিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা থেকে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন ঘোষণা দেওয়ার জন্য, তাঁর স্ত্রীর সাক্ষাৎকার আমার বইয়ে ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে। হাজি গোলাম মোরশেদের সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তথ্যটি আমার জানামতে আমার বইতেই প্রথম উল্লেখ হয়। বইয়ে আরও উল্লেখিত যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ২৬ মার্চ দুপুরে এবং সেই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (১৪৭ পৃষ্ঠা) এবং ২৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে পরবর্তী ঘোষণা দেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান (৭১ ও ১৪৭ পৃষ্ঠা)।

আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, যা বইয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামের সাক্ষাৎকারে উদ্বৃত হয়েছে, তা হলো,’..... অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অতএব, ওইদিন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হবে।’’ (২৭১ পৃষ্ঠা) (প্রথম আলো ১৩/১০/২০১৪) ।

এরপর কি বলা যায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি? এ কথা থেকে এটাও উদঘাটিত হওয়া স্বাভাবিক যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার তিনটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমটি ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে, দ্বিতীয়টি সুবেদার মেজর শওকত আলীর মাধ্যমে এবং তৃতীয়টি পুলিশের ওয়ারলেসের মাধ্যমে।

ঘোষণাগুলো নিম্নরুপ: ‘THIS MAY BE MY LAST CALL. FROM TODAY BANGLADESH IS INDEPENDENT. I CALL UPON THE PEOPLE OF BANGLADESH WHEREVER YOU MIGHT BE AND WITH WHATEVER YOU HAVE, TO RESIST THE ARMY OF OCCUPATION TO THE LAST. YOUR FIGHT MUST GO ON UNTIL THE LAST SOLDIER OF THE PAKISTAN OCCUPATION ARMY IS EXPELLED FORM THE SOIL OF BANGLADESH AND FINAL VICTORY IS ACHIEVED.’ এই ঘোষণাটি রাত ১০.৩০ মিনিটের আগেই ইথারে চলে যায়।

দ্বিতীয় ঘোষণাটি নিম্নরুপ: ‘Message to the People of Bangladesh and the people of the world. Rajarbagh Police Camp and Peelkhana EPR suddenly attacked by Pak Army at 24:00 hours. Thousands of people killed. Fierce fighting going on. Appeal to the world for help in freedom struggle. Resist by all means. May Allah be with you. Joy Bangla.’

তার তৃতীয় ঘোষণাটি ছিলো: ‘The enemy has sruck us. Hit them back. Victory is ours. Insa Allah, Joy Bangla, Mujibur Rahman.’

তিনটি ঘোষণা দিয়েছেন একই ব্যক্তি, একই স্থান থেকে একই দিনের বিভিন্ন প্রহরে। তাহলে এখানে যে অন্যের কোনো অংশীদারিত্ব নেই বা বাইরের কেউ জড়িত নেই তা স্পষ্ট। এর ভিত্তিতে ১৭ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটির রচয়িতা আমিরুল ইসলাম। এ ব্যাপারে তাজউদ্দিন আহমদ, রেহমান সোবহান ও সুব্রত রায় চৌধুরীর কিছুটা অংশীদারিত্ব রয়েছে। তবে এই ঘোষণাপত্রের মূল মালিক বা গ্রন্থস্বত্ব বা উৎস হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং দেশের সকল অঞ্চল থেকে হাজারো ঘোষণা পঠিত হলেও তার মূল প্রণেতা, প্রকাশক ও প্রবক্তা হচ্ছেন আইনত কার্যত ওবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

একথা অস্বীকার করলে আমাদের দেশে কোনো স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়নি, কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, দেশ স্বাধীন হয়নি। এসবই হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষণাপত্র রয়ে গেছে। মুজিবনগরে গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি নিম্নরুপ:

মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র

মুজিবনগর, বাংলাদেশ, ১৭ই এপ্রিল ’৭১

যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ’৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনার অভিপ্রায়ে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্যে বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল;

এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৬৭ জনই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত করেছিলেন। এবং যেহেতু জেনারের ইয়াহিয়া খান একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্যে ’৭১ সনের ৩রা মার্চ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন;

এবং যেহেতু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুতি পালনের পরিবর্তে বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলাকালে একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে;

যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্যে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান;

এবং যেহেতু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একত্র হয়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ও নিজেদের সরকার গঠন করতে সুযোগ করে দিয়েছে এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কর্যক্রমের দ্বারা বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডের ওপর তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন;

যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং এতদ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি;

এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রেও রাষ্ট্রপ্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হবেন;

রাষ্ট্রপ্রধানই ক্ষমা প্রদর্শনসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী ও প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নিয়োগ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপ্রধানের কর ধার্য ও অর্থ ব্যয়ের এবং গণ-পরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবির ক্ষমতা থাকবে এবং বাংলাদেশের জন্যে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে অন্যান্য সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন;

বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি, যেকোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন; আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের স্বাধীনতার এ ঘোষণা ’৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে; আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্যে আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ক্ষমতা দিলাম; এবং রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করলাম।”

যেকোনো পাঠক এই ঘোষণাপত্র আগ্রহ নিয়ে পড়লে বুঝতে পারবেন যে স্বাধীনতার প্রেক্ষিত, প্রেক্ষাপট কী, স্বাধীনতার ঘোষক কে? তদুপরি মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে কিভাবে সংগঠিত করে যৌক্তিক পরিনতিতে পৌঁছানো হয়েছিল তাও এই ঘোষণা থেকে জানা সম্ভব।

১৭ এপ্রিলের স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র সংবিধানের ৪র্থ তফসিলের ৩য় অনুচ্ছেদেও অঙ্গীভূত করা হয়েছে যা পঞ্চম সংশোধনীর পরও অবিকৃত রয়েছে যেখানে উপক্রমনিকায় বলা হচ্ছে ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ করিয়াছি।’ স্পষ্ট মনে হবে সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষক কেবল একজন ব্যক্তি নন বরং আমরা, বাংলাদেশের জনগণ। আবার ঘোষণার তারিখ অন্য কোনো দিন না, ২৬ মার্চ ১৯৭১ সাল।

লক্ষণীয় যে বিষয় হলো, ‘আমরা’ শব্দটি; তারপর এসেছে বাংলাদেশের জনগণ। এই জনগণ কী করেছে, এই জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করল এবং যেদিন থেকে আমরা স্বাধীনতা ও আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করলাম সেদিনটি ২৬ মার্চ ছাড়া অন্য কোনো দিন নয়।

এই সংবিধান রচিত হয়েছে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ দ্বারা যা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে ৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ সালে। সংবিধানটি স্বাধীনতার আকর দলিল স্বাধীনতার ঘোষণা বা Proclamation of Independence ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যা মুজিব নগরে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ঘোষিত হয়েছে এবং যাতে কেবল ঘোষণা নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি ও স্বাধীনতা ঘোষণার আদি পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বলা হয়েছে।

এই ঘোষণার পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তা করা হয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে এবং বাংলাদেশে জনগণের জন্য সমতা, মানবমর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে। আরও বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক নীতি ও আইন অনুসারে। স্বাধীনতার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় একজনের নাম আসে তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত জননেতা।

প্রক্রিয়াটি এমন যে অন্য কোনো ব্যক্তি বা নেতার নাম আসতে পারে না এবং স্বাভাবিকভাবে আসেনি। এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম স্বাধীনতার ঘোষণা দাতা রূপে বহু কাটা ছেঁড়ার পরও সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়ে আছে। এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে ও তার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান সকলের কর্তব্য। একই কারণে এসবের যেকোনো জাতীয় লঙ্ঘন পেনাল কোর্ট ১২৩ এ ও সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক দণ্ডনীয় অপরাধ।

এই ঘোষণার বিরাট বিস্তার ও পটভূমি বিবেচনায় নিয়ে এবং বিশেষত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে এ স্বাধীনতার ঘোষণা বা ডাক। এই ডাক শুধু একজনই দিতে পারেন এবং এক ডাক দেবার পেছনে ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব একজন ব্যক্তিরই ছিল যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ঘোষণা তৈরি ও ১৭ এপ্রিল এই ঘোষণা প্রকাশ্যে পঠিত হলেও তা ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সাল থেকে কার্যকরী করা হয়েছে বলে গণ্য হয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধু নিজে এই ঘোষণা প্রত্যাহার করেননি এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ এই ব্যক্তি ও ঘোষণা ব্যতিরেকে অন্য কোন ব্যক্তি বা ঘোষণার অনুমোদন দেয়নি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষণাপত্র ঘোষিত হয়েছে মুজিব নগরে। তবুও ঘোষণার স্থান একমাত্র ঢাকা ছাড়া অন্য কোন জায়গা নয়। সর্বাধিক সংখ্যকবার পঠিত এই ঘোষণার স্থান চট্টগ্রাম হলেও স্বাধীনতার ঘোষণায় আইনত চট্টগ্রামের কোনো স্থান নেই।

চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাই দেখা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানে আক্ষরিক অর্থে স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হচ্ছেন ফাউন্ডিং ফাদারদের নেতা। এই ফাউন্ডিং ফাদারগণ বা প্রতিষ্ঠাতা জনগণ, সার্বভৌম জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আবার এই প্রতিষ্ঠাতা জনকবৃন্দের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে তিনি নির্বাচিত সদস্যদের সংসদীয়নেতা এবং ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যত তিনি প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট; ২৬ মার্চ ঢাকার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে প্রেসিডেন্ট ও সংবিধান রচনার সময় প্রধানমন্ত্রী রূপে সবসময় এই প্রক্রিয়ায় জনকদের নেতা। এই ঘোষণা বলেই তিনি পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সুতরাং সংবিধানের মর্মার্থে ও পরবর্তী সংশোধনীর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জাতির পিতাও বটে। এতে সার্বভৌম জনগণেরও সম্মতি রয়েছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে তাজউদ্দিন আহমদ এর কন্যা শারমিন আহমদ কর্তৃক প্রথমে উদ্ধৃত বক্তব্য শুধু অবাঞ্ছিত নয়, বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ যদিও তিনি তার বইয়ের শেষ দিকে সত্যটাকে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যে তার কাকু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথম আলো’র (১৩/১০/২০১৪) সর্বশেষ নিবন্ধেও শারমিন নির্দ্ধিধায় সে কথা বলেছেন।

এর আগে শারমিন বলেছিলেন যে, “বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের শুরুতে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক নিয়ে যে বির্তকের সৃষ্টি হয় তা অনাকাঙ্ক্ষিত’’। তিনি সম্ভবত সে বিতর্কের একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্যে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, হাজী গোলাম মোর্শেদ ও শহীদ ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের পরিবার বর্গের সাক্ষাৎকার নেন (পৃ. ২৬৩-৩১০)। তার সিদ্ধান্ত হলো যে, বঙ্গবন্ধু যে গোপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তার প্রমাণ হলো শহীদ ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হককে তিনি ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি খুলনা থেকে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের কাছে সে বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছিলেন ২৫ মার্চ মধ্যাহ্নে।

ওদিকে ২৫ মার্চ রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন আসে। ফোন কলটা রিসিভ করেন তার পার্সনাল এইড হাজী গোলাম মোর্শেদ (পৃ. ১৪৭) ফোন কলটি ছিল এরূপ “আমি বলদা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানো হয়ে গিয়েছে। মেশিন নিয়ে কী করব?” বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে উত্তর দিলেন, “মেশিনটা ভেঙে পালিয়ে যাও।” এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আমিরুলের কিছু কথা সংযোজন করছি যা ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক বলেছিলেন (পৃ. ২৬৫) ‘‘বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন একটি ট্রান্সমিটার যোগাড় করতে। আমি খুলনা থেকে এটা নিয়ে এসেছি। আমি এটা এখন কোথায় পৌঁছে দেব’’। আমি (আমিরুল) বললাম ‘ট্রান্সমিটার কাজ করে? উনি বললেন, হ্যাঁ এটা কাজ করে।’ আমি তখন বললাম ‘আমাকে ত বঙ্গবন্ধু এ সম্বন্ধে কোনো নির্দেশ দেননি। বলেননি ট্রান্সমিটার সম্বন্ধে।’ এ কথাতে মইদুল হাসানের একটি কথাই প্রতিধ্বনি হচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু অনেক কাজই করতেন One to one ভিত্তিতে (মইদুল হাসান, মূলধারা ৭১)।

প্রকৌশলী নূরুল হক, ব্যারিস্টার আমিরুলের আত্মীয় (খোকা ভাই) হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু আমিরুলকে কিছু না বলে সরাসরি তা নূরুল হককেই বললেন। নূরুল হক এই কথা পরিবারের কাউকেও জানাননি, যদিও তিনি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে কি কঠিন কাজটি করতে হবে তা জানতেন। আমিরুল বলছেন আমার ধারণা He was the one who sent the wireless message. হাজী মোরশেদকে বঙ্গবন্ধু রাত ১০.৩০ বললেন যে, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম’। বঙ্গবন্ধু একই কথা আতাউল সামাদকেও বলেন কিন্তু আর বেশি কিছু বলেননি।

সুবেদার মেজর শওকত আলী নিজস্ব ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ই পি আর প্রধানের মাস্ট ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেশে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন তা প্রতিষ্ঠিত সত্য (জনকণ্ঠ ১৭ ও ১৮ মার্চ, ২০১৩)। এর আগে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু পাশের বাসার মোশারফের মাধ্যমে চাটগাঁয়ে খবর পাঠালেন যে আলোচনায় ব্যর্থ হয়েছে, সেনাবাহিনী আঘাত হানতে যাচ্ছে এবং চট্টগ্রাম থেকে লড়াই শুরু করতে হবে। ইংরেজিতে তৈরি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তিনি তা টেলিফোনে নিশ্চিত করেন। ড. মাযহারুল ইসলাম এক গ্রন্থে জহুর হোসেন চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে এ সম্পর্কে ইতিবাচক উত্তর পান (পিতৃ পুরুষ পৃষ্ঠা ১৮-১৯)।

হাজী মোরশেদের বক্তব্যে আরও জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেই দুপুর থেকেই বিভিন্ন পুলিশ ও আনসার হেড কোয়ার্টর্সে আর্মস বণ্টনের নির্দেশ দেন। সেলিনা পারভীন অর্থাৎ ই পি আর এর সুবেদার মেজর শওকত আলীর কন্যার মতে তার পিতা বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ পাঠিয়ে দেন। আমরা আরও জেনেছি একই কিংবা ভিন্ন ম্যাসেজ ভি এইচ এফ-এর মাধ্যমে সারাদেশে পাঠিয়ে দেন আবদুল কাদেরসহ অনেকে। সে সব থেকে অনেকে টেলিফোনে, টেলিগ্রাফে ও টেলিপ্রিন্টারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়ে দেন, যার ফলে সারাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠে। প্রথম ঘোষণার পরই বঙ্গবন্ধুর আর দুটো ঘোষণা দেন। কী ছিল সেই ঘোষণায় দেখা যাক। সম্প্রতি জানা গেছে এই ঘোষণাটির কারণেই পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে রায় দিয়েছিল। তবে এসব থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন নয় যে কোনো এক ব্যক্তিকে প্রদত্ত দায়িত্ব সকল সম্পাদনের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু বলতে পেরেছিলেন। আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।

অতএব স্বাধীনতার আদি ঘোষক একজনই, তার ঘোষণার ভিত্তিতে মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ঘোষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়ে তা বিরাজ করছে। এই ঘোষণায় অন্যের অংশীদারিত্ব বা কর্তৃত্ব নেই। সেটা যদি ঢাকা থেকেও কেউ তার পক্ষে ঘোষণা করে থাকে তাহলে ঘোষণাটি একান্ত আইনত ও কার্যত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। ৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাটি কেবলমাত্র বাঙালিদের জন্য এবং ২৬ শে মার্চ ঘোষণাটি সর্বজনীন। অনেকগুলো সরকার হতো, যার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা কোনদিন অর্জিত হতো না।

১) ভারতের কাছ থেকে কোনো সাহায্য সহায়তাও মিলত না। অনেকগুলো সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুদ্ধটাই ভেস্তে যেত।

২) শরণার্থীরা আশ্রয় পেত না এবং পেলেও শরণার্থী, এমনকি মুক্তির জন্যে জিম্মি নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা ক্রমশ পাকিপক্ষ সমর্থন করত।

৩) যুদ্ধের জন্যে আশ্রয়, ট্রেনিং ও অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যেত। কেননা, ভারতের সর্বজনীন সমর্থনটা বিভক্ত হয়ে পড়ত। ভারত সোভিয়েট মেত্রী চুক্তি অকল্পনীয় হতো।

৪) উগ্র-বামদের উত্থান হতো এবং তাদেরকে নিয়ে চীনের মধ্যস্ততায় একটা দাস-প্রভূ সমাধান হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারত আমাদের যুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে কোনো উদ্যোগ নিত না।

৫) দালালের সংখ্যা অধৈর্য বাঙালিদের মধ্যে বেড়ে যেত। কোনো গেরিলা অপারেশন চালান যেত না।

৬) শেষ মেশ কিছু দালাইনামা জাতীয় কেউ কেউ ভারতে থেকে যেত যারা কোনোদিনও দেশে ফিরতে পারত না।

৭) স্বীকৃতির প্রশ্ন আসলেও কাকে স্বীকৃতি দেয়া হবে তা নির্ধারণ কঠিন ব্যাপার হতো।

৮) গণ-প্রশাসন অসম্ভব হতো। বড় কথা হলো যে ঐতিহাসিক অভূতপূর্ব ঐক্যের কারণে বঙ্গবন্ধু অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল তা ভেঙ্গে যেত। ফলাফল শুধু কল্পনাই করা যায়।

৯) সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটোর পর ভেটো দিতে পারত না।

১০)সপ্তম নৌ-বহর ক্রিয়াশীল হতো।

১১) অনেক সরকারের মধ্যে বেশির ভাগের সম্মতিতে বড়জোর একটা কনফেডারেশনের রূপ হতো ।

১২)ক্রমাগত জৈবিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানিকরণ সইতে না পেরে সাধারণ মানুষ ক্রমশ দলে দলে আত্মসমর্থন করত।

১৩)মেজর জিয়াউর রহমান আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতেন। সেই কারণেই হয়তো মেজর জিয়াউর রহমান নিজেকে কখনও স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালিত হলেও মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে। ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পর কী কী অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে সে কথা জাতি কমবেশ অবগত আছে। মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার যে ঘোষণা গৃহীত হয় তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্ফটিক স্বচ্ছ হচ্ছে।

তবে যারা বলেন বঙ্গবন্ধু ২৬ শে মার্চ তেমন কোনো ঘোষণা দেননি কিংবা অন্য কেউ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তারা একটি অবৈধ কাজ করছেন যা সামাল দেয়া সাংবিধানিক ও আইনি দায়িত্ব।

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

ইসরাইলের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন যে বাঙালি পাইলট

১৯৬৭ সালের ৫ জুন বিকালে ইসরাইলের চারটি ফাইটার জেট (যুদ্ধবিমান) জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য ছিল— ওই ছোট্ট দেশের বিমানবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। সেদিন মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইলি বিমানবাহিনী মাটিতে থাকা ২০০-এরও বেশি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছিল। খবর বিবিসি বাংলার।

৪ দিন আগে

রাষ্ট্র, সংস্কার ও নির্বাচন

জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একদফা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিলে ছাত্রদের সাথে দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলসমূহও আন্দোলনে যোগ দেয়। ফলে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন।

৬ দিন আগে

ইসরায়েলের কাছে কত পারমাণবিক বোমা রয়েছে?

গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই যে ইসরায়েলের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, সেটি কারোরই অজানা নয়। যদিও দেশটিকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিষয়টি স্বীকার করতে দেখা যায়নি। বরং ইরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি রয়েছে’ দাবি করে সপ্তাহখানেক আগে দেশটির ওপর হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।

৭ দিন আগে

আ. লীগ ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিবিসিকে যা বললেন ড. ইউনূস

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের রাজনীতি, সংস্কার, নির্বাচন ও রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।

৯ দিন আগে