রিকশাচালকের ঘর থেকে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্যে

শাহরিয়ার শরীফ
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৯: ১২
চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদ। ছবি: সংগৃহীত

‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ের আড়ালে রাজধানীতে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়ে তোলা রিকশাচালকের ছেলে রিয়াদ—তার গল্প এখন তরুণ রাজনীতির অন্ধকার গলির এক বিপজ্জনক প্রতিচ্ছবি।

সাবেক এক সংসদ সদস্যের বাসায় চাঁদা তুলতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে আব্দুর রাজ্জাক বিন সুলাইমান ওরফে রিয়াদের নাম। একদিকে দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে শিক্ষাজীবনের সংগ্রাম, অন্যদিকে রাজনীতির ছায়ায় অপরাধে গা ভাসানো— দুই বিপরীত বাস্তবতা মিলিয়ে রিয়াদের এই পথচলা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, রিয়াদের শেকড় নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার নবীপুর ইউনিয়নে। দাদা ওয়ালীউল্যাহ চালাতেন রিকশা, বাবা আবু রায়হানও দীর্ঘদিন রিকশা চালিয়ে পরে দিনমজুরের কাজ ধরেন। মা সামসুন্নাহার অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। পাঁচ সদস্যের পরিবারে দিন এনে দিন খেয়ে চলত সংসার।

স্থানীয়দের সহযোগিতায় রিয়াদের পড়াশোনার খরচ চলত। নবীপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন কোম্পানীগঞ্জ সরকারি মুজিব কলেজে। সেখানেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি।

সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই কাদের মির্জার হাত ধরে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পান ‘কাদের মির্জার ক্যাডার’ হিসেবে। পরে ঢাকায় এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাজনীতির নতুন অধ্যায় শুরু করেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে পরে যুক্ত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক হন। ধীরে ধীরে উত্থান ঘটে তার ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ের।

Razzak Bin Sulaiman Riyad News Photo 28-07-2025 (2)

সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদা নিতে গিয়ে গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে চারজন। সবার ডানে রিয়াদ। ছবি: সংগৃহীত

২০২৫ সালের আগস্টের পর রিয়াদ নিজ রাজনৈতিক পরিচয় বদলে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন ‘সমন্বয়ক’ হিসেবে। এ পরিচয়ের আড়ালে চলতে থাকে সংগঠন, যোগাযোগ, ফান্ড সংগ্রহ— যার মধ্যে কতটা ছিল আদর্শ, কতটা ছিল স্বার্থসিদ্ধি, তা অনেকেরই অজানা। কিছুদিনের মধ্যে রাজপথের রাজনীতি, পোস্টার-ফেস্টুন আর ফেসবুক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরেন ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি, সচিবালয় ও রাজপথে উপস্থিতি— সব মিলিয়ে নিজেকে তরুণ সংগঠকের চেহারায় স্থাপন করেন।

কিন্তু আড়ালের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন।

পুলিশ জানায়, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফরকে (৭৪) জিম্মি করে প্রথম দফায় ১০ লাখ টাকা আদায় করেন রিয়াদ ও তার সহযোগীরা। এরপর আরও ৪০ লাখ টাকার দাবিতে গত শনিবার (২৬ জুলাই) সন্ধ্যায় তারা ফের গুলশানের সেই বাসায় গেলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহীম হোসেন মুন্না, সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব এবং কর্মী মো. আমিনুল ইসলাম। এর মধ্যে চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আরেকজন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাকে গাজীপুরের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় রিয়াদের গ্রামে ফের আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে তার অতীত ও বর্তমান। একসময় যেসব মানুষ তাকে সাহায্য করেছিলেন, আজ তারা বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। নবীপুরে তাদের পুরোনো জরাজীর্ণ ঘরের পাশেই এখন উঠছে পাকা ভবন। দামি গাড়িতে রিয়াদকে ঘুরতে দেখা গেছে এলাকায়। অভিজাত রেস্টুরেন্ট, বিলাসী জীবন, প্রভাবশালী চলাফেরা— সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর বিস্ময় তৈরি করেছে তার চারপাশে।

এক প্রতিবেশী বলেন, ‘যে ছেলেটার মা মানুষের বাসায় কাজ করতেন, সেই ছেলে এখন ঢাকায় বড় নেতা হয়ে গেছে। আমরা তো শুধু অবাকই না, ভয়ও পাই।’

নবীপুর হাই স্কুলের সাবেক সভাপতি শিহাব উদ্দিন বলেন, ‘ওকে আমরা বই-খাতা দিয়েছি, পাশে থেকেছি। ভাবিনি সে এই পথে যাবে।’

Razzak Bin Sulaiman Riyad News Photo 28-07-2025 (4)

(বাঁয়ে) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম ও (ডানে) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে রিয়াদ। ছবি: ফেসবুক থেকে

রিয়াদের মা সামসুন্নাহার পর্যন্ত তার ছেলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমরা না খেয়ে ওকে শহরে পাঠিয়েছি। কেউ ষড়যন্ত্র করে ওকে চাঁদাবাজ বানিয়েছে।’

তবে এই ‘ষড়যন্ত্র’ ঠিক কাদের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে, তা স্পষ্ট হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা এক বিস্ফোরক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘এদের শেকড় অনেক গভীরে।’ তিনি অভিযোগ করেন, সচিবালয়, মিছিল-মিটিং থেকে গুলশান-বনানীর গ্যাং কালচার পর্যন্ত সবখানেই ছিল তাদের অবাধ বিচরণ।

উমামার ভাষায়, ‘রিয়াদ গত ডিসেম্বরে রূপায়ন টাওয়ারে আমাদের মেয়েদের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছিল। পরে জানতে পারি, তার বিরুদ্ধে হুমকি, চাঁদাবাজি, মারধরের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সে রাজনৈতিকভাবে প্রোটেকটেড ছিল—এই বাস্তবতা আমরা দিনের পর দিন দেখেছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একসময় সামনের কাতারে থাকা এই ছাত্রনেতা আরও লিখেছেন, ‘আজকের এই চাঁদাবাজির খবরে সবাই অবাক হওয়ার ভান করছেন। কিন্তু আমরা যারা ভেতর থেকে দেখেছি, তাদের কাছে এসব নতুন কিছু নয়।’

চাঞ্চল্যকরভাবে রিয়াদের ফেসবুক ঘেঁটে পাওয়া গেছে লুৎফুজ্জামান বাবর, আন্দালিব রহমান পার্থ, নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম এবং অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে তোলা ছবি। এসব সংযোগই তাকে রাজনৈতিকভাবে ‘নিরাপদ’ বলয়ে রেখেছিল বলে ধারণা করছেন অনেকে।

ঘটনার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আজ পত্রিকা খুলে দেখি পাঁচজন সমন্বয়ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা সাবেক একজন সংসদ সদস্যের কাছ থেকে জোর করে ৫০ লাখ টাকা আদায় করেছে। আমি বেদনায় নীল হয়ে গেছি।’

Razzak Bin Sulaiman Riyad News Photo 28-07-2025 (3)

বাঁ থেকে যথাক্রমে লুৎফুজ্জামান বাবর, আন্দালিব রহমান পার্থ ও কাদের মির্জার সঙ্গে রিয়াদ। ছবি: ফেসবুক থেকে

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? দেশের মানুষ কি এটা চেয়েছিল? এখনো এক বছর হয়নি, এত দ্রুত যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে ভবিষ্যৎ কী?’

এদিকে, চাঁদাবাজির অভিযোগে সংগঠনের একাধিক নেতাকর্মীর নাম জড়ানোর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি রিফাত রশিদ ঘোষণা দেন, কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সারাদেশের সব কমিটি স্থগিত করা হয়েছে।

রিফাত বলেন, ‘গতকালের ঘটনা (শনিবার চাঁদাবাজির অভিযোগে পাঁচজন গ্রেপ্তার) এবং এর আগের কিছু ঘটনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, সংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করে নানা অপকর্মের চেষ্টা হয়েছে। আমরা যখন আত্মপ্রকাশ করেছিলাম, তখনই বলেছিলাম— এই প্ল্যাটফর্ম কোনো অপরাধের আড়াল হবে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এই সভাপতি আরও বলেন, ‘আমরা দেখছি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের কেউ কেউ বিভিন্ন মহলের আশ্রয়ে বিপথে চলে গেছে। দুর্নীতির চিহ্নও স্পষ্ট। এই পরিস্থিতি এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই সম্মিলিত সিদ্ধান্তে সারাদেশের কমিটিগুলো স্থগিত করা হলো।’

রিয়াদদের গল্প সমাজের সেই ভয়ংকর সত্যকে সামনে আনে, যেখানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতে কেউ কেউ নিজেরাই হয়ে উঠছে বৈষম্যের প্রতীক।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

বাংলাদেশের শুল্ক সুবিধা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

শুল্ক আরোপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের পণ্য ২৫ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়ছে, পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের কারণে অতিরিক্ত জরিমানাও গুনতে হচ্ছে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-সমান ২০ শতাংশ শুল্ক থাকলেও, অবৈধভাবে অন্য দেশের পণ্য নিজেদের নামে পাঠানোর অভিযোগে তাদে

৯ দিন আগে

পাকিস্তানকে ছাড়, ভারতকে ‘ট্যারিফ ফাঁদে’ ফেললেন ট্রাম্প

দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন শুল্কনীতির মোড় ঘুরে গেছে পাকিস্তানের দিকে। ভারতের তুলনায় কম শুল্ক পাচ্ছে ইসলামাবাদ, যার ফলে দেশটির গার্মেন্টস খাতে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা মিলবে।

১০ দিন আগে

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব ঘরটি হোক আস্থার জায়গা

এগুলো নিয়ে আমরা চিকিৎসক/স্বাস্থ্য কর্মীরা কথা বলি না অথবা কম বলি, কিন্তু এই কথাগুলোই পরবর্তী সকল জটিলতা থেকে মাকে রক্ষা করতে পারে। প্রসব পূর্ববর্তী আলোচনার পরই, প্রসবকালীন সময়ে মা কোথায় যাবেন, কীভাবে দেখাবেন এবং শেষ পর্ব অর্থ্যৎ প্রসব কোথায় হবে, সেটাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

১৩ দিন আগে

পোনামাছ নিধনকারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জরুরি

সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত মৎস্যজীবীর জীবন-জীবিকার রক্ষার্থে এবং উন্নয়নে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৬৬৯টি অভয়াশ্রম পরিচালিত হচ্ছে।

১৩ দিন আগে