ড. মিহির কুমার রায়
বাঙালির পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রথমে এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। দশক তিনেক মঙ্গল শোভযাত্রা নামের পর এবার সেটি হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, এই নামের মধ্যে সর্বজনীনতা নেই। তারপরও ১৪৩২ বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে গোটা দেশ। প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রার জন্য নানা উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন শিক্ষার্থী ও শিল্পীরা।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যেত না। তখনই সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী ওই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন।
বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর, অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে এই বর্ষপঞ্জি।
আধুনিক নববর্ষ পালনের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে জানা গেল, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৩ সালে একইভাবে ভালো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় নববর্ষ পালনের জন্য। মোদ্দা কথা, ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়নি। এরপর থেকে প্রতিবছরই বাড়তে থাকে বৈশাখ বরণের সাড়ম্বরতা।
১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা-টিএসসি-শাহবাগে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় মঙ্গলশোভা যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এখানে পশু-পাখির মুখাকৃতিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রং-বেরঙের মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে। ছেলে-বুড়ো সবাই তখন মেতে ওঠে বর্ষবরণের মঙ্গলশোভা যাত্রার আনন্দে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতিরও ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করছি এবং তা ধারণ করার প্রতিজ্ঞাও করছি পহেলা বৈশাখে। ফলে এই দিনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা বছরের প্রথম দিন আনন্দময় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। কালবৈশাখীর কালো মেঘের মাঝেও মিশে থাকে আনন্দ, মিশে থাকে উদ্দীপনা। প্রতি বছর তো সেভাবেই পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সামিল হয় এই উৎসবে।
পহেলা বৈশাখ একটি ঐতিহ্য, একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা। এই ধারা মনে করিয়ে দেয়, আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্বতা বলে কিছু আছে। আমরা সযতনে এই ধারা লালন করে চলেছি। বৈশাখের প্রথম দিনে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর, প্রাণবন্ত। এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলায় এক নববর্ষ পার হয়েছে, আরেকটি নববর্ষ এসেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে বাঙালিরা। নিজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এটাই সুযোগ। বিদেশি সিরিয়াল, বিদেশি ফ্যাশন করতে করতে আমরা যখন নিজেদের হারাতে বসেছি, তখন এই নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা। এই সংস্কৃতি আমাদের আপন সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার এক লেখায় বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হয়েও উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আইয়ুব খানের আমল এবং আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ছিল বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান ২০২২ সালে তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, বাংলা সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সৌর সন ও আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সন ও তারিখ নির্ধারণ করেন। আর এই ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার নাম দেওয়া হয় তারিখ-ই-এলাহী।
এই পুরো কাজটি করা হয়েছিল ফসল উৎপাদনের ঋতুচক্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, যেন ফসল ওঠার সময়টাতেই খাজনা আদায় করা যায়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। এর পরদিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা বসত। আয়োজন করা হতো আরও নানা অনুষ্ঠান।
ড. মীজানুর রহমান আরও লিখেছেন, সম্রাট আকবরের অনুকরণে সুবেদার ইসলাম চিশতি তার বাসভবনের সামনে প্রজাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ ও বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। এ উপলক্ষে খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি মেলায় গান-বাজনা, গরু-মহিষের লড়াই, কাবাডি খেলা হতো। পহেলা বৈশাখের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ছিল ভালো খাবার খাওয়া, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মাছ, মাংস, পোলাও।
বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক সৌমিত্র শেখর বলেন, বাঙালি মনস্তত্ত্বে এটা ঢুকে যায় যে পহেলা বৈশাখ বা বছরের প্রথম দিনে যদি ভালো খাবার খাওয়া হয়, ভালো পোশাক পরা হয় এবং মিথ্যা না বলা হয়, তাহলে পুরো বছর জুড়েই ভালো পোশাক, ভালো খাবার পাওয়া যাবে, বলতে বা শুনতে হবে না মিথ্যাও। ওই সময়ে কারও যাদের সাধ্য কম থাকত বা যারা দরিদ্র ছিল, তারা অন্তত গরম ভাত খেত। আর গরম ভাতের সঙ্গে থাকতো মৌরালা মাছ বা মলা মাছ। এই মলা মাছ দিয়ে গরম ভাত খাবে— এটিই আমরা বই-পুস্তকে পেয়েছি। আমরা প্রাচীন গ্রন্থে পেয়েছি যে বছরের পহেলা সময়ে আমরা এটা খাব।
কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখে খাবারের পদ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন পহেলা বৈশাখে খাবার হিসেবে পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছই মূল পদ হিসেবে উঠে এসেছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, বাঙালি সংস্কৃতিতে পান্তা দারিদ্র্যের প্রতীক। তাই পান্তাকে পহেলা বৈশাখের খাবার হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারটি আগে ছিল না।
সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘যারা পান্তা প্রতিদিন খেত, তারা মনে করত যে সেদিন তারা ভালো খাবে। আর যারা ছেঁড়া পোশাক পরত ওই দিন অন্ততপক্ষে তারা ভালো পোশাক পরার চেষ্টা করত।’
বিভিন্ন গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন— বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম, আর হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। সম্রাট আকবরের সময়ে একটি বিষয় ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, তা হলো মাসের প্রতিটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম ছিল, যা কিনা প্রজাদের মনে রাখা খুবই কষ্ট হতো। তাই সম্রাট শাহজাহান ৭ দিনে সপ্তাহভিত্তিক বাংলায় দিনের নামকরণের কাজ শুরু করেন। ইংরেজি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ইংরেজি সাত দিনের নামের কিছুটা আদলে বাংলায় সাত দিনের নামকরণ করা হয়। যেমন— সানডে থেকে রবিবার। সান অর্থ রবি বা সূর্য, আর ডে অর্থ দিন। এভাবে বর্ষ গণনার রীতিকে বাংলায় প্রবর্তনের সংস্কার শুরু হয় মোঘল আমলে।
বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন একটি উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। এটি বর্ষবরণের দিন, শুভ নববর্ষ। এ দিনটি প্রতিটি বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। বাংলাদেশে বর্ষবরণের মূল আয়োজন মূলত ঢাকার রমনা পার্কের বটমূলকে (অনেকে বলেন অশ্মথ মূল) ঘিরেই। সেই আনন্দ আয়োজন আর পান্তা-ইলিশের বাঙালিয়ানায় পুরো জাতি নিজেকে খুঁজে ফেরে ফেলে আসা গত দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন আর নতুন অনাগত সময়কে বরণের ব্যস্ততায়।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিই নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বরণের জন্য বিশেষ বিশেষ দিনকে স্মরণীয় করে রাখে। যেমন— প্রাচীন আরবীয়রা ‘ওকাজের মেলা’, ইরানিরা ‘নওরোজ উৎসব’ ও প্রাচীন ভারতীয়রা ‘দোলপূর্ণিমা’য় নববর্ষ উদযাপন করত। এর মধ্যে ইরানিরা অনেক অনেক ঘটা করেই নওরোজ উৎসব পালন করে থাকে।
বলে রাখা ভালো, পাকিস্তান অমলে পূর্বপাকিস্তানে সবসময়ই বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে (১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো...’ গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। বর্ষবরণ এগিয়ে যায় আরও এক ধাপ। বিস্তৃত হতে শুরু করে ছায়ানট নামের সংগঠনটি, যা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি মহীরূহে পরিণত হয়েছে।
১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে এখন ভোরে রমনা বটমূলে শুরু হওয়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠান উপভোগ করে কয়েক কোটি বাঙালি। ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় বৈশাখকে বরণের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় আগেভাগে। পহেলা বৈশাখের দিন ভোরেই শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে উম্মুক্ত কনসার্ট, বাউল, লালন, জারি-সারি, মুর্শিদী গানের আসর। আর শহুরে অ্যামিউজমেন্ট পার্কের স্বাদ থাকলেও পহেলা বৈশাখের দিন অন্তত নাগরদোলায় চড়তে চায় অনেক শিশুই।
১৯৮০ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। ছড়িয়ে পড়ে সবার অন্তরে অন্তরে। প্রতি বছরই তাই কোটি কোটি বাঙালির অপেক্ষা থাকে কবে আসবে বাংলা। এবার ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হবে বলে জানা গেছে।
এখন বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ পান্তা-ইলিশ, যেন এই পান্তা-ইলিশ না হলে আর পহেলা বৈশাখের আমেজই থাকে না। এই সুযোগে রমনার লেকের পারেই অনেকে বসে পড়েন ইলিশ-পান্তা খেতে। সঙ্গে থাকে কাঁচামরিচ। মানে সম্পূর্ণভাবেই বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে যেন ব্যস্ত সবাই।
বৈশাখ মাস বলতে তো মেলার মাসকেই বোঝায়। একসময় শুধু গ্রামগঞ্জে মেলা হলেও এখন এর পরিধি ছড়িয়েছে শহরের বড় অ্যাপার্টমেন্ট আর হাই-সোসাইটিতেও। তবে গ্রামের মেলার সঙ্গে শহুরে মেলার পার্থক্য আছে। বাঁশ-বেতের তৈজস আর নানা জাতের খেলার সামগ্রী, নারকেল-মুড়কিসহ আরও কত কী থাকে এসব মেলায়, তার ইয়াত্তা নেই। মেলার সময়ে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর বসে।
ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম বউ মেলা। এটি স্থানীয়ভাবে বটতলার মেলা নামেও পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে চলছে এই মেলা। পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা চলে পাঁচ দিন। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজার জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী ও নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যšন্ত তাদের মনষ্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা, পাঁঠা বলির রেওয়াজও পুরনো। তবে বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে।
এ ছাডা সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়, যার নাম ঘোড়া মেলা। লোকমুখে প্রচলিত, যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর সেখানেই তার স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখেন এবং সেখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে মেলাটি ঘোড়া মেলা নামে সুপরিচিত।
ঘোড়া মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো— নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নতুন মাত্রা হিসেবে এতে পরে যোগ হয় কীর্তন, যা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।
প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত একটি বিষয় হালখাতা। তখন প্রত্যেকে চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা প্রজাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরে এই চর্চা ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রামগঞ্জে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে বাজার, বন্দর ও গঞ্জে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের একমাত্র উৎসব, যা বাঙালি সংস্কৃতিকে সারা পৃথিবীর কাছে সবচেয়ে বেশি আঙ্গিকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই দিনটি একই সঙ্গে পালিত হয় শহর ও গ্রামে, সমান মর্যাদায়, আয়োজন করা হয় বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান আর মেলা।
মুঘল সম্রাট আকবরের আদেশে বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণের কথা আগেই বলা হয়েছে। ওই সময় বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করা এবং পরদিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকদের নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়নের রেওয়াজই ধীরে ধীরে সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। সেটিই পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপ নিয়েছে।
তখনকার সময় এ দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা অর্থ নতুন হিসাব বই। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা— সবখানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাবের বই খোলা হয়।
গবেষকরা বলছেন, পহেলা বৈশাখের উৎসব বড় করে পালিত হতে শুরু করে ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে, যা পর্যায়ক্রমে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, ওই একই সময়ে অন্যান্য জমিদারও আনুষ্ঠানিকভাবেই পহেলা বৈশাখ উৎসব পালন করতেন। বছরের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি আর নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ— এ দুদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রচলন হয় ইংরেজ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে।
ওই সময় বছরের শেষ মাস চৈত্রের শেষ দিনে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বকেয়া আদায় করার পর চালু করে নতুন খাতা, আর নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উৎসব হয় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই উৎসবে থাকত কবিয়ালদের গান, নানা উৎসব আয়োজন। তাদেরও লক্ষ্য ছিল খাজনা আদায়। আর দিনটাও বেছে নেওয়া হয় নতুন বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনকেই। কারণ তখন ঘরে ঘরে ওঠে নতুন ফসল, কৃষকের চোখে-মুখে থাকে আনন্দের ছটা। পহেলা বৈশাখ উৎসবের শুরুটা ছিল এভাবেই।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ঢাকাকে ঘিরে মুসলিম বাঙালির মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটে। প্রকৃত অর্থে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয় সমাজের এ অংশের মধ্যে আত্মপরিচয় সম্পর্কে নতুন জিজ্ঞাসা, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের সন্ধান। ঠিক ওই সময়ই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণার ঘটনাটি বাঙালি জাতীয়বাদকে সামনে নিয়ে আসে। ধর্মীয় পরিচয়ের পাশাপাশি তখন এ সমতল ভূমির অগ্রসর মানুষের কাছে ভাষাগত প্রশ্নে ‘বাঙালি’ পরিচয়টিও হয়ে ওঠে অত্যন্ত পরিষ্কার।
সরকারি ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ দিনটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তৈরি করে দেয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ। বর্ষপঞ্জির প্রথম সংস্কারও হয় ১৯৫২ সালেই, ভারতের বিশিষ্ট জ্যোতির্পদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহার হাত দিয়ে। এরপর ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার তার এ সংস্কারের সুপারিশ গ্রহণ করে। সেই সুপারিশ সামনে রেখে ১৯৬২-৬৩ সালে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম সরকারি নথিতে সইসহ বাংলা সন চালুর নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরও সেই একই কার্যধারা চালু থাকে। এরপর অনেক পথঘাট পার হয়ে ১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদ সরকারি সব কাজকর্মে ইংরেজি সাল-তারিখের পাশাপাশি বাংলা তারিখ লেখার নির্দেশ দেন।
বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের একটি সোনালি পটভূমি রয়েছে, যা ইতিহাস স্বীকৃত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-জীবিকা, আয়-রোজগারের প্রশ্ন। যেমন— কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য, বৈশাখী পোশাকের বাণিজ্য, গ্রামীণ বা শহুরে মেলার বাণিজ্য। আরও রয়েছে মৃৎশিল্পী বা কামার-কুমারদের বাণিজ্য, নাট্যকর্মী-যাত্রাশিল্পী ও পালাকারদের আয়-রোজগারের পথসহ আরও বহু অনুষঙ্গ।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। সেখানে থাকে নানা কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠা পুলির আয়োজন, অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওযার ব্যবস্থা থাকে।
এ দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি ইত্যাদি। বৈশাখী মেলাকেন্দ্রিক যে অর্থনেতিক কর্মকাণ্ড, তা আগের মতো সচল না থাকলেও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। যদিও এলাকাভিত্তিক এর প্রধান্য রয়েছে অনেকাংশে। তবে অনেকেই তাদের মূল পেশা ধরে রাখতে পারছে না কেবল প্রণোদনার অভাবে।
আদি পেশাজীবী যারা নববর্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসত, এখন জেনারেশন গ্যাপের কারণে তাদের পোষ্যরা আর সে কাজ করছে না। দারা শিক্ষা নিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। যেমন— কৃষকের ছেলে আর কৃষিতে নেই, বাঁশীওয়ালার ছেলে সেই বাঁশী বাজানোর পেশায়। কুমারের ছেলেও আর পৈত্রিক পেশায় থাকতে চাইছে না। আরও অন্য সব পেশার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখন বরং কোন কাজে আয় বেশি কিংবা কোন বিষয়ে পড়ালেখা করলে চাকরি পাওয়া যাবে, গুলোই হয়ে পড়েছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ফলে বাংলা নববর্ষ কিংবা পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক উপাদানগুলোও সংকটে পড়েছে।
পহেলা বৈশাখ প্রতিবছরই আসবে। হয়তো অন্য কোনো বছর আসবে অন্য কোনো আমেজ নিয়ে, অন্য কোনো আবহ নিয়ে। এর মধ্য দিয়েই জীবন ও জীবিকার বাহনগুলো স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। পহেলা বৈশাখের সর্বজনীন যে রূপ রয়েছে, সেটিই আরও ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র, এটুকুই প্রত্যাশা। সৃষ্টিকর্তা সবার সহায় হউন।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি) ও সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা); সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
বাঙালির পহেলা বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রথমে এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। দশক তিনেক মঙ্গল শোভযাত্রা নামের পর এবার সেটি হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
সাম্প্রতিক সময়ে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, এই নামের মধ্যে সর্বজনীনতা নেই। তারপরও ১৪৩২ বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে গোটা দেশ। প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রার জন্য নানা উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন শিক্ষার্থী ও শিল্পীরা।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছর হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর কোনো মিল পাওয়া যেত না। তখনই সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী ওই সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন।
বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এই গণনা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর, অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে এই বর্ষপঞ্জি।
আধুনিক নববর্ষ পালনের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে জানা গেল, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৩ সালে একইভাবে ভালো কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় নববর্ষ পালনের জন্য। মোদ্দা কথা, ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়নি। এরপর থেকে প্রতিবছরই বাড়তে থাকে বৈশাখ বরণের সাড়ম্বরতা।
১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা-টিএসসি-শাহবাগে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় মঙ্গলশোভা যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এখানে পশু-পাখির মুখাকৃতিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয় নানা রং-বেরঙের মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে। ছেলে-বুড়ো সবাই তখন মেতে ওঠে বর্ষবরণের মঙ্গলশোভা যাত্রার আনন্দে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতিরও ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করছে। নিজেদের সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করছি এবং তা ধারণ করার প্রতিজ্ঞাও করছি পহেলা বৈশাখে। ফলে এই দিনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির জীবনে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা বছরের প্রথম দিন আনন্দময় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। কালবৈশাখীর কালো মেঘের মাঝেও মিশে থাকে আনন্দ, মিশে থাকে উদ্দীপনা। প্রতি বছর তো সেভাবেই পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সামিল হয় এই উৎসবে।
পহেলা বৈশাখ একটি ঐতিহ্য, একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা। এই ধারা মনে করিয়ে দেয়, আমরা বাঙালি, আমাদের নিজস্বতা বলে কিছু আছে। আমরা সযতনে এই ধারা লালন করে চলেছি। বৈশাখের প্রথম দিনে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর, প্রাণবন্ত। এই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলায় এক নববর্ষ পার হয়েছে, আরেকটি নববর্ষ এসেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে বাঙালিরা। নিজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এটাই সুযোগ। বিদেশি সিরিয়াল, বিদেশি ফ্যাশন করতে করতে আমরা যখন নিজেদের হারাতে বসেছি, তখন এই নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা। এই সংস্কৃতি আমাদের আপন সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার এক লেখায় বলেন, বিভিন্ন সময়ে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হয়েও উঠেছে। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আইয়ুব খানের আমল এবং আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ছিল বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান ২০২২ সালে তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, বাংলা সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজীকে। তিনি সৌর সন ও আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা সন ও তারিখ নির্ধারণ করেন। আর এই ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার নাম দেওয়া হয় তারিখ-ই-এলাহী।
এই পুরো কাজটি করা হয়েছিল ফসল উৎপাদনের ঋতুচক্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, যেন ফসল ওঠার সময়টাতেই খাজনা আদায় করা যায়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। এর পরদিন অর্থাৎ বৈশাখ মাসের প্রথম দিন ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা বসত। আয়োজন করা হতো আরও নানা অনুষ্ঠান।
ড. মীজানুর রহমান আরও লিখেছেন, সম্রাট আকবরের অনুকরণে সুবেদার ইসলাম চিশতি তার বাসভবনের সামনে প্রজাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ ও বৈশাখী উৎসব পালন করতেন। এ উপলক্ষে খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি মেলায় গান-বাজনা, গরু-মহিষের লড়াই, কাবাডি খেলা হতো। পহেলা বৈশাখের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ছিল ভালো খাবার খাওয়া, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল মাছ, মাংস, পোলাও।
বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক সৌমিত্র শেখর বলেন, বাঙালি মনস্তত্ত্বে এটা ঢুকে যায় যে পহেলা বৈশাখ বা বছরের প্রথম দিনে যদি ভালো খাবার খাওয়া হয়, ভালো পোশাক পরা হয় এবং মিথ্যা না বলা হয়, তাহলে পুরো বছর জুড়েই ভালো পোশাক, ভালো খাবার পাওয়া যাবে, বলতে বা শুনতে হবে না মিথ্যাও। ওই সময়ে কারও যাদের সাধ্য কম থাকত বা যারা দরিদ্র ছিল, তারা অন্তত গরম ভাত খেত। আর গরম ভাতের সঙ্গে থাকতো মৌরালা মাছ বা মলা মাছ। এই মলা মাছ দিয়ে গরম ভাত খাবে— এটিই আমরা বই-পুস্তকে পেয়েছি। আমরা প্রাচীন গ্রন্থে পেয়েছি যে বছরের পহেলা সময়ে আমরা এটা খাব।
কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখে খাবারের পদ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন পহেলা বৈশাখে খাবার হিসেবে পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছই মূল পদ হিসেবে উঠে এসেছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, বাঙালি সংস্কৃতিতে পান্তা দারিদ্র্যের প্রতীক। তাই পান্তাকে পহেলা বৈশাখের খাবার হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারটি আগে ছিল না।
সৌমিত্র শেখর বলেন, ‘যারা পান্তা প্রতিদিন খেত, তারা মনে করত যে সেদিন তারা ভালো খাবে। আর যারা ছেঁড়া পোশাক পরত ওই দিন অন্ততপক্ষে তারা ভালো পোশাক পরার চেষ্টা করত।’
বিভিন্ন গবেষণায় আরও দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন— বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হতো বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হতো। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম, আর হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। সম্রাট আকবরের সময়ে একটি বিষয় ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, তা হলো মাসের প্রতিটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম ছিল, যা কিনা প্রজাদের মনে রাখা খুবই কষ্ট হতো। তাই সম্রাট শাহজাহান ৭ দিনে সপ্তাহভিত্তিক বাংলায় দিনের নামকরণের কাজ শুরু করেন। ইংরেজি বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ইংরেজি সাত দিনের নামের কিছুটা আদলে বাংলায় সাত দিনের নামকরণ করা হয়। যেমন— সানডে থেকে রবিবার। সান অর্থ রবি বা সূর্য, আর ডে অর্থ দিন। এভাবে বর্ষ গণনার রীতিকে বাংলায় প্রবর্তনের সংস্কার শুরু হয় মোঘল আমলে।
বাঙালি জীবনের অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন একটি উৎসব হলো পহেলা বৈশাখ। এটি বর্ষবরণের দিন, শুভ নববর্ষ। এ দিনটি প্রতিটি বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। বাংলাদেশে বর্ষবরণের মূল আয়োজন মূলত ঢাকার রমনা পার্কের বটমূলকে (অনেকে বলেন অশ্মথ মূল) ঘিরেই। সেই আনন্দ আয়োজন আর পান্তা-ইলিশের বাঙালিয়ানায় পুরো জাতি নিজেকে খুঁজে ফেরে ফেলে আসা গত দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন আর নতুন অনাগত সময়কে বরণের ব্যস্ততায়।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিই নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে বরণের জন্য বিশেষ বিশেষ দিনকে স্মরণীয় করে রাখে। যেমন— প্রাচীন আরবীয়রা ‘ওকাজের মেলা’, ইরানিরা ‘নওরোজ উৎসব’ ও প্রাচীন ভারতীয়রা ‘দোলপূর্ণিমা’য় নববর্ষ উদযাপন করত। এর মধ্যে ইরানিরা অনেক অনেক ঘটা করেই নওরোজ উৎসব পালন করে থাকে।
বলে রাখা ভালো, পাকিস্তান অমলে পূর্বপাকিস্তানে সবসময়ই বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে (১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো...’ গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানায় নতুন বছরকে। বর্ষবরণ এগিয়ে যায় আরও এক ধাপ। বিস্তৃত হতে শুরু করে ছায়ানট নামের সংগঠনটি, যা এখন বাংলাদেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি মহীরূহে পরিণত হয়েছে।
১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কল্যাণে এখন ভোরে রমনা বটমূলে শুরু হওয়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠান উপভোগ করে কয়েক কোটি বাঙালি। ছায়ানটের শিল্পীদের পরিবেশনায় বৈশাখকে বরণের সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় আগেভাগে। পহেলা বৈশাখের দিন ভোরেই শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে উম্মুক্ত কনসার্ট, বাউল, লালন, জারি-সারি, মুর্শিদী গানের আসর। আর শহুরে অ্যামিউজমেন্ট পার্কের স্বাদ থাকলেও পহেলা বৈশাখের দিন অন্তত নাগরদোলায় চড়তে চায় অনেক শিশুই।
১৯৮০ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। ছড়িয়ে পড়ে সবার অন্তরে অন্তরে। প্রতি বছরই তাই কোটি কোটি বাঙালির অপেক্ষা থাকে কবে আসবে বাংলা। এবার ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হবে বলে জানা গেছে।
এখন বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ পান্তা-ইলিশ, যেন এই পান্তা-ইলিশ না হলে আর পহেলা বৈশাখের আমেজই থাকে না। এই সুযোগে রমনার লেকের পারেই অনেকে বসে পড়েন ইলিশ-পান্তা খেতে। সঙ্গে থাকে কাঁচামরিচ। মানে সম্পূর্ণভাবেই বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে যেন ব্যস্ত সবাই।
বৈশাখ মাস বলতে তো মেলার মাসকেই বোঝায়। একসময় শুধু গ্রামগঞ্জে মেলা হলেও এখন এর পরিধি ছড়িয়েছে শহরের বড় অ্যাপার্টমেন্ট আর হাই-সোসাইটিতেও। তবে গ্রামের মেলার সঙ্গে শহুরে মেলার পার্থক্য আছে। বাঁশ-বেতের তৈজস আর নানা জাতের খেলার সামগ্রী, নারকেল-মুড়কিসহ আরও কত কী থাকে এসব মেলায়, তার ইয়াত্তা নেই। মেলার সময়ে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর বসে।
ঈশা খাঁর সোনারগাঁওয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম বউ মেলা। এটি স্থানীয়ভাবে বটতলার মেলা নামেও পরিচিত। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে চলছে এই মেলা। পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা চলে পাঁচ দিন। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজার জন্য এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী ও নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যšন্ত তাদের মনষ্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা, পাঁঠা বলির রেওয়াজও পুরনো। তবে বদলে যাচ্ছে পুরনো অর্চনার পালা। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে।
এ ছাডা সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়, যার নাম ঘোড়া মেলা। লোকমুখে প্রচলিত, যামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর সেখানেই তার স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখেন এবং সেখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে মেলাটি ঘোড়া মেলা নামে সুপরিচিত।
ঘোড়া মেলার অন্যতম আকর্ষণ হলো— নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হয় এবং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নতুন মাত্রা হিসেবে এতে পরে যোগ হয় কীর্তন, যা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।
প্রাচীন বর্ষবরণের রীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত একটি বিষয় হালখাতা। তখন প্রত্যেকে চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ ভূমির মালিকরা প্রজাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরে এই চর্চা ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। এ উৎসব গুলো সামাজিক রীতির অংশে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রামগঞ্জে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে বাজার, বন্দর ও গঞ্জে।
পহেলা বৈশাখ আমাদের একমাত্র উৎসব, যা বাঙালি সংস্কৃতিকে সারা পৃথিবীর কাছে সবচেয়ে বেশি আঙ্গিকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই দিনটি একই সঙ্গে পালিত হয় শহর ও গ্রামে, সমান মর্যাদায়, আয়োজন করা হয় বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান আর মেলা।
মুঘল সম্রাট আকবরের আদেশে বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণের কথা আগেই বলা হয়েছে। ওই সময় বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করা এবং পরদিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকদের নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়নের রেওয়াজই ধীরে ধীরে সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। সেটিই পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপ নিয়েছে।
তখনকার সময় এ দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা অর্থ নতুন হিসাব বই। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা— সবখানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাবের বই খোলা হয়।
গবেষকরা বলছেন, পহেলা বৈশাখের উৎসব বড় করে পালিত হতে শুরু করে ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে, যা পর্যায়ক্রমে সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, ওই একই সময়ে অন্যান্য জমিদারও আনুষ্ঠানিকভাবেই পহেলা বৈশাখ উৎসব পালন করতেন। বছরের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি আর নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ— এ দুদিন উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রচলন হয় ইংরেজ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে।
ওই সময় বছরের শেষ মাস চৈত্রের শেষ দিনে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বকেয়া আদায় করার পর চালু করে নতুন খাতা, আর নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উৎসব হয় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এই উৎসবে থাকত কবিয়ালদের গান, নানা উৎসব আয়োজন। তাদেরও লক্ষ্য ছিল খাজনা আদায়। আর দিনটাও বেছে নেওয়া হয় নতুন বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনকেই। কারণ তখন ঘরে ঘরে ওঠে নতুন ফসল, কৃষকের চোখে-মুখে থাকে আনন্দের ছটা। পহেলা বৈশাখ উৎসবের শুরুটা ছিল এভাবেই।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ঢাকাকে ঘিরে মুসলিম বাঙালির মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটে। প্রকৃত অর্থে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয় সমাজের এ অংশের মধ্যে আত্মপরিচয় সম্পর্কে নতুন জিজ্ঞাসা, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের সন্ধান। ঠিক ওই সময়ই ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটি ঘোষণার ঘটনাটি বাঙালি জাতীয়বাদকে সামনে নিয়ে আসে। ধর্মীয় পরিচয়ের পাশাপাশি তখন এ সমতল ভূমির অগ্রসর মানুষের কাছে ভাষাগত প্রশ্নে ‘বাঙালি’ পরিচয়টিও হয়ে ওঠে অত্যন্ত পরিষ্কার।
সরকারি ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ দিনটি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তৈরি করে দেয় অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ। বর্ষপঞ্জির প্রথম সংস্কারও হয় ১৯৫২ সালেই, ভারতের বিশিষ্ট জ্যোতির্পদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহার হাত দিয়ে। এরপর ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার তার এ সংস্কারের সুপারিশ গ্রহণ করে। সেই সুপারিশ সামনে রেখে ১৯৬২-৬৩ সালে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম সরকারি নথিতে সইসহ বাংলা সন চালুর নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরও সেই একই কার্যধারা চালু থাকে। এরপর অনেক পথঘাট পার হয়ে ১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদ সরকারি সব কাজকর্মে ইংরেজি সাল-তারিখের পাশাপাশি বাংলা তারিখ লেখার নির্দেশ দেন।
বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের একটি সোনালি পটভূমি রয়েছে, যা ইতিহাস স্বীকৃত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-জীবিকা, আয়-রোজগারের প্রশ্ন। যেমন— কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য, বৈশাখী পোশাকের বাণিজ্য, গ্রামীণ বা শহুরে মেলার বাণিজ্য। আরও রয়েছে মৃৎশিল্পী বা কামার-কুমারদের বাণিজ্য, নাট্যকর্মী-যাত্রাশিল্পী ও পালাকারদের আয়-রোজগারের পথসহ আরও বহু অনুষঙ্গ।
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পরে এবং আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটামুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। সেখানে থাকে নানা কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানা রকম পিঠা পুলির আয়োজন, অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওযার ব্যবস্থা থাকে।
এ দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি ইত্যাদি। বৈশাখী মেলাকেন্দ্রিক যে অর্থনেতিক কর্মকাণ্ড, তা আগের মতো সচল না থাকলেও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। যদিও এলাকাভিত্তিক এর প্রধান্য রয়েছে অনেকাংশে। তবে অনেকেই তাদের মূল পেশা ধরে রাখতে পারছে না কেবল প্রণোদনার অভাবে।
আদি পেশাজীবী যারা নববর্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসত, এখন জেনারেশন গ্যাপের কারণে তাদের পোষ্যরা আর সে কাজ করছে না। দারা শিক্ষা নিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। যেমন— কৃষকের ছেলে আর কৃষিতে নেই, বাঁশীওয়ালার ছেলে সেই বাঁশী বাজানোর পেশায়। কুমারের ছেলেও আর পৈত্রিক পেশায় থাকতে চাইছে না। আরও অন্য সব পেশার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখন বরং কোন কাজে আয় বেশি কিংবা কোন বিষয়ে পড়ালেখা করলে চাকরি পাওয়া যাবে, গুলোই হয়ে পড়েছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ফলে বাংলা নববর্ষ কিংবা পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক উপাদানগুলোও সংকটে পড়েছে।
পহেলা বৈশাখ প্রতিবছরই আসবে। হয়তো অন্য কোনো বছর আসবে অন্য কোনো আমেজ নিয়ে, অন্য কোনো আবহ নিয়ে। এর মধ্য দিয়েই জীবন ও জীবিকার বাহনগুলো স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। পহেলা বৈশাখের সর্বজনীন যে রূপ রয়েছে, সেটিই আরও ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র, এটুকুই প্রত্যাশা। সৃষ্টিকর্তা সবার সহায় হউন।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি) ও সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা); সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
১৬ বছরের নিমরার ঘুমটা কয়েক মুহূর্ত আগেই ভেঙে গিয়েছিল একটা ভারতীয় মিসাইলের শব্দে। বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। পা যেন আর নড়ছিল না নিমরার। পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে নিমরাদের বাড়ির কয়েক মিটার দূরের মসজিদে ততক্ষণে আঘাত করেছে ওই ভারতীয় মিসাইলটা।
৪ দিন আগেসাম্প্রতিক সময়ের ছাত্রদল নেতা সাম্যের মৃত্যু আমাদের সামনে এমনই এক সাংস্কৃতিক সংঘাতের নির্মম প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। সাম্যর মৃত্যু কেবল রাজনৈতিক হত্যা নয়, এটি এক ভয়াবহ মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিনাশের দৃষ্টান্ত। তরুণদের চিন্তা, মত, অবস্থান, এমনকি অস্তিত্ব যদি সহ্য না হয়, তাহলে আমাদের সমাজ কোন পথে যাচ্ছে, তা
৪ দিন আগেবাংলাদেশের তৈরি পোশাক-সহ অন্যান্য বহু পণ্যের আমদানিতে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শনিবার (১৭ই মে) যে সব নতুন কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, ভারতের বেশির ভাগ মূল ধারার সংবাদমাধ্যম সেটিকে একটি ‘রেসিপ্রোকাল মুভ’ বা ‘পাল্টা পদক্ষেপ’ হিসেবেই বর্ণনা করছে।
৫ দিন আগেবাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বা এনসিটির ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হবে কি-না তার পক্ষ-বিপক্ষে বিতর্ক আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। অনেকে এ ধরনের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ করছেন।
৬ দিন আগে