বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের কতটা নবায়ন হলো দুই নেতার বৈঠকে?

বিবিসি বাংলা

অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ব্যাংককে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদী যে প্রথমবারের মতো দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসলেন, এটিকেই দুই দেশের সম্পর্কে একটি ‘ইতিবাচক’ ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারে পতনের আকস্মিকতায় থমকে গিয়েছিল দুই দেশের সম্পর্কের গতি।

তারপর থেকে দুই দেশের মধ্যকার টানাপোড়েন কূটনৈতিক পরিসর ছাপিয়ে রাজনৈতিক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এমনকি অনেক সাধারণ মানুষের বয়ানেও ছড়িয়ে পড়ে। মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদীর শুক্রবারের বৈঠকটিকে, কয়েক মাস ধরে চলে আসা সেই টানাপোড়েনে থেকে উত্তরণের সুযোগ বলে বর্ণনা করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে, দুই দেশই অপরপক্ষের পছন্দের নয় এমন দুয়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছে শীর্ষ বৈঠকে। আবার সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজ নিজ ভাষ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েই বৈঠক সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছে ঢাকা ও দিল্লি। তো বাংলাদেশ-ভারত পুরনো বন্ধুত্বের কতটা নবায়ন হলো শীর্ষ দুই নেতার বৈঠকে?

সম্পর্কের টানাপোড়েনের সাম্প্রতিক চিত্র

শেখ হাসিনার পতনের আগে থেকেই ভারত-বিরোধী প্রচারণা দানা বাঁধছিল। এর মধ্যে, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। ফলশ্রুতিতে, তার দলকে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়েও ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করার যে অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে তোলা হতো, সেটি আরো বেশি করে সামনে আসে।

এছাড়া, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা ও অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনে ন্যায্যতার দাবিতেও ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে বরাবরই আওয়াজ উঠতে দেখা গেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে বারংবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লি। সেই অভিযোগের বাস্তবতা নিয়ে ঢাকাও প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন সময়।

ভারতের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যু 'সেভেন সিস্টার্স' বা উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানসহ অনেকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন, যা ভালোভাবে নেয়নি দিল্লি।

সর্বশেষ ২৮ মার্চ মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রথম চীন সফরের সময়ও তার বক্তব্যে 'সেভেন সিস্টার্সের' প্রসঙ্গ টানেন। এতে বেশ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ভারতে। যদিও পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে তিনি কানেক্টিভিটির পটভূমিতেই কথাটি বলেছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়েই ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে বৈঠকে বসেন মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদী।

নতুন বাস্তবতায় নতুন বোঝাপড়া?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে 'ভারত ফ্যাক্টর' সবসময়ই আলোচনায় ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ককে বিরোধীরা বরাবরই সমালোচনার নিশানা করে থাকেন।

প্রশ্নবিদ্ধ সংসদীয় নির্বাচন করেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা ক্ষমতায় থাকা ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হতো না বলে বিশ্বাস করেন অনেকেই।

শেখ হাসিনার পতন ভারতের জন্য একটি ধাক্কা হয়ে দেখা দিয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। যে কারণে বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতার সঙ্গে সহজে মানিয়ে নেয়া সহজ হয়নি তাদের জন্য। কিন্তু, বাংলাদেশের তরফে জোর চেষ্টা ছিল সম্পর্ক সচল ও স্বাভাবিক করার।

‘বাংলাদেশ একটু নতুন বাস্তবতায় নিজেদের তৈরি করার চেষ্টা করছে। ফলে প্রতিবেশী, বন্ধু, সহযোগী সবার সাথে নতুন করে আন্ডারস্ট্যান্ডিং দাঁড় করানোর ব্যাপারে তারা আন্তরিক। নতুন সম্ভাবনায় সহযোগীদের তারা পাশে পেতে চায়,’ বলছিলেন বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

তার মতে, শীর্ষ পর্যায়ে পারস্পরিক আলোচনা হলে এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। ‘তারা আগের বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করেছেন মোটা দাগে। তারপরও একটা কমন (সাধারণ) জায়গা তৈরি করতে হবে। দুই পক্ষই কিছু কিছু ছাড় দিলে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে পৌঁছানো সম্ভব,’ যোগ করেন মি. কবির।

‘এক্সট্র্যাডিশন বা মাইনরিটি ইস্যু বাধা হবে না’

শুক্রবার বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস। ‘প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, ভারতে বসে উনি (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন ইনসেনডিয়ারি (আক্রমণাত্মক) মন্তব্য করছেন, সেসব বিষয়ে কথা বলেছেন,’ সাংবাদিকদের বলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

বাংলাদেশ সরকার ও ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার দাবি বরাবরই আলোচনায় ছিল। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ভারতের জন্য 'শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ' সংক্রান্ত আলোচনাটি ঠিক স্বস্তিদায়ক নয়।

অবশ্য তাদের যে এই ইস্যুতে অস্বস্তি আছে সেটি শুক্রবার আবারও দেখা গেল পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সংবাদ সম্মেলনে। যেখানে এই সংক্রান্ত প্রশ্ন একরকম এড়িয়েই গেছেন তিনি।

‘এক্সট্র্যাডিশন একটি জটিল প্রক্রিয়া। তার ওপর, শেখ হাসিনা ভারতে বন্ধু এবং অতিথি হিসেবে সমাদৃত। সুতরাং বাংলাদেশ তাদের অবস্থান থেকে বললেও ভারতের মেনে নেওয়ার কথা নয়,’ বলছিলেন ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, ‘মাইনরিটি (সংখ্যালঘু) হিন্দু নির্যাতন ইস্যুটি নিয়েও ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। সেই বক্তব্য তারা তুলে ধরেছে।’ তবে এক্সট্র্যাডিশন বা মাইনরিটি সংক্রান্ত মতভেদ সত্ত্বেও যেহেতু সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, আগামীতে এগুলোর কোনোটিই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক দত্ত।

বিশ্লেষকদের কথায় স্পষ্ট, অস্বস্তিকে পাশ কাটিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক কিংবা অস্বস্তি পুষে রেখেই 'ওয়ার্কিং রিলেশন' বা কাজের সম্পর্ক স্থাপন যাই হোক না কেন তার পথচলা শুরু হয়ে গেলো ব্যাংককের এই বৈঠক থেকে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে